মোহামেদ এল-বিসাতি (১৯৩৮-২০১২) মিশরের একজন বিশিষ্ট সাহিত্যিক। যিনি আরবি সাহিত্যে ছোটগল্প ও উপন্যাস লেখার জন্য বেশ পরিচিত। তার লেখায় মিশরের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা, সামাজিক বৈষম্য ও রাজনৈতিক অবস্থা ফুটে ওঠে। তার গল্পগুলো সাধারণত সংক্ষিপ্ত, গভীর, এবং প্রতীকী অর্থবোধক। আরবি সাহিত্যের সমসাময়িক ধারায় তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে।
সে দ্বিতীয়বারের মতো এই জায়গায় এসেছে। পুলিশটি ঘোড়ার ওপর থেকে তার দিকে তাকায়।
সময়টা তখন বিকেল। রাস্তার ধার ঘেঁষে হলুদ-রঙা দেয়াল। দেয়ালের ওপাশে একটা বড়সড় আয়তাকার তিনতলা বাড়ি; একইরকম দেখতে তার ছোট ছোট জানালাগুলোকে অন্ধকার ফোকরের মতো মনে হচ্ছিল। মেয়েটি ঘোড়া থেকে কয়েক কদম দূরে দাঁড়ানো। পুলিশটি তার পেছনের জানালাগুলো দেখে, তারপর মেয়েটির দিকে তাকায়। সে জিনের প্রান্তদেশে তার দুহাত রাখে, তারপর চোখ বন্ধ করে। কিছুক্ষণ পর ঘোড়াটি চলতে শুরু করে। সেটি রাস্তার মাঝামাঝি দাঁড়ানো ছিল। তারপর, মুহূর্তের মধ্যে সেটি আধা পাক ঘুরে রাস্তার গোড়ায় গিয়ে দাঁড়ায় আবার।
মেয়েটি দু’পা এগিয়ে আসে। ঘোড়াটি তার সামনের একটি পা একটুখানি বাঁকায়, তারপর হাঁটুমুড়ে বসে পড়ে পুরোপুরি।
“সার্জেন্ট, প্লিজ আমাকে ওর সঙ্গে দুটো কথা বলতে দিন।”
তার চোখ তখনও বন্ধ, হাতদুটো জিনের কিনারা ছুঁয়ে আছে নিথর।
দেয়ালের ওপর তারকাঁটার বেড়া, যার শেষপ্রান্তে একটি কাঠের মিনার। তার ভেতরে দণ্ডায়মান এক সশস্ত্র প্রহরী।
মেয়েটি আরেক পা এগিয়ে যায়।
“শুনুন, তাকে বদলি করে দেওয়া হয়েছে…”
সূর্য মধ্যগগন পেরিয়ে গেছে। তারপরও দিনের উত্তাপ কমেনি তখনও। দেয়ালের নিচে এক চিলতে ছায়া পড়ে আছে কেবল।
মেয়েটি তার বাচ্চাকে কাঁধে তুলে নেয়।
সে যখন পুনরায় পুলিশের দিকে তাকায়, তখন তার কপালে ঘামের সরু একটি রেখা দেখতে পায়।
ঘোড়ার সামনে থেকে সে নীরবে সরে যায় এবং দেয়ালের পাশ ধরে হাঁটতে থাকে। আধাআধি গিয়ে সে দালানের বিপরীত দিকে একটা পাথরের স্তূপে বসে পড়ে।
বন্দিদের ধোয়া কাপড়ের হাত-পাগুলো জানালার বাইরের দড়িতে ঝুলে থাকতে দেখা যায়। অধিকাংশই একেবারে নিথর, নিশ্চল, মাঝেমধ্যে বয়ে যাওয়া বাতাসের ঝাপটা সত্ত্বেও।
মেয়েটি নিজেকেই ফিসফিস করে বলে—
“সেগুলো নিশ্চয়ই ভেজা।”
সে বাচ্চাটিকে কোলে নেয়। এক মুহূর্তের জন্য তার চোখ হাওয়ায় দুলতে থাকা একটা জেলাবার ওপর আটকে যায়। সে তার পা-জোড়া সামনে ছড়িয়ে দিয়ে নখে আটকানো শুকনো কাদাকে দেখে। পাগুলো ভালো করে ঘষে নিয়ে সে আরও একবার তার দিকে তাকায়।
মাথা হেলিয়ে সে আধখোলা চোখে তিনতলার জানালাটাকে দেখে।
মিনারের সৈন্যটা এক পা এগিয়ে আসে। কাঠের দেয়ালের কিনারে সে তার মাথা রাখে।
মেয়েটি আকাশের দিকে তাকায়, তারপর রাস্তা, বাড়ির ছাদগুলো এবং সাদা ঘোড়ার মাথাটার দিকে চেয়ে দেখে।
এক আচমকা চিৎকারে নীরবতা ভেঙে যায়। মেয়েটি দ্রুত তার পা টেনে নেয়। সে তিনতলার জানালার গরাদের ভেতর থেকে একটা নগ্ন বাহুকে তার দিকে ইশারা করতে দেখে।
“আজিজা, আজিজা, আমি আশুর।”
সে দেয়ালের দিকে এক পা এগিয়ে যায় এবং নীরবে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে।
“আমি আশুর, আজিজা, শোনো আমি আশুর।”
সে জানালা দিয়ে বার করা তার অন্য হাতটাকে দেখে। সে তার চোখ দিয়ে দুই হাতের ভেতরে কিছু একটা খোঁজে এবং একসময় দুটো গরাদের মাঝখানে চেপে রাখা একটা মুখ দেখতে পায়। তার ওপরে ও পাশাপাশি অন্য কিছু মুখও দেখা যায়।
“আজিজা, আমার বদলির আদেশ এসে গেছে। আমার চিঠিটা পেয়েছ তুমি? আর চার দিনের মধ্যেই আমাকে বদলি করে দেওয়া হবে। তুমি কি খেজুর গাছ দুটোকে ছেঁটে দিতে পেরেছিলে? হামিদ আর সানিয়া কোথায়? তুমি ওদেরকে সঙ্গে আনোনি কেন? আমি বদলি হয়ে যাচ্ছি। হামিদ কোথায়?
প্রহরীটি হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলে—
“চুপ কর, বেজাতগুলো!”
সে তাকে চিৎকার করতে শোনে এবং দেখে জানালা থেকে মুখগুলো অদৃশ্য হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ বাদে তার মুখ আবারও দেখা যায় জানালার গরাদের ফাঁক দিয়ে, তখন ওপরের তলা থেকে অন্যান্য মুখগুলোও দৃশ্যমান হয় পুনরায়।
“আজিজা।”
সে ঘোড়ার ওপর বসা পুলিশটিকে দেখে, তারপর মিনারের সেই প্রহরীটির দিকে তাকায়।
“তুমি কাকে কোলে নিয়ে আছ, আজিজা? শাকির?” সে দুবার তার মাথা নাড়ে।
“তাকে একটু উঁচুতে তুলে ধরো। একটু ওপরে।”
সে বাচ্চাটাকে তার দুই হাতের মধ্যে নিয়ে মাথার ওপরে তুলে ধরে। সে লক্ষ করে, তার বাহুদুটো হঠাৎ করে ভেতরে ঢুকে যায় এবং তার হাতজোড়া জানালার লোহার শিকগুলো চেপে ধরে। তারপর তার মুখ্য দৃশ্য থেকে সরে যায়। কিছুক্ষণের জন্য মেয়েটি নিচের দিকে তাকিয়ে থাকা মুখগুলোর মাঝে তাকে খোঁজ করে। সে তার বাহুদ্বয় একটু নিচে নামায় আর তখনই জানালা থেকে হাসির আওয়াজ শুনতে পায়। সে বাইরের দিকে বাড়ানো তার বাহুটা আরেকবার দেখতে পায়, তারপর তার মুখখানি পরিষ্কারভাবে দৃশ্যমান হয় জানালার মাঝখানে।
“ওপরে, আরেকটু ওপরে, আজিজা। তার মুখটা সূর্যের দিকে ঘোরাও যাতে করে আমি তাকে দেখতে পাই।”
মেয়েটি তার বাহুদুটো একটু নিচে নামায় কিছুক্ষণের জন্য, তারপর বাচ্চাটাকে আবারও তুলে ধরে, তার মুখখানি সূর্যের দিকে ফেরানো। বাচ্চাটা চোখ বন্ধ করে এবং চিৎকার করে কেঁদে ওঠে।
“সে কাঁদছে।”
আশুর হাসতে হাসতে ঘুরে দাঁড়ায়।
“ছেলেটা কাঁদছে। আমাদের ক্ষুদে… কী যেন নাম! আজিজা, বউ আমার, ওকে কাঁদতে দাও।”
সে তার হাত জোড়া মুখের কাছে গোল করে চিৎকার করে বলে—
“ওকে কাঁদতে দাও।”
সে আবারও হেসে ওঠে। তার পাশ থেকে কয়েকটা চিৎকারের ধ্বনি ওঠে। আজিজা তাদের চিৎকারের ধ্বনি ও কথাগুলো শুনতে পায়। তারপর সে শিকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা আশুরের বিশাল নাকটা দেখে।
“বোকা মেয়ে, যথেষ্ট হয়েছে। তার মাথাটা ঢাকো এবার, নইলে সে রোদে পুড়ে যাবে।”
সে বাচ্চাটাকে বুকের কাছে চেপে ধরে এবং মিনারের ভেতরে সৈন্যটাকে সরে দাঁড়াতে দেখে।
“খেজুর গাছ দুটোকে ছেঁটে দিয়েছ তো?” মেয়েটি মাথা নাড়ে।
“কেন নয়? তুমি কথা বলছ না কেন? আমি বদলি হয়ে যাচ্ছি। ইসমাইলের সঙ্গে দেখা করে বলো আমি তাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছি। সে তোমার উপকার করে গাছ দুটো ছেঁটে দেবে। তখন তুমি কিছু খেজুরও আনতে পারবে। তা, আমার সিগারেট এনেছ তো?”
সে হাত নেড়ে কিছু একটা ইঙ্গিত করে।
“কথা বলো। কী বললে?”
“তোমার তা আছে তো।”
“জোরে বলো।”
“তোমাকে পাঠিয়েছি তো?”
“কখন?”
“এইমাত্র।”
“এখন? একটু দাঁড়াও তাহলে, নড়বে না কিন্তু।”
সে হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে যায়। জানালায় শুধু দুটো মুখ। একজন তার হাত বাড়িয়ে দেয়; সে তার হাত দিয়ে শূন্যের মধ্যে কী একটা অশ্লীল ভঙ্গি করে। মেয়েটি চোখ নামায়, তারপর সেই পাথরের স্তূপে গিয়ে বসে আবার।
“আজিজা।”
আজিজা মুখ তুলে জানালার দিকে তাকায়, যদিও গলাটা সে চিনতে পারে না। সে পুরুষটিকে হাসতে দেখে, তার হাত তখনো নড়ছে। দ্বিতীয় লোকটি হাঁটু গেড়ে বসা, তার জেলাবা উরুর ওপরে তোলা। সে তাকে বলতে শোনে—
“আজিজা, দেখো!”
সে মুচকি হাসে। পুলিশটি তখনও ঘোড়ার ওপরে বসা, ঘুমন্তপ্রায়। মিনারের পাশের জানালা দিয়ে সে সৈন্যটির মাথার অংশবিশেষ দেখতে পায়। সে তার হেলমেট খুলে নিয়েছে।
আজিজা তার নাম ধরে ডাকা কয়েকটি কণ্ঠ শুনতে পায়। সে মনোযোগ দিয়ে শোনে, তার দৃষ্টি নিবদ্ধ সৈন্যটির মাথার ওপর, যখন তা জানালার ভেতরে নড়াচড়া করে। ডাকগুলোর পুনরাবৃত্তি হয়, ফাঁকে ফাঁকে দেওয়া গালিগুলোসমেত। সৈন্যটি হেলমেট পরে, যদিও মিনারের ভেতরেই রয়ে যায়।
হঠাৎ করে তাদের আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়, তার কিছুক্ষণ পরেই আজিজার কানে আসে তার স্বামীর রুদ্ধশ্বাস গলা—
“আজিজা? আমি পাঁচটা বলেছি, আমি তোমাকে পাঁচটা প্যাকেটের কথা বলিনি?” সে নীরবে তার দিকে মুখ তুলে তাকায়।
“এই মেয়ে, তিনটা প্যাকেট আনার কী মানে আছে?” মেয়েটি হাত নেড়ে কী যেন বলে।
“কী বললে তুমি?”
“পাঁচ, আমি পাঁচ প্যাকেট পাঠিয়েছি।”
“পাঁচটা?” সে ক্রুদ্ধস্বরে চিৎকার করে। “জারজগুলো!”
সে অদৃশ্য হয়ে যায় হঠাৎ করে, তারপর নিচের দিকে ঝুঁকে চিৎকার করে বলে: “দাঁড়াও। যেয়ো না।”
আজিজা মিনারের জানালার দিকে মুখ তুলে তাকায়। পুরুষটি কিছুক্ষণ পরে ফিরে আসে।
“ঠিক আছে, আজিজা। কিছু মনে করো না। পাঁচটা, হ্যাঁ পাঁচটিই ছিল। কিছু মনে করো না, দুটো খোয়া গেছে। কোনো ব্যাপার না। শোনো, আমি যা বলতে চেয়েছিলাম।”
তারপর নীরবতা। সে তাকে জানালা দিয়ে নীরবে চেয়ে থাকতে দেখে। আজিজা তার কালো জেলাবা ঝাঁকায়, তারপর দেয়ালের দিকে হেঁটে যায়। পুরুষটি হাসে।
“আজিজা, আমি তোমাকে কিছু বলব বলে ভেবেছিলাম।”
তারপর আবারও নীরবতা। সে তার মুখ ফিরিয়ে নেয়, এতে তার মুখের একাংশ সূর্যের বিপরীতে চলে যায়। সে তার মুখের ঘোমটা সরায় খানিকটা।
“তারা খানদুই প্যাকেট নিয়ে গেছে। কিছু মনে করো না আজিজা।”
পুরুষটি হাসে। তার কণ্ঠ শান্ত হয়ে এসেছে। তার ওপরের জানালা থেকে অন্য মুখগুলো সরে গেছে, তার পাশাপাশি কেবল একটা মুখ রয়ে যায় তখনো।
“দেয়ালটা তুলেছ তুমি?”
“না, এখনও তুলিনি।”
“কেন নয়?”
“আহমেদ চাচা চুল্লিটা জ্বালালে আমি সেখান থেকে কয়টা ইট নেব।”
“ঠিক আছে। ট্রামে যাবার সময় সাবধানে থেকো। ছেলেটার দিকে খেয়াল রেখো।”
সে দাঁড়িয়ে থাকে।
“আর কিছু চাও তুমি?”
“না।”
সে তার মুখের দিকে তাকায়, তার বিশাল নাক, তার নগ্ন বাহু। আশুর মুচকি হাসে। তার পাশের মুখটিও পাল্টা হাসে।
হঠাৎ সে চিৎকার করে বলে— “তুমি কি চিঠিটা পেয়েছ? আমাকে বদলি করে দেওয়া হচ্ছে।”
“কোথায়?”
“আমি জানি না।”
“কখন?”
“তারা আসলে এই কারাগারটা বন্ধ করে দিচ্ছে।”
“তোমরা কোথায় যাবে?”
“খোদাই জানে, যেকোনো জায়গায়, কে বলতে পারে।”
“কখন?”
“দু-তিনদিনের মধ্যে। এখানে আর এসো না। আমি বদলি হয়ে যাবার পার তোমাকে জানাব। ছেলেটা কি ঘুমিয়ে পড়েছে?”
“না, সে জেগে আছে।”
সে কয়েক মুহূর্তের জন্য চেয়ে থাকে।
“আজিজা।”
আবারও নীরবতা। তার পাশের মুখটি হাসে, তারপর ধীরে ধীরে মাথাটা ভেতরে ঢুকিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। তার স্বামী চুপচাপ চেয়ে থাকে, তার হাতগুলো শিকের ওপর রাখা। তারপর হঠাৎ সে পেছনের দিকে তাকিয়ে হাতগুলো ভেতরে টেনে নেয়। সে তাকে সরে যাবার ইশারা করে, ভেতরে চলে যায়।
আজিজা কয়েক পা পিছিয়ে যায়, যদিও তখনো দাঁড়িয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে।
কিছুক্ষণ পর সে পাথরের স্তূপের ওপর গিয়ে বসে, পাগুলো সামনে ছড়িয়ে দেয়। জামার আড়াল থেকে বুক বার করে বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে শুরু করে।
রাস্তার আধা-আধি অবধি ছায়া এগিয়ে আসে। সে দেখে ছায়ার প্রান্তদেশ তার পায়ের পাতা স্পর্শ করেছে। সে পা টেনে নেয় খানিকটা। জায়গাটা শান্ত, আর ধোয়া কাপড়গুলো মাথার ওপরে মৃদুমন্দ বাতাসে দোল খায়।
সে যখন তার পায়ের দিকে তাকায় আবার, তখন দেখে ছায়া তার পায়ের আঙুলসমূহ আবৃত করে দিয়েছে। সে উঠে দাঁড়ায়।
সৈন্যটি তখনও মিনারের ভেতরে; কাঠের পাটাতনের কিনারে তার বুটের আঙুল দেখা যায়। ঘোড়াটার কাছে পৌঁছানোর আগে সে একবার পেছনের দিকে তাকায়, কিন্তু জানালায় কেউ নেয়।
সে পুলিশটির দিকে নীরবে তাকায়; তার চোখ বন্ধ, তার হাত জিনের কিনারা ছুঁয়ে আছে। ঘোড়াটা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।
সে সরু গলিটা ধরে বড় রাস্তার দিকে হেঁটে যায়।