একদিন দুপুরে একটু ঘুমিয়ে নিয়ে—বারোটায় দুপুরের খাবারের পর—মিতিয়া বাড়ি থেকে বের হলো এবং ধীরে ধীরে বাগানের ভিতরে গেল। কয়েকটি মেয়ে সেখানে কাজ করছিল। তারা ওখানে সবসময়ই কাজ করে। আপেল গাছের নিচে মাটি দিয়ে সমান করছিল। মিতিয়া তাদের সঙ্গে বসার জন্য গেল, এবং তার স্বভাব অনুযায়ী কথা বলতে গেল।
দিনটি ছিল উষ্ণ ও ঠান্ডা। মিতিয়া হেঁটে গেল গলিতে রোদ ছাওয়ার নীচ দিয়ে। দেখল একটু দূরে তার ডানদিকে, সাদা আঁকাবাঁকা শাখাগুলি রোদের নিচে ছড়িয়ে আছে। নাশপাতি গাছগুলি সেই বছর অজস্র সতেজ ফুলে পরিপূর্ণ ছিল। এই সাদা ফুলগুলির বিপরীতে নীলাকাশের আকাশি রং মিলেমিশে তৈরি করেছিল বেগুনি প্রতিফলন। আপেল ও নাশপাতি উভয় রকমের গাছ থেকেই ঝরে পড়েছিল অজস্র ফুল আর গাছের তলাটা ঢাকা পড়ে ছিল অসংখ্য বিবর্ণ পাপড়িতে। পাপড়িগুলোর মিষ্টি গন্ধের সাথে মিশে যাওয়া, গোরু চরানোর জায়গায় গোবর পচানোর গন্ধটাও সে পাচ্ছিল। সময়ে সময়ে ভেসে যাচ্ছিল ছোট ছোট মেঘ আর তার রং পরিবর্তিত হচ্ছিল সহিংস ক্রুদ্ধ নীল থেকে হালকা নীলে। পচা গন্ধটাও ধীরে ধীরে তেজ হারিয়ে মিষ্টি হয়ে গেল। বসন্তের স্বর্গের উষ্ণ নিঃসাড়তা পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল মৌমাছির গম্ভীর গুঞ্জনের সঙ্গে, গাছের ফুলের ভিতরের শায়িত বরফের মিশে যাওয়াতে। এরমধ্যেই, এই সুখী সময়ে মিশেছে চাঁদের আলোয় একটি বুলবুল পাখির গান।
খোলা জায়গাটা শেষ হয়েছিল, একটি গেটের কাছে, মাড়াইয়ের চাতালের কাছে। সেখানে বাম দিকের কোণে, যেখানে বাগানের একটি ঢাল আছে, সেখানে ফার গাছের বন রচনা করেছে অন্ধকার। ফার গাছগুলো ও আপেল গাছের কাছে দুটো মেয়ের উপস্থিতির কারণে রচিত হয়েছিল বর্ণিল রং। ডালপালাগুলোর নীচ দিয়ে মাথা নীচু করে মিতিয়া তাদের দিকে এগিয়ে গেল বড় রাস্তাটির মাঝামাঝি জায়গা থেকে। যেতে যেতে নীচু ডালগুলির শাখা থেকে আসা লেবু ও মৌচাকের মধুর গন্ধ তার মুখটাকে ছুঁয়ে গেল নারীর মতো। একটি মেয়ে, যেমন সাধারণত হয়ে থাকে, শুকনো ও লাল চুলের, তার নাম সনকা, মিতিয়াকে দেখে হেসে উঠেছিল বন্যভাবে।
একটা ভয়ের অভিনয় করে, সে জোরে হেসে উঠে বলল— “ওহ, আমাদের প্রভু এসেছে।” নাশপাতি গাছের বড় একটি ডালে শুয়ে সে বিশ্রাম নিচ্ছিল, সেই শাখা থেকে সে লাফ দিয়ে পড়ল। তারপর যেদিকে কোদাল রাখা আছে, সেদিকে দৌড় দিল।
অন্যদিকে আরেকটি মেয়ে ক্লাচকা, এমন একটি ভাব করল যেন সে মিতিয়াকে দেখেইনি। সে তার কোদালের লোহার ডান্ডাটির গায়ে এলিয়ে, সোজা হয়ে, অলস ভাবে শুয়ে ছিল। তার পাগুলো আবৃত ছিল নরম কালো মোজায় যাতে এমব্রয়ডারী করে সাদা ফুল তোলা আছে। সে তার কোদালটিকে মাটিতে অনেক জোরে আঘাত করে রাখল। তারপর তা উল্টে দিয়ে শক্ত ও প্রীতিকর গলায় গান গাইতে লাগল— “কার জন্য আমার বাগান ফুল ফুটাচ্ছে?” মেয়েটি লম্বা ও পুরুষালি গড়নের। সবসময় গম্ভীর।
মিতিয়া সনকার কাছে গেল। সনকা বসে ছিল, পুরানো একটি নাশপাতি গাছের ডালে, যেখানে জমি চাষের লাঙলটি হেলানো ছিল। সনকা খুব দ্রুতই তাকে দেখে ফেলল, এবং সেভাবেই দ্রুত তার কাছে এলো। খুব পরিচিত, ও অতিরঞ্জিত স্ফূর্তির স্বরে তাকে জিগ্যেস করল— “এখনি কি তুমি বিছানা ছাড়লে? নিশ্চয়ই খুব সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখছিলে। তুমি কি সেই বুলবুল পাখিটার গান শুনছিলে না, যেটি তোমার জানালায় বসে গাইছিল? দেখ! তুমি কিন্তু অনেক কিছু হারাচ্ছ!”
মিতিয়ার প্রতি তার আবেদনের প্রকাশকে সনকা চেষ্টা করছিল বিষয়টা লুকাতে কিন্তু তা ছিল বৃথা চেষ্টা। যখন মিতিয়া উপস্থিত থাকছিল তখন সে বেকায়দায় কিছু বলে ফেলছিল অস্থিরভাবে। তার নানা দুর্বোধ্য আচরণ ও নিয়মিত ইশারা সত্ত্বেও মিতিয়ার তার প্রতি উদাসিনতাকে সে স্বাভাবিক মনে করছিল না। সনকার সন্দেহ হচ্ছিল, সে নিশ্চয়ই পারিচার দিকে মনোযোগী, অথবা পারিচাকেই দেখছে। সে খুবই ঈর্ষান্বিত বোধ করল, এবং পর্যায়ক্রমে তার প্রতি নরম ও কর্কশ দুইভাবেই কথাবার্তা চালিয়ে গেল। সে তার দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছিল যে মনে হচ্ছিল তার প্রতি আবেগ আছে, আবার কখনও এমন ঠান্ডা চোখে তাকাচ্ছিল যে মনে হচ্ছিল শত্রুতা আছে। পুরো বিষয়টাই মিতিয়াকে একটি তৃপ্তিকর অনুভব দিচ্ছিল।
এখনও চিঠি এলো না। সে থামিয়ে দিয়েছিল তার বেঁচে থাকার প্রক্রিয়া। শুধুমাত্র দিনের পরদিন তার অস্তিত্ব বজায় রাখছিল, আর বিষণ্ন থেকে বিষণ্নতর হচ্ছিল অজানা অপেক্ষায়। আর যেন অসম্ভবভাবে সে এমন কাউকে খুঁজে পেতে চাইছিল যার কাছে সে তার একান্ত ব্যক্তিগত ভালবাসা, যন্ত্রণার কথা বলতে পারে। এমন কাউকে সে চাইছিল যাকে সে বলতে পারে কাতিয়ার কথা, এবং ক্রাইমিয়া যাবার আশার কথা। সেই কারণেই যেন তার প্রতি সনকার ভালোবাসার ইশারাগুলো মিতিয়ার ভাল লাগছিল। তাদের কথোপকথনের ভিতরের বিষয়গুলো কিছুটা দূর থেকে হলেও তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছিল, কারণ তার যন্ত্রণার কারণটি যে প্রেম, তা সনকার রহস্যাবৃত ভালোবাসার সংকেতের মধ্যে ছিল। সেও একটু দোলায়িত হচ্ছিল, কারণ সনকা তাকে ভালোবেসে ফেলেছিল আর ওই ভালোবাসা তাদের পরস্পরকে কিছুটা কাছেও টেনেছিল। কারণ সনকা ও মিতিয়া দুজনেই নিজস্ব ভালোবাসার ভিতরে জড়িয়ে গিয়েছিল। ভিতরে ভিতরে সে পূর্ণ হয়েছিল এক অদ্ভুত আকাঙ্ক্ষায়, যে সনকা হয়তে তার একজন বিশ্বস্ত সহযোগী হয়ে উঠতে পারে, বা কোনো এক নির্দিষ্ট সময়ে, সে হয়ত কিছুদূর পর্যন্ত কাতিয়ার বিকল্প হয়ে উঠতে পারে। এটি ভাবার কারণ সম্ভবত সনকা যেহেতু যুবতী, এবং এসব যুবতী মেয়েদের ভিতরে নারীত্ব ও নারী শরীর— মনের রহস্যঘেরা মারাত্মক বিষয়টির প্রতি তার তৃষিত লোভ ছিল।
আবার একদিন, তার গোপন গভীরের প্রেমকে যেন ছুঁয়ে গেল সনকা অজানিত ভাবে এই কথা বলে— “খেয়াল রাখ, তোমার সুযোগ কিন্তু নষ্ট কর না।” সে তার চারদিকে চোখমেলে তাকাল। দেখল সামনেই অন্ধকারময় আলোর ভিতর সবুজ ফার গাছের সারি পরস্পরের সঙ্গে মিলেমিশে প্রায় কালো দেখাচ্ছে। আবার গাছের মাথার উপর দিয়ে যে আকাশটি দেখা যাচ্ছে তা ছিল দারুণ নীল রঙের। লেবু গাছ, ম্যাপল গাছ, এমস গাছের পাতাগুলো সূর্যের আলোতে উজ্জ্বল হয়ে, তার আলোর প্রতিফলন চারদিককে ঘিরে বাগানের উপরের দিকে আলো ও ছায়ার এক ঘেরাটোপ তৈরি করেছিল আর আলো-ছায়ার বিস্তার করেছিল ঘাসের উপর, পথের উপর, ও লনের উপর। ঘেরাটোপের নিচে সেই আলোর কিরণ সৌরভময় সাদা ফুলগুলির যেখানে প্রবেশ করেছে, সেখানেই চিনামাটির তৈজষের মতো সৌন্দর্যে ফুটে উঠেছে। মিতিয়া ভাবল—
পৃথিবীতে এর চেয়ে ভালো নেই কোনো আশ্রয়
যখন নিদ্রামগ্ন ম্যাপল গাছের পাতারা ছায়াময়
এই পৃথিবীতে ভাল চুলের নেই কোনো বেনী
প্রেমিকার মাথায় সুরভিত চুলের বেনীর মতো
নিজের সঙ্গে হাসতে হাসতেই সে সনকাকে বলল, “ঘুমিয়ে পড়লে আমি কি সুযোগ হারাব? তুমি কী বলতে চাও ,আমি বুঝতে পারছি না?” চাঁচাছোলা কণ্ঠে সনকা উত্তর দিল, “তুমি কিছু বুঝ না, তা বল না।”
মিতিয়া যে স্পষ্ট করে কিছু বলছিল না, আর তাতে যে সনকার সন্দেহ হচ্ছিল, তা দেখে মিতিয়া খুব মজা পাচ্ছিল। হঠাৎ করে দেখা গেল সাদা কোঁকড়ানো চুলের একটি ছোট্ট বাছুর। সনকা সেটিকে খুব বকছিল কারণ বাছুরটি তার এমব্রয়ডারি পোষাকটিকে কামড়াচ্ছিল। সনকা চিৎকার করছিল, “তুই কি যাবি! তুই কি যাবি!”
কী বলা উচিত তা সে বুঝতে পারছিল না কিন্তু কথা চালিয়ে নেওয়া দরকার মনে করে, সে জিগ্যেস করল, “এটা কি সত্যি যে কেউ তোমাকে বিয়ে করতে চাচ্ছে?” আমি শুনলাম যে পরিবারটি ধনী ও লোকটি সুদর্শন, কিন্তু তুমি তাকে না করে দিয়েছ, তোমার বাবার কথা শুনছ না— “সে ধনী কিন্তু নির্বোধও। তার মাথায় শুধু রাত (শরীরী চিন্তা) ঘুরে বেড়ায়।” সনকা উত্তরটি দিয়ে ভিতরে ভিতরে একটু সন্তুষ্টি পেলো। “মনে হয়, আমি অন্য কারো কথা ভাবছি।”
ক্রাচকা নামে একজন মহিলা সেখানে কাজ করছিল নীরবে, গম্ভীরভাবে। সে তার মাথা নাড়াল এবং কাজের কোনো ব্যাঘাত না ঘটিয়েই বলল, “কীসব আজেবাজে কথা বলছ তোমরা”, তারপর গলার স্বর নিচে নামিয়ে আরও বলল— “গ্রামে কিন্তু এসব কথা রটে গেলে ঢি ঢি পড়ে যাবে।” সনকা খুব জোরে চিৎকার করে বলে উঠ— “চুপ কর! বাণী দিও না। আমি কারো দাবার নৌকা না। আমি জানি কীভাবে নিজের বিষয়ে বুঝে নিতে হয়।”
এরমধ্যে মিতিয়া জিগ্যেস করল, তুমি আরেকজন কার কথা ভাবছ?
“তোমাকে আমি অবশ্যই বলব।” সনকা উত্তরে বলল। “দেখ আমি কিন্তু তোমার বৃদ্ধ মেষ পালকের প্রেমে পড়েছি। ওকে দেখলেই আমি একটা উষ্ণতা অনুভব করি। আমি তোমারই মতো। আমি পুরানো মানুষদের পছন্দ করি।” সে মিতিয়াকে ক্ষ্যাপানোর জন্যই পারিচার দিকে একটি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিল। পারিচা বিশ বছরের কিন্তু এর মধ্যেই গ্রামে পুরাতন মহিলা ভৃত্য হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। হঠাৎ করে সে ঔদ্ধত্যের সাথে তার কোদালটি ছুড়ে দিল যা তার তরুণ প্রভুর প্রতি গোপন ভালোবাসার কারণে অধিকার দিয়ে থাকে এমন আচরণ করার। সে মাটিতে বসে পড়ে, হাতগুলি প্রসারিত করে, পাগুলো ছড়িয়ে দিয়ে বসল। তার পাগুলো ঢাকা ছিল ধূসর উলের মোজায় ও হাঁটু পর্যন্ত ছিল বুটজুতা।
সে চিৎকার করে হেসে উঠে বলল, “আমি কিছুই করিনি, তবুও আমি ক্লান্ত।” সে গাইছিল খুব সূক্ষ্মভাবে ভেদ করে যাওয়া সুরে— “আমার জুতার সবটাতেই শুধু ছিদ্র।”
আমার জুতার সবটাতেই ছিদ্র
তার উপরটা প্রলেপ দিয়ে ঢাকা
বালিকা ও নারীদের ক্ষেত্রে তা
সবসময়ই একইরকম।
সে জোরে জোরে হাসছিল, বলল— “আস আর আমার সঙ্গে বিশ্রাম কর কুটিরের মধ্যে, আমি সবকিছুর জন্যই তৈরি আছি।” তার হাসি সঞ্চারিত হল মিতিয়ার বিস্তৃত লাজুক হাসিতে, সে গড়িয়ে পড়ল শাখা থেকে এবং শুয়ে থাকল তার মাথাটি সনকার কোলের উপর রেখে। সনকা তাকে সরিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু সে আবার শুয়ে পড়ল। গত কিছুদিন ধরে অনেক বেশি কবিতা পড়ার কারণে তার ভাবনাগুলো কবিতা হয়ে উঠছিল।
ও গোলাপ, তোমাকে দেখি, তুমিই আমার সুখের উৎস
তোমার উজ্জ্বল বন্ধনে বাধাহীন,
শিশিরের আর্দ্রতা
কত প্রাণবন্ত ও অবোধ্য
চিত্তাকর্ষক ও বিস্ময়কর
প্রেমের ভুবনকে যেন এমন করেই পাচ্ছি!
“তুমি আমাকে ছোঁবে না।” সনকা চিৎকার করে বলল। এখন সে সত্যিই ভয় পেয়ে মিতিয়ার ভারী মাথাটাকে তার হাঁটুর উপর থেকে জোরে সরিয়ে দিতে চাইল যেটা মিতিয়া শক্ত করে তার হাঁটুর উপর দিয়ে রেখেছে।
সে বলল, “তুমি যদি এখন না ওঠো, আমি এত জোরে চিৎকার করবে যে বনের নেকড়েরাও এর সঙ্গে চিৎকার করে ওঠে। তোমার জন্য আমার কাছে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। যা ছিল তা পুড়ে গেছে, তা এখন নিষ্কৃতি পেতে চাইছে। আমি উচ্চকণ্ঠ ও শুকনো, তোমার সঙ্গে মোটেই খাপ খাবো না।”
মিতিয়া তার চোখ বন্ধ করল, আর নীরব হয়ে রইল। সূর্যটা পাতার ফাঁকে ফাঁকে ও শাখার ফাঁকে ছড়ানো, এবং নাশপাতি গাছের শাখা ও ফুলগুলি থেকে উষ্ণতা এসে তার চোখে-মুখে লাগছে। সনকা একটু নরম দুষ্টুমি করে তার সোজা শক্ত চুলগুলি ধরে জোরে বলে উঠল— ঠিক ঘোড়ার চুলের মতো —আর তার টুপি দিয়ে চোখ দুটো ঢেকে দিল। সে তার ঘাড়ের পিছনে সনকার পায়ের স্পর্শ পাচ্ছিল, যেটা তার কাছে ছিল মারাত্মক। সনকার পেটের উপর তার মাথার উপরের অংশটি স্পর্শ করছিল বলে সে তার স্কার্টের গন্ধ ও সুতি কাপড়ের ব্লাউজের গন্ধ পাচ্ছিল। তার মনে হচ্ছিল ফুল আর বাগানের মধ্যে কাতিয়া মিশে রয়েছিল। কাছে এবং দূর থেকে সে শুনতে পাচ্ছিল বুলবুল পাখির ডাক, মৌমাছিদের নিরন্তর গুঞ্জন, ঘুমের আবেশ এনে দেওয়া শব্দ, উষ্ণ বাতাসে মধুর গন্ধ, এবং পিঠের নিচের মাটিও যেন বুলিয়ে দিচ্ছিল তার মধ্যে এক সহজ অনুভব। সামগ্রিক পরিস্থিতি তাকে এক বিমূর্ত সুখের জন্য তৃষ্ণার্ত করে তোলে। হঠাৎ করে ফার গাছের বনের ভিতর কি যেন একটা নড়ে উঠল, উৎফুল্ল ও দুষ্ট হাসিটা বিস্ফারিত হলো, তীক্ষ্ণ স্বরের কোকিলের ডাক শোনা গেল। স্বরটি ছিল এত তীক্ষ্ণ, এত কাছে, এত ধারালো, এত ভীতিকর, এত স্পষ্ট যে মনে হচ্ছল সুচালো কোনো কিছুকে টেনে হিঁচড়ে সরানো হচ্ছে। যে কোনো মূল্যে কাতিয়াকে মুহূর্তের মধ্যে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তার মধ্যে এমন নেশার মতো কাজ করছিল যা অনেকটা যেন অতিমানবের পর্যায়ের। তৃষ্ণাটা এমন জোরালো হয়ে উঠল যে, সে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গিয়ে দ্রুত হাঁটা শুরু করল এবং সনকার দিকে একটি আরোপিত হাসি দিয়ে জোরে বলল,
“আমার এখনি যাওয়া দরকার, চা খাবার জন্য। আমি তোমার খুব কাছে আসলেই দুর্ব্যবহার ঘটে যায়।”
ফার গাছের বনের ভিতর থেকে যে রকম ভয়ংকর, বিস্ফোরিত, স্পষ্ট কণ্ঠ ভেসে এসেছিল, তার প্রভাবে তাৎক্ষণিকভাবে তার মধ্যে জেগে গিয়েছিল কাতিয়ার প্রতি তার তৃষ্ণা, প্রেমের সেই গৌরব। বলতেই হয়, বসন্তের শুরু থেকেই মিতিয়া জেনেছিল, চিঠি কখনও আসবে না, কোনোদিন আসবে না। কিছু একটা ঘটে গেছে মস্কোতে, অথবা ঘটতে যাচ্ছে। সবই হারিয়ে গেছে। সবই শেষ! চলবে