বিধবা হয়ে নিঃস্ব আমি সন্তানদের নিয়ে আবার উঠলাম ঠাকুরপোর বাসায়। সেই আন্তরিকতাহীন, সহানুভূতিহীন স্তব্ধতা বিশাল পাথর হয়ে চেপে রইল আমার ওপর। এমনকি বাইরে থেকে যারা আসে দেখা করতে, মৃত্যু পরবর্তী যত কাজকর্ম কথাবার্তা তার লেখা নিয়ে যত পরিকল্পনা সব তাদের সাথে। কোথাও আমার ডাক পড়ে না, আমি যেন কেউই না! যে আমি প্রতিবাদী, কিছু পছন্দ না হলে মেনে নিতাম না সেই আমি এই পৃথিবীর নিঃসঙ্গতম মানুষ হয়ে একটা ঘরে পড়ে রইলাম। আমার দুটি সন্তান কিন্তু তারাও আমার আশ্রয় হতে পারল না। তোমার দাদা বেঁচে থাকতেই মঞ্জুর বিয়ে নিয়ে আমি চিন্তিত থাকতাম ও দেখতে ভালো নয় বলে। কিন্তু তা হচ্ছিল না। আমাদের সন্তান দুটির শারীরিক এবং মানসিক অসুস্থতার কারণও তোমার দাদা, মনে মনে এমনই বিশ্বাস করতাম আমরা দুজনেই। তারা যে দেখতে ভালো নয় সে জন্যেও তোমার দাদা নিজের চেহারাকেই দায়ী করত। সেটা যে সত্যি তা তুমিও স্বীকার করবে নিশ্চয়ই? সম্পূর্ণ আশ্রয়হীন একজন মানুষ তার এবং তার সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবলে তা নিন্দনীয় কেন হবে?
আমি অনেক অনেকবার ভেবেছি সে আত্মহত্যা করেছে নাকি করেনি। হ্যাঁ বা না। কিন্তু সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি না। দুপক্ষেই জোড়ালো যুক্তি। মঞ্জু কিছুতেই মানে না তার বাবা আত্মহত্যা করতে পারে। মঞ্জু আর তার বাবা দুই দেহে এক আত্মা। তাকে ফেলে তার বাবা ইচ্ছাকৃতভাবে চলে যাবে এ সে কোনদিনই মেনে নেয়নি। সে বরাবরই বলে এসেছে অ্যাক্সিডেন্ট। হতেই পারে মানসিক অস্থিরতা, শারীরিক অসুস্থতা—তখন তো খুব বেশি অন্যমনস্ক আর ঘোরের মধ্যে থাকত, চোখেও কম দেখত। এসবের কথাও মানে রাখতে হবে বইকি। কিন্তু আমার কেবলই ঘুরেফিরে সন্দেহ হয়। তবে এ কথা ভুলেও ভেবো না যে নিজেকে দায়ী করি। আমার জন্য আত্মহত্যা করবে এত মর্যাদা তোমার দাদা আমাকে কখনোই দেয়নি। তার প্রতিভা বাংলা সাহিত্যের অনেক উপকারে লেগেছে, বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে সে, বাংলাসাহিত্য যুগের পর যুগ সেই ঋণ স্বীকার করবে। কিন্তু আমার কোনো ঋণ নেই তার কাছে। আমি পেয়েছি বঞ্চনা, পেয়েছি উপেক্ষা, পেয়েছি দারিদ্র। আর পেয়েছি জীবনভর অপমান, লাঞ্ছনা। এমন একটা মৃত্যু ঘটিয়ে সে আমার জন্য কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করে গেল, সারাটাজীবন ধরে যে কাউকে আমার দিকে আঙুল তোলার অধিকার দিয়ে গেল।
মাঝে মাঝে ভাবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী যদি আত্মজীবনী লিখতেন কী লিখতেন তিনি? বছর বছর সন্তানের জন্ম দিয়ে দশ বছরে পাঁচটি সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। মাত্র আটাশ বছর বয়সে মারা গিয়েছিলেন। আত্মজীবনী লিখলে তিনি কি তার মৃত্যুর জন্য দায়ী করতেন রবীন্দ্রনাথকে? শুনেছি তার কোনো চিঠি পাওয়া যায়নি। চিঠিতে কি তিনি অভিযোগ জানাতেন স্বামীর কাছে? অসন্তোষ ব্যক্ত করতেন বা প্রতিবাদ? তার চিঠিতে গোপনতা ফাঁস হবার মতো কিছু ছিল কিনা জানি না, তবে কেউ কখনো রবীন্দ্রনাথের বিপক্ষে এরকম কোন কথা তুলেছে বলে শুনিনি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী আত্মত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত হয়েছেন। স্যাক্রিফাইস করতে করতে অবশেষে জীবনটাই দিয়ে দিলেন আর সমাজ ধন্য ধন্য করল! আমার অপরাধ তো এটাই ছিল যে আমি নিজেকে বলি দিতে চাইনি। জীবনকে উপভোগ করতে চেয়েছি, বেকার স্বামীর দায়িত্বহীনতার প্রতিবাদ করেছি, পাশাপাশি নিজেকে দায়িত্বগ্রহণের জন্য প্রস্তুত করেছি!
তোমার দাদার মৃত্যুর পর বোধহয় তার প্রেমে পড়লাম! তার কবিতা বার বার করে পড়তে লাগলাম। তাকে নিয়ে যেখানে যত লেখা হতো সব সংগ্রহ করে পড়তে লাগলাম। জীবনভর তার ওপর রাগ ছিল, অ্যাক্সিডেন্টটা আরও রাগিয়ে দিল, মৃত্যুতে মনে হলো যেন চরম শোধ নিল কিন্তু তার কবিতা পড়তে পড়তে একদিন আমিও আমার মৃত জীবনের খোঁজে ড্রয়ার খুললাম। সেই যে যৌবনারম্ভে বিপ্লবী কবিতা লিখতে শুরু করেছিলাম সেও তো বাক্সবন্দীই ছিল এতকাল, সেই খাতা খুললাম আবার। লেখার খাতা হাতে নিতে নিতে দেখি খুব সুন্দর করে কাটা চারটে পেন্সিল কলমের পাশে সাজানো। দুটো পুরোনো একটু ছোট হয়ে গেছে আর দুটো নতুন—কাটার পরে একবারও লেখা হয়নি। তোমার দাদার কাণ্ড! কী যত্ন করে যে পেন্সিল কাটত! সে নিজে অনেক সময় পেন্সিলে লিখত তাই এক সঙ্গে অনেকগুলো পেন্সিল কিনে এনে সুন্দর করে কাটত। তারপর নিজের জন্য রেখে আমাদেরকেও একটা করে দিত। তাতেই আমার বেশ কিছু পেন্সিল জমে যেত, আমি পেন্সিল কমই ব্যবহার করতাম। সেদিন আমিও একটি পেন্সিলই তুলে নিলাম আর একটি দুটি লাইন করে আমার দুঃখী পঙক্তিগুলো লিপিবদ্ধ করতে লাগলাম। লিখতে লিখতে আমাদের পুরো জীবনটার একটা রিভিউ সিনেমার মতো আমার চোখের সামনে দুলতে লাগল! বরিশালের জীবনানন্দ দাশ আর কলকাতার উদ্বাস্তু জীবনানন্দ দাশের জীবনযুদ্ধ, জীবনযাপন! সমাজটা তখন তার জন্য বাসের অযোগ্য হয়ে উঠেছিল। অর্থনৈতিক মন্দা, যুদ্ধের দামামা, মন্বন্তর সব মিলিয়ে দিশেহারা একটা সময়। যে মানুষ ধর্মে আস্থা রাখত না, ঈশ্বরে বিশ্বাস করত না বিশ্বাস রাখত মানুষের নীতিবোধে সে মানুষ দেখল ধর্মীয় উন্মাদনায় মানুষে মানুষে হানাহানি, অভাব অনটনে লক্ষ লক্ষ মানুষের পশুর মতো মৃত্যু, নিজের দেশে পরবাসী হয়ে যাওয়া! যে বরিশাল তার প্রাণ সেখানে ফেরার আর কোনো সম্ভাবনা রইল না। এগুলো ভেতরে ভেতরে নিঃশেষ করছিল তাকে। এরকম সময়ে সে একটা পুরস্কার পেল। রবীন্দ্র পুরস্কার। কাউকেই কিছু বলেনি। মঞ্জু কবিতা লিখত তাকেও না। বাড়ি ফিরে চৌকির তলায় ঢুকিয়ে দিল। মঞ্জু জানতে চাইলে বলল ‘ওই আরকি’। পুরস্কার এর পেছনে সে কখনোই ছুটেনি, যূথবদ্ধতা তার ধাঁতে ছিল না জানি কিন্তু সাহিত্য পুরস্কার পেয়েও সামান্য খুশি হলো না এটা আশ্চর্যজনক না? কবিতার ব্যাপারে তো খুবই সিরিয়াস ছিল সবসময়। পত্রিকায় কোনো পাতায়, কার আগে-পরে, কীভাবে কবিতা ছেপেছে তা নিয়ে অসন্তোষ, পত্রিকার ছাপার মান, বইয়ের প্রচ্ছদ নিয়ে খুঁতখুঁত করা তো আগে খুবই ছিল। সে সময় পুরস্কার পেলে কি এমনই নির্মোহ প্রতিক্রিয়া হতো নাকি ততদিনে ভেতরে ভেতরে সন্ন্যাস নিয়ে নিয়েছে? নইলে সাহিত্য পুরস্কার নিয়ে এমন তাচ্ছিল্য সে করতে পারে! আমার অভিজ্ঞতায় তো সাহিত্য তার প্রাণেরও অধিক!
সবচেয়ে বেশি অপমান সাহিত্যজগতই তাকে দিয়েছে তবু তো সাহিত্য তার কাছে স্ত্রীর চেয়ে বড়, সন্তানের চেয়ে বড়, ঈশ্বরের চেয়েও বড় ছিল। সাহিত্যেও কি তবে ক্লান্তি এসেছিল অথবা বিতৃষ্ণা? লিখত না তো, অনেকদিন লিখতে দেখিনি। অনেকেই বলেছে তখন কোন সাহিত্য আড্ডাতেই সে যোগ দিত না। কারো সাথে রাস্তায় দেখা হয়ে গেলে রাস্তা পাল্টে নিত। সাধারণ মানুষদের সাথে বরং একটু সহজ ছিল। এসময় আবার একটা চাকরি পেল। সেই অপছন্দের অধ্যাপনা। তবু স্বস্তি পেয়েছিল তো! সংসারে মন দিয়েছিল। নাকি ভান করেছিল আমাদেরকে স্বস্তি দিতে? সাহিত্য ছাড়া বাঁচা তার পক্ষে অসম্ভব।
ভালোবাসা শুকিয়ে গেছে—‘প্রেমহীন বিস্বাদ জীবন’, সংসারে সুখ নেই, সাহিত্যেও মুক্তি নেই (সাহিত্য থেকে আস্থা, বিশ্বাস হারিয়ে গেছে)। ভবিষ্যৎ বিপর্যস্ত—যেদিকে তাকায় কেবলই অন্ধকার। আমার এখন খুবই মনে হয় ততদিনে তোমার প্রতিও তার প্রেম ফুরিয়ে গিয়েছিল, নতুন প্রেমও আর আসেনি। সেজন্যেই কি লেখাও ফুরিয়ে যাচ্ছিল? নিজেকে গড়ার, প্রতিনিয়ত নিজেকে এগিয়ে নেয়ার প্রতিযোগিতা থেমে গিয়েছিল? জীবনে প্রেম না থাকলে কি কবিতা থাকে? আর কবিতা না থাকলে কবির জীবন কী করে চলতে পারে বল? তোমার দাদাই তো বলেছে প্রেমময় প্রাণের শক্তি সূর্যের অধিক!
ইতি,
কবি জীবনানন্দ দাশের বিধবা পত্নী (এছাড়া কী আর লিখি! তোমাদের দিক থেকে সম্পর্ক তো কবেই খারিজ হয়ে গেছে, এইমাত্র আমিও তোমার সাথে তেমন করাই মনস্থ করলাম শোভনা)
বি:দ্র: তোমাকে কখনও শোভনা লিখেছি কখনও বেবি। কাটাকুটি করলাম না আর শুধু শুধু চিঠিটা নোংরা হবে। তোমার দাদা তো ওয়াই বিওয়াই কত কী লিখেছে তোমাকে! তোমার দাদার ডায়েরি বার বার পড়ে পড়ে এমন হয়েছে, আমিও অজান্তেই যখন তোমার যে নাম মনে এসেছে লিখে ফেলেছি। নামে কীবা আসে যায় তুমি তো তুমিই, চিঠিটা বরং পরিচ্ছন্ন থাক।