অধ্যায় : ৬
যখন সে তার প্যাকিং শেষ করল এবং কুলির সাহায্য নিয়ে গুছিয়ে লাগেজগুলো নিরাপদে গাড়িতে তুলল, যদিও লাগেজগুলো তার আসনের পেছনে রাখায় তার বসতে অসুবিধা হচ্ছিল, তখন আরো একটি অজানিত অনুভব তার উপর ভর করে তাকে অস্বস্তি দিচ্ছিল, তা হচ্ছে পরিচিত জায়গা ছেড়ে চলে যাবার বিষয়টি। তার হতাশ মন তাকে বলছিল, জীবনের একটি পর্যায় হয়ত চিরদিনের জন্য এখানে শেষ হয়ে গেল, আবার পাশাপাশি সে তাও ভাবছিল হয়ত নতুন জীবনের শুরু হতে যাচ্ছে। সে শান্ত হয়ে গেল, সাহস করে তার চারপাশে তাকাল নতুন দৃষ্টিতে। শেষ হয়ে গেল তার মস্কোর জীবন।
তখন গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল, আবহাওয়া ছিল ম্রিয়মাণ, সংকীর্ণ গলির রাস্তাগুলি জনশূন্য, ফুটপাতগুলো দেখাচ্ছিল কালো লোহার পাতের মতো, বাড়িগুলো যেন নোংরা আর মনখারাপের ভেতর পড়ে আছে। আর কোচোয়ান যে গাড়িটা চালাচ্ছে খুবই বিরক্তিকর ধীর গতিতে।
ক্রেমলিন ও প্রোভকা পার হওয়ার পর তারা আবার সংকীর্ণ আঁকা-বাঁকা গলির ভেতর দিয়ে ঢুকল। বাগানের মধ্যে পাখিগুলো তাদের কর্কশ কণ্ঠে জানান দিচ্ছিল ঘনায়মান সন্ধ্যায় বৃষ্টি নামবেーকিন্তু এটা ছিল একটি বসন্তের সন্ধ্যা। কোলাহল আর হুইসেলের আওয়াজ আসছিল ট্রেন স্টেশন থেকে। মিতিয়া তার কুলির পেছনে পেছনে গিজগিজে ভিড়ের ভেতর, প্রচণ্ড ধ্বনি-প্রতিধ্বনির ভেতর দিয়ে শেষপর্যন্ত প্ল্যাটফর্মের কাছে ওয়েটিং রুমের ভেতরে এসে পৌঁছল। তারপর তারা ৩ নাম্বার ট্র্যাকে যাবে, যেখান থেকে বিশাল ভারী ট্রেনটি কারস্কের উদ্দেশ্যে যাবার জন্য রীতিমতো প্রস্তুত হয়ে আছে। নানা ধরনের লোক হুড়মুড় করে ট্রেনে উঠছিল, কুলিরা হাতে-পিঠে ব্যাগের বোঝা নিয়ে, ঠেলেঠুলে চিৎকার করে পথ পরিষ্কার করতে করতে এগোচ্ছিল। এসবের ভেতর হঠাৎ মিতিয়ার মনে হলো, কেউ একজন পৃথিবীর সকল সৌন্দর্য নিয়ে এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। বড্ড একাকী, অনেক জনতার ভেতরেও খুব একা। তাকে মনে হচ্ছিল সমস্ত পৃথিবী থেকে দূরে কোথাও সে দাঁড়িয়ে আছে। প্রথম ঘণ্টাটি বেজে গেলーমিতিয়ার দেরি হয়ে গিয়েছিল। কাতিয়া কিন্তু আগেই এসে পৌঁছে গেছে। কাতিয়া দৌড়ে গেল তার কাছে, যেন তার প্রেমিকা বা স্ত্রীর মতো।
‘তুমি যাও আর তাড়াতাড়ি একটি আসন নিয়ে নাও ডার্লিং। এক মিনিটের মধ্যেই দ্বিতীয় ঘণ্টাটি বাজবে।’
দ্বিতীয় ঘণ্টাটি বাজার পর সে তৃতীয় শ্রেণীর দুর্গন্ধযুক্ত ও ভিড়ের মধ্যে একটি কামরার জানালার পাশে এসে দাঁড়াল। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকা কাতিয়াকে সেই মুহূর্তে অপূর্ব মনে হচ্ছিল, যা আগে মনে হয়নি। কাতিয়ার সবকিছুই কী যে সুন্দর, তার সুন্দর স্বতঃস্ফূর্ত মুখ, পাতলা শরীর, সজীবতা যেখানে তার তরুণীসুলভ সরলতা আর নারীত্বের গাম্ভীর্য মিলেমিশে আছে। তার উজ্জ্বল চোখ, তার ধূসর গম্ভীর রঙের পোশাক, তার সাধারণ নীল টুপি, যার আকৃতি তাকে একটা বন্য আভিজাত্য দিয়েছে। মিতিয়া সিল্কের লাইনিং দেয়া কাতিয়ার এই পোশাকটিকে খুবই পছন্দ করত। দাঁড়িয়ে থাকা মিতিয়াকে খুবই লম্বা, রোগা আর বেখাপ্পা লাগছিল। ভ্রমণে সে পড়েছিল বুট জুতা যা দৌড়ে ব্যবহৃত হয়, আর একটি পুরানো কোট যার সাদা বোতামগুলো পুরানো হয়ে রং উঠে যাবার কারণে নিচের তামার অংশটিকে দেখা যাচ্ছে। এটি ছিল তার কলেজে পড়ার সময়ের পোশাক। এসব কিছু সত্ত্বেও কাতিয়ার দুঃখ ভারাক্রান্ত চোখগুলোতে ছিল পূর্ণ ভালোবাসা, যা নিয়ে সে তার দিকে তাকাচ্ছে।
থার্ড সিগন্যালটি দেবার সঙ্গে সঙ্গে এমন একটি আকস্মিক আঘাত তাকে করল যে মিতিয়া ওই অবস্থায় তার কামরা থেকে লাফ দিল আর কাতিয়াও তার দিকে দৌড়ে গেল। মিতিয়া প্রাণভরে চুমু দিয়ে ভরিয়ে দিতে লাগল গ্লাভস পরা কাতিয়ার হাত দুটি, এবং এক দৌড়ে আবার ট্রেনে উঠে গেল অশ্রুপূর্ণ চোখ নিয়ে। সে উন্মত্তভাবে নাড়তে লাগল তার টুপিটি, আর কাতিয়া তার স্কার্টটি ধরে স্থির দাঁড়িয়ে থেকে দেখছিল অপস্রিয়মাণ মিতিয়াকে। মিতিয়া শরীরটাকে ট্রেনের জানালার ভেতর দিয়ে বাঁকিয়ে কাতিয়ার দ্রুত সরে যাওয়া দেখছিল, আর বাতাসে বন্য হয়ে উড়ছিল মিতিয়ার এলোমেলো চুল। দানবীয় ইঞ্জিনটা একসময় ধীরে ধীরে উদ্ধত চিৎকারে গতির সঞ্চার করল, তারপর একসময় প্ল্যাটফরম ও কাতিয়া দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল।
অধ্যায় : ৭
বসন্তের গোধূলিটা অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল বৃষ্টিভরা মেঘের কারণে। সজীব আর উন্মুক্ত মাঠ চিড়ে বিশালদেহী ট্রেনটি গর্জন করতে করতে যাচ্ছিল। এই অঞ্চলে বসন্তকালের শুরু হয়েছে মাত্র। টিকিট পরীক্ষক একটি কক্ষের পর আরেকটি কক্ষে যাচ্ছিল টিকিট সংগ্রহের জন্য আর লণ্ঠনের বাতিগুলো জ্বেলে দিচ্ছিল। মিতিয়া চলন্ত ট্রেনের কম্পমান জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বিচ্ছেদের শেষ মুহূর্তটিকে আস্বাদন করছিল, কাতিয়ার দস্তানার উপর তার ঠোঁটের স্পর্শগুলোর উষ্ণতা তীব্র ব্যথার সাথে মূর্ত হয়ে উঠছিল। পার হয়ে যাওয়া শীতকালটাকে সে নতুন আলো দিয়ে দেখছে, তা ছিল পরিপূর্ণ সুখ ও যন্ত্রণার যা তার সমস্ত জীবনকে রূপান্তরিত করে ফেলেছে। এসব ভাবনার ভেতর কাতিয়াও যেন নতুন আলোয় অবতীর্ণ হচ্ছিল তার কাছে। হুম, কে বোঝাতে পারবে, কাতিয়া তার কাছে কী ছিল? কাতিয়া তার কাছে কী অর্থ বহন করত? ভালোবাসা, কাম, আত্মা আর শরীর? এগুলি কী? সেগুলোইতো সব নয়! এটি ছিল অন্যরকম। তার হাতের দস্তানার যে সৌরভ? সেটি কি কাতিয়া নয়, সেটি কি ভালোবাসা নয়, তা কি তার শরীর নয়, তা কি তার হৃদয় নয়? এইযে কৃষকেরা, যে শ্রমিকটি কাজ করছে কোঠার ভেতর, যে মহিলাটি তার বেতালা ছেলেটিকে বাথরুমে নেবার জন্য চেষ্টা করছে, এই যে অল্প আলো লণ্ঠনের ভেতর কেঁপে কেঁপে উঠছে, সব কিছুই ভালোবাসা, সব কিছুতেই হৃদয়ের প্রকাশーআর এই সবকিছুই অনির্বচনীয় আনন্দ, সব কিছুই তীব্র যন্ত্রণার।
সকালে ট্রেনটি ওরেলে পৌঁছল। তাকে এখন ট্রেন পরিবর্তন করে অন্য একটি ট্রেনে যেতে হচ্ছিল যে ট্রেনটি অন্য একটি ট্র্যাকে তখন অপেক্ষা করছিল। মিতিয়া অনুভব করছিল, মস্কোর লোকদের তুলনায় কত সাধারণ, শান্ত আর বন্ধুবৎসল এখানকার লোকেরা। সেই মস্কো এখন কত দূরে! সেই দূরের পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে যে মেয়েটি কাতিয়া, কী লজ্জারাঙা, কী কোমল ছিল মেয়েটা! যদি আকাশের কথা বলি, যা এখানে সেখানে ছড়িয়ে আছে বৃষ্টিভরা মেঘ নিয়ে, যদি বলি বিশুদ্ধ বাতাসের কথা যা বয়ে যায় মাঠের উপর, সবকিছুই সরল ও শান্ত এখানে। ট্রেনটা ওরেল ছেড়ে যাচ্ছিল খুবই ধীরে ধীরে, মিতিয়া বসেছিল একটি খালি কামরায়, খুব আয়েশে কেক খাচ্ছিল, যা সে কিনেছিল তুলা থেকে। ট্রেনটি ওরেল ছেড়ে যাবার পর গতির সঞ্চার করল এবং মিতিয়া ওই গতির সঙ্গে ছন্দায়িত হয়ে আরামে ঘুমিয়ে পড়ল।
যখন সে জাগল, তারা তখন ভারকোহেভে পৌঁছে গেছে। ট্রেনটি সেখানে থামল এবং সেখানে প্রচুর লোক হাঁটাহাঁটি করছে। এখানে সবকিছুই ছিল মফস্বলিয়। স্টেশনের রেস্তোরাঁয় ধোঁয়া ওঠা রান্নার গন্ধ তার নাকে এসে লাগল এবং তার খুব খিদে পেল। সে প্রাণভরে এক প্লেট সুপ খেল, এক বোতল বিয়ার খেল। তারপর তার এত ক্লান্তি লাগল যে সে আবার ঘুমাতে চলে গেল। যখন সে জেগে উঠল ট্রেনটা তখন প্রবল গতিতে ছুটছে বার্চ গাছের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে। এর পরের স্টেশনটিই তার। আবার রাত নেমে এল। তা ছিল বসন্তের এক ম্রিয়মাণ রাত।
খোলা জানালা দিয়ে ভেসে আসছিল বৃষ্টি ও ব্যাঙের ছাতার গন্ধ। যদিও গাছগুলোতে পাতা নেই, তবুও ট্রেনের গর্জনটা যেন খালি মাঠের চেয়ে এখানে একটু বেশি প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। অনেক দূরের স্টেশনের বিষণ্ন আলোগুলো তখন ধীরে ধীরে ভেসে উঠছিল। অসাধারণ সুন্দর গোধূলিতে পাতাহারা গাছগুলোর ভেতর দিয়ে দেখা গেল সবুজ দণ্ডটি যেখানে ট্রেনের সময়সূচি লিপিবদ্ধ আছে, এবং ঠিক তখনই ট্রেনটি বিপুল শব্দ তুলে এক ট্র্যাক থেকে অন্য ট্র্যাকের দিকে যাচ্ছিল। যে মানুষটি তার তরুণ কর্তাকে (মিতিয়াকে) নেবার জন্য প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষা করছিল, সে ছিল গ্রামীণ ও আন্তরিক। আর মিতিয়ার কল্পনায় তখনও জ্বলজ্বল করছিল কাতিয়ার সৌন্দর্য।
তারা স্টেশন থেকে চলতে শুরু করল একটি বড় গ্রামের ভেতর দিয়ে। গ্রামটি নোংরা ও বসন্তকালে যেমন হয় তেমনই। তখন গোধূলিবেলা ও মেঘগুলো ঘন হয়ে আসছিল। সবকিছুই যেন ডুবে আসছিল এক অসাধারণ পেলবতায়, চরম নিস্তব্ধতায়। নেমে আসা নরম মেঘের ভেজা অন্ধকারের মতোই সে যেন খুঁজে পেল এক উষ্ণতা সেই আবহের ভেতর।
মিতিয়া খুব অবাক ও উৎফুল্ল হয়ে দেখছিল, কী সহজ, শান্ত আর দরিদ্র এই গ্রামীণ জনপদ! খড়ে ছাওয়া কুটিরগুলোকে মনে হচ্ছিল ধোঁয়াটে, যেন দীর্ঘ সময় ধরে ঘুমিয়ে আছে, কারণ অ্যানানসিয়েসান দিবসের আগে গ্রামের লোকেরা কোনো কৃত্রিম আলো জ্বালায় না। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো প্রান্তরের বিরান অন্ধকারের ভেতরেও তারা নরম উষ্ণতায় মুড়িয়ে থাকে! এক ধনী কৃষকের বাড়ির সামনে যেখানে কিছু কিছু ওক গাছের পাতা নেই, যে গাছগুলোতে বাসা বেধেছিল দাঁড়কাক, সেখানে তাদের শকটটা কাদামাটির গর্তের ভেতর আটকে গেল।
একজন অপরিচিত কৃষক বাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে ছিল আকাশের দিকে তাকিয়ে, যাকে দেখে মনে হচ্ছিল সে যেন মধ্যযুগ থেকেই দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে খালি পায়ে, ছেঁড়া কোট গায়ে, তার লম্বা সোজা চুলের উপর ভেড়ার চামরার টুপি পরে। এখন নরম বৃষ্টি পড়া শুরু হল, যা উষ্ণ ও সুন্দর গন্ধযুক্ত। মিতিয়া ভাবছিল, সে সব ঘরে যে সকল মেয়েরা ঘুমায় তাদের কথা, এবং সেই ভাবনা কাতিয়ার ভাবনার সঙ্গে মিশে গিয়ে গত শীতের ভেতরে কাতিয়ার ভেতর দিয়ে মেয়েদের জগতের কথা মনে করিয়ে দিল। আর যাদুমন্ত্রের মতো তার ভাবনার সঙ্গে, তার চৈতন্যের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল বিভ্রমের মতো কাতিয়া, এখানকার মেয়েরা, বসন্তকাল, বৃষ্টি, বীজ বপনের জন্য লাঙল দিয়ে সদ্য কর্ষিত জমিতে যে গন্ধ, ঘোড়ার গায়ের গন্ধ, আবার মিতিয়ার দস্তানায় সুগন্ধীর গন্ধ। শকটের মধ্যে মিতিয়া বাঁকা হয়ে উঠে বসল, তার চোখে জল, সে কাঁপা হাতে একটি সিগারেট ধরাল। চলবে