Homeসাহিত্যভাইরাল হবার হলো তার সাধ

ভাইরাল হবার হলো তার সাধ


ইউটিউব আর ফেসবুক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ক্লাস না-করলে, জীবনের খাতায় লাল দাগ ওঠে না ঠিক; তবুও কারণে-অকারণে একটা নেশারমতো হয়ে গেছে। তাছাড়া আপনি যখন জ্যামে আটকে থাকেন, ডাক্তারের চেম্বারে অপেক্ষারত থাকেন, অথবা ঘণ্টার পর ঘণ্টা কারও জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন— তখন সময় কাটাবেন কীভাবে? যদি হাতে মুঠোফোন থাকে; নেটে বিচরণ করে অনায়াসেই আপনি বিরক্তিকে পাশ কাটাতে পারবেন, অথবা কনভার্ট করতে পারবেন মাছির মতন। এতক্ষণতো ভালোই লাগছিল হঠাৎ মাছির কথা বললেন কেন? তৌফিক ঘটনাটা খুলে বলে—

৫/৬ মাস আগে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখি—আমার এক চাচাতো ভাই মাছির চাষ করেছে। শাহরিয়ার বলে, বলেন কী? —হ্যাঁ  নিজের চোখে দেখে এসেছি। এই মাছির নাম বিএসএফ। আবার ভাববেন না, ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনিকে নিয়ে রসিকতা করছি। এই বিএসএফ মানে ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই। মশারির ভেতর পালতে হয়। নোংরা, পচা সব খাবার খায়। লক্ষ লক্ষ ডিম পাড়ে। সেই ডিমগুলোকে জাগ দিতে হয়। কয়েকদিনের ভেতর লার্ভা বের হয়। সেগুলোকে মুরগির খাবার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। মাছ-মুরগিকে খাওয়ানো হয়। এ কথা শোনে শাহরিয়ার বমি করতে থাকে। তৌফিক তাকে ধরে মাথায় পানি দেয়। কী একটা বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। শাহরিয়ার বলে— ভাই আর কত কিছু যে খাইতে হয়। দেশি মুরগি এখন আর চোখে দেখি না, গরুর গোস্ত ধরতে পারি না। মাংস খাওয়ার ভেতর এই সোনালি মুরগিডাই খাইতাম। আপনি যা শুনাইছেন এই মুরগিও আর খাইতে পারব না। আগে আমার পুরো কথা শুনবেন তো। আমার ভাই বলল— প্রচলিত মুরগির ফিডে ভেজাল বেশি। কয়েকটা টিভি রিপোর্টেও দেখছি, টেনারির বর্জ্য দিয়া ফিড বানায়। সেই ফিডের দামও অনেক। বিষাক্ত কেমিক্যাল যুক্ত খাবার খেয়ে মুরগি দ্রুত বাড়লেও আপনার আমার জীবন শেষ কইরা দেয়। আর এই যে মাছির লার্ভা তাতে কোনো বিষ নাই। সেই খাবার খেয়ে মুরগি যদি সুস্থভাবে বড় হয়—সেই মুরগি খেতে  সমস্যা কোথায়? শাহরিয়ার বলে, ভাই রুচি বলে একটা কথা আছে। পায়খানার বদনি যতই পবিত্র হোক ওইটা দিয়া কেউ পানি খায় না। আপনি যে কী বলেন! আমার কাছে বিষয়টা ভালোই লাগছে। শাহরিয়ার বলে, আপনি একটা ইউটিউব চ্যানেল খুলেন। আমারে যেই কথাগুলো কইছেন, এইগুলাই ক্যামেরার সমানে বলবেন। আজকাল এই অদ্ভুত বিষয়গুলা মানুষে খায়। শুনেছি ইউটিউবে ভাইরাল হলে অনেক ইনকাম। শাহরিয়ার ভাই আপনিতো দারুণ একটা আইডিয়া দিছেন। বিষয়টা ভাবনায় থাকল।

শাহরিয়ার আর তৌসিফ সহকর্মী। তারা একটা এনজিও-তে কাজ করে। তৌসিফ শৈশব থেকে অনেক চেষ্টা করছে আয়-উন্নতি বাড়ানোর জন্য। কম বয়সে বাবা মারা গেছে। খুব কষ্ট করে পড়াশোনা শেষ করেছে। কোনো রকমে বিএ পাশ করে এই চাকরিটা হয়; তা-ও যায় যায়। আঠার হাজার টাকা বেতন। ঠিকমতো কিস্তি আদায় করতে না-পারলে বেতন হয় না। তার ব্রাঞ্চে ৭ জন আছে। ম্যানেজারসহ সবাই অফিসেই থাকে। মাঝে মাঝে কিস্তির টাকা আদায় করার জন্য গ্রাহকের ঘরে গিয়ে বসেও থাকে। না, কিছুতেই কিস্তির টাকা দেবে না। তার ওপর কত কথা শুনতে হয়। দেখতে শুনতে ভালো পাত্রির বাবা কয়েকজন মুখের ওপর দিয়েছে, সুদখোর পোলার কাছে মেয়ে বিয়ে দেবে না। ঘটক যদি বলে সুদখোর পাইলেন কই? ছেলেতো চাকরি করে। দুই/একজন ফিরিয়ে বলে—আগেকার দিনের মহাজনই এখনকার এনজিও। তাগো কাজ ওই একটাই রক্ত চুইষা খাওয়া। এ কথা শোনে শাহরিয়ার বলে, আহারে তারা যেন স্বর্গের ব্র্যাঞ্চ অফিসে বসবাস করে। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি সুদ খায়—তাইলে আর কে সুদ খায় না? সব মাছই গু খায় নাম পরে টাকির। যেহেতু অফিস আর বাসা একই জায়গায় তারা সারাক্ষণ এক সঙ্গেই থাকে। তারা পরস্পরের গায়ের গন্ধ, গুয়ের গন্ধ, ঘামের গন্ধ, বিড়ির গন্ধ সমানভাবে ভাগ করে নেয়। ম্যানেজার একটু নাক উঁচু স্বভাবের। ইস্ত্রিকরা কাপড়ের মতো একটা গাম্ভীর্য নিয়ে থাকে। বস বলে কথা। বস যদি লুডু খেলার সাথী হয়ে যায় এর থেকে বড় মহব্বত আর কী হতে পারে! পরে কিস্তির টাকা কে তুলবে? বসের চাকরিতো যাবেই অধস্তনদেরও চাকরিও যাবে। ম্যানেজার সব সময় ৪ জন আর ২ জনের একটা গ্রুপ করে রাখে। ২ জনকে ঝাড়ির ওপর রাখে। আর ৪ জনকে নিজের প্যানেলে রাখে। ৪ জনের মধ্যে একজন ম্যানেজারের পোস্টিং পাওয়ার জন্য অপেক্ষমান একজন সে সিনিয়র, খুব ভালো পারফরমেন্স। ২ জন হচ্ছে তেলবিদ। কাজ যে একবারে করে না তা-না, ৭০% কাজ করলে ৩০% তেল দেয়। ম্যানেজারও বিষয়টা বুঝে। বুঝলে কী হবে? তেল কার না ভালো লাগে। আর বাকি থাকে একজন সে ম্যানেজারের আত্মীয়। কাজেই ম্যানেজারের দুই চোখ সব সময় তৌসিফ আর শাহরিয়ারের প্রতি লাল থাকে। তৌসিফ তাদের মধ্যে সবচেয়ে কনিষ্ঠ। যেকোনো চাকরিতে কনিষ্ঠদের একটু দৌড়ের ওপর থাকতে হয়। শাহরিয়ার মানুষ হিসেবে চমৎকার। মনটা তার দয়ার সাগর। কোনো মহিলা কিস্তির টাকা না দিতে পারলে তার নিজের পকেট থেকে টাকা দিয়ে দেয়। পারিবারিকভাবে সে মোটামুটি স্বচ্ছল। কিছু একটা করতে হবে—তার জন্যই চাকরিটা করা। গোমতীর আইলের পাশেই তাদের অফিস কাম বাসা।

বিকালে নদীর আইলে বসে বাতাস খাওয়াই তাদের কাজ। মাঝেমধ্যে এলাকার ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলে সময় কাটে। অফিস আর অফিসের বাইরে তৌসিফ আর শাহরিয়ার মানিকজোড়। শাহরিয়ার তৌসিফকে বলে—আরে ভাই, মনটা তো পইরা থাকে বউবাচ্চার কাছে। কী করব বলেন? চাকরি নামের গোলামি করি। স্বাধীনতা বইলা কিছু নাই। তার পরও ভালো মাস শেষে কিছু টাকা পাই। বাপের কিছু জমি আছে বইলা সারা গেছে, আর না হয় এই চাকরি কইরা পেট চলে? এই মিয়া আপনেরে তো কইছি, একটা ইউটিউব চ্যানেল খুলেন। একটা কাজ করেন, আজকেই কান্দিরপাড় যান। না, অনলাইনে বরং অর্ডার দেন ঘরে আইনা মাল দিয়া যাইব। এই কয়দিন ইউটিউব দেখে কীভাবে ভিডিও এডিট করতে হয় শিখেন। কী হইল, না হইল মাথায় নিয়েন না। নিজের আনন্দের জন্য ভিডিও বানান। চুপ করে আছেন কেন? আচ্ছা বুঝেছি—২০ তারিখ হয়ে গেছে এখনো বেতন হয় নাই। টাকার চিন্তা কইরেন না। আমি টাকা দেমু। ভাই, আপনি তো আমার কাছ থাইকা ২৪৬০ টাকা পাবেন। আপনি আমাকে কেন টাকা দেন? শাহরিয়ার জবাব দেয়— মারার লাইগা। তারপর দুজন একসাথে হেসে ওঠে।

তৌসিফ টাকা নিতে না-চাইলে, শাহরিয়ার বলে— আমি আপনারে টাকা ধার দেই, পরামর্শ দেই এইটা তো ইনভেস্ট। আপনি যখন ইউটিউবে টাকা ইনকাম করা শুরু করবেন—ওই টাকার ভাগ হবে। আপনার ৬০ আমার ৪০ হিসাব বরাবর। এরমধ্যে তৌসিফ ঠিক করে—রান্নার ওপর একটা ভিডিও বানাবে। গোমতীর পাড়ে রাঁধবে শীতের সবজি, রান্নার ফাঁকে ফাঁকে নিজের কিছু কথা উপস্থাপন করবে। এরমধ্যে মোবাইলে ভিডিও এডিটিং শিখতে থাকে।

একদিন অফিসের ম্যানেজার বলে, তৌসিফ তোমার কিন্তু আমি ভালো কোনো কিছু দেখতেছি না। কী শুরু করছ? ঠিক ভাবে কিস্তির টাকা তুলতে পার না। তোমার জন্য কিন্তু ওপর থাইকা কথা শুনতে হয়। এরকম করলে তো তোমার চাকরি থাকব না। তৌসিফ কিছু বলতে গিয়েও বলে না। এর মধ্যে সে একটা ভিডিও আপলোড করে।

প্রিয় দর্শক আপনারা যারা এই ভিডিও দেখছেন, সবাইকে গোমতীর পাড় থেকে স্বাগত। আজ আমি শিম রান্না করব। উপকরণ হিসেবে লাগবে: শিম এক কেজি, (ভাল ভাবে কেটে নিবেন) আলু ২০০ গ্রাম, টমেটো ২০০ গ্রাম, মাছ (আপনি যে মাছ খেতে চান), আমি রুই মাছ নিয়েছি। স্বাদমতো লবণ, কাঁচা মরিচ ১০/১২টা, পেঁয়াজ কুচি, রসুন কুচি, ধনেপাতা কুচি।

প্রথমে মাছ ভেজে নেব। তারপর হালকা আঁচে পেঁয়াজ কুচি, রসুন কুচি, কাঁটা মরিচ হালকা বাদামি করে নেব তারপর শিমগুলো ৮/১০ মিনিট কষানোর পর কড়াইয়ের এক তৃতীয়াংশ গরম পানি ঢেলে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দেব। ৩০/৩৫ মিনিট পর ভাজা মাছগুলো ছেড়ে দেব। এই ফাঁকে আমরা একটু অন্য কথা বলি। সবকিছু মিলিয়ে ৯/১০টা উপাদান দিয়ে আমাদের রান্না। এই তরকারিতে যদি মাছ না থাকত, তাহলে এত একটা স্বাদ লাগত না। যদি তেলে না-কষাতাম এত একটা মজা লাগত না। যদি টমেটো না দিতাম এত একটা ভালো লাগত না। মোটকথা, ১০ উপাদান সুসামঞ্জস্য হলেই অপূর্ব একটা তরকারি আমরা পাই। জীবনেও সামঞ্জস্যটাই আসল। এই যে দেখেন— পৃথিবীতে খারাপ মানুষের অভাব নাই। আপনি কিন্তু একজনও খারাপ পিতা পাবেন না; যে তার সন্তানের অকল্যাণ চায়। আমরা অনেকেই পূর্ণ বয়স্ক কিন্তু পূর্ণ মনস্ক আমরা কজন?

আমাদের জীবন যদি ৬৫ বছর ধরি। তাহলে প্রথম ১০ বছর কেটে যায় মা-বাবার সান্নিধ্যে। তখন মা-ই সব। ১০ থেকে ২০ বছর বয়স পড়াশোনা কী করব, না-করব? একটা আভাস পেয়ে যাই। একটু বুঝ হবার পর থেকেই ছেলে বা মেয়ে চায় একটা অন্তত বন্ধু হোক। প্রাণের মানুষ। এই সময়ে কারও প্রেম হলে, তারা সারা জীবন একসঙ্গে থাকতে চায়। ২০ থেকে ২৬/২৭ বছর বয়সটা প্রেমিক বা প্রেমিকার জন্য একটা ত্রাহি অবস্থা। ধরেন ঠিকঠাক ভাবে প্রেমিকের একটা চাকরি হয়ে গেল। তারপর সংসার গুছানোর বিষয়টা একটা বিরাট বিস্ময়। বউ আর মাকে সমন্বয় করা মানেই আপনি পৃথিবীটা জয় করে ফেলেছেন। আর সমন্বয়টা যার জীবনে হয়নি—পৃথিবী তার কাছে বিরাট বোঝা! মা আর বউ একজন পুরুষের প্রধান আশ্রয়। তাদেরকে কীভাবে আপনি সমন্বয় করবেন? সেটা একান্ত আপনার বিষয়। আশেপাশে অনেক পরামর্শ পাবেন হয়ত কোনো পরামর্শই আপনার কোনো কাজে আসবে না। পথটা একান্ত নিজের মতো আপনাকে সমাধান করতে হবে। বন্ধুগণ শিম তরকারি একবারে শেষ পর্যায়ে। দেখুন সুন্দর একটা রং হয়েছে। শিমের সবুজ, টমেটোর লাল, আলুর হালকা হলুদ এবার ভাজা মাছটা তরকারির ওপর ছেড়ে দেব। কুচি করে কেটে রাখা ধনে পাতা ছড়িয়ে দেব। ধনে পাতার গন্ধটা নাকে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আপনার ক্ষুধা বহু গুণ বেড়ে যাবে। সুধী দর্শক, তরকারির স্বাদ ঠিক আছে কিনা দেখার জন্য আমি একটু চেখে দেখছি। প্রিয় দর্শক, আমার একটা ভুল হয়ে গেছে—আমি লবণ দিতে ভুলে গেছি। এক্ষুনি লবণ দিয়ে দিচ্ছি। আমি আর একবার দেখছি লবণটা  ঠিক আছে কিনা? একেবারে পার্ফেক্ট। তৈরি হয়ে গেল রুই মাছের শিমকারি। বাসায় রান্না করে দেখতে পারেন। দয়া করে আমাদের চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন তাহলে নিত্য নতুন রান্নার রেসিপি পেয়ে যাবেন। সুধী দর্শক, আবার দেখা হবে নতুন কোনো রান্না দিয়ে সেই পর্যন্ত ভালো থাকুন।

—শাহরিয়ার ভাই, ভিডিওটা তো আপলোড করলাম এক সপ্তাহ হয়ে গেল।

—ফেসবুকে শেয়ার দিছেন?

—দিয়েছি ভাই। কোনো কিছুই তো বুঝতেছি না।

—আরে মিয়া দুই-একটা পোস্ট দিয়ে বসে থাকলে হইব। মাত্রই তো শুরু করছেন। প্রচার করতে হবে, প্রচারেই পরিচিতি।

—ভাই, বুস্টিং করতে তো টাকা লাগে।

—আরে মিয়া কিছু পাইতে হলে কিছু খরচ করতে হয়। আপনি এটা নিয়া আরও ভাবেন।

এর মধ্যে ম্যানেজার ডাকে, তৌসিফ আপনি একটু এদিকে আসেন।

—স্যার

—মিথিলাপুরের অদুদ সরকারের বউয়ের কিস্তির কী অবস্থা?

—স্যার, আমি একদিন পরপরই যাই। আজকে দেবে কালকে দেবে বলে ঘুরাচ্ছে।

—শুনেন তৌসিফ, চাকরি করলে করেন; না করলে নাই। আপনার জন্য আমি কথা শুনতে পারব না। ঠিকমতো কিস্তির টাকা তুলতে পারেন না, আবার ইউটিউব মারান। কালকের মধ্যে রমিজ ব্যাপারির কিস্তির টাকাটা তুলতে না পারলে রান্না আপনার পিছন দিয়া দেমু। যান আমার সামনে থাইকা। বইসা রইছেন কেন?





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত