Homeসাহিত্যপ্রবাসী বাংলাদেশিদের ১১টি বই

প্রবাসী বাংলাদেশিদের ১১টি বই


আমি এমন এক সাহিত্য-জগতের স্বপ্ন দেখি যেখানে পাঠক হিসেবে আমাদের চিরাচরিত ‘ক্যানন’-এর গণ্ডি পেরিয়ে আমরা আরো বিস্তৃত পরিসরে বৈচিত্র্যময় আখ্যানধর্মীতার ঐতিহ্য এবং দৃষ্টিভঙ্গিগুলোর সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাব।

দক্ষিণ এশিয়ার সাহিত্য পশ্চিমা প্রকাশনার জগতে ইদানীং নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে শুরু করেছে, এই সংকীর্ণ পরিসরে বাংলাদেশি আখ্যানসমূহ দেখা যায় ভারতীয় কিংবা পাকিস্তানি সাহিত্যের আড়ালে থেকে যায়। প্রকৃতপক্ষে স্বল্পসংখ্যক পশ্চিমা পাঠকই বাংলাদেশি সাহিত্যের সাথে পরিচিত, যা বাংলাদেশের জাতিগত বৈচিত্র্যকে ধারণ করে এবং বাংলাদেশি লেখকদের রচনা (ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি লেখকদের সাহিত্য নয়)। রাজনীতিতে এই শ্রেণি বিভাজন থাকলেও শিল্পের ক্ষেত্রে আমরা জানি, সকলেই একটি সাধারণ ঐতিহ্যের অংশ, যেখানে ইতিহাস, রোমান্স,  রাজনীতি, প্রহসন, লোককথা, জাদুবস্তবতা, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি এবং থ্রিলারের সহযোগে কল্পনা এবং প্রামাণ্যতার এক সমৃদ্ধ চিত্রপট তৈরি হয়।

কোনো শিল্পমাধ্যমের প্রতি পাঠকরা যখন অনাগ্রহী হয়ে ওঠে, তখন প্রকাশকরা সে শিল্পমাধ্যমের অবস্থান তৈরি করার জন্য সংগ্রাম করেন। যখন প্রকাশকরা কোনো শিল্পমাধ্যমের জন্য অবস্থান তৈরি করেন না, তখন পাঠক হন বঞ্চিত।
সঠিক জানাশোনার অভাবে আমরা অনেক সময় কোনকিছুকে হেলা করি, ভুল বুঝি কিংবা স্টেরিওটাইপ করি। তবে সাহিত্যের সৌন্দর্য হলো, সাহিত্য একজন পাঠক এবং বইয়ের মাঝে একটি সঠিক মুহূর্তের সংযোগ ঘটাতে পারে যা অন্যসকল শূন্যস্থানগুলোকে পূর্ণ করতে পারে—একটি অনন্য সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে বাণিজ্যিক,  স্থানিক কিংবা সময়ের বেড়াজালকে অতিক্রম করতে পারে।

১.
বেঙ্গল হাউন্ড
লেখক: রাহাত আবির

যদিও ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের চিত্রপট তুলে ধরেছে এমন অনেক বই আমরা হাতের নাগালে পাই কিন্তু আবিরের প্রথম উপন্যাসটি সেইসব বইয়ের মাঝে একটু ব্যতিক্রম, এটি আমাদের নিয়ে যায় ষাটের দশকে যখন পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ, বর্তমান বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের গণজাগরণ দানা বেঁধেছিল। ব্রিটেন কর্তৃক ভারত ও পাকিস্তানের বিভাজন এই অঞ্চল জুড়ে ঝড় তোলে। এক অদ্ভুত আজ্ঞাধীনে পরিবারগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে থাকে নিজেদের বাস্তুভিটা কিংবা আপনজনের থেকে, যেখানে ধর্মই হবে তাদের একমাত্র ঠিকানা, ঘরবাড়ি নয়। পাকিস্তান আক্রমণের প্রধান লক্ষ বিন্দু হয়ে ওঠে হিন্দু সংখ্যালঘুরা। তেমনি একজন হিন্দু পুরুষ শেলি, যিনি পূর্ব পাকিস্তানে ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র এবং তার নামটিও ব্রিটিশ কবি পারসি শেলির নামেই। রোকসানা নামের একজন মুসলিম নারী ছিলেন তার শৈশবের প্রেম। তাদের সম্পর্কটি হয়ে ওঠে ধর্মীয় বিভেদের প্রতিফলন যা এই অঞ্চলটিকেও ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছিল। জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃজনশীল লেখনীর ওপর পিএইচডিরত বাংলাদেশি লেখক রাহাদ আবির তার লেখায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা এবং ছাত্র আন্দোলনের উত্থানে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলার চিত্রপটের মাঝেই মূর্ত করে তুলেছেন ঐতিহাসিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, মধুর ক্যান্টিন এবং ফুলার রোডকে। যেখানে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক অতীতের নানা অধ্যায় উদ্ভাসিত হয়েছে।

আরো খোলামেলা বলতে গেলে, উপন্যাসের শুরুর দিকে যার মৃত্যু গল্পটিকে গভীরভাবে মর্মস্পর্শী করে তোলে সেই প্রিয় চরিত্রটির ভাস্কর্যকেও জীবন্ত করে তুলেছেন লেখক। উপন্যাসটি পরিণত হয় মানুষের মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধানে যেখানে আমরা দেখতে পাই, প্রেম ও রাজনীতি একই সূত্রে গ্রন্থিত হলে মানুষ কি করে শোককে গ্রহণ করে।

২.
দ্য চিলড্রেন অফ দিস ম্যাডনেস
লেখক: জেমিনি ওয়াহহাজ

জেমিনি ওয়াহনাজ বর্তমানে হিউস্টনে বসবাসরত বাংলাদেশি লেখক এবং লোন স্টার কলেজে ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। তার প্রথম উপন্যাস ‘The Children of this Madness’ একটি বহুমাত্রিক কণ্ঠে বর্ণিত উপন্যাস। উপন্যাসটি একইসাথে আংশিকভাবে আমেরিকার ইরাক আক্রমণের সময়কাল এবং অন্যদিকে বাংলা ভাগ, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রচিত।

উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র নাসির উদ্দিন প্রকৌশল বিভাগের একজন অধ্যাপক। তার প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি একজন নায়কের মতো, যারা সকলেই আজ প্রতিষ্ঠিত এবং সফল। তার প্রথম পুরুষে বর্ণিত স্মৃতিচারণ পাঠককে নিয়ে যায় তার দারিদ্র্যময় শৈশবে, যেখানে তিনি বাংলার রাজনৈতিক অস্থিতিশীল এক পটভূমিতে বেড়ে উঠেছেন।

এই স্মৃতির পাশাপাশি উপন্যাসে স্থান পেয়েছে তার কন্যা বীণার বর্তমান জীবন। টেক্সাসে ইংরেজি সাহিত্য অধ্যয়নরত বীণা একজন পিএইচডি গবেষক। নিজের বাড়ি কিংবা ঠিকানার ধারণার প্রতি বীণার একধরণের আনুগত্য কাজ করে উপন্যাস জুড়ে,  উপন্যাসের আবেগময়তার কেন্দ্রবিন্দু হলো নিজ বাড়ি কিংবা ঠিকানার প্রতি বীণার বশ্যতা। বাংলাদেশ, যা তার বাবা মায়ের কাছে ঠিকানা। মসুল, যেখানে তার শৈশবের কিছু সময় কেটেছে; এবং আমেরিকা, যেখানে একজন গবেষক এবং স্ত্রী হিসেবে তার প্রাপ্তবয়স্ক জীবন কাটছে ইরাক আক্রমণের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন ঘটনাবহুল সময়ের মধ্য দিয়ে, যার সাথে সে এক অস্তিত্বের দ্বন্দ্বে লিপ্ত।

৩.
দ্য ইনহেরিটর্স
লেখক: নাদিম জামান

এই উপন্যাসটি মূলত বিখ্যাত ‘The Great Gatsbay’ এর ঢাকাভিত্তিক একটি রূপান্তর। এখানে নিক ক্যারাওয়ের ভূমিকায় আমরা দেখব নিসার চৌধুরী নামে একজন বাংলাদেশি প্রবাসীকে, যিনি বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা। পারিবারিক সম্পত্তি ও রিয়েল এস্টেটের লেনদেন মেটানোর জন্য তিনি ঢাকায় ফিরে আসতে বাধ্য হন। জুনায়েদ গাজি নামের একজন ধনী ব্যবসায়ী কিনতে আগ্রহী হন তার সম্পত্তি , পাঠকগণ সঠিক অনুমান করেছেন, বিশেষত সেই বাড়িটি যেটি দিশা নাম্নী এক নারীর গৃহের মুখোমুখি অবস্থিত। দিশা নিসারেরই খুড়তুতো বোন।

নিকের মতোই, নিসারও লেখকের দৃষ্টিকোণ থেকে দিশা এবং গাজির জীবনযাপন পর্যবেক্ষণ করেন। তবে ইংরেজি উপন্যাসের ডেইজি ও গ্যাটসবির মতো প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্ক এখানে নেই; বরং দিশা ও গাজি বিবাহ বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে বিচ্ছিন্ন হওয়া এক প্রাক্তন দম্পতি।

দ্য ইনহেরিটর্স নাদিম জামানের চতুর্থ বই, যিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট মেরিস কলেজ অফ মেরিল্যান্ডে ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপনা করেন। স্কট ফিটজেরাল্ডের এই ক্লাসিক আখ্যানের রূপান্তরের মাধ্যমে তিনি ঢাকার প্রাচীন সম্ভ্রান্ত সমাজ এবং নব্য সম্ভ্রান্ত সমাজের অভিজাত শ্রেণির জীবনযাত্রাকে সমালোচনামূলক দৃষ্টিতে উপস্থাপন করেছেন।

৪.
গুড গার্লস
লেখক: লিসা গাজী
অনুবাদ: শবনম নাদিয়া

উপন্যাসের দুই প্রধান চরিত্র লাভলী এবং বিউটি দুই বোন। তাদের দু’জনেরই বয়স ৪০ এর ঘরে এবং তাদের সেই জন্মদিনেই মূলত এই উপন্যাসের সূত্রপাত। তাদের মা, ফরিদা, আগে কখনোই তাদের একা একা বাড়ির বাইরে বেরোতে দেননি। কিন্তু আজকের দিনটি ছিল ৪০ বছর বয়সি লাভলীর জন্য একটি ব্যতিক্রমী দিন। নিজের জন্মদিনেই সে প্রথমবারের মতো ঢাকার পথে ঘাটে একা বের হবার অনুমতি পায়। তবে সেই সুযোগটিও কেবলমাত্র নির্দিষ্ট একটি বেঁধে দেয়া সময়ের জন্য।

লন্ডন-প্রবাসী লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা লিসা গাজী ‘কমলা কালেক্টিভ’-এর মাধ্যমে থিয়েটারের পর্দায় তুলে ধরেন নারীদের অজানা সব গল্প, নারীদের দৃষ্টিকোণ থেকে। ‘IOWA’ রাইটার্স ওয়ার্কশপ থেকে স্নাতক ডিগ্রি প্রাপ্ত শবনম নাদিয়া, তিনি তার অনুবাদের মাধ্যমে লিসা গাজীর আঁটোসাটো বুননে বাধা এবং টানটান উত্তেজনাকর গদ্য ভঙ্গিতে বর্ণিত লাভলীর এই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার দিনটিকে জীবন্ত করে তোলেন ।

 

উপন্যাসে লাভলীর সাথে আমরাও ঢাকার পরিচিত রাস্তায় হেঁটে বেড়াই, গাউসিয়া মার্কেটের অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়াই, যেখানে নারীরা তাদের পোশাক কেনায় ব্যস্ত। আমরা উত্তেজনাপূর্ণ রিকশা যাত্রার থেকে শুরু করে রমনা পার্কের প্রলোভনেরও সাক্ষী হই,  যেখানে মিলিত হয় ঢাকার প্রেমিক-প্রেমিকারা । এই যাত্রার মধ্য দিয়ে, আমরা উপলব্ধি করি যখন স্বাধীনতা বিরল এক অধিকার, তখন তার স্বাদ কেমন হতে পারে। পাশাপাশি সেই অন্ধকার-পঙ্কিলতাময় দিকগুলোকেও দেখি যেগুলো স্বাধীনতার অভাবে সুপ্তাবস্থায় থাকে ।

৫.
ইন সেন্সরিয়াম: নোটস ফর মাই পিপল
লেখক: তানাইশ

তানাইশ “In Sensorium” এ লেখেন, “আমরা এখনো উর্দু শব্দ ব্যবহার করি—‘আব-ও-হাওয়া’, অর্থাৎ পানি আর বাতাস—যার মানে আবহাওয়া। একটি সুন্দর বাক্যকে আমরা কখনোই ত্যাগ করতে পারি না। বাংলাদেশি মুসলমান হিসেবে আমরা বলি ‘পানি’, উত্তর ভারত এবং পাকিস্তানেও পানির জন্য  ব্যবহৃত শব্দ এটি। পশ্চিমবঙ্গের ভারতীয়রা ‘জল’ বা ‘পানি’ বলেন , তারা কার সাথে কথা বলছেন তার ওপর নির্ভর করে মূলত শব্দের ব্যবহার করেন। বাংলাদেশি হিন্দুরা ‘জল’ শব্দটি ব্যবহার করেন নিজেদেরকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ থেকে আলাদা করে তুলে ধরতে।

দুই শব্দেরই উৎস মূলত সংস্কৃত; ‘পানীয়ম’ অর্থ পানের উপযোগী, আর ‘জল’ অর্থ পানি। ভাষার একটিমাত্র শব্দ বা বাক্যাংশই হয়ত উন্মোচিত করে দেয় আমাদের ধর্মীয় পরিচয়, ঠিক যেমন ভাবে বদলে যায় আমাদের পানির, গোসলের, অভিবাদনের কিংবা বিদায়ের জন্য ব্যবহৃত শব্দগুলো।”

তানাইশ লেখক ও স্বশিক্ষিত সুগন্ধি প্রস্তুতকারক। আমেরিকান-বাংলাদেশি মুসলিম ‘Femme Artist’ হিসেবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চল, মিডওয়েস্ট এবং নিউইয়র্কে বেড়ে উঠেছেন। তার বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতার প্রতিফলনের দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা ‘ইন সেনসরিয়াম’ গ্রন্থটি একটি ‘ঘ্রাণজ স্মৃতিকথা’, যেখানে তিনি দক্ষিণ এশিয়ার বৈচিত্র্যময় অতীতের সঙ্গে নিজের সাংস্কৃতিক, আধ্যাত্মিক, যৌন ও সৃজনশীল পরিচয়ের যাত্রাকে জুড়ে দিয়ে বিনুনি গেঁথেছেন।

এই বইটি একটি সুগন্ধির মতোই তিনটি ভাগে বিভক্ত: বেস নোট, হার্ট নোট এবং হেড নোট। প্রতিটি অধ্যায়ে দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসের সেই দিকগুলোকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে, যা গঠনের পেছনে রয়েছে ‘পাওয়ার ডায়নামিকস’— যেটিকে লেখক নিজে ‘পত্রমিথ’ নামে অভিহিত করেছেন। লেখক এতে ভাষা, পুরাণ, আচার-অনুষ্ঠান এবং আধ্যাত্মিক অনুশীলনের বহুস্তরীয় ঐতিহ্য যা যুগের পর যুগ ধরে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে প্রবাহিত হয়েছে, তা মেলে দেখানোর চেষ্টা করেছেন।

৬.
দ্য স্টার্ট-আপ ওয়াইফ
লেখক: তাহমিমা আনাম

তাহমিমা আনামের চতুর্থ উপন্যাস আমাদের নিয়ে যায় আমেরিকার দ্রুতগামী, ঝকঝকে টেক স্টার্ট-আপ সংস্কৃতির জগতে। বাংলাদেশি পিতামাতার সন্তান আশা রায় যিনি জ্যাকসন হাইটসে বেড়ে উঠেছেন। আশা রায়ের পিএইচডির বিষয় এমন একটি অ্যালগরিদম তৈরি করা যা রোবটকে করে তুলবে সহানুভূতিশীল। কিন্তু ভালোবাসা ও অনুপ্রেরণার আকস্মিকতা তাকে খুব দ্রুত একাডেমিয়া থেকে উদ্যোক্তা হওয়ার পথে নিয়ে যায় একটি টেক ইনকিউবেটরের অধীনে, যেখানে তিনি এবং তার সঙ্গী এমন একটি অ্যাপ তৈরি করতে সক্ষম হন যা বিশেষভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, যাকে বলে ‘কাল্ট স্ট্যাটাস’ প্রাপ্ত হয়ে ওঠা। এর পরের গল্পটি বেশ মজার হলেও তাতে রয়েছে লক্ষণীয় কিছু বিষয়—টেক জগতে কীভাবে লৈঙ্গিক রাজনীতি কাজ করে তার বিশ্লেষণ।

লন্ডনে বসবাসকারী আনাম তার ‘বেঙ্গল ট্রিলজির’ জন্য সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়েছেন। এই ট্রিলজি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলোকে তুলে ধরেছে। দ্য স্টার্ট-আপ ওয়াইফ টেক জগতের প্রতি তার এক ভিন্ন ধরনের যাত্রা এবং তিনি তাকে বলেছেন ‘ক্রোধে বেড়ে ওঠার গল্প’। যদিও এর পটভূমি বাংলাদেশের বাইরের, তবে আনাম জানিয়েছেন, তার উপন্যাসটি অনুপ্রাণিত হয়েছে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ‘সুলতানার স্বপ্ন’ থেকে। তা একটি ঐতিহাসিক বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি, যেখানে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নারীবাদী ইউটোপিয়ার চিত্র এঁকেছেন। তিনি ছিলেন প্রথমদিকের বাঙালি মুসলিম নারী লেখকদের একজন, যিনি বিশ শতকের শুরুর দিকে ইংরেজিতে লিখেছেন।

৭.
দ্য স্টর্ম
লেখক: আরিফ আনোয়ার

কক্সবাজারের উপকূলে, বঙ্গোপসাগরের তীরে, একটি ধ্বংসাত্মক ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পরে লন্ডভন্ড হয়ে যায় উপকূলের জনমানুষের জীবন, উপকূলবাসী পরিবারগুলো হয়ে ওঠে বিচ্ছিন্ন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, বার্মায় অবস্থানকালে এক জাপানি পাইলট এবং এক ব্রিটিশ চিকিৎসক একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর এক দম্পতি পরিস্থিতির চাপে পড়ে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসতে বাধ্য হয় এবং নতুনভাবে জীবন শুরু করে। এই ঘটনাগুলোর মাঝামাঝি কোনো এক সময়, সৈকতে থাকা এক অশিক্ষিত কিশোরী যুদ্ধের প্রচারপত্র থেকে পড়তে শেখে, যা দুর্ঘটনাক্রমে তার হাতে এসেছিল। উপন্যাসের এই সমস্ত চরিত্রগুলোর জীবন বিভিন্ন সময়ে একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে যায়, এবং তাদের দ্বারা সংঘটিত ঘটনাগুলো আমাদের যুক্ত করে শাহরিয়ারের জীবনের সূত্রে। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র শাহরিয়ার যুক্তরাষ্ট্রে একজন অভিবাসী পিতা এবং চেষ্টারত স্কলার। কানাডা-ভিত্তিক লেখক আরিফ আনোয়ার তার এই প্রথম উপন্যাসে তার চরিত্রদের জীবনের গল্পগুলোর মাধ্যমে কয়েক দশক ধরে প্রতিধ্বনিত হওয়া সহিংসতা এবং ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাবকে তুলে ধরেছেন।

উপন্যাসটিতে ১৯৭০ সালের ভোলা ঘূর্ণিঝড়ের চিত্রকল্পও উঠে এসেছে, যা পূর্ব পাকিস্তান এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল।

৮.
ইন দ্য লাইট অফ হুয়াট উই নো
লেখক: জিয়া হায়দার রহমান

জিয়া হায়দার রহমানের প্রথম উপন্যাস In the Light of What We Know-  আফগানিস্তান যুদ্ধ এবং (২০০৭-০৮) সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের পটভূমিতে রচিত। এই উপন্যাসটি পাঠকদের নিয়ে যায় কাবুল থেকে লন্ডন, নিউ ইয়র্ক থেকে ইসলামাবাদ, এবং ঢাকা থেকে অক্সফোর্ড ও নিউ জার্সি অবধি ভিন্ন ভিন্ন জগতে।

গল্পটি দুই গণিতজ্ঞ বন্ধুর জীবনকে ঘিরে আবর্তিত হয়, যারা শ্রেণিগত অবস্থান ও জীবনের পারিপার্শ্বিক পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। তাদের মধ্যে একজন অজ্ঞাতনামা ব্যাংকার, যিনি এই গল্পের সেবাল্ডীয় ধারার বর্ণনাকারী, আর অন্যজন জাফর, যিনি অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে তার বন্ধুর দোরগোড়ায় এসে উপস্থিত হন। তাদের পুনর্মিলনের মধ্য দিয়ে ভালোবাসা, ক্ষমতা এবং মানব জ্ঞান ও সম্ভাবনার বিভিন্ন দিকের বিস্তার দেখতে পাই আমরা।

উপন্যাসটির প্রেক্ষাপট এবং মূল ভাবনা লেখকের নিজের জীবনের সাথে গভীরভাবে সংযুক্ত। বাংলাদেশের সিলেটে জন্মগ্রহণ করা রহমানের পরিবার ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান, যেখানে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে গণিত নিয়ে পড়াশোনা করেন, তিনি কর্মজীবনে নিউ ইয়র্কের গোল্ডম্যান স্যাক্সে একজন ব্যাংকার হিসেবে কাজ করেন এবং পরবর্তীতে জনহিতকর কাজ ও লেখালেখির পাশাপাশি সম্প্রচার কর্মেও যুক্ত হন।

৯.
ওলিভ ওয়াচ
লেখক: আবীর হক

উপন্যাসটি তার সংবেদনশীল ও কাব্যময় গদ্যের মাধ্যমে এমন তিনটি ভিন্ন ভূখণ্ডকে জীবন্ত করে তোলে, যেগুলো একসময় তার কাছে ছিল নিজের বাড়ির মতোই আপন: নাইজেরিয়া, বাংলাদেশ এবং যুক্তরাষ্ট্র। এই স্মৃতিকথাময় দীর্ঘ, বিশ্লেষণধর্মী অধ্যায়গুলোর মাঝে জায়গা পেয়েছে সংক্ষিপ্ত কিছু কবিতা, কিছু কথোপকথন, আত্মহত্যার চেষ্টার পর মানসিক পুনর্বাসন কেন্দ্রে কাটানো কিছু সময়ের টুকরো টুকরো স্মৃতিকথাও কখনো উঠে এসেছে।

এই খণ্ডিত গল্পগুলো একত্রিত হয়ে জীবনের গভীর অভিজ্ঞতাগুলোর প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে। এখানে রয়েছে পরিবারের সঙ্গে সংঘাত, বহুসাংস্কৃতিক পরিচয়ের দ্বন্দ্ব, প্রেম ও বন্ধুত্বের অমোচনীয় ছাপ, মানসিক স্বাস্থ্যজনিত লড়াই, এবং লেখার জগতে আশ্রয় খুঁজে পাওয়ার মধ্য দিয়ে জীবনের এক স্বচ্ছতার সন্ধান।

১০.
সূর্য’স ক্ল্যান
লেখক: ইফফাত নাওয়াজ

উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র সূর্যমুখী, যার নামকরণ করা হয়েছে সূর্যমুখী ফুলের নামে। যুদ্ধে দুটি সন্তান হারানো একটি পরিবারে সূর্যমুখীর জন্ম। তার বাবা-মার ভাইয়েরা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হয়েছিলেন। তার আগেই তার দাদীর পানিতে ডুবে মৃত্যু হয়। তবুও এই পরিবার একে অপরকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছে এবং বসবাস করছে একটি ‘অপ্রতিসম’ বাড়িতে। এটি বাংলার ঐতিহ্যবাহী একতলা-দেড়তলা বাড়িরই এক আধুনিক রূপ।

উপন্যাসে এই অপ্রতিসম বাড়ি মূলত তাদের অসম দৈনন্দিন জীবনকে প্রতিফলিত করে। দিনে তারা বসবাস করে পরিচিত এক জগতে যেখানে সাধারণ মানুষের মতোই চলে দৈনন্দিন কাজকর্ম ও জীবনযাপন। কিন্তু রাতে তারা ফিরে আসে এক ‘অপরিচিত জগতে’ যেখানে সূর্যের শহিদ চাচারাও একসঙ্গে খাওয়া, গল্প করা, এবং ভালোবাসার উৎসবের মধ্য দিয়ে যোগ দেয় দৈনন্দিন জীবনযাপনে, যেন এই বাড়িতে কিছুই বদলায়নি।

বাংলাদেশে বেড়ে ওঠা ইফফাত নাওয়াজ তার বাবার আকস্মিক মৃত্যুতে পাড়ি জমাম যুক্তরাষ্ট্রে। সূর্যমুখীর চাচাদের মতোই তার নিজের চাচারাও ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সারির শহিদ। এই শূন্যতার অভিজ্ঞতা নাওয়াজকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। বর্তমানে কেরালা থেকে লেখা এই প্রথম উপন্যাসে, তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে ইতিহাস প্রজন্মের পর প্রজন্মের উপর ছাপ ফেলে, বিশেষত তখন, যখন সেই ইতিহাসের কথা অব্যক্তই থেকে যায়।

১১.
ট্রুথ অর ডিয়ার
লেখক: নাদিয়া কবির বার্ব

ছোটগল্প সংগ্রহে আশা, হতাশা এবং সহানুভূতির এক উত্তাল ঢেউয়ের মধ্য দিয়ে উঠে আসে লন্ডন এবং ঢাকা উভয় শহরই। ইংল্যান্ডে বসবাসকারী লেখিকা এবং কলামিস্ট বার্ব, যিনি দক্ষিণ এশীয় লেখকদের একটি সংগঠন The Whole Kahani এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা, তার গল্পগুলিতে এমন কিছু মুহূর্তের চিত্রপট অঙ্কন করেন যা তার চরিত্রগুলোর মানসিক ও আবেগি মর্মস্থলকে প্রকাশ করে।

তার গল্প সংগ্রহে ‘ডোন্ট শ্যুট দ্যা মেসেঞ্জার’ গল্পের ভাই-বোনেরা তাদের বাবা-মায়ের বিবাহবিচ্ছেদকে বিশ্লেষণ করে। ‘স্ট্রেঞ্জার্স ইন দ্য মিরর’ গল্পে এক পুত্র তার প্রয়াত মায়ের অতীতের সাথে সমঝোতা করতে চায়। আরেকটি গল্পে এক গৃহহীন পুরুষ একটি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তরুণীকে অন্য কোথাও জীবন শুরু করার জন্য অনুরোধ করে। এই গল্পগুলো বাংলাদেশের এবং ইংল্যান্ডের শহুরে জীবনের ব্যস্ততার মাঝে ঘনিষ্ঠ মুহূর্তগুলোকে চমৎকারভাবে তুলে ধরে।

তথ্যসূত্র: ইলেকট্রিক লিটারেচার





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত