Homeসাহিত্যমিতিয়ার ভালোবাসা ।। অধ্যায়ー৩

মিতিয়ার ভালোবাসা ।। অধ্যায়ー৩


ইভান আলেক্সিভিচ বুনিন রাশিয়ান কবি ও ঔপন‌্যাসিক, যিনি রুশ সাহিত্যে প্রথম নোবেল পুরস্কার পান ১৯৩৩ সালে। ম‌্যাক্সিম গোর্কি বুনিনকে রাশিয়ার জীবিত লেখকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম বলে বিবেচনা করেছিলেন। রোমান্টিক গতিময়তায় লেখা তার ‘মিতিয়াস লাভ’ উপন্যাসটি যৌবনের প্রেমবোধ ও অনুভব নিয়ে সরল, নিরীহ ও বিয়োগান্ত এক মনোগ্রাহী লেখা। সাধারণকে অসাধারণে পরিণত করার গোপন রহস্য ও নিপুণ গদ‌্যময়তা ইভান বুনিনের লেখার অন‌্যতম বৈশিষ্ট‌্য। ‘মিতিয়াস লাভ’ ফরাসি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন, ম‌্যাডেলিন বয়েড এবং বইটির ভূমিকা লিখেছেন আর্নেস্ট বয়েড।

শেষ পর্যন্ত লেন্টের উপবাস-পর্বের শেষ সপ্তাহে কাতিয়ার পরীক্ষার দিনটি এসে গেল। মিতিয়ার কাছে তার ভেতরে ভেতরে পীড়নের কারণটাও আগের চেয়ে আরো বেশি যৌক্তিক মনে হলো।
কাতিয়া তার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে না, তার দিকে তাকাচ্ছে না, সে যেন অপরিচিতর মতো, শুধু তার থিয়েটার নিয়ে ব‌্যস্ত হয়ে আছে।
কাতিয়া থিয়েটারে অসম্ভব রকমের সফল হলো। সাদা জামায় তাকে মনে হচ্ছিল নববধূর মতো, আর তার অন্তর্গত উত্তেজনায় তাকে আরো চমৎকার লাগছিল। সে স্বতঃস্ফূর্তভাবে লোকজনের প্রশংসা পেতে শুরু করল। তার পরিচালক যিনি নিজেও একজন অভিনেতা তিনি সামনের সারিতে বসে বিষণ্ন ও নির্লিপ্ত চোখে কাতিয়াকে আরো চমৎকারভাবে অভিনয় করার উপদেশ দিচ্ছিল।
তিনি খুব নরম স্বরে কিন্তু এমন উচ্চতায় কথা বলছিলেন, যা মিতিয়াকে ক্রুদ্ধ করেছিল।
‘আরেকটু স্বাভাবিকভাবে অভিনয় করো’—পরিচালক কথাটি এমন গুরুত্বের সাথে, শান্ত স্বরে, ঘনিষ্ঠভাবে ও কর্তৃত্বের সঙ্গে বলছিলেন যে মনে হচ্ছিল কাতিয়া পরিচালকের ব‌্যক্তিগত সম্পত্তি।
অসহ্য! কাতিয়ার পাঠ ও অভিনয়ের প্রশংসা মিতিয়ার কাছে অসহনীয় লাগছিল। অভিনয়ের সময়ে তার কণ্ঠস্বরের ওঠা-নামা, হঠাৎ করে উচ্চকিত হওয়া। কখনো কখনো দমবন্ধ অবস্থা যা ছিল অত‌্যন্ত মনোগ্রাহী, যা ছুঁয়ে যাচ্ছিল দর্শকদের। তার অভিনয়ের পাঠের মধ্যে ছিল কিছু একঘেয়ে সুর, কিছু মূঢ়তা, বা কিছু বিকৃত উপস্থাপনের ভঙ্গিও, যা অভিনয় শিল্পের কলাকৌশলের সঙ্গেই যাচ্ছিল, কিন্তু মিতিয়া এসবকে ঘৃণা করছিল। সে ঘৃণা করছিল কাতিয়ার অভিনয়-শিল্পের সঙ্গে মিশে থাকার তীব্র নিমগ্নতাকে। কাতিয়া তখন স্বাভাবিক স্বরে কথা বলছিল না, তার গলার স্বরের আবৃত্তিগুলো ছিল কখনো উচ্ছ্বাসের, কখনো অতিরঞ্জিত স্বরের প্রার্থনায়, যা মিতিয়ার কাছে মনে হলো সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। মিতিয়া এতটাই বিব্রত হচ্ছিল যে, সে কোন দিকে তাকাবে, বুঝতেই পারছিল না।

অনেকগুলো রূপের সংমিশ্রণে কাতিয়া যেন কখনো পবিত্র এক নারী, আবার পাশাপাশি যেন তার রক্তিম ছোট্ট চেহারায় তার নষ্টামি। অর্ডিয়েন্স দেখছে, ছোট্ট সাদা পোশাকের ভেতর তার সিল্কের আবরণে ঢাকা পা-গুলো, তার ছোট্ট সাদা জুতোগুলো।

‘একটি যুবতী মেয়ে চার্চে গান করছে’ অভিনয়ের এই দৃশ্যটির সঙ্গে কাতিয়া যখন অতিরঞ্জিত ও সরলভাবে যুবতী মেয়েটির পবিত্রতার কথা বলছে, তখন কাতিয়ার সঙ্গে একাত্মতা বোধ করছিল মিতিয়া। সে সময় মিতিয়ার মনে হচ্ছিল, এই কাতিয়া শুধু আমার, তার গর্ব বোধ হচ্ছিল। আবার পরক্ষণেই যখন কাতিয়ার অনবদ্য অভিনয় সে দেখছিল, ব‌্যাথায় তার হৃদয় ছিঁড়ে যাচ্ছিল, তার মনে হচ্ছিল, ‘না, না, সবকিছুই আসলে শেষ হয়ে গেছে, না, সে কোনোদিনই আমার হবে না।’

পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর সুখের দিনগুলো আবার ফিরে এলো। কিন্তু মিতিয়াকে আর বিশ্বাসী মনে হচ্ছিল না। পরীক্ষার সময়ে মিতিয়ার আচরণগুলোর কথা কাতিয়ার মনে পড়ল।

‘তুমি কেমন ধরনের বোকা! তুমি কি বোঝনি, ওই সময়ে আমার আবৃত্তি যে এত ভালো হয়েছিল, সে তো তোমার জন‌্যই! তুমি ছিলে তাই!’
কাতিয়া তার হাঁটুর কাছে এসে বসল। মিতিয়া তার দিকে একটু বাঁকা হয়ে সাদা উন্মুক্ত হাঁটুতে ও স্তনে চুমু খেতে থাকল। সে চুপ থাকছিল। সে কিছুতেই ভুলতে পারছিল না, পরীক্ষার সময়ে সে আসলে কেমন অনুভব করছিল, এবং সে যে এখনো সেইসব ভয়ংকর বিষয়গুলো ভেবে যাচ্ছে, তা সে কাতিয়াকে বলতে পারছিল না। সময় থেকে সময়ান্তরে সেইসব ভাবনাগুলো তাকে অধিকার করে রেখেছে কখনো শক্তিশালী হয়ে, কখনো একটু দুর্বলভাবে, কিন্তু কাতিয়ার বিষয়ে দ্বিধাটা তার কিছুতেই মুছে যাচ্ছে না। কাতিয়া মনে মনে ঠিকই তার এইসব লুকানো ভাবনাগুলোকে বুঝে ফেলছিল, এবং একদিন ঝগড়ার মুহূর্তে বলেছিল, ‘আমি আসলে বুঝতে পারছি না, কেন তুমি আমাকে ভালোবাস! যখন আমার সবকিছুই তোমার কাছে এত আপত্তিকর! আমাকে বল, তুমি আমার কাছ থেকে কী চাও!’

কিন্তু মিতিয়া নিজেই জানে না, কেন সে কাতিয়াকে এত ভালোবাসে! যদিও সে অনুভব করে এসব ঈর্ষার যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে তার প্রেম দুর্বল হওয়ার পরিবর্তে কাতিয়ার প্রতি আরো বেশি পরিণত হচ্ছিল। সে যে কারো বিরুদ্ধে ঈর্ষার যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তা তো কাতিয়ার জন‌্যই, তার ভালোবাসার জন‌্যই, ভালোবাসাটা যে আরো শক্তিশালী হয়ে আরো বেশি কিছু চাইছে তারই জন‌্য।

কাতিয়া খুব তিক্ত হয়ে একবার বলেছিল, ‘তুমিতো আমার আত্মাকে ভালোবাসো না, ত‌ুমি শুধু আমার শরীরকে ভালোবাসো।’

এসব নাটকের কথাগুলো কোনো একটি জায়গা থেকে সে পড়েছিল, কিন্তু যদিও এসব বোকা বোকা কথা যেন তুচ্ছ, কিন্তু তবুও অসমাধানযোগ‌্য একটি পীড়নের ইঙ্গিত এখানে রয়েছে। মিতিয়া জানে না, কেন সে ভালোবাসে, সে আসলে কী চায়, তা সে বলতে পারে না—শেষ পর্যন্ত ভালোবাসা আসলে কী? তার পক্ষে এটা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। এই পর্যন্ত ভালোবাসা বিষয়ে যা সে পড়েছে, যা সে শুনেছে, তার কোথাও সে পায়নি তার নিজস্ব আবেগের প্রকাশ। বইগুলোতে, এবং জীবনে, এক বিশেষ ধরনের ভালোবাসার কথা আছে যা সকলেই জানে, যা অবাস্তব বা কখনো কখনো শার‌ীরিক। ভালোবাসা দু-ধরনের হতে পারে, প্লেটোনিক বা শারীরিক। তার ভালোবাসা এই দুইয়ের কোনোটিই নয়। শার্লট, মার্গারিট, পুশকিনের তাতিয়ানা বা টুর্গেনিভের নায়িকা, অথবা অন‌্যদিকে জোলা বা মোপাঁসার রচিত নায়িকাদের কারো সঙ্গেই কাতিয়াকে মিলানো যায় না। কাতিয়া ওদের কারো মতো নয়, আবার ওয়ার্দার, রোমিও, ওনেগিন বা আরো অসংখ‌্য নায়কদের যেসব চরিত্র সৃষ্টি করা হয়েছে, সে নিজেও তাদের মতো নয়।

তাহলে কাতিয়ার প্রতি তার অনুভবটা কেমন? ভালোবাসা ও কামুকতার মধ্যে পার্থক্যটা কী? এটা কী কাতিয়ার আত্মা না শরীর, যা তাকে মূর্ছিত করে, এমন সুখপ্রদ, যা সুখের মতো মৃত‌্যু নিয়ে আসে, যখন সে তার ব্লাউজ খুলে কাতিয়ার স্তনের কুঁড়িতে মুখ রাখে, যখন কাতিয়া তার ঠোঁটের কাছে মেলে ধরে তার কুঁড়ি—যখন মিতিয়া তা তীব্রভাবে আস্বাদন করে—এর মধ্যে যেমন রয়েছে ধৃষ্টতা, তেমনি মিশে রয়েছে সরলতা। চলবে





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত