প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদের বড় মেয়ে মৌলি আজাদের একটি ভিডিয়ো সাক্ষাৎকার বাংলা ট্রিবিউনের ফেসবুক পেইজে প্রকাশিত হয়েছিল, তারই লিখিত রূপ আজ প্রকাশ করা হলো।
জাহিদ সোহাগ : হুমায়ুন আজাদ প্রথাবিরোধী—বিশেষত উনি ধর্মকেই আক্রমণ করেছেন। আমি জানতে চাই, ওনার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে ধর্ম কীভাবে সংশ্লিষ্ট হয়েছে?
মৌলি আজাদ : আমার বাবা ধর্মান্ধতা পছন্দ করতেন না। মুসলিম সমাজে যে রিচুয়ালস আছে সবকিছুই আমরা পালন করতাম। যেমন ধরুন, কুরবানি, আকিকা এগুলো তিনি করেছেন।
হুমায়ুন আজাদ প্রথাবিরোধী হলেও তিনি তো একটা সমাজে বাস করতেন, তার পরিবার ছিল—আমরা চাইতাম, আমার মা চাইত, চারপাশের স্বজন ও প্রতিবেশিরা চাইত, তাই তিনি ধর্মীয় রিচুলাল পালন করতেন।
যেমন আমি সবসময় নামাজ পড়ি। বাসায় নামাজ পড়ার স্বাধীনতা ছিল। আব্বা কখনও বলেননি, ‘তুমি এটা করতে পারবে না।’
ধর্মের যে সৌন্দর্য দেখি, সেগুলোর বিষয়ে তার কোনো আপত্তি ছিল না।
জাহিদ সোহাগ : মৌলবাদ এবং রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের বিরোধিতা করতেন?
মৌলি আজাদ : তিনি ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়িই তুলে ধরতেন। আমার মনে হয়, বাবাকে লোকজন মিস ইন্টারপ্রেট করতেন।
জাহিদ সোহাগ : তিনি কি কখনো বলেছেন, এই যে নামাজ পড়ছ এগুলো তো তুচ্ছ?
মৌলি আজাদ : আমি কখনো শুনিনি।
জাহিদ সোহাগ : হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে বলা হয়, ওনার রচনা বিদেশি লেখার ভাবানুবাদ বা হুবহু অনুবাদ; যেমন ‘শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ’-এর কথা বলা হয়। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন ‘নারী’ গ্রন্থের মৌলিকতা কোথায়? উনার নানান রকম চিন্তার জায়গায় ভাষা বিজ্ঞানের বিষয়টিও আছে, সেই বিষয়ে আপনার মতামত কী?
মৌলি আজাদ : আমি যখন খুব ছোট ছিলাম তখন ‘শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ’ বইটি নিয়ে পত্রিকায় আলোচনা সমালোচনা হতো। বাবাও এসব লেখার জবাব দিতেন। দুই পক্ষের কলম চালাচালি হতো। এরপরে ‘নারী’ নিয়েও অনেকের অনেক কথা আছে। এগুলো মূলত গবেষণাধর্মী বই। তিনি তো বলেননি, এগুলো তার মৌলিক বই। গবেষণাধর্মী বইয়ে অনেক রেফারেন্স থাকতে পারে। সেটাই তিনি করেছেন। আমাদের দেশে তখন এরকম বই ছিল না।
বাবার প্রিয় বিষয় নারীবাদ। তিনি নারীবাদ নিয়ে বই লিখবেন বলে পিএইচডি করে দেশে ফেরার সময় অনেক বই নিয়ে এসেছিলেন। ‘নারী’ লেখার জন্য তিনি একবছর ছুটিও নিয়েছিলেন। আসলে বাবাকে বিতর্কিত করার জন্য এসব প্রশ্ন তোলা হতো।
জাহিদ সোহাগ : হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে তার সমসাময়িক লেখকদের প্রচুর উত্তপ্ত কথার বিনিময় ঘটত। ওনার শব্দ প্রয়োগ ভীষণ আক্রমণাত্বক। পারিবারিক জীবনে আপনাদের দুইবোন এক ভাই এবং মা এদের সাথে যখন সময় কাটাতেন বা ডাইনিং টেবিলে খেতে বসতেন তখনকার মানুষটা কি খুব গম্ভীর, নাকি প্রেমময় সন্তান বাৎসল্যপূর্ণ ছিলেন?
মৌলি আজাদ : আমার বাবা আসলে খুব রাগী ছিলেন। সবকিছু একদম নির্ভুল চাইতেন। স্বভাবত তিনি গম্ভীর ছিলেন। বাবাকে বেশ ভয়ই পেতাম। আমাদের পড়াশোনার ব্যাপারে তার প্রচণ্ড খেয়াল ছিল। আমাদের মা আসলে বাবাকে মানিয়ে নিতেন।
জাহিদ সোহাগ : হুমায়ুন আজাদ রবীন্দ্রনাথের খুব সমালোচনা করতেন। উনি কি রবীন্দ্রসংগীত শুনতেন?
মৌলি আজাদ : রবীন্দ্রসংগীত পছন্দ করতেন কিনা এটা আমি ওভাবে বলব না। রবীন্দ্রনাথের যে সবসময় সমালোচনা করতেন তাও না। তিনি মাঝে মাঝে রবীন্দ্রসংগীত শুনতেন কিন্তু খুব বেশি না। বেশি শুনতেন গীতা দত্তের গান।
জাহিদ সোহাগ : হুমায়ুন আজাদের প্রেরণায় অনেক নারী প্রতিষ্ঠিত লেখক হয়েছেন। তাদের লেখা প্রকাশে উনি ভূমিকা রেখেছেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পর সেই নারী লেখকরা তাদের প্রিয় লেখকের তালিকায় বা পঠন-পাঠনের কথায় অনেকের কথা বললেও হুমায়ুন আজাদের কথা উচ্চারণ করেন না। কেন এমন ঘটে বলে আপনার মনে হয়?
মৌলি আজাদ : আমি অনেক নারী লেখককে দেখছি, তারা ইদানীং আব্বার নামই নিচ্ছেন না। আমি দেখেছি, অনেক প্রতিষ্ঠিত লেখিকার পেছনে আমার বাবার ভূমিকা ছিল। অনেকের পিএইচডি থিসিসের লাইন বাই লাইন বাবাই লিখে দিয়েছেন। হয়ত তারা কোনো ভয়ে হুমায়ুন আজাদের নাম নিচ্ছেন না। স্বভাবতই বাঙালি অকৃতজ্ঞ সেটাও একটা বিষয়।
জাহিদ সোহাগ : আপনি আপনার বাবাকে কি রূপে দেখতে পান—একজন ভাষাবিজ্ঞানী, কবি, কথাসাহিত্যিক না প্রাবন্ধিক?
মৌলি আজাদ : আমার মনে হয়, আমার বাবা আসলে কবি। তার লেখালেখি শুরু হয়েছিল কবিতা দিয়ে। প্রথম বই, কবিতার বই, ‘অলৌকিক স্টিমার’। যদিও তার কবিতার বই মাত্র ৭টি, কিন্তু তার প্রতিটি বইই খুব জনপ্রিয়।