Homeসাহিত্যমিতিয়ার ভালোবাসা ।। অধ্যায়ー৮

মিতিয়ার ভালোবাসা ।। অধ্যায়ー৮


ইভান আলেক্সিভিচ বুনিন রাশিয়ান কবি ও ঔপন‌্যাসিক, যিনি রুশ সাহিত্যে প্রথম নোবেল পুরস্কার পান ১৯৩৩ সালে। ম‌্যাক্সিম গোর্কি বুনিনকে রাশিয়ার জীবিত লেখকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম বলে বিবেচনা করেছিলেন। রোমান্টিক গতিময়তায় লেখা তার ‘মিতিয়াস লাভ’ উপন্যাসটি যৌবনের প্রেমবোধ ও অনুভব নিয়ে সরল, নিরীহ ও বিয়োগান্ত এক মনোগ্রাহী লেখা। সাধারণকে অসাধারণে পরিণত করার গোপন রহস্য ও নিপুণ গদ‌্যময়তা ইভান বুনিনের লেখার অন‌্যতম বৈশিষ্ট‌্য। ‘মিতিয়াস লাভ’ ফরাসি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন, ম‌্যাডেলিন বয়েড এবং বইটির ভূমিকা লিখেছেন আর্নেস্ট বয়েড।

তার মফস্বলের জীবনটা শুরু হলো শান্তিপূর্ণ ও আনন্দের সঙ্গে। স্টেশন থেকে আস‌ার পথ থেকেই কাতিয়া চারপাশের জনপদের সঙ্গে মিলে যাচ্ছিল। এই মিলে যাবার বিভ্রম বেশ কিছুদিন ছিল, কিন্তু এখানে আসার পর সে তার এলোমেলো ঘুমটাকে বিন‌্যস্ত করে নেবার চেষ্টা করছিল নিজের মধ্যে এবং শৈশবের সময়গুলোর সঙ্গে আবার নিজেকে মেলাবার চেষ্টা করে নিচ্ছিল। যে বাড়িতে তার জন্ম, যেখানে গ্রাম‌্য বসন্ত সে দেখেছিল, যেখানে ছিল অনুর্বরতা আর পৃথিবীর সকল শূন্যতা, তাতেই ছিল পৃথিবীর সব পূর্ণতা আর খাঁটিত্ব, সেখানে সে নতুনভ‌াবে বিকশিত হওয়ার জন‌্য তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু ঐ দিনগুলোতেও কাতিয়া কিছুতেই তাকে ছেড়ে যাচ্ছিল না, সে ছিল সর্বত্র, তার চৈতন্যে, তার মননে।

ーনয় বছর আগের এই রকমের এক বসন্তে মিতিয়ার বাবা যখন মারা যায়, সে তখন মৃত্যুচিন্তায় ভেসে যাচ্ছিল, সবকিছুতে মৃত্যু এসে যেন পেছনে দাঁড়াত।

তাদের জমিদারিটা ছিল ছোট, বাড়িটা পুরানো, সাধারণ এবং এই সরল জীবন যাপনের জন‌্য খুব বেশি চাকরবাকরের প্রয়োজন হতো না। মিতিয়ার জন‌্য একটি শান্তিপূর্ণ জীবন শুরু হল। মিতিয়ার বোন আনিয়া হাই স্কুলের দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে, আর তার ভাই কস্টিয়া একজন ইয়ং ক্যাডেট, অরেলে লেখাপড়া করে। মে মাসের আগে ওরা আসবে না। মিতিয়ার মা ওলগা পেট্রোভোনা সবসময় ব‌্যস্ত থাকত তাদের জমিজমা নিয়ে। তাকে সাহায‌্য করার তেমন কেউ নাই, তবে একজন আছেন যিনি দেখভাল করত সবকিছুইーচাকররা যাকে সর্দার বলে ডাকত। দিনের বেলায় সারাদিন মিতিয়ার মা মাঠে ব‌্যস্ত থাকত, মাঝে মাঝে ব্যবসার কাজে শহরে যেত, আর ঘুমাতে আসত একেবারে রাত গভীর হলে।

গ্রামে পৌঁছার পর প্রথম রাতে মিতিয়া বারো ঘণ্টা ঘুমিয়েছিল। পরদিন হাতমুখ ধুয়ে পরিচ্ছন্ন হয়ে পূর্বদিকে মুখ করা নিজের রৌদ্রালোকিত কক্ষটির ভেতর থেকে বাগানটিকে দেখল। তারপর সে পুরো বাড়িটাকে ঘুরে ঘুরে দেখল, এবং অনুভব করছিল বাড়িটার সঙ্গে কী নিবিড়ভাবে সে জড়িয়ে আছে। এবং বাড়িটির ভেতর যে শান্তি ও সরলতা আছে তা তার শরীর ও মনকে শান্ত করে দিচ্ছিল। সবকিছুই ছিল আগের মতো, অনেক দিন ধরে কিছুই পরিবর্তিত হয়নি। সর্বত্রই ছিল এক প্রীতিকর গন্ধ। তার ফিরে আসার উপলক্ষ্যে বাড়িটা খুব যত্ন করে পরিষ্কার কর‌া হয়েছিল। সে ফিরে এসেছিল বালক হয়ে নয়, রীতিমতো যুবক প্রভু হয়ে। প্রতিটি রুমের মেঝেগুলোকে ধোয়ামোছা করা হয়েছিল। শুধু হল রুমের কাছে যে বড় ড্রয়িং রুমটা আছে, যেটি কোনো অনুষ্ঠানে ব‌্যবহৃত হয়, কেবল সেটির ধোয়ামোছার কাজটি বাকি ছিল। দরজার কাছে তাকযুক্ত জানালার উপর দাঁড়িয়ে সে দেখছিল সোপানের উপর এক তামাটে মুখের মেয়ে শার্সির উপরের কাচটিকে মুছে দেবার চেষ্টা করছে। তখন নিচের দিকের শার্সিতে পড়া আলোর প্রতিফলন তার মুখের উপরে পড়ে মুখটিকে মনে হচ্ছে নীল। যে মেয়েটি কাজ করছিল, তার নাম পারাচা। গরম পানির বালতির ভেতর থেকে সে একটি লম্বা কাপড় বের করল। এবং ভেজা মেঝের উপর হাঁটতে গিয়ে গোড়ালির উপর ভর করে হাঁটতে লাগল মিতিয়ার দিকে। তার সাদা সাদা পা-গুলি দেখা যাচ্ছিল। সে হাত বাঁকা করে ভেজা ভেজা জ্বলজ্বলে মুখটা মুছতে মুছতে মিতিয়াকে খুব আন্তরিকতার সুরে বলছিল : ‘যাও, তোমার সকালের খাবারটা খেয়ে নাও। দিনের আলো ফোটার আগেই তোমার মা সর্দারের সঙ্গে স্টেশনে গেছে। আমার মনে হয় না তার যাবার সময়ে যে শব্দ হয়েছে, তা তুমি শুনতে পেয়েছ।’

ঠিক তখনই তার মনের ভেতরে কাতিয়া যেন উদ্ধ্যতভাবে ডেকে উঠল। সে যেন কামার্তভাবে তাকাচ্ছিল পারাচার হাতা গোটানো জামার ভেতরে সুডৌল বাহুর দিকে, কাজ করার সময় তার শরীরে স্পষ্ট হয়ে ওঠা নারীসুলভ খাঁজগুলোর দিকে। স্কার্টের নিচে লুকায়িত তার নগ্ন পা-দুটিকে মনে হচ্ছিল শক্ত থামের মতো। মিতিয়া কল্পনায় সেই পা-দুটির ভেতরে কাতিয়ার সামর্থ্যকে আনন্দের সঙ্গে অনুভব করছিল। তার মনে পড়ছিল কাতিয়া কতটা সবল ছিল। পুরো সকালটা জুড়েই ছিল কাতিয়ার অদৃশ্য উপস্থিতি।

যত দিন যাচ্ছিল, মিতিয়া নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাচ্ছিল। সে তার উপস্থিতি অনুভব করছিল গভীরভাবে আর দারুণভাবেও। সে অনেক শান্ত হয়ে গেল। আর ধীরে ধীরে তার যে অসুস্থ সংবেদনশীলতা আছে, তার থেকেও মুক্ত হতে লাগল, মস্কোর দিনগুলোতে কোনো কারণ ছাড়াই যে-সব তাকে যন্ত্রণা দিত। যতই সে মফস্বলের জনপদের সঙ্গে, তার বসন্ত ঋতুর সঙ্গে গভীরভাবে মিশে যেতে লাগল, ততই সে মস্কোর কাতিয়াকে ভুলে যেতে থাকল। সেই কাতিয়াকে, সেই যন্ত্রণাকে, যাকে সে তার স্বপ্নের সঙ্গে, আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে মেলাতে ব‌্যর্থ হচ্ছিল। চলবে





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত