তোমার জন্য প্রাণ কতটা কাঁদে বুঝতে পারার উপায় তেমন রাখেনি তোমার দাদা। এ কি তার অভিনয় ছিল? তাহলে বলতে হয় অভিনয়টা সে বেশ ভালো জানতো। সবার কাছে নিজেকে কেমন গোবেচারা বোকাসোকা বানিয়ে উপস্থাপন করে গেল! এদিক থেকে তোমরা ভাইবোন দুজনেই সমান দক্ষ দেখা যাচ্ছে। আর আমি কিনা অর্থ উপার্জনের আশায় অভিনয়ে নাম লেখালাম! হ্যাঁ শোভনা সংসারের সাচ্ছল্যের কথা ভেবে অভিনেত্রী হতে গিয়েছিলাম কিন্তু ভালো অভিনয় হয়নি আমাকে দিয়ে। এদিকে তোমার দাদার কতগুলো মুখোশ! সন্তানদের কাছে স্নেহময় পিতা। একটুও শাসন করে না, পড়তে বলে না। আমি শাসন করলে উল্টে আমার সাথেই রাগ করে অথচ সমাজ-সংসার সব নিয়েই দুঃখিত সেও ছিল। সংসারে প্রকাশ না করলেও মঞ্জুর খারাপ রেজাল্ট নিয়ে, রঞ্জুর লেখাপড়ায় অমনোযোগ নিয়ে নলিনীর কাছে দুঃখ করেছে, হতাশা জানিয়েছে। আমার সাথে সারাদিনে তার দুটি বাক্য বিনিময় হতো না। সারাদিন সে ব্যস্ত থাকতো লেখা আর পড়া নিয়ে। কিন্তু ভাইবোন এলে এই মানুষই বদলে যেতো। গাম্ভীর্য সরে যেতো, দেখতাম সারাক্ষণ গল্প করছে। হো হো করে হাসছে, হাসাচ্ছে। সংসারটা তখন মুখর হয়ে উঠত। তার কলিগ বা সাহিত্যিক বন্ধুরাও তার নানাবিধ রূপ দেখেছে। কারও কাছে সে অতি ভদ্র, শান্ত, গম্ভীর কারও কাছে পলাতক তো অন্যজন বলেছেন নির্জনতম, কারও কাছে বিষণ্ন, কেউবা অবসাদগ্রস্ত আবার কারও কাছে অলস, কেউ কেউ আবার সাইকোসিসও বলেছেন। কারও স্মৃতিচারণের সাথে কারোরটা মেলে না।
আরও একটি মুখোশ দেখো—তোমার দাদা প্রতিভা বসুর কাছে খুব যেতেন গল্প উপন্যাস লেখা শিখতে। বুদ্ধদেব বসুর স্ত্রী প্রতিভা বসুও লিখতেন। লেখক হিসেবে তার পরিচিতিও হয়েছিল। হেসে মরি এখন। এখন তো তোমরাও জানো যে ততদিনে কী পরিমাণ গল্প উপন্যাস তিনিও লিখে ফেলেছিলেন! যে কিনা রবীন্দ্রনাথকে রেয়াত করে না, সমালোচনাকে চ্যালেঞ্জ করে পালটা জবাব দেয়, এমনি যার আত্মবিশ্বাস সে প্রতিভা বসুর কাছে গল্প উপন্যাস লেখা শিখবে? হয়তো সুন্দরী সেই নারী যে আবার লেখে তার প্রতি মুগ্ধতা তৈরি হয়ে থাকবে। হ্যাঁ প্রতিভা বসু সুন্দরী ছিলেন, ভালো গাইতেন। কাজী নজরুল ইসলামের প্রিয় শিষ্যা তার সাথে গল্প করবে সামনে বসে, সান্নিধ্য নেবে, তাই গল্প লিখে আয় করবার ইচ্ছার কথা জানিয়ে তার কাছে যেতো গল্প কীভাবে লিখতে হবে সেই আলোচনা করতে। প্রতিভা বসুকে বোকা বানিয়ে ভেতরে ভেতরে নিশ্চয়ই হাসতো। তার গল্পকে আমলে নেয়ার মানুষ তোমার দাদা? যে কিনা বুদ্ধদেব বসুকেই গুরুত্ব দেয় না। নিজেরই তখন দু-ডজন গল্প লেখা হয়ে গেছে, সেই সময়ে যা একেবারে অন্যরকম!
বুদ্ধদেব বসু তার এক প্রবন্ধে লিখলেন, ‘বাংলা কাব্যের প্রধান ঐতিহ্য থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন, এবং গেলো দশ বছর যে-সব আন্দোলনের ভাঙা-গড়া আমাদের কাব্যজগতে চলেছে, তাতেও কোনো অংশ তিনি গ্রহণ করেননি। তিনি কবিতা লেখেন, এবং কবিতা ছাড়া আর-কিছু লেখেন না; তার উপর তিনি স্বভাবলাজুক ও মফস্বলবাসী; এই সব কারণে আমাদের সাহিত্যিক রঙ্গমঞ্চের পাদপ্রদীপ থেকে তিনি সম্প্রতি যেন খানিটকটা দূরে সরে গিয়েছেন।’ ভাবা যায় বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্য থেকে যাকে বিচ্ছিন্ন বলা হচ্ছে, তিনি বাংলা সাহিত্যের শুধু নয় বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাস বর্তমান সব গুলে খেয়ে নতুন ভবিষ্যৎ রচনা করছেন আর বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্যেরও প্রধান পুরুষ হয়ে উঠছেন। এ কথা সম সাময়িক কবি এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও বোধগম্যতায় ছিল না!
বুদ্ধদেব বাবুর সেই লেখার এক যুগ আগেই তোমার দাদা শ’খানেক গল্প, খান দশেক উপন্যাস আরও অনেক প্রবন্ধ, লিটারারি নোটস লিখে ট্রাংক ভর্তি করে রেখেছেন। বাংলা সাহিত্যের সর্বোচ্চ ভাঙা-গড়া তিনিই শুরু করেছেন এ কথা বুদ্ধদেব বসুর মতো একান্ত সুহৃদকেও জানতে দেননি এমনই চাপা স্বভাব তার! আমি অবশ্য নিশ্চিত না চাপা স্বভাবের কারণে নাকি তারা বুঝতে পারবেন না ভেবে কিছুটা তাচ্ছিল্য করেই চুপ থেকেছেন! তাচ্ছিল্য কথাটাও কি ঠিক বললাম? রবীন্দ্রনাথ তার লেখা নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করার পর তিনি তো মেনে নেননি। নিজের পক্ষে যুক্তি দিয়ে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য চমৎকারভাবে খণ্ডন করেছেন কিন্তু পরে আর সেই লেখা তাকে পাঠালেন না। শোভনা এ কথা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, রবীন্দ্রনাথকে তোমার দাদা তাচ্ছিল্য করেননি, তবে নিশ্চিতভাবে বুঝতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ তার পুরোনো চোখ দিয়ে নতুন যুগের কবিকে শনাক্ত করতে পারেননি। তাই দ্বিতীয় বইটি পাঠানোর পরেও তোমার দাদার দীর্ঘ চিঠির উত্তরে তিনি যখন এক লাইনে ‘খুশি হইয়াছি’ জাতীয় উত্তর দিয়ে কর্তব্য সম্পাদন করলেন, তোমার দাদা ক্ষুণ্ন হলেও আত্মবিশ্বাস হারাননি বা আবার চিঠি লিখতে বসেননি।
এরকম আরও ঘটনা আছে। সজনীকান্ত ‘ক্যাম্পে’ কবিতা নিয়ে যা নয় তাই সমালোচনা করলেন। অশ্লীল বললেন। এর বিপরীতেও তোমার দাদা দারুণভাবে প্রতিবাদ লিপি তৈরি করলেন কিন্তু সেটাও পাঠালেন না। কথায় কথায় ভূমেন্দ্রর সাথে আলাপ হতে ভূমেন্দ্র খুব চেয়েছিল প্রতিবাদ হোক কিন্তু কবিকে রাজি করাতেই পারল না, উল্টে ভূমেন্দ্র প্রতিবাদ করবে বলায় তাকেও মানা করেছিল। আমি ভূমেন্দ্রর কাছেই শুনেছি, তোমার দাদা নাকি বলেছে ‘এসব করে আসলে কিছু হয় না, পাঠক নিজের মতো করে সময় মতো বুঝে নেবে।…এসব ছেপে কী হবে? ওরা যখন থাকবেন না, আমিও থাকব না, এবং আপনারাও নির্ঘাত বুড়ো হয়ে পড়বেন, তখন হয়তো ব্যাপারটার এক ধরনের যাথার্থ্য নির্ণীত হবে, হয়তো হবে না। এসব ছেপে কিছু হয় না। ছাপাবেন না।’ ভূমেন্দ্র হতবাক হয়ে গিয়েছিল।
ভাবা যায় এতো সময় এত পরিশ্রম যে সাহিত্যের পেছনে ব্যয় করছে সেখানেই কতটা নির্মোহ সে! বাংলা সাহিত্যে এরকম আর একজন সাহিত্যিক ছিল কি? আমি চ্যালেঞ্জ করতে পারি, না ছিল না। এমনকি জীবনানন্দ দাশ যে এত বড় মাপের সাহিত্যিক তা বোঝার সামর্থ্যও সমকালের সাহিত্যিক বা সমালোচকদের ছিল না। কলকাতার নামজাদা সাহিত্যিকরা তাকে মফস্বলের কবি হিসেবেই ছোট করে দেখেছে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ পূর্ববাংলাকে সবসময়েই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতো। ধ্যারধ্যারে পূর্ববাংলায় ম্যালেরিয়া ছাড়া আর কিছু থাকতে পারে নাকি, তাই গ্রাম্য এক কবির পেছনে কেউ হিংস্রভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, কেউ কূটচালে আক্রমণ করেছে, কেউবা নিজেকে মহৎ প্রমাণ করতে করুণা করেছে। কিন্তু সমমর্যাদা দিতে চায়নি। এটা বুঝেই হয়তো তোমার দাদাও তাদের পাত্তা দিতো না। নিজের লেখার ওপর তার গভীর আস্থা ছিল, জানতো অগ্রসর পাঠক তার মূল্যায়ন করবেই।
হ্যাঁ ঠাকুরঝি শুধু সমাজে, পরিবারে বা ব্যক্তিগত সম্পর্কই নয় এমনকি লেখার ক্ষেত্রেও সে বহুরূপী। কবিতায় যে বিশুদ্ধ হৃদয়, শুদ্ধতম কবির খেতাব পেলো, কবিতার জগৎকে নিত্য আলোড়িত করলো নতুনত্বে, ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়ে দিলো সমসাময়িক কবি ও সমালোচকদের। গদ্যে আবার তার আরেক রূপ! গল্প উপন্যাসগুলো প্রকাশিত হবার পর সবাই কেমন চমকে গেল দেখো। বললো যে চারপাশের পরিবেশ, মানুষ ইত্যাদি নিয়ে তিনি যে ব্যঙ্গ, শ্লেষ, তীর্যক মন্তব্য করেছেন তা সেই সময় প্রকাশ পেলে তার জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠত। অনেকেই তার মধ্যে মূর্তিমান শয়তান দেখলো। কেতকী কুশারী ডাইসন তো বলেই দিলেন, এ নাকি চাঁদের উল্টোপিঠের মতোই অন্ধকারাচ্ছন্ন… অর্ন্তমুখী, হীনম্মন্য, কমপ্লেক্স সমন্বিত, দ্বন্দ্বদীর্ণ, জটিল—এমনি সব অভিধায় ভূষিত করলেন বলবো নাকি গালাগাল? আসলে তোমার দাদার গল্পের নায়কেরা তার সাহিত্যিক বন্ধুদের প্রতি যে মনোভাব পোষণ করতো তা থেকেই এই বিচার। সবাই তো তার লেখা থেকেই তার জীবন বৃত্তান্ত বানিয়েছে। তারা জানে না যে লেখকের সব লেখাই আত্মজৈবনিক হলেও আত্মজীবনী নয়। তাহলে তা আর শিল্প হয় না। তোমার দাদার মতো লেখক, নান্দনিকতার উচ্চমার্গে যার অবস্থান, সে কি কোনো সরল কবিতা বা গল্প-উপন্যাস লিখতে পারে! তাহলে তো খুব সহজেই এই কবিতাটি— ‘আলো অন্ধকারে যাই— মাথার ভিতরে/ স্বপ্ন নয়, কোন এক বোধ কাজ করে;/ স্বপ্ন নয়-শান্তি নয়-ভালোবাসা নয়,/ হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়;/ আমি তারে পারি না এড়াতে, সে আমার হাত রাখে হাতে,/ সব কাজ তুচ্ছ হয়-পণ্ড মনে হয়,/ সব চিন্তা-প্রার্থনার সকল সময়/ শূন্য মনে হয়,/ শূন্য মনে হয়’—দেখো এই ক’টি লাইন দিয়েই তার সমস্ত সাধনা শেষ করে ফেলা যায়। কিন্তু সব তো শেষ হয়নি, শূন্যতার বোধ যেমন সত্য তার কাজের বিশালতাও তো সত্য। শূন্যতা বোধে তার প্রিয় সব কাজ তো পণ্ড করে ফেলেননি।