Homeসাহিত্যনারীদেহ ও মাটির শরীর পাঠ

নারীদেহ ও মাটির শরীর পাঠ


আস্তুরিয়াসের উপন্যাস লোস ওহোস দে লোস এন্তেররাদোস থেকেই মূলত আস্তুরিয়াস তার টেক্সটে প্রচুর ডট ও ড্যাশ ব্যবহার শুরু করেন। ডট ও ড্যাশ মানে কিছু বয়ান ফেলে যাওয়া, অর্থাৎ পাঠককে অনুমান করতে দেয়া কী বয়ান ফেলে যাওয়া হলো। ইংরেজিতে এই টেকনিককে সাধারণত এলিপসিস বলা হয়। লোস ওহোস দে লোস এন্তেররাদোস-এর তিন বছর পরে প্রকাশিত হয় মুলাতা দে তাল। তিন বছর পরে প্রকাশিত এই উপন্যাসে এলিপসিস প্রভৃত পরমিাণে বেড়ে যায়। এলিপসিসের এই বেড়ে যাওয়া আকস্মিক বা পরিকল্পনাহীন নয়। অর্থের বিস্তৃত কিছু দিককে পাঠকের সৃষ্টিশীলতার হাতে ন্যস্ত করতে বেশ পরিকল্পিত এই প্রয়াস আস্তুরিয়াসের, অন্তত আমি তাই জ্ঞান করি। মুলাতা দে তাল-এর শেষ দুই অধ্যায়ের এই বিস্তৃত অর্থ-ইঙ্গিতের দুটো দিকের এক দিকে রয়েছে মৃত্তিকার শরীর, আরেক দিকে তারই সমান্তরালে রয়েছে নারীদেহ।

সেই আলোচনায় প্রবেশের পূর্বে উপন্যাসটির আখ্যান ও প্রধান চরিত্রগুলোর সাথে একটু পরিচিত হওয়া দরকার। উপন্যাসটির শুরু হয় কর্ন হাস্ক ডেভিল নামের এক পেত্নীর সাথে এক চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে। চুক্তিটির মাধ্যমে এক স্বামী তার স্ত্রীকে এই পেত্নীর কাছে বিক্রি করে দেয়। এই পেত্নীর নাম হলো তাজোল, স্বামীটির নাম সেলেস্তিনো ইয়ুমি আর বউটির নাম কাতারিনা জাবালা। উপন্যাসের নাম চরিত্র মুলাতা দে তাল হলো এক ধর্ষকামী বেশ্যা। তাকে ইয়ুমি ক্রয় করে উপন্যাসের তৃতীয় অধ্যায়ে। দেখা যাচ্ছে উপন্যাসের চরিত্রগুলো মোটামুটি সবাই পাপের বাজারের লোকজন। উপন্যাসের মূল প্লটের গতিপথে এই পাপের খতিয়ানগুলো মাঝে মাঝে প্লটকেই স্থবির করে দেয়। মূল প্লটে রয়েছে কিয়াভিকাস গ্রামের এক গরিব দম্পতি ইয়ুমি ও জাবালা কীভাবে তিয়েররাপাউলিতার অন্ধকার জগতের এক শক্তিধর জাদুকর হয়ে উঠলো।

মুলাতা দে তাল-কে কেনার পরে সে ইয়ুমির রক্ষিতা রূপে তার সংসারের অংশ হয়ে যায়। তবে রক্ষিতা হলেও কার্যত ইয়ুমি ও জাবালা দুজেনরই সে নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে। কাতারিনা জাবালা ইতোমধ্যে অবশ্য পেত্নী তাজোলের কারসাজিতে বামনে রূপান্তরিত হয়ে যায়। উপন্যাসের শেষ দুই অধ্যায়ে উপন্যাসে ব্যবহৃত এলিপসিসের বাড়াবাড়ির সাথে সাথে এই চরিত্রদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা ও বিভক্তি বাড়তে থাকে। এই বিভক্তি নারীর শরীর ও মাতা বসুমতীর শরীরের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে ভিন্ন রূপ অর্থের ইঙ্গিতও তৈরি করতে থাকে।

এই বিভক্তির দ্যোতক হিসেবে উপন্যাসের শেষ দুই অধ্যায়ে অনেক ফাঁক, ফাটল, ছেঁদা, চিড়, হা-মুখ গর্ত ইত্যাদির বর্ণনা আছে, যেগুলো মাটির শরীরের ফেটে যাওয়া চৌচির, পরিখা, নালা ইত্যাদির প্রতি যেমন ইঙ্গিতপূর্ণ, তেমনি নারীর শরীরের যোনিপথের রহস্যময়তার প্রতিও ইঙ্গিতবাহী। ভূমিকম্পের তীব্র ঝাঁকুনি যেমন মাটির শরীরে ফাঁক, ফাটল ও গর্তের অসীম আশঙ্কা তৈরি করে। যৌনসঙ্গমের তীব্র আন্দোলনও তেমনি নারী শরীরের ফাঁক ও ফাটল যেমন মুখবিবর ও যোনিদ্বার উভয় পথ আপ্রাণ খুলে দিয়ে শিশুকে আমূল গ্রহণের আগ্রহ সুষ্টি করে। আর এই সকল ফাটল ও বিভক্তির প্রতীকী রূপ হিসেবে লেখক তার লেখায় বা টেক্সটে রেখে দিচ্ছেন ডট আর ড্যাশ, যা দুই গুচ্ছ শব্দের মাঝে ফাটল সৃষ্টি করে, দুটি বাক্যের মাঝে ফাটল সৃষ্টি করে।

শেষ অধ্যায় শুরুর একটু আগে একটি ভূমিকম্পেরই বর্ণনা রয়েছে। বর্ণনাটি এমন:

…between fallen houses…, some two stories…two-storied houses that were sitting down, that were becoming onestoried, he was advancing, well it seemed to him like he was advancing, but really he was retreating, Jerónimo, wobbling to the rhythm of buildings that separated from themselves, they went away, went away from their center of gravity, and then suddenly were returning to place…

ধরিত্রীর শরীরের এই কম্পন সবকিছু এলোমেলো করে দিচ্ছে। চার্চের বেলবাদক জেরোনিমোও সে কম্পনে স্থির হতে পারছে না। দুই তলার ভবন একতলা হয়ে যাচ্ছে। বর্ণনার শুরুতে দুটো এলিপসিস বলে দিচ্ছে এই কম্পন এখনই শুরু হয়নি। বর্ণনাটি বরং ঘটনার মাঝপর্ব থেকেই শুরু হয়েছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো বর্ণনাটি ভূমিকম্পের, অথচ সেখানে ভয়ের বা আতঙ্কের কোনো অনুষঙ্গ নেই। বরং সেখানে রয়েছে নৃত্যের তাল। এমনকি ভবনসমূহের অস্থির কম্পনকে rhythm শব্দে বর্ণনা করা হয়েছে। বিষয়টি এলিপসিসের ছুরতেই অন্য অর্থের দিকে ইঙ্গিত দেয়। ধরিত্রীর এ হয়ত কোনো সম্ভোগানন্দেরই কম্পন। সেলেস্তিনো ইয়ুমি এবং কাতারিনা জাবালার নীতিহীন যৌন ও জাদু জীবনের প্রবেশকে ঘিরেও তিয়েররাপাউলিতানের এই ভূমিকম্প ভিন্ন রকম অর্থ প্রদান করে।

সেলেছিনো ও কাতারিনা দূর থেকে দেখছে তিয়েররাপাউলিতানের ঘরবাড়ি আর শৈলশিরা এবং তারা লক্ষ্য করছে সেখানে পৌঁছতে হলে পার হতে হবে একটি গভীর পরিখা আর তার ওপর রয়েছে একটি মাত্র দীর্ঘ সংকীর্ণ সেতু। নারীজীবনের গভীর জগতের আহ্বানে সেখানে পৌঁছার একমাত্র সংযোগ সেতু রূপ যৌনক্রিয়ার প্রতিও যেন এখানে বিশেষ ইঙ্গিত দৃশ্যমান। কিন্তু সেই রহস্যরাজ্যে পৌঁছার পরে আশাভঙ্গই মানবের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা। তিয়েররাপাউলিতাতে এই কামজীবীর অভিজ্ঞতাও তাই। পড়ে দেখি কী বলছে এই কামজীবী দম্পতি:

Here, as you can see, nothing’s straight, just as they told us. Twisted streets like ribs of rock, twisted houses, twisted plaza and the church… haha!… with one bell tower here and the other over there and the dome with more bellows than an accordion…what wind could have twisted it like that!

“Hush!” interrupted Celestino, “Tierrapaulita’s this way because it’s this way, and to earth with you…!”

“You hush! because I’m going to leave here with a twisted neck, like betraying guilt, and you with your legs like a pitchfork…!”

“I already told you to go to earth…”

এই যে অভিজ্ঞতা, ভূমিকম্পের সাথে সম্ভোগানন্দের সাদৃশ্যের, ভূপ্রকৃতির রহস্যরাজ্যের সাথে যৌনজীবনের রহস্যরাজ্যের সাদৃশ্যের, এই অভিজ্ঞতা থেকেই উপন্যাসের এলিপসিসের ইঙ্গিত ধরে অগ্রসর হওয়া যাবে নারীর শরীর রাজ্যের দিকে।

এই কামজীবী দম্পতি তিয়েররাপাউলিতা নিয়ে আশাভঙ্গের পরে পালাতে চেয়েও পারে না। এখানেই ফিরে আসতে হয়। তাদের সাথে সেখানে দেখা হয় ধরিত্রী প্রেত দলের যাদের নেতৃত্বে ছিল কাশতোক। কামজীবী জাদুকর দম্পতি তাদেরকে অসুর ও জাদুকরে রূপান্তর করে দেয়। কাতারিনা জাবালা নিজে জাদুকরী দেবী জিরোমায় রূপান্তরিত হয়। এখানেও নারী রূপ কাতারিনা ও মুলাতার বর্ণনায় নারী শরীর ও ধরিত্রী শরীরের ব্যাপক সাদৃশ্য ইঙ্গিতবহ হয়ে ওঠে। তাদের শরীরের মানব থেকে দানবে রূপান্তরের বিবরণের সাথে ধরিত্রীর শরীরের বিবর্তন-পরিবর্তনের ব্যাপক সাদৃশ্য ইঙ্গিতে তুলে ধরা হয়েছে।

কাতারিনার শরীরের কথাই ধরা হোক। উপন্যাসের প্রথম পর্বে তার শরীর খর্ব হতে হতে বামনে রূপান্তরিত হয়। এরপর দ্বিতীয় পর্বে তার শরীর রূপান্তরিত হয় দানবে। দানবী জিরোমার শরীরের সাথে ধরিত্রী দেহের সাদৃশ্যের ইঙ্গিত দেখা যাক প্রেত শরীর তাজোলের সাথে সঙ্গমের দৃশ্যের বর্ণনায়:

she felt decapitated, her headless body moving about the ground, the twin peaks of her breasts shaken by a tremor that downed villages, opened fissures in the earth, uprooted trees, changed the course of rivers, overflowed lakes, shook up the clouds and turned the moon—suspended in the bluegreen atmosphere—the color of black pepper.

…মনে হলো তার মাথাটি আর শরীরে নেই, যেন মস্তকহীন মাংসল দেহটি মাটির উপরে উঠছে নামছে, বিশাল স্তনের শীর্ষ বিন্দুদুটি সেই শক্তিতে আন্দোলিত হচ্ছে, ধরিত্রীর যে শক্তি গ্রামগুলোকে ধসিয়ে দেয়, মৃত্তিকার শরীরে ফাটল ধরিয়ে দেয়, বৃক্ষরাজিকে উপড়ে ফেলে, নদীর গতিপথ পাল্টে দেয়, গভীর হ্রদগুলোকে তরলে উপচে তোলে, মেঘগুলোতে তাণ্ডব চালায়, চাঁদকে আসমানে ঝুলিয়ে দেয়—ঝুলে থাকে কালো মরিচের রং হয়ে।

একটি নারীর শরীরের যৌনান্দের চূড়ান্তক্ষণের উপভোগের বর্ণনাকে কী অবলীলায় ধরিত্রীর শরীরে তুলে দেয়া হলো! একইভাবে সিগুয়ানার যৌনসমম্ভোগ বর্ণনায়ও ধরিত্রীর শরীর যেন একাকার হয়েছে নারীর শরীরের সাথে।

এমনটাই আস্তুরিয়াসের কারিগরি—বর্ণনার ও আখ্যানের। এলিপসিস দিয়ে প্রথমে পাঠকের মনকে বিভিন্ন না বলা কথার দিকে আহ্বান। তারপর বর্ণনার প্রতিটি শব্দে, রূপকে ও প্রতীকে এমনই হাজারো অর্থের হাতছানি। তবে এ হাতছানি সেই পাঠককেই সত্যিকার আস্বাদনের জায়গায় পৌঁছে দিবে যিনি আস্তুরিয়াসের উপন্যাস তার ভাষায় পড়তে সক্ষম।

Andrea Leigh Dewees এর পিএইচডি অভিসন্দর্ভ Maya, Mulatto, Woman and God in Miguel Ángel Asturias এর চতুর্থ অধ্যায়ের আংশিক তর্জমা





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত