Homeসাহিত্যলাবণ্য দাশের চিঠি ।। পর্ব—এক

লাবণ্য দাশের চিঠি ।। পর্ব—এক


তোমাকেই লিখছি ঠাকুরঝি। তোমার দাদা মারা যাবার পরে আমার প্রতি সবচেয়ে বেশি উষ্মা তুমিই প্রকাশ করেছিলে। তা শুনতে শুনতে, পড়তে পড়তে মুখস্থ হয়ে গেছে। তোমার দাদাকে নিয়ে যেখানে যত কথা, যত লেখা, সবখানেই তোমার ওই উক্তি! ওটাই এখন ট্রাম্পকার্ড আমাকে পিষে ফেলবার, তোমার দাদার পুরো জীবন থেকে আমাকে নস্যাৎ করে দেবার। তোমার দাদার জীবনে সবাই কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা প্রমাণ করতে হুলস্থূলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আর সেটা করতে গিয়ে অবধারিতভাবে আমার বদনাম এসে পড়বেই! কবি, লেখক, সম্পাদক, ভক্ত, শিষ্য—যার সাথেই তোমার দাদার সামান্য পরিচয় ছিল সেই স্টেটমেন্ট দেয় আর আমার বদনাম করে—আমি সারাটা জীবন জ্বালিয়েছি, খাওয়ার খোঁটা দিয়েছি। আমার কারণেই না কি আত্মহত্যা! মৃত্যুর পরও আমি না কি অসন্তোষের ঝুড়ি উলটে দিই সবার কাছে, জনে জনে আমার কেবল দুঃখকথন। মৃত্যুর সময়ও কাছে ছিলাম না, সেবা করতাম না, কত কী!

সেসব কথার কিছু বোঝার ভুল, কিছু অতিরঞ্জিত আর অনেকটাই মিথ্যে সে তুমি নিশ্চিত জানো। তবে তাদের সেসব অভিযোগের প্রায় সবই আটপৌরে অভিযোগ। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মানুষের একপেশে মনোভাব, সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে করা এইসব অভিযোগ আমি ব্যাখ্যা করতে পারি। পারি কারণ সবই কবির প্রতি ভক্তের একপেশে অঞ্জলি। একপেশে কারণ তারা শুধু কবির কবিত্বই দেখেছে আর দেখেছে বহিরঙ্গের শান্ত স্নিগ্ধ কোমলতা। দাম্পত্যের মতো জটিল সম্পর্কে পড়ে দুজন ভালোমানুষও যে দুজনের নির্মম শত্রু হয়ে উঠতে পারে, তা সেই অবস্থায় না পড়লে বোধহয়  কেউই বোঝে না। আপনজনেরাই বোঝে না, সেক্ষেত্রে ভক্ত বা বন্ধু তো একপাশটাই দেখে—তারা ওই গভীরতায় পৌঁছাবে কী করে! আমিও তাই তাদের বহুবিধ সমালোচনার ঘায়ে গণশত্রু হয়ে গেলাম—যেভাবে সক্রেটিসের স্ত্রী, তলস্তয়ের স্ত্রী হয়েছিলেন। আরও অনেকেই হয়েছেন নিশ্চয়ই আমি জানতে পারিনি তাদের নাম। কত প্রতিভাময়ী যে স্বামীর ইচ্ছের বলি হয়েছেন তার অল্পই তো জানি আমরা। তলস্তয়ের স্ত্রী তো পালটা উপন্যাস লিখেও রেহাই পাননি। জানাতেই পারেননি তার বক্তব্য। এই পৃথিবী নারীর অধিকারের প্রতি এতটাই বিমুখ। তোমার মতো সুযোগ পাওয়া আর তার সদ্ব্যবহার করতে পারা পাবলিক সমাজের উচ্চাসনে বসে উৎপটাং থিয়োরি কপচাবে আর এই সমাজ সতীর গুণে পতির সাফল্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে ধন্য ধন্য করবে—এমনি ওপর কাঠামোয় আমাদের নাজুক বসবাস বটে! 

অপার দুঃখে ডুবেই তো ছিলাম, অসন্তোষ অভিমান থাকাই কি স্বাভাবিক ছিল না? বাইরের মানুষের হয়ত এত বড় কবির বিপক্ষে কিছু শুনতে ভালো না লেগে থাকতে পারে, কিন্তু তুমি এ  কী বললে! দুঃখ অনেক পেয়েছিলাম তবে তুমি একেবারে হতবাক করে দিয়েছিলে! ভূমেন্দ্রর ব্যাপারটা বুঝি, একে ভক্ত তায় পুরুষ, কিন্তু তুমি কেন এই কাজ করলে শোভনা? ঈর্ষা? এত ঈর্ষা জমানো ছিল! অথচ তোমার দাদা যতদিন বেঁচে ছিল আমাদের সম্পর্ক ভালোই তো ছিল তাই না? বিয়ের সময় সবার প্রথমে তুমিই না গলা জড়িয়ে বন্ধুত্ব করেছিলে? আমার রূপের প্রশংসা করেছিলে, লাবণ্য নামের সার্থকতার কথা বলে, ইনোসেন্টও বলেছিলে। অবশ্য এখন মনে হচ্ছে আমার ধারণা ভুল ছিল। তুমি হয়ত অভিনয় করতে আর আমি তাই সত্য ভাবতাম।

তুমি ঈর্ষা কেন করবে আজও তা বুঝি না। ঈর্ষা তো হতে পারত আমার! তোমার দাদা লিখেছিল,

‘এই তো সে-দিন

ডিব্রু নদীর পাড়ে আমরা ঘুরছিলাম

মনে হয় যেন হাজার বছরের ও-পারে চলে গিয়েছ তুমি

শুধু অন্ধকারে বাবলাফুলের গন্ধ যখন পাই

কিংবা কখনও-কখনও গভীর রাতে ঘাস মাড়িয়ে

তারার আলোয় সেই ব্যথিত ঘাসের শব্দ যখন শুনি

রক্তের বিমূঢ় উত্তেজনায়

তখন তোমাকে আমি পাখির কাছে পাখিনীর মতো পাই।’

পাখির কাছে পাখিনীর মতো পাওয়াটা কেমন শোভনা? খুব নিবিড়, পালকে পালক, চঞ্চুতে চঞ্চু—আর? সবাই বলে এ তোমাকে নিয়েই লেখা। হ্যাঁ শোভনা তুমি তখন ক্লাস নাইনে পড়। তখনও আমি আসিনি তোমাদের পরিবারে। ডিব্রুগড়ে ছিলে তখন। খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়েছিল তোমাদের। ১৯২৯ সাল সেটা। তোমার বেকার দাদা চাকরি বা ব্যবসার উছিলায় গিয়েছেন ডিব্রুগড়ে তোমাদের বাড়িতে। উছিলা বললাম কারণ জীবিকার কোনো সন্ধানই তোমার দাদা করেননি সেখানে। কেবল তোমার সাথে প্রেমই করেছে। পরীক্ষার অজুহাত দেখিয়ে বেড়াতে পর্যন্ত যায় না। কাকিমা টেনশনে মরেন, বাড়িতে নালিশ করেন কিন্তু তোমরা লা-পরোয়া।

তুমি তখন ছোট ছিলে বলেই হয়ত সরল ছিলে, সাড়া দিতে দ্বিধা করোনি কাকিমার রাগারাগি সত্ত্বেও। অথচ যত বড় হলে হিসাব নিকাশ বুঝলে আর আলগোছে সরে পড়লে মানুষটাকে পাগল করে দিয়ে। সেই সময়টি নিয়ে অনেক কথা চালু ছিল তোমাদের পরিবারে। আমি সেভাবেই জেনেছি সব। কাকা কাকিমার রাগারাগি নিবৃত্ত করতে পারেনি তোমার দাদাকে, কিন্তু তুমি পেরেছ। না নিবৃত্ত করোনি লেজে খেলিয়েছ। হ্যাঁ রূঢ় শোনালেও তাই বলব আমি। সারাটা জীবন কাছে টানা আর দূরে ঠেলার খেলা। প্রেম ছিল তোমার দাদার, যেখানে তুমি গিয়েছ সে ছুটেছে তোমার পিছু পিছু। তুমি কখনও সামান্য দয়া করেছ কখনও করোনি। ভালোবাসোনি তাকে, কিন্তু তার কবিত্বের মোহ জড়িয়ে রেখেছিল তোমায় তাই না?

তুমি তখন বুদ্ধিমতী হয়েছ, তোমার মর্জিমতো নাচাচ্ছ মানুষটাকে। কেমন সুন্দর প্রেম করলে দিনের পর দিন। মানুষটা যখন তোমার ভেতর ঢুকে গিয়েছে। অজস্র কবিতা লিখছে তোমাকে উৎসর্গ করে, ক্ষেপে উঠেছে তোমাকে পাওয়ার জন্য, তখন হিসেব নিকেশ করে কী সুন্দর সরিয়ে নিলে নিজেকে। সে কিন্তু তোমার ক্ষেত্রে কোনো হিসেব নিকেশ করতে জানে না। তোমার পরিবর্তনও কি বুঝতে পারত না? পারত নিশ্চয়ই। ডায়েরি ভরে লিখেছে দুঃখ আর ক্ষোভের কথা। কিন্তু গভীর প্রেমে যা হয়। ভুলে যেত সব রাগ, দুঃখ। আমাকে যেমন ভালোবাসতো না বলে প্রতিটি ত্রুটির জন্য, অথবা অযথাই গভীরভাবে ঘৃণা করত, তেমনি তোমার সব অন্যায় ভুলে যেত ভালোবাসতো বলে। তাই প্রত্যাখ্যানের পরেও আবার ছুটে যেত। সেই ডিব্রুগড়ের তোমার কথাই মনে রাখত। যেখানে কি না তোমাকে ‘বিমুঢ় রক্তের উত্তেজনায় পাখির কাছে পাখীনির মতো’ পেয়েছিল। আর সবসময়েই তার মনে হয়েছে এ বেশিদিন আগের কথা নয়। এই তো সেদিন, এই তো সেদিন। কী ভীষণ কী তীব্র সে প্রেম! ভাবতেই আমি শিউরে উঠি! প্রেম তো এমনই হওয়া উচিত। এতোটাই নিবিড়, উত্তাল—আমরা পরস্পরকে কখনোই এভাবে পাইনি, বুঝতে পারো নিশ্চয়ই তার কারণ? হ্যাঁ, আমি যেমন তাকে ভালোবাসতে পারিনি সেও আমাকে। সে আমার টাইপের ছিল না, আমিও তার টাইপের ছিলাম না, কিন্তু তুমি বা তোমরা যেভাবে আমাকে গবেট প্রতিপন্ন করতে চাও সত্যি করে বলো তো, মনে মনে স্বীকার না করে পারো কি, আমারও যে কিছু গুণাগুণ ছিল? 

তোমাদের সম্পর্কের কথা সব জেনেও আমি কিন্তু তোমাকে দোষ দিইনি বা হিংসাও করিনি কোনোদিন। সব সময়ে তোমার সাথে বন্ধুত্বই রেখে গেছি। আমার তো তোমার দাদার ওপর খুব রাগ ছিল, তাই তোমার সাথে খানিকটা একাত্মবোধ করতাম। কিন্তু একই যাত্রায় ফলল দু’রকম ফল। যে প্রত্যাখ্যান তোমার জন্য হলো আশীর্বাদ আমার জন্য তাই হলো অভিশাপ। তুমি নন্দিত হলে, খ্যাতির ভাগীদার হলে, আর আমি নিন্দিত!

পোড়াকপাল আমার, নইলে এমন হয়! (পোড়াকপাল শব্দটি লিখে নিজেই হাসছি নিজেকে নিয়ে। আমি কবে কপালে বিশ্বাস করতে শুরু করেছি নিজেই জানতে পারিনি!)। আমি যে পোড়াকপালি তাতে কারোরই কোনো দ্বিমত হওয়ার কথা না। আমি জন্মেছিলাম একটি সম্পন্ন পরিবারের সুন্দরী মেয়ে হয়ে। কী সুখের দিন ছিল আমাদের। রূপবান, সদাহাস্যময় উদার বাবা, অপূর্ব সুন্দরী আর তীক্ষ্ম বুদ্ধিমতী মায়ের সুখী সংসার। বাবা মায়ের রূপগুণ মিলিয়ে আমি হয়েছিলাম অনন্যা—এ কথা শুনে শুনেই বড় হয়েছি। আমার জীবন তো হেসেখেলেই কাটার কথা ছিল। কিন্তু বিধিবাম বলেই ছোটবেলাতেই বাবা মা অল্প সময়ের ব্যবধানে মারা গেলেন, আর আমাদের চার ভাইবোনকে ভাগাভাগি করে কাকাদের গলগ্রহ হতে হলো। সেখানেও কিন্তু খুব খারাপ ছিলাম না আদর পেয়েছি অফুরান। লেখাপড়ায় ভালো ছিলাম। গান গাইতাম, নাচতাম। বাইরে বাইরে একটু জেদী, একটু আবদেরে মনে হলেও আমাকে বুঝিয়ে বললে বেশ বুঝতাম, মেনে নিতে, মানিয়ে নিতেও শিখেছিলাম। কলেজে ভর্তি হয়ে স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন দেখে বিপ্লবের পথে হাঁটতে শুরু করেছিলাম। বিভিন্ন দেশের বিপ্লবের ইতিহাস পড়া, ভারতের ঐতিহ্যময় ইতিহাস পড়া, শরীরচর্চা, ব্রতচারী নৃত্য, নাটক—এ সবই করছিলাম নিজেকে তৈরি করতে। যে ঢাকার মেয়েকে খেকো বললে সেই ঢাকা-চট্টগ্রামের মেয়েরা কিন্তু তখন ব্রিটিশ তাড়াতে বিপ্লব করছে, অকাতরে প্রাণ দিচ্ছে। আমার মাথায়ও তখন কেবলই বিপ্লব। প্রেম বা বিয়ের কথা ভাবতেও পারি না। এসময় নিতান্ত অনিচ্ছায় অপছন্দে জ্যাঠামশায়ের ভুল সিদ্ধান্তে আমার বিয়ে হয়ে গেল তোমার দাদার সাথে। দিল্লিকা লাড্ডুর লোভে জ্যাঠামশায় কাত হয়ে গিয়েছিলেন বলা যায়। পরে কিন্তু যতদিন বেঁচেছেন আমার সর্বনাশের জন্য নিজেকে দায়ী ভেবেছেন। যদিও সব অভিভাবকের মতো মানিয়ে নেয়ার উপদেশই দিয়েছেন বরাবর। তাঁকে আমি দোষ দিই না। জ্যাঠামশায় সাদাসিধে মানুষ আমাকে ভালোবাসতেন খুব। তোমার দাদার মতো নরম, ভদ্র দেখতে মাটির মানুষটির ভেতর কী কী যে চলে তা বোঝার সাধ্যি ওই একবেলায় কী করে হবে বেচারির! একদিন একমাস তো দূর, সারাজীবনেও আমি বা এই জগতের কেউ কি বুঝেছে তাকে? বুদ্ধদেব বসু পর্যন্ত বুদ্ধু হয়ে গেলেন! চলবে





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত