Homeসাহিত্যস্বনির্বাচিত স্বপ্ন ও মৃত্যু

স্বনির্বাচিত স্বপ্ন ও মৃত্যু


সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ ৪টি নাটক লিখলেও তাতে তার রচনাশৈলী ও চেতনা প্রবলভাবেই বিদ্যমান; সুচারু সংলাপ ও নির্মেদ গদ্য পাঠককে দ্রুতই রচনার সঙ্গে সংলগ্ন করে ফেলে।

তার অন্যান্য নাটকের তুলনায় ‘উজানে মৃত্যু’ সবচেয়ে বেশি সফল নাট্যশৈলী ও অ্যাবসার্ডিটির কারণে।   

‘উজানে মৃত্যু’ নাটকটি তিনটি চরিত্রকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এরা নৌকাবাহক, সাদা পোশাক পরিহিত ও কালো পোশাক পরিহিত ব্যক্তি নামে চিহ্নিত। আপাতদৃষ্টিতে চরিত্র তিনটি হলেও আমরা কালো পোশাক পরিহিত ব্যক্তিতে কখনো বিবেক বা কোরাসের ভূমিকায় দেখি। যে বাল্যবন্ধু নৌকাবাহক ও সাদা পোশাক পরিহিত ব্যক্তির মধ্যকার যোগসূত্র হিসেবে কাজ করেন।

মঞ্চে আমরা নৌকাবাহককে দেখি নৌকার দাঁড় টানতে, যার স্ত্রী ও সন্তানরা মৃত, ঘরবাড়ি-ফসলের জমি নদীগর্ভে বিলীন; শেকড়চ্যুত এই ব্যক্তিটির মনোজগৎকে কেন্দ্র করেই এই নাটক। শুরুতে যাকে আমরা হাঁপানিতে আক্রান্ত পরিশ্রমধ্বস্ত এবং শেষেও তাই দেখি, তাতেই তার মৃত্যু; কিন্তু তিনি তার স্বপ্ন থেকে বিচ্যুত নন, যা একই সঙ্গে অস্তিত্বহীন এবং অনিশ্চিত যাত্রার চক্রে বাঁধা।

চরিত্র তিনটি গ্রামের ছিন্নমূল দরিদ্র মানুষ হলেও তারা নাট্যকারের ক্রীড়ানক ছাড়া কিছু নয়। যেমনটা লালসালুর মজিদ কেবলমাত্র দরিদ্র, ভাগ্যান্বেষী মাজারপূজারি নন, তার মনও বিদ্রোহ করে উঠতে চায়, বলতে চায়, এখানে মোদাচ্ছের পীর বলে কেউ নেই। কিন্তু মজিদ বাঁধা আছে তার অস্তিত্বের সঙ্গে; তার জীবনের বিবিধ অন্তর্লোকই যেন ব্যক্তি মজিদের পরিচালক। 

উজান বলতে আমরা স্রোতের বিপরীত দিককে বুঝি, কিন্তু ‘উজানে মৃত্যু’ নাটকটির মানে জীবনস্রোতের উলটো দিকে চলে নৌকাবাহকের মতো মৃত্যুকে কেবল নিশ্চিত করা নয়; এই মৃত্যু নৌকাবাহকের নিজের নির্মিত অনিশ্চিত ও কল্পিত জগৎস্বপ্নের বলি। সব হারানো নৌকাবাহক নক্ষত্রের মতো শান্ত একটি গ্রামের কল্পনার মধ্যদিয়ে তার অনিকেত সত্তার স্থিতি অনুসন্ধান করেন : ‘কিন্তু ঐ যে! অসীম আকাশ আর উন্মুক্ত ধরণীর প্রান্তে; একান্ত নিরাপদ, একান্ত নিশ্চিত! আর কী শুদ্ধ-পবিত্র, কী শান্তিময়।’ এই অপার শান্তিময় জগতে তার শিশুসন্তানের মৃত্যু নেই, স্ত্রীর মৃত্যু নেই; আছে বেঁচে থাকরে সবকিছু—ঘরবাড়ি উর্বর ফসলি জমি।

তাদের সংলাপ দার্শনিক আলাপের বাইরে কিছু নয় এবং নৌকাবাহক ও সাদা পোশাক পরিহিত ব্যক্তির পরস্পরের আলাপ প্রশ্নানুগও নয়; নৌকাবাহকের মনোজগৎ গড়ে উঠেছে একটি অস্তিত্বহীন গ্রাম ও এক ব্যক্তির মৃত্যুযন্ত্রণার মধ্যদিয়ে, যা থেকে নৌকাবাহক অন্য কোনো প্রসঙ্গে যেতে পারেন না : ‘নদীর ওপারের গ্রামটি আমি চিনি। কী নাম? গ্রামটি সত্যিই আমি চিনি। কিন্তু তার নাম মনে পড়ছে না। গ্রামটা চিনি, কারণ দু-বছর আগে সেখানে একটি লোক ভীষণভাবে মরেছিল। বাঁশে বিদ্ধ হয়ে মরেছিল লোকটা, ব্যথা লাগবে বলে কাউকে বাঁশটা বের করতে দেয় নাই। মরতে তিন-দিন তিন-রাত লেগেছিল।’

অপরদিকে কালো পোশাক পরিহিত ব্যক্তিও দুর্ভাগ্যের শিকার। তার কাছেও আছে অপমৃত্যুর খবর : ‘অন্য মানুষটাও শান্তিতে ডুবে মরেছিল। কারণ, প্রতিবারই কোন প্রকারে মাথা তুলতে পেরে যা সে দেখেছিল তা সে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ভুলতে পারে নাই। পানির অন্ধকারেও সে দৃশ্য জলজ্যান্ত থাকে এবং কিছুই তার কাছে অসাধারণ মনে হয় নাই।’

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর অ্যাবসার্ড চেতনা ‘উজানে মৃত্যু’তে এসে পরিপূর্ণতা লাভ করেছে যা ‘তরঙ্গভঙ্গ’, ‘সুড়ঙ্গ’ ও ‘বহিপীর’-এ ততটা পরিস্ফুটিত হয়নি।

বিশ শতকের পৃথিবী গল্পহীন। মানুষের কাজ আছে, কিন্তু কাজের পরিণতি পুনরাবৃত্তিতে। ঈশ্বর মৃত। উন্মূল তথা শূন্যতায় আক্রান্ত, তার কেবল গ্লানি ও বিচ্চিন্নতা আছে; পরস্পরের সঙ্গে থেকেও সে বিচ্ছন্ন। একই নৌকার সঙ্গে সংযুক্ত নৌকাবাহক ও সাদা পোশাক পরিহিত ব্যক্তি; তারা পরস্পরের মধ্যে কথা বলে, কিন্তু কথা বলে পরস্পরের নির্মিত জগতের সঙ্গে। এই অস্তিত্ব অনস্তিত্বের সমান। তাদের মৃত্যুও স্বনির্বাচিত।

কালো পোশাক পরিহিত ব্যক্তি সাদা পোশাক পরিহিত ব্যক্তিকে নির্দোষ ও কল্যাণকামী মনে করে না। নৌকাবাহকের প্রতি তার মমতার আড়ালে আছে তার ভেতর-জীবনের অন্য অভীপ্সা, যা তার ব্যক্তিমানুষের আকাঙ্ক্ষাজাত।

কালো পোশাক পরিহিত ব্যক্তিও জীবন সম্পর্কে তার ব্যাখ্যা প্রদান করেন। তিনি বলেন : ‘প্রতিবার শ্বাস নেবার জন্যে কোনোমতে উঠে এলে সে দেখতে পায় আকাশ, মেঘ, নদীতীর, গাছপালা এবং ঘরবাড়ি এবং প্রতিবারই মনে হয় সবকিছুই যেন ঠিকঠাক আছে।’ এই শ্বাস নেবার জন্য মুহূর্তখানেক দেখাই হলো মানুষের জীবন। বাকিটা নদীর তলদেশের মতো অন্ধকার, মৃত্যুর মতো নিশ্চিত।

কখনো মনে হয় এই নৌকাবাহকই হলো বেঁচে থাকা মানুষ। যারা ‘ক্ষুধা তৃষ্ণায় মরে যাবে কিন্তু নিজের জগৎকে ধ্বংস করবে না।’ নইলে সাদা পোশাক পরিহিত ব্যক্তির শত অনুরোধেও তিনি খাদ্য গ্রহণ এবং বিশ্রামের প্রয়োজন মনে করেন না। যেন তার কাজ ক্রমাগত রশি টেনে টেনে নৌকাটি উজান বেয়ে নিয়ে যাওয়া।

কিন্তু নৌকাবাহক কি পুনরায় গার্হস্থ্য জীবন চায়? তার শুদ্ধ-পবিত্র জগৎ কি মৃত্যুর মতো নিশ্চিতি? সে বিয়ে করলে স্ত্রী পেত, সন্তান পেত; আবার নতুন করে সে জীবনের আহ্লাদ পূরণ করতে পারত। কিন্তু সে তা চায় না। সে বৈষয়িক জীবনের বাইরে কী এক আত্মিক জীবনের সন্ধান করে; যে বিশ্বাস করে ‘…সেখানে কোথাও ভুল আছে, কোথায় একটা ফাটল আছে, একটা অদৃশ্য শক্তি আছে যা সবকিছু শুষে নেয়।’

এই ফাটলটি কী? 

দুই

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘বহিপীর’ ১৯৬০ সালে প্রকাশিত হলেও ১৯৫৫ সালে ঢাকায় P.E.N. ক্লাবের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক নাট্যপ্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিল। ‘উজানে মৃত্যু’ বই আকারে প্রকাশিত হয়নি, সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৩৭০ সালের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায়। ‘সুড়ঙ্গ’ ১৯৬৪ সালে বই আকারে প্রকাশিত, যা ‘বহিপীর’ সময়কার রচনা। ‘তরঙ্গভঙ্গ’ ১৯৬৪ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত। এর মধ্যে ‘সুড়ঙ্গ’ নাটকটি তিনি শিশু-কিশোরদের জন্য লিখেছেন। ‘বহিপীর’ রঙ্গব্যঙ্গ ধরনের কমেডি। ফলে ‘তরঙ্গভঙ্গ’ ও ‘উজানে মৃত্যু’তে তার নাট্যকার সত্তার স্বকীয় বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। সাঈদ আহমেদের ‘কালবেলা’ প্রকাশিত হয় ১৯৬২ সালে, অনুমান করা যায় ‘উজানে মৃত্যু’র রচনাকাল প্রায় কাছাকাছি সময়ে। যদিও হায়াৎ মামুদ বলেছেন, ‘আমাদের নাট্যসাহিত্যে অ্যাবসার্ড নাটকের জন্মদাতা সম্ভবত তিনিই।’ তার মন্তব্যের ‘আমাদের’ বলতে পূর্ববাংলাকেই বোঝায় আর ‘সম্ভবত’ সম্ভাবনাকেই বোঝায়। তবে এ বিষয়টি নিয়ে তথ্যানুসন্ধানের সুযোগ রয়েছে।

তিন

‘বহিপীর’ নাটকে তাহেরাকে তার বাবা ও সৎমা বিয়ে দেয় বৃদ্ধ পিরের সঙ্গে। তার বাড়ি সুনামগঞ্জ। তিনি সাধারণের ভাষা অপবিত্র মনে করেন এবং বইয়ের ভাষায় তথা সাধুরীতিতে কথা বলেন এ জন্য যে, এতে তার শিস্যদের কাছে তার কথা যেন দুর্বোধ্য না হয়।

তাহেরা লালসালুর জমিলার মতো পিরের কর্তৃত্ব মেনে নেয়নি, উপরন্তু সে পালিয়ে নদীর ঘাটে আসে। তখন নদীপথে রেশমপুরের জমিদার হাতেম স্ত্রী খোদেজা ও পুত্র হাশেমকে নিয়ে ঢাকায় আসছিলেন। নদীর তীরে তাহেরাকে দেখে তিনি তাকে বজরায় তুলে নেন।

বহিপীর তার খাদেমকে নিয়ে তাহেরাকে খুঁজতে নৌকা নিয়ে বের হন। তাদের নৌকা জমিদারের বজরার সঙ্গে ধাক্কা লেগে দুর্ঘটনা ঘটার আগেই হাতেম বহিপীর ও ভৃত্যকে নিজের বজরায় তুলে নেন। নাটকীয়তা শুরু এখানেই, একই বজরার দুই কামরায় বহিপীর ও তাহেরা অবস্থান করলেও কেউ তা জানেন না; জমিদারের কাছেও তাদের মধ্যকার পরিচয় অজানা। তবে তাদের পরিচয় জানাজানি হয়ে গেলে বহিপীর তাহেরাকে নিজের আস্তানায় নিতে চেয়ে ব্যর্থ হন। তবে জমিদারপুত্র হাশেম ও তাহেরা পালিয়ে যায় নবজীবনের আশায়।

‘তরঙ্গভঙ্গ’ আমেনা নামে এক দরিদ্র নারীর বিচারের কাহিনি। পুরো নাটকে আমেনার কোনো সংলাপ নেই। আমেনার বিরুদ্ধে অভিযোগ দুটি : তিনি তার স্বামী ও সন্তানকে হত্যা করেছেন। তার স্বামী কুতুব দারিদ্র্যের কশাঘাতে মরণাপন্ন, চিকিৎসার সামর্থ্য নেই, মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। তার এই কষ্ট লাঘব করতে আমেনা ধুতুরার পাতার রস পান করিয়ে তার কষ্টের অবসান ঘটান। স্বামীর মৃত্যুর পর কাজের সন্ধানে বের হলেও কোনো কাজ না পেয়ে কোলের শিশুকে হত্যা করে তার ক্ষুধার যন্ত্রণা ঘোচান।

দারিদ্র্যপীড়িত সাধারণ মানুষের জীবনসংগ্রাম এবং অপরদিকে বিচারব্যবস্থা দুইয়েরই উপস্থাপন এই নাটকে অত্যন্ত নগ্নভাবে দেখানো হয়েছে : বিচারকক্ষে বিচারিক কার্যক্রমের অপেক্ষা করছে সবাই। আসামি, ফরিয়াদি, সাক্ষী সবাই হাজির; কিন্তু বিচারক ঘুমিয়ে আছেন তার চেয়ারে। সবাই বলাবলি করে, বিচারক ঘুমিয়ে থাকলে বিচার হবে কীভাবে?

হঠাৎ বিচারকের ঘুম ভাঙে, বিচার শুরু হয়। যেই বিচারকার্য চিরদিন প্রযুক্ত হয়ে আসছে অসহায় দুর্বলের ওপর। যাদের নেই বেঁচে থাকার সামান্য আশা ও শস্যদানা।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত