Homeসাহিত্যলাবণ্য দাশের চিঠি ।। পর্ব—সাত

লাবণ্য দাশের চিঠি ।। পর্ব—সাত


তোমার দাদা সাহিত্যিক ছাড়া আর কাউকে শিল্পী মনেই করতেন না, এমনকি মানুষ হিসেবেই গুনতেন না। মা-বাবা-ভাই-বোন এর বাইরে কারো সাথেই তার সখ্য ছিল না বলা যায়। আমি যেহেতু কবি বা লেখক না, আমাকে তিনি মেয়েমানুষের বাইরে কিছুই ভাবেননি—একমাত্র শরীরের টান ছাড়া আর কিছুতো দেখতে পেলাম না! আমি তো নাচ-গান-শরীরচর্চা-লেখাপড়া কোনোকিছুতেই ফেল করিনি বরং নিজেকে নাম্বার ওয়ান বলে গড়ে তুলছিলাম। প্রতিটি মানুষ আমাকে মুগ্ধতা নিয়ে দেখতো, পঞ্চমুখে আমার প্রশংসা করতো। সেই আমি, আমার নিরুত্তাপ শ্বশুরবাড়িতে এসে ডাঙায় তোলা মাছের মতো খাবি খেতে থাকলাম, আর ততোধিক নিরুত্তাপ তোমার দাদা আমার ভেতরটা আরও হিম করে ফেললো! আমার যে বিপ্লবের স্বপ্ন ছিলো নেতৃত্ব দেয়ার গুণ ও আগ্রহ ছিল তাও নিভিয়ে দিলো। তাছাড়া আমি যে লেখাপড়ায়ও ভালো ছিলাম, ঢাকায় হোস্টেলে থেকে পড়ার সুযোগটা পেলে, আরও ভালো কিছু করতে পারতাম—ভালো অভিনেত্রী, ভালো গায়িকা, ভালো চাকরিও করতে পারতাম, সেই বিবেচনা কি তার ছিল? হয়তো ছিল, কিন্তু পেরে ওঠেনি। হোস্টেলে রাখার সামর্থ্য ছিলো না যে। এমনকি পরিকল্পনা করে চলার সামর্থ্যও তার ছিল না। গর্ভবতী হয়ে কী এক অসহায় অবস্থায় পড়লাম! এত অল্প সময়ের মধ্যে স্বর্গ থেকে সোজা নরকে নেমে গেলাম যেন! আজও ভেবে শিহরিতো হই, ওই বয়সে এমন ধাক্কা সামলে ছিলাম কী করে! বেঁচে ছিলাম কী করে! অন্যের বিচার করা খুব সহজ শোভনা, পারতে নিজেকে সেখানে রাখতে? পারলে তো পালাতে না, তাই না?

অবশ্য তোমার দাদাকে প্রণতি জানাই, যখন সামর্থ্য হয়েছে অর্থাৎ বি.এম কলেজে চাকরি যখন পেলো, তখনই আমি পড়া শুরু করতে চাওয়ার সাথে সাথেই ভর্তি করে দিয়েছে। আমার পড়ায় সাহায্য করেছে, আর কী করে আমি সেই প্রতিকূলতা জয় করেছি, তাতো বললামই। তুমি কি জানো, কলকাতা যাওয়ার পর তোমার দাদাই আমাকে চাকরি পেতে সহযোগিতা করতে চেষ্টা করেছিল? অভিনয়েও উৎসাহ দিয়েছে। আমি উপার্জন করলে সে সাংসারিক দায় থেকে রেহাই পায়, এটাই হয়তো কারণ। তবু সে যে আমার একটা ভালো চাকরি হোক, সেজন্য চিঠি লিখেছিল। চিঠিতে আমার গুণকীর্তন করেছিল, তাতে আমার খুশী হওয়াই তো উচিত। আমার অবশ্য মন খারাপই হয়েছিল। চাকরির উমেদারির জন্য যে-সব গুণপনার কথা লেখা হয়েছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি যোগ্যতা যে আমার ছিল, তা প্রতিমুহূর্তেই আমার মনে পড়তো। জীবনের এই অপচয় আমিই বা কী করে মেনে নেই বলো?

আমাকে প্রতিভা বসুর উদাহরণ দেওয়া হয়, তার সাথে তুলনা করা হয়, কিন্তু মানুষ বুদ্ধদেবের সাথে মানুষ জীবনানন্দের তুলনা করা হয় না। প্রতিভা বসু লেখক হলেও বুদ্ধদেব বসু যদি তোমার দাদার মতো ঠিক এমনি করতেন, তাহলে কতটা ধৈর্য তিনি রাখতে পারতেন আমার কিন্তু যথেষ্টই সন্দেহ আছে। যে নারীরা কিনা দেখতে মানুষের মতো, কিন্তু পুরো মানুষ নয়—জলের মতো যে পাত্রে রাখে, সেই পাত্রের রূপ ধরে অথবা স্বামী পরমেশ্বর মেনে, সংসারের আগুনে বিনা প্রতিবাদে সতীদাহের পুনঃনির্মাণ করতে থাকে, তারা কেউ কেউ হয়তো পেরে থাকবে, আমি পারি না। পারি না বলার চেয়ে বলা উচিত পারতে আসলে চাইওনি। তবে, অনেক কিছু পারার যোগ্যতাই আমার ছিলো, কিন্তু কোন সুযোগটা আমি পেয়েছি বলো দেখি? পড়তে পারবো বলা হয়েছিল, সেই পড়া যে ঢাকা থেকে উন্মূল হয়ে বরিশালে একান্নবর্তী সংসারের দায়িত্ব পালন করে, বেকার স্বামীর দায়িত্বহীনতায় বিয়ের সাথে সাথে গর্ভবতী হয়ে তারপর পড়াশুনো সামলানো, সেটা কে ভাবতে পেরেছিল! হয় নাকি এভাবে? তুমি তো বেশ হোস্টেল-টোস্টেলে থেকে পড়াশুনো করেছ, তোমার চেয়ে কিছুতে কম ছিলাম আমি? এক কপালের লিখন ছাড়া? দেখো আবার সেই কপাল! সারাটা জীবন ভুগে ভুগে আমি এখন আমার কপালকেই সঙ্গী করেছি, দোষ চাপানোর জন্য। এত প্রতিবন্ধকতার মাঝেও আমি লেখাপড়া করে গেছি। কলকাতায় যাওয়ার পরে তো সংসারের হাল আমাকেই ধরতে হয়েছে। অনটন লেগেই ছিলো,  কিন্তু সন্তানের মুখে ভাত তুলে দিতে পেরেছিলাম, লড়াকু ছিলাম বলেই। এ সবই তুমি দেখেছ, যথেষ্ট সহানুভূতিও দেখিয়েছ তখন।

বুদ্ধদেব বসুর স্ত্রী প্রতিভা বসুর সাথে কোনোভাবেই কি আমার তুলনা হতে পারে? প্রতিভা বসু নিজে লেখক ছিলেন। তাছাড়া তারা ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। প্রেম থাকলে কি লাগে আর? আবার দুজনেই লেখক হওয়ায় জীবনের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে তারা ছন্দবদ্ধ। তাদের জীবনের সাথে কী করে আমাদের জীবনের মিল খোঁজা যেতে পারে, আমি তো বুঝি না! আর বুদ্ধদেব কি তোমার দাদার মতো ছন্নছাড়া ছিলেন? সংসারের জন্য পাণপাত করেননি? সাহিত্যিক সাফল্য, অর্থনৈতিক সাফল্য দুই-ই অর্জন করেছিলেন। তিনিও তো ঢাকা থেকেই গিয়েছিলেন, অথচ কলকাতার সাহিত্যমহলে কুণ্ঠিত হয়ে থাকেননি তো। তোমার দাদা ভেতরে ভেতরে কী বিরক্তই ছিলেন তার ওপর, অপছন্দ করতেন তাকে। গল্পের চরিত্র বানিয়ে বেশ করে গালাগাল করলেন, অথচ তোমার দাদাকে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা তিনিই তো করেছেন! বুদ্ধদেব আমাদের পারিবারিক বন্ধুও ছিলেন। সেই যে বিয়ের সময়, তোমার দাদা তাকে ‘রত্নবিশেষ’ বলে পরিচয় করে দিলেন, এরপর থেকে তাকে আমাদের সুহৃদ বলেই জেনেছি। তোমার দাদার কাছে কতজনই তো আসতো—কবিবন্ধু, নতুন লেখক-কবি, পাঠক, স্তাবক আমি কারো সামনেই যেতাম না—এক বুদ্ধদেব বাবু ছাড়া। এমন উজ্জ্বল, চটপটে, তুখোড় বক্তা ছিলেন তিনি, খুব দ্রুতই মনে স্থায়ী ছাপ ফেলতে পারতেন। সাহিত্যে বুদ্ধদেব বসুর সাফল্যই তোমার দাদার এই মনোভাবের কারণ কিনা ভেবেছি অনেক। বুদ্ধদেব বাবুর বাজার চলতি গল্প উপন্যাসগুলো হয়তো তোমার দাদার অপছন্দ ছিলো, কিন্তু তিনি নিজেকে সুপিরিয়র ভাবতেন। তাছাড়া তোমার দাদাকে হয়তো অনেক উপদেশ দিয়ে থাকবেন, এসব মিলেই বিরক্তি থেকে থাকতে পারে। তোমার দাদার চেয়ে দুর্বল সাহিত্যিকদেরও সাহিত্যপাড়ায় রমরমা ছিলো, আর বুদ্ধদেব বসু বলা যায়, অভিভাবকই হয়ে উঠেছিলেন। এসব মিলিয়ে কলকাতার শুচিবাইগ্রস্ত সাহিত্যসমাজের ওপর বিরক্তি, হতাশা থাকতেই পারে। সে তো সব সাহিত্যানুষ্ঠান, আড্ডা বর্জনই করেছিল বলা যায়। ঈর্ষা বলে অনেকে, আমার তা মনে হয় না। আমার বরং এখন মনে হয়, তিনিই কারও কারও ঈর্ষার শিকার হয়েছিলেন।

সজনীকান্ত তোমার দাদা মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত তার লেখা নিয়ে যা-তা বলেছেন। রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত ধমক দিলেন। বুদ্ধদেব বসু শুরু থেকেই তোমার দাদাকে সাপোর্ট করেছেন, সেই তিনিও ‘মহাপৃথিবী’ প্রকাশের পর ক্ষেপেই গেলেন। সমালোচনা করলেন। এরমধ্যে কি তৎকালীন পরিবেশের প্রভাব ছিলো না? আমি তো মনে করি ছিলো। কিন্তু তোমার দাদা কারু নির্দেশে চলার বা লেখার মানুষ তো নন। তিনি সবার থেকে এগিয়ে থাকা কবি, ভবিষ্যতের কবি। এ তিনিই শুধু জানতেন, আর জানতেন বলেই এতটাই নীরব থাকা সম্ভব হয়েছে। কেউ তার লেখা জানতে বা বুঝতে পারবে না—বুঝেই হয়তো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ট্রাঙ্ক বন্দী করেছে। ভাবা যায়, ঘর ভরা অভাব তবু লেখার জন্য চাকরি করছে না, বা চাকরি বজায় রাখতে পারছে না! ওদিকে  ট্রাঙ্ক ভরা শ’খানেক গল্প, ডজনখানেক উপন্যাস আর কবিতার তো হিসেবই নেই। লেখা ছাপা হলে টাকা আসে, সবাই চাইছে তার লেখা, তবু তিনি লেখা ছাপতে গড়িমসি করেন! লেখার নিন্দা যেমন হয়েছে। প্রশংসাও তো হয়েছে। আর নিন্দা যে যার লেখায় দম আছে তারই হয়, সাধারণ লেখকের হয় না, তা কি তোমার দাদা জানতো না? অবশ্যই জানতো!

এখন ভাবলে শিউরে উঠি, মানুষটা স্রোতের বিপরীতে ছিল তো বটেই, সেও যেমন তেমন স্রোত নয়, একেবারে টর্নেডোর বিপরীতে কী করে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলো! এতো এতো লিখতে পারলো, আবার ছাপতে দিলো সাকুল্যে শ’দেড়েক! একেই হয়তো লেখকের অহংকার বলে। বাঘা বাঘা কবিরা, গবেষকরাও সম্পূর্ণ তাকে আজও আবিষ্কার করতে পারেনি, এ আমি স্পষ্ট করেই বলছি ঠাকুরঝি।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত