ভদ্রমহিলা হাতদুটো বুকের সামনে আনে। ভ্রূ কুঁচকে ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে তাকায়।
“উচ্চস্বরে পড়ুন”, রুপালি রিমের মোটা কাঁচের চশমা পড়া পুরুষ মানুষটি মৃদু হেসে বললেন।
নারী তার ঠোঁট দুটো মৃদু মুড়লো। অধরকে জিহ্বার ডগা দিয়ে ভেজাল। বুকের সামনে তার হাত দুটো অস্থির হয়ে উঠলো। নিজের মুখ খুলল এবং বন্ধ করল। নিশ্বাস ধরে রাখল এবং গভীরভাবে ছেড়েও দিল। ভদ্রলোক ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে এগোলেন এবং ধৈর্যের সঙ্গে আবারও তাকে পড়তে বললেন।
ভদ্রমহিলার চোখের পাতা দুটো কাঁপতে শুরু করল, ঠিক যেভাবে পোকাগুলো খুব দ্রুত ওড়ার জন্য পাখা দুটোকে ঘষে। সে চোখ দুটো বন্ধ করল আবার খুলেও ফেলল। যেন সে চোখ খুলে ফেললেই নিজেকে অন্য কোথাও চলে যাওয়া পাবে, শ্রেণিকক্ষে নয়।
ব্ল্যাকবোর্ডের সামনের ভদ্রলোক নিজের চশমা ঠিক করলেন, তার আঙুলগুলো পুরু সাদা চকে মাখামাখি হয়ে আছে।
“আহা, এখন আওয়াজ করে পড়ুন।”
নারীটি উঁচু কলারের কালো সোয়েটার এবং মোটা পাজামা পড়েছে। চেয়ারের সঙ্গে ঝুলানো জ্যাকেটটাও কালো, ব্যাগের মধ্যে স্কার্ফ, কালো উলে বুনানো কাপড়ের ব্যাগটির রংও কালো। এই মলিন ও বিষণ্ন পোশাকে তাকে মনে হচ্ছিল যেন মাত্রই কোনো শেষকৃত্যের অনুষ্ঠান থেকে এসেছে, মুখটা পাতলা, টান টান খসখসে, যেন কোনো বিশেষ ধরনের কাদায় তৈরি বড়সড় চেহারার ভাস্কর্য।
ভদ্রমহিলা বয়সেও তরুণ নয় দেখতেও তেমন সুন্দরী নয়। তার চোখ দুটোতে বুদ্ধিদীপ্ত চাউনি, কিন্তু তার চোখের পাতায় অনবরত সংকোচন-প্রসারণ এটা বুঝতে দেয় না। পিঠ ও কাঁধ স্থায়ীভাবে ঝুঁকে পড়েছে। মনে হয় যেন সে তার কালো পোশাকের বহরে নিজেকে গোপন আশ্রয় দিতে চাইছে। এবং তার নখগুলোও মাংস ঘেঁষে কাটা। তার বাম হাতের কব্জিতে একটা গাঢ় বেগুনীরঙের চুলের ব্যান্ড বাঁধা, এই একটু বেরঙা চিহ্ন ছাড়া তার পুরো বাহ্যিক অবয়ব একরঙা।
“আসুন সকলে সমস্বরে পড়ি।”ভদ্রলোক আর নারীটির জন্য অপেক্ষা করলেন না। তিনি শিশু-চেহারার বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের উপর দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলেন, ছেলেটি ঐ নারীটির সঙ্গে একই সারিতে বসে ছিল। মধ্যবয়সী লোকটি একটা পিলারের আড়ালে অর্ধেকটা ঢাকা পড়ে গেছেন, এবং তরুণ স্নাতকোত্তর ছাত্র জানালার পাশের চেয়ারে কাঁধ ঝুঁকিয়ে বিসদৃশভাবে বসে আছে।
“প্রাচীন গ্রিক ভাষায়-‘ইমোস, হেমেটেরোস।’ অর্থ “আমার” আমাদের।” তিনজন ছাত্রই পড়ল, তাদের কণ্ঠস্বর নীচু এবং লাজুক। “প্রাচীন গ্রিক ভাষায়, ‘সোস, হুমেটেরোস’। “তোমার” একবচন, “তোমার” বহুবচন।
ভদ্রলোক ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, বয়স ৩৫-৪০। তার নাকের গোড়ায় গভীর খাঁজসহ চোখের উপর সাহসী উচ্চারণের মতো ঘন ভ্রুর অধিকারী কৃশদেহ মানুষটির সংযত আবেগের একটা ভীরু মৃদু হাসি তার মুখের চারধারে খেলা করছে। তার গাঢ় বাদামি সস্তা মোটা সুতি কাপড়ের জ্যাকেটের কনুইয়ের কাছে হলুদ-বাদামী চামড়ার তাপ্পি লাগানো। জ্যাকেটের হাতাদুটো সামান্য ছোটো, কব্জি দেখা যাচ্ছে। নারীটি তার মুখের একটা খুঁতের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল, মুখের কিনারা থেকে বাম চোখের পাতা পর্যন্ত একটা সরু ম্লান রেখা বেঁকে গেছে। প্রথম ক্লাসে নারীটি যখন ঐ রেখাটিকে দেখেছিল, সে ভেবেছিল হয়ত চোখের জল কখনো ওখান থেকে গড়িয়ে গিয়েছিল, এটা তারই শুষ্ক রেখা।
ম্লান-সবুজ চশমার পিছন থেকে লোকটির চোখ দুটো নারীটির শক্ত করে চেপে বসা ঠোঁটের উপর স্থির হয়ে থাকল। তার মুখের সেই মৃদু হাসি এখন অদৃশ্য। তার অভিব্যক্তি এখন কঠোর হয়ে গেছে। তিনি ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে ফিরে প্রাচীন গ্রিক ভাষায় একটা ছোট বাক্য তাড়াতাড়ি লিখে ফেললেন। এর সঙ্গে বৈশিষ্ট্যসূচক চিহ্ন যোগ করার আগেই চকটা ভেঙে দুটো টুকরোই মেঝেতে পড়ে গেল।
২.
গতবছরেরর বসন্তের শেষে, নারীটি এমনই একটা ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়েছিল। একটা চকমাখা হাত এগিয়ে নিয়েছিল বোর্ডের দিকে। যখন একমিনিটের মতো সময় চলে গেল এবং সে পরবর্তী শব্দটাও লিখতে পারল না, তার ছাত্ররা তাদের বসার জায়গা থেকে উঠে দাঁড়াতে শুরু করল এবং নিজেদের মধ্যে গোপনে কথা বলা শুরু করল। নারীটি উগ্র চকচকে চোখে না দেখছিল ছাত্রদের, না দেখছিল ঘরের ছাদ, না দেখছিল জানালা, সে শুধু নিজের সামনের শূন্য বাতাসকে দেখছিল।
“আপনি ঠিক আছেন তো ম্যাডাম?”
সামনর সারিতে বসা কোঁকড়ানো চুল ও মিষ্টি চোখের মেয়েটা জিজ্ঞাসা করেছিল। নারীটি জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করল, কিন্তু চেষ্টায় তার চোখের পাতা সামান্য কুঁচকে গেল মাত্র। ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা চল্লিশের চেয়ে কয়েকজন বেশি হতে পারে, তারা একে অন্যের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে থাকল। সে কি করছে? প্রশ্নের ফিসফিসানি এক ডেস্ক থেকে অন্য ডেস্কে ছড়িয়ে পড়েছিল।
নারীটি শুধু নীরবে শ্রেণিকক্ষ থেকে বেরিয়ে যেতে পেরেছিল। নিজের উদ্যোগে কোনোমতে এটা করে করেছিল। যে মুহূর্তে সে করিডরে পা রেখেছে অমনি ক্লাসরুমের সেই চাপা ফিসফিসানি সরব হয়ে উঠেছিল, যেন একটা লাউডস্পিকারের আওয়াজ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তার জুতোর শব্দও এই গুঞ্জনে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। কাঁপা কাঁপা ঠোঁটদুটো শক্ত হয়ে একে অন্যের সঙ্গে সেঁটে ছিল, সে নিজের নিজের সঙ্গে বিড়বিড় করছিল, জিহ্বা ও গলার অনেক গভীর থেকে উৎসারিত সেই বিড়বিড়ানি। এটা ফিরে এসেছে।
তার ষোলো বছর বয়স পেরিয়ে প্রথম যে শীতকাল এলো, তখন প্রথমবার ঘটনাটা ঘটেছিল। হাজারো সূচের তীক্ষ্ণধার ডগা যেভাবে কাপড় বুনে চলে সেভাবেই ‘ভাষা’ও তার মুখের মুখের মধ্যে গেঁথে গিয়ে আটকে গেল। শব্দগুলো তখনও তার কাছে পৌঁছাত, কর্ণকুহর এবং মস্তিষ্কের মাঝে বাতাসের ঘন স্তর বাঁধা হিসেবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। ঐ কুয়াশাচ্ছন্ন নীরবতায় মুড়ে, তার জিহ্বা ও ঠোঁটের স্মৃতি, যে প্রত্যঙ্গ দুটো যত্নে উচ্চারণ করত শব্দগুলোকে, সেই হাত যেটা শক্ত করে পেনসিল ধরে রাখত, এসব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থেকে অনেক দূরে তার মস্তিষ্কে সে আর ভাষা নিয়ে ভাবত না। ভাষাহীন কিশোরীটি ঘুরে বেড়াত এবং সে অন্যের ভাষাও বুঝত ভাষার সাহায্য ছাড়াই, কথা বলতে শেখার আগে সে যেমন ছিল— না, বলা যায়, যেন জীবনটাও পাওয়ার আগে যেমন ছিল তেমন অবস্থায়। তুলোর বলের মতো নীরবতা সময়ের প্রবাহকে শোষণ করে নিয়েছিল, তার শরীর ও মন দুটোকেই আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল।
কিশোরীটির সচেতন সতর্ক মা তাকে মনোচিকিৎসকের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন, সে ভদ্রলোক তাকে সেসব ট্যাবলেট দিত সেগুলোকে সে না গিলে জিহ্বা নিচে লুকিয়ে রাখত এবং পরে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ফুলবাগানের বেডে কবর দিত। গাঢ় লাল রঙা পুংকেশর অঙ্কুরিত হতো ফুলের বেড থেকে, তার মাটি চাপা ওষুধের পরিচর্যা পেয়ে। তার মা ও মনোচিকিৎসক দুজনে মিলে পরামর্শ করে ঠিক করলেন তাকে আবারও স্কুলে ফেরত পাঠানো হবে। এটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে বাড়িতে গণ্ডিবদ্ধ হয়ে বসে থাকলে তার কোনো উপকার হবে না, এবং তাকে তার সমবয়সীদের থেকে পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়লেও চলবে না।
প্রথমবারের মতো সে স্টেট হাইস্কুলে ঢুকল, মার্চ মাসে শুরু হওয়া নতুন শিক্ষাবর্ষের ঘোষণার চিঠিটি তাদের কাছে পৌঁছাবার কয়েকমাস পর পর্যন্ত স্কুলটা একটা ভীতিকর, আতঙ্ক জাগানিয়া স্থান ছিল তার জন্য। স্কুলের পড়াশোনা এরমধ্যে অনেকটা এগিয়ে গেছে। শিক্ষকরা সকলেই বয়সী, কর্তৃত্বপরায়ণ, ছাত্রদের প্রতি ততটা মনোযোগীও নয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বোবা হয়ে বসে থাকা একটা মেয়ের সঙ্গে কোনো সহপাঠীও আলাপচারিতায় আগ্রহী হল না। যখন তাকে একটা বই থেকে কিছুটা অংশ উচ্চস্বরে পাঠ করে শোনানোর জন্য বলা হতো অথবা শারীরিক শিক্ষার ক্লাসের সময় দলের সঙ্গে উচ্চারণ করে নম্বর হিসাব করে তালে তালে প্র্যাকটিসের জন্য যখন বলা হতো তখন সে শূন্য চোখে কোনোরকম প্রত্যাশা ছাড়াই শিক্ষকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত। বাধ্য হয়ে শিক্ষকগণ তাকে ক্লাসের বাইরে পাঠিয়ে দিত অথবা তার গালে পড়ত ঠাস শব্দে চড়।
তার মা ও তার মনোচিকিৎসকের আশা ভঙ্গ করে, এসব সামাজিক মিথস্ক্রিয়া তার নীরবতায় এতটুকু চিড় ধরাতে পারল না। এর বদলে একটা আরও বেশী একাগ্র স্থির উজ্জ্বলতা তার শরীরে যেন ঘন কাদামাটির পাত্রের মতো ভরে গেল। বাড়ি ফেরার পথে কোলাহলপূর্ণ রাস্তা দিয়ে সে ওজনহীন হেঁটে যেত, যেন সে অসংখ্য সাবানের বুদবুদে মুড়ে ভাসমান এগিয়ে যাচ্ছে।
অন্তর্গত এই চকচকে নীরবতায়, মনে হতো যেন সে পানির নিচে ডুবে থেকে পানির উপরিতলকে দেখছে, তখন গাড়িগুলো বজ্রগর্জন করতে করতে পাশ কাটাত এবং পথচারীরা তার কাঁধে ও বাহুতে কনুইয়ের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যেত।
অনেক সময় পার হয়ে গেলে তার হুঁশ হতো সে কোথায় আছে।
কী যেন সব অতি সাধারণ ফরাসি শব্দ, ওইসব অতি সাধারণ পঠন-পাঠন, তার মধ্যে কি কোনো স্ফূলিঙ্গই জ্বালাতে পারত না? যদি সে অসাবধানতাবশত যথাযথ ভাষাকে মনে করতে না পারত, ঠিক যেন সে একটা অবসন্ন অঙ্গের অস্তিত্ব মনে করতে পারছে না তেমন কি? ফরাসি ভাষাই বা হতে হবে কেন, প্রথম শ্রেণীর চীনাভাষা বা ইংরেজি ভাষা কেন নয়? সম্ভবত এটা নতুনত্বের কারণে, কারণ এটা এমন একটা ভাষা যেটাকে সে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অধীত বিষয় হিসেবে পড়ার জন্য শিখতে পারে। সবসময়ের মতোই শূন্য চোখে ব্ল্যাকবোর্ডের উপরে তাকিয়ে ছিল সে, কিন্তু সেখানে কিছু একটার অপ্রত্যাশিত বাঁধা পড়ল। টেকো মাথা খাটো আকৃতির ফরাসি ভাষার শিক্ষক উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে নির্দিষ্ট ভাষাটি দেখিয়েও দিচ্ছিলেন। শিক্ষকের নজরদারিতে পড়ে সে লক্ষ্য করল, তার ঠোঁট একটা শিশুর ঠোঁটের মতো থিরথির করে কাঁপছে। শব্দটা ছিল: লাইব্রেরি। জিহ্বা ও গলার অনেক গভীর থেকে বিড়বিড় আওয়াজে শব্দটা উঠে এলো। সে কথা বলার ক্ষমতা ফিরে পেলো।
ঐ মুহূর্তটা কত গুরুত্বপূর্ণ সেটা জানার তার কোনো উপায় ছিল না।
তখন অবধি ভীতি ছিল অস্পষ্ট, নীরবতার গভীর থেকে বেদনা দীর্ণ দ্বিধা এটা যোগসূত্রকে সামনে মেলে ধরল। যেখানে উচ্চারণ, ধ্বনি এবং হারিয়ে যাওয়া অর্থের সাক্ষাৎ হয়, একটা অতি ধীরে জ্বলতে থাকা উচ্ছ্বাস এবং একীভূতকরণের মৃদু গলন যেন আলোকবর্তিকা হয়ে জ্বলে উঠছিল।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করার পর, ভদ্রমহিলা প্রথম চাকরি নিয়েছিল একটা বই প্রকাশনা সংস্থায়, এরপরের চাকরি একটা সম্পাদনা প্রতিষ্ঠানে। দুটো চাকরি মিলে মোট কেটেছে বছর ছয়েকের কিছু বেশি; এরপর তিনি দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্যের প্রভাষক হিসেবে এবং একটি মাধ্যমিক স্তরের শিল্পকলা বিষয়ক স্কুলের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। এসব প্রতিষ্ঠানগুলোই রাজধানীর আশেপাশে ছিল। এর পাশাপাশি তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তিনটি কবিতা সংগ্রহ রচনা করেন, যেগুলো তিন-চার বছরের ব্যবধানে প্রকাশিত হয়েছিল। এবং বেশ কয়েকবছর ধরে একটি পত্রিকায় পনেরো দিন পরপর সাহিত্য সমালোচনাও লিখেছিলেন। ইদানীং একটি সংস্কৃতিবিষয়ক পত্রিকার একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে সম্পাদনা পর্ষদের সাপ্তাহিক সভায় প্রতিবুধবার যোগ দিচ্ছেন, পত্রিকাটির শিরোনাম অবশ্য এখনো ঠিক করা হয়নি।
এখন আবার সেই জিনিসটা ফিরে এসেছে, তাঁর এই এতদিনের অর্জন, এসবকিছু পিছনে ফেলে যাওয়া ছাড়া তাঁর আর কোনো গতি নেই।
এটা ঘটতে পারে এমন কোনো ইঙ্গিত ছিল না, এবং এমনটা ঘটতে পারে এরও কোনো কারণ ছিল না। এটা অবশ্য ঠিক যে, ছয় মাস আগে সে তার মমতাময়ী মাকে হারিয়েছে, কয়েক বছর হল ডিভোর্স হয়েছ, এবং ধীরে ধীরে আট বছর বয়সী সন্তানকে কাছে রেখে বড় করার অধিকারও হারাচ্ছে। এবং এই অসুখটা ফিরে এসেছে পাঁচমাস আগে যখন থেকে তার ছেলে আর তার সঙ্গে থাকতে পারছে না, তার একমাত্র ছেলেটি তাকে ছেড়ে প্রাক্তন স্বামীর সঙ্গে চলে গেছে। আদালতে ছেলেটির কাস্টডি নিয়ে দীর্ঘ লড়াই চলেছিল স্বামীর সঙ্গে। যেহেতু তার আট বছরের ছেলেটি তাদের পরিবারের প্রথম পুত্র সন্তানের প্রথম পুত্র (নাতি) এবং তার স্বামীর পরিবারের একমাত্র ছেলে শিশু, যেহেতু ছেলেটি এখন আর দুধের-শিশু নয়, যেহেতু তার প্রাক্তন স্বামী মনে করে তার প্রাক্তন স্ত্রী তার সন্তানের সঙ্গে খুব বেশি ঘনিষ্ঠ সংশ্লিষ্ট ও আন্তরিক এবং ছেলেটিও মায়ের প্রতি অত্যন্ত অনুরক্ত— যেটা ছেলেটার ভবিষ্যৎ জীবন গঠনে খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে— তার কৈশোর কালের মনোচিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ভদ্রমহিলার বিরুদ্ধে প্রমাণপত্র হিসেবে কোর্টে উপস্থাপন করা হলো— যেহেতু নারীটির আয়-রোজগার ছিল তার প্রাক্তন স্বামীর তুলনায় অনেক কম (ব্যাংকে চাকরি করা লোকটি সম্প্রতি প্রমোশন পেয়ে ব্যাংকের হেড অফিসে পোস্টিং পেয়েছে), মানে অনিয়মিত ও যৎসামান্য, কোর্টের শুনানির ফলাফলে নারীটি অত্যন্ত করুণভাবে হেরে গেল।
নিজের কলিজার টুকরা সন্তান দূরে চলে যাবার পর থেকে অনিদ্রা রোগে আক্রান্ত হয়ে যে ধূসর-চুলের মনোচিকিৎসকের সঙ্গে সে সপ্তাহে একদিন করে দেখা করেছে, সে ভদ্রলোক বুঝে উঠতেই পারছেন না এ ধরনের কেসে মা হিসেবে নারীটি এত স্পষ্ট কারণগুলোকে কেন অস্বীকার করছেন। না, তিনি লিখলেন, টেবিলে রাখা লেখার সাদা কাগজে, বিষয়টা এতো সহজও নয়।
এটাই ছিল নারীটি ও মনোবিদের শেষ সিটিং। একে তো লেখার মধ্য দিয়ে সমস্যার সমাধানে মনোরোগের চিকিৎসা করতে অত্যধিক সময় নেয়, এতে প্রচুর ভুল বোঝাবুঝিরও সুযোগ সৃষ্টি হয়। মুখ থেকে কথা উচ্চারণ করতে না পারার কারণে, একজন বক্তা ও ভাষা বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য মনোচিকিৎসকের সিদ্ধান্ত নেওয়া চিকিৎসাপদ্ধতির প্রস্তাবকে নারীটি অত্যন্ত ভদ্রভাবে প্রত্যাখ্যান করল।
৩.
ভদ্রমহিলা দুইহাত ডেস্কের উপরে রাখল। তার শরীরের ভঙ্গি অত্যন্ত কঠোর ও দৃঢ়, সে এমন ভাবে নুয়ে ছিল যেন একটা শিশু তার শিক্ষককে আঙুলের নখ পরীক্ষা করতে দিয়ে অপেক্ষা করছে। সে শুনল যে তার শিক্ষকের গমগমে কণ্ঠস্বর পুরো পাঠকক্ষ ভরে ফেলেছে।
“প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ বাচ্যের সঙ্গে, একটা তৃতীয় বাচ্যও ছিল প্রাচীন গ্রিক ভাষায়, যেটাকে আমি এর আগের ক্লাসে সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করেছিলাম, ঠিক তো?”
তরুণ লোকটি সেই একই সারিতে বসেছিল, যেভাবে নারীটি প্রতিবার একইভাবে জোর দিয়ে মাথা নাড়ে। তরুণটি দর্শন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, ছেলেটার গোলগাল গাল তার চালাক-চতুর দুষ্ট ধরনের স্বভাবের পরিচয় দিচ্ছে।
ভদ্রমহিলা নিজের দৃষ্টি জানালার দিকে ফেরালেন। তার চোখের দৃষ্টি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট করা ছাত্রটির চেহারার উপর থেকে ঘুরে গেল, এই ভদ্রলোক প্রি-মেডিকেলে কোনোক্রমে একটা গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি লাভ করেছিলেন, কিন্তু অন্যের জীবনের দায়িত্ব নেবার জন্য যে পর্যাপ্ত দায়বদ্ধতা দরকার, তা তার মধ্যে ছিল না, তাই মেডিসিনের ইতিহাস অধ্যয়ন করার জন্য তিনি ঐ বিভাগ ছেড়ে দিয়েছিলেন। ভদ্রলোক একজন নাদুস-নুদুস দৈত্যের মতো বিশাল, গলায় চর্বির পুরু স্তর, এবং চোখের চশমা কালো রঙের শিং দিয়ে তৈরি ফ্রেমের, গোলধরনের, এবং প্রথম দর্শনেই বোঝা যায় লোকটা অত্যন্ত সহজ-সরল মিশুক। সে ক্লাসের প্রতি বিরতিতে তরুণ দর্শন বিভাগের ছাত্রটির সঙ্গে গল্প জুড়ে দিচ্ছিল— তারা রিনরিনে কণ্ঠে বারবার এক ধরনের বোকা বোকা কৌতুক বলছিল ও শুনছিল। কিন্তু প্রতিবার পাঠদান শুরু হরার সঙ্গে সঙ্গে প্রি-মেডিকেল পাশ ডাক্তারের আচরণ পাল্টে যাচ্ছিল। যে কেউ বুঝতে পারবে, যেন সে শ্রেণিকক্ষে কোনো ভুল করে না ফেলে সেজন্য ভদ্রলোক কী পরিমাণ টেনশনে আছে।
“ঐ বাচ্য, যেটাকে তৃতীয় বাচ্য বলা হয়, ওটা কোনো কাজকে ব্যাখ্যা করতে পারে, যেটা আলোচ্য বিষয়টির প্রতিফলনকে সম্পর্কিত করতে পারে।”
তৃতীয় তলার জানালার বাইরে, নিরানন্দ নীচু নীচু দালানগুলোকে কমলা রঙের আলো বিক্ষিপ্তভাবে আলোকিত করে আছে। চ্যাপ্টাপাতাওয়ালা অল্পবয়সী গাছগুলোর অনাবৃত শীর্ণ কালো শাখাগুলোকে আধার আড়াল করে রেখেছে। নারীটির স্থিরদৃষ্টি নীরবে সেই জনশূন্য দৃশ্যকে পেরিয়ে গেল, আরও পেরিয়ে গেল পোস্টগ্রাজুয়েট ছাত্রের ভীতু চেহারা, গ্রিক প্রভাষকের বিবর্ণ কব্জি।
যে নীরবতা বিশ বছর পরে ফিরে এসেছে সেটা মোটেই আগের মতো নয়; উষ্ণ, গাঢ় অথবা উজ্জ্বল কিছুই নয়। অতীতে আসা নীরবতা যদি তার জন্মের আগেকার নীরবতার মতো হয়ে থাকে, এই নতুন নীরবতা তাহলে মৃত্যুকে অনুসরণ করছে। যেখানে আগে সে গভীর জলে নিমজ্জিত ছিল, উপরের জ্বলজ্বলে পৃথিবীর দিকে অপলক তাকিয়ে ছিল, এখন তার নিজেকে একটা ছায়া মনে হয়, নগ্ন মাটি এবং শীতল কঠিন দেয়ালের উপরে চড়ে আছে, নিজের জীবনকে দেখছে একজন বাইরের পর্যবেক্ষক হিসেবে, বিশাল জলের ট্যাঙ্কে পড়েছে নিজের ছায়া। সে প্রত্যেকটা শব্দই পড়তে ও শুনতে পারে, কিন্তু তার ঠোঁট ফেটে কোনো শব্দ বের হয় না। দেহের রূপ ছাড়া ছায়ার মতো, একটা মৃত গাছের ভিতরের গর্তের মতো একটা উল্কা থেকে অন্য উল্কার মাঝেকার গাঢ় কালো শূন্যের মতো, এটা একটা তিতকুটে পাতলা নীরবতা।
বারো বছর আগে, একটা অপরিচিত ভাষাকে আয়ত্তে আনতে সে ব্যর্থ হয়েছিল, যে ভাষার সঙ্গে তার মাতৃভাষা কোরিয়ান ভাষার কোনো দিক থেকে কোনো মিল নেই, থাকলে হয়ত তার নীরবতাকে ভাঙ্গতে পারত। এখন সে নিজেই এই প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানটিতে প্রাচীন গ্রিক ভাষা শিখতে চেয়েছিল, কারণ সে নিজের ইচ্ছায় এই ভাষাটা শিখে আগেকার ক্ষতিপূরণ পোষাতে চেয়েছে। হোমার, প্লেটো এবং হেরোডাটাসের সাহিত্য সম্পর্কে অথবা এদের পরবর্তীকালের সাহিত্য সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই, যে পুস্তকগুলোকে তার সহপাঠীরা মূল ভাষায় পড়তে আগ্রহী হয়ে গ্রিক ভাষা শিখতে এসেছে। এখানে যদি বার্মিজ বা সংস্কৃত ভাষার তো অধিকতর অপরিচিত কোনো ভাষা সাহিত্যের কোর্স করার অফার থাকত, তাহলে সে ঐ অপরিচিত ভাষাটাকেই বেছে নিত।
উদাহরণ হিসেবে দেখুন, ‘নিতে’ ঐ মধ্যম বাচ্যে, আসলে বোঝায়, ‘আমি বেছে নেই’। ‘ধোয়া শব্দটিও মধ্যম বাচ্যে উপস্থাপিত হয়, ‘আমি ধুই,’ যেখানে ঐ ‘ক’ আমারই একটা অংশ। এখানে ইংরেজি ভাষায় অভিব্যক্তিটা এভাবে প্রকাশ করা হয়, ‘সে নিজেকে ফাঁসি দিয়েছে,’ এরকম হবে, তাই তো? প্রাচীন গ্রীকে ‘নিজেকে শব্দটা উল্লেখ করার দরকার নেই— যদি আমরা এই মধ্যম বাচ্য ব্যবহার করি, এই একই অর্থ একটি শব্দে প্রকাশ করা সম্ভব। এভাবে।” কথাটা বলে প্রভাষক মুখে উচ্চারণ করে বললেন ও বোর্ডে গ্রিক অক্ষরে লিখলেন: অপহরণ।
ব্ল্যাকবোর্ডে লেখা বর্ণগুলোর দিকে তাকিয়ে গভীর চিন্তা করে, নারীটি তার পেনসিল নিয়ে নোটবুকে শব্দটি লিখল। সে এর আগে কখনো ভাষা নিয়ে এরকম জটিল নিয়মের মুখোমুখি হয়নি। ক্রিয়াপদগুলো বিভিন্নভাবে তাদের রূপ পরিবর্তন করতে পারে : পুরুষ এবং বচনের ব্যকরণগত বিষয় রয়েছে; কালের রয়েছে বিভিন্ন অবস্থা; ভাব এর রয়েছে পৃথক চারটি বিভাগ; এবং এই যে বাচ্য, তারও আছে তিনটি প্রকারভেদ। কিন্তু ধন্যবাদ জানাতে হয় এসবের অস্বাভাবিকভাবে বিস্তৃত এবং সূক্ষ্ম নিয়ম-কানুনগুলোকে, যেগুলো প্রত্যেকটা একক বাক্য হিসেবে আছে, যেগুলো একেবারে সহজ সরল এবং সুস্পষ্ট। এখানে বিষয়কে বিশেষায়িত করার কোনো প্রয়োজন নেই, অথবা শব্দের ধারাবাহিকতা ধরে রাখারও দরকার নেই। এই একটি শব্দই— এটা বোঝাতে বদলে যায় যে, এখানে বিষয় হচ্ছে একবচন সম্বলিত তৃতীয় ব্যক্তি; অতীতকালের অসমাপিকা ক্রিয়া, এটা বোঝায় যে অতীতের কোনো সময়ে কিছু একটা ঘটেছিল এবং সমাপ্তিও টেনেছিল; এবং তৃতীয় বাচ্য— এরমধ্যেই সংকুচিত হয়ে বোঝাচ্ছে যে, কোনো ব্যক্তি নিজেকে ফাঁসি দিয়েছে।
যে বাচ্চাকে সে আটবছর আগে জন্ম দিয়েছিল এবং যাকে সে লালন-পালনের সামর্থ্যরে প্রশ্নে আজ সে অযোগ্য সাব্যস্ত হচ্ছে— সেই বাচ্চার মুখে প্রথম বুলি ফোটার সময়ে, নারীটি এমন একটা শব্দের কথা ভাবত যার মধ্যে পৃথিবীর সকল মানবীয় ভাষাগুলো ঘিরে থাকবে। ওটা ছিল এমন একটা প্রাণবন্ত দুঃস্বপ্ন যে তার পিঠ ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে গেল। একটা একক শব্দ অসাধারণ গন্তব্য ও গভীরতা তৈরি করবে। এমন এক ভাষা হবে, যে ভাষা মানুষ মুখ খোলার সঙ্গে সঙ্গে উচ্চারিত হয়ে যাবে, মহাবিশ্বের সৃষ্টি হওয়ার সময় সমস্ত পদার্থ যেমন বিস্ফোরিত এবং প্রসারিত হয়েছিল (বিগ ব্যাং)। প্রতিটাবার সে তার ক্লান্ত, বিরক্ত, খিটখিটে মেজাজের শিশুটাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নিজেও তার পাশে তন্দ্রায় ডুবে যেত, সে স্বপ্ন দেখত, সমস্ত ভাষার বিশাল স্ফটিকভর তার উত্তপ্ত হৃদয়ের কেন্দ্রে একটি বরফ ঠান্ডা বিস্ফোরকের মতো তার স্পন্দিত বুকের নিলয়ে আবদ্ধ হয়ে আছে, সেই মনের মধ্যে রয়ে যাওয়া স্মৃতি, যেটায় সে শীতল হয়, ঐ সংবেদনা তাকে পীড়ন করতে লাগল এবং সে খাতায় গ্রিক ভাষায় লিখল: অপহরণ।
একটা ভাষা এত শীতল এবং কঠোর যেন এটা একটা স্ফটিকের পিলার। একটা ভাষা যেটা অন্য কোনো পূর্বতর ভাষার সঙ্গে সম্মিলনের জন্য অপেক্ষা করেনি, একটি সর্বোচ্চ আত্ম-সন্তুষ্টিমূলক ভাষা। এমন একটা ভাষা।
নারীটি ছাত্রদের উচ্চস্বর পাঠের গর্জন ধ্বনির মধ্যেই কোনো কথা না বলে নীরবে বসে পড়ল। গ্রিক ভাষার শিক্ষক তার নীরবতা নিয়ে কোনো ঝামেলা করলেন না। তিনি ক্লাস থেকে সরে গিয়ে ব্ল্যাকবোর্ড থেকে বাক্যটা মুছে ফিরলেন, তিনি নরম মোচনি কাপড় দিয়ে বোর্ডটা ঘষে হাত বাড়িয়ে আলগোছে পুরোটা ঝেড়ে ফেললেন।
“জুন মাসের শুরুতে আমরা প্লেটো পড়ব,” নতুন করে পরিষ্কার করা বোর্ডে হেলান দিয়ে গ্রীকভাষার শিক্ষক ঘোষণা দিলেন। “আমরা অবশ্যই এর পাশাপাশি ব্যাকরণ শিক্ষাও চালিয়ে যাব।” তিনি ডান হাতে চক ধরে আছেন, এবং বাঁ হাত দিয়ে চশমাটাকে ঠেলে উপরে তুলেছেন।
৪.
যখন নারীটি কথা বলতো, সে বলাও ছিল অত্যন্ত মৃদুস্বর। এটা তার ফুসফুসের দুর্বলতা অথবা কণ্ঠনালীর সমস্যা থেকে উদ্ভূত কোনো সমস্যা নয়। সে আসলে জায়গা দখল করতে চাইত না। প্রত্যেক ব্যক্তি তার শরীরের ভর অনুসারে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ শারীরিক জায়গা দখল করে থাকে। কিন্তু ভাষার ভ্রমণ এর চাইতেও বেশি কিছু। তার নিজেকে প্রচার করার কোনো বাসনাই নেই।
পাতাল রেল অথবা রাস্তা, কোনো ক্যাফে বা রেস্তোরাঁ কোথাও সে কারুর মনোযোগ আকর্ষণের জন্য উদাত্ত কণ্ঠে কথা বলে ওঠেনি। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল তার শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করা (তখন সে প্রয়োজনীয় উচ্চস্বরে কথা বলত)— এছাড়া অন্য সব পরিস্থিতিতে তারই ছিল সবচেয়ে শান্ত মৃদু কণ্ঠস্বর। ভীষণ শীর্ণ দেহে সে তার পিঠ ও কাঁধ কুঁজো করে কুঁকড়ে বসত যেন তার শরীর অপেক্ষাকৃত কম জায়গা দখল করে। সে কৌতুক বুঝতে পারত এবং তার ঠোঁটে বেশ একটা প্রফুল্ল হাসি ঝোলানো থাকত সবসময়, কিন্তু যখন সে উচ্চস্বরে হাসত তখন তার কণ্ঠস্বর প্রায় শোনাই যেত না।
এমনকি সে যখন কথা বলতে পারত, সে কখনো কখনো তার মনোযোগ তার কথোপকথনের উপরেই ধরে রাখত, যেন সে তার দৃষ্টিপাত দিয়ে কী বলতে চাইছে তা-ও সবাই বুঝে নিতে পারবে। সে মানুষজনদের অভিবাদন জানাত, ধন্যবাদ দিত, এবং ক্ষমাও চাইত দরকার হলে এসব কিছুই সে করত তার চোখ দিয়েই, মুখে উচ্চারিত শব্দ দিয়ে নয়। তার কাছে দৃষ্টিপাতের চেয়ে অন্য কোনো স্পর্শ এতো তাৎক্ষণিক এবং সজ্ঞাত নয়। এটা ছিল স্পর্শ না করেও স্পর্শের খুব কাছাকাছি।
চোখের ইশারার তুলনায় ভাষা বহুগুণ বেশি শারীরিক স্পর্শ সম্পৃক্ত। ভাষা ফুসফুস, গলা, জিহ্বা ও ঠোঁটের মধ্যে দিয়ে আসে, ভাষা বাতাসকে স্পন্দিত করে, যেন এটা তার শ্রবণকারীদের দিকে নিজের পাখা সাগ্রহে মেলে দেয়। কথা বলতে গেলে জিহ্বা শুকনো হয়ে যায়, থুথু ছিটতে থাকে, ঠোঁট ভাগ হয়। যখন সে দেখল যে কথা বলার এই শারীরিক চাপ আর নেওয়া যাচ্ছে না, সে লেখালেখিতে মনোযোগ দিতেও পারল না, যখন সে নিঃসঙ্গ ছিল, তখনো। যেমন করে সে বাতাসে নিজের কণ্ঠস্বরকে ছড়িয়ে দিতে অপছন্দ করত, সে এটাকে সয়ে নেওয়া জটিল কাজ হিসেবে দেখল যে, নীরবতার দেয়ালে তার বাক্য ব্যাঘাত হিসেবে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠেছে। ঐ সময় সে তার জিহ্বার নীচ থেকে পিত্তরসের তেতো স্বাদ নিতে পারছে এমনকি কাগজের উপরে কলমটা রাখার আগে সে দুটো বা একটা শব্দ লেখার জন্য চিন্তা করতে থাকল।
এইমাত্র লিখে ফেলা শব্দগুলো কে নিজের ঠোঁটদুটো ধীরে ধীরে খুলে উচ্চারণ করার আগে নিরীক্ষণ করার জন্য সময় নিল। প্রতিরোধহীন মাটিতে মিশে যাওয়া চ্যাপ্টা আকারের শারীরিক অসংগতি এবং নিজের কণ্ঠস্বর দিয়ে মন্থরভাবে সেগুলি বলার চেষ্টা করার কারণে সে এর সঙ্গে সঙ্গে মনে মনে তাড়িতও ছিলেন।
সে পড়া বন্ধ করল এবং ঢোক গিললো, তাঁর গলা শুকিয়ে এল। কোনো কাঁটার আঘাত থেকে রক্ত বের হওয়া বন্ধ করতে যখন সে ক্ষতস্থানের উপরে সজোরে টিপে ধরত সেই সময়গুলোর মতো। অথবা, বিপরীতভাবে ব্যাকটেরিয়া যেন তার রক্তনালীতে প্রবেশ করত না পারে সেজন্য যে-রকম সে ক্ষতস্থান চেপে চেপে রক্ত বের করে ফেলত তেমনভাবে।
ধূসরচুলো মনোবিদ তার মানসিক সমস্যা বোঝার জন্য শৈশবকালের মূল সমস্যাটা বের করতে অনেক চেষ্টা করেছিল। ভদ্রলোকের সঙ্গে নারীটি আধা-আধি সহযোগিতা করল। একজন বয়ঃসন্ধিকালের কিশোরী হিসেবে ভাষা হারিয়ে ফেলার অভিজ্ঞতাকে সে সবাইকে জানাতে চায়নি, সে বরং তার দূর অতীত থেকে একটা স্মৃতি পুনরুদ্ধার করতে পেরেছিল।
সে যখন তার মায়ের পেটে ছিল, তার মা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, টাইফয়েড হয়েছিল মায়ের। দফায় দফায় জ্বর আর ঠান্ডায় কষ্ট পেয়ে তিনি প্রত্যেকবেলা খাবারের সঙ্গে একমুঠো করে ট্যাবলেট গিলতেন। তার মা-ও ছিল তার মতোই উদ্দাম এবং হঠকারী স্বভাবের, এবং যখন সে কিছুটা সুস্থ হয়ে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারলেন, দ্রুত নারীরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে গেলেন এবং বললেন যে সে বাচ্চাটাকে আর রাখতে চায় না। তার মা এ বিষয়ে স্থির নিশ্চিত ছিলেন যে যেহেতু তিনি শারীরিক ক্লেশ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য মুঠো মুঠো ওষুধ গিলেছেন, সেহেতু তার বাচ্চা অসুস্থ শরীরে জন্ম নেবার সম্ভাবনা প্রবল।
ডাক্তার তখন তাকে বলেছিলেন যে, এখন বাচ্চাকে নষ্ট করা খুব বিপজ্জনক হবে, যেহেতু এরমধ্যেই গর্ভফুল তৈরি হয়ে গেছে, এবং তাকে দু’মাস আবার যেতে বলল, তখন সে একটি মৃত সন্তান হিসেবে বাচ্চাটাকে প্রসব করাতে পারবে। কিন্তু ঐ নির্ধারিত দু’মাস পার হলে পেটের মধ্যে ভ্রূণটি নড়াচড়া শুরু করল, এতে মা মায়াশীল হয়ে মমতায় দুর্বল হয়ে গেলেন, এবং তিনি আর হাসপাতালে গেলেন না। বাচ্চাটা প্রসব না হওয়া পর্যন্ত ভীষণ উদ্বিগ্ন জর্জর সময় কেটেছে তার মায়ের। যতক্ষণ না সদ্য জন্ম নেওয়া জরায়ুর পানি মাখানো মেয়ে বাচ্চাটার হাত-পায়ের আঙুল গুণে নিশ্চিত হলেন যে বাচ্চাটা বিকলাঙ্গ হয়নি, ততক্ষণ তিনি স্বাভাবিক স্বাভাবিক হতে পারেননি।
খালা, ফুপু, তুতো ভাইবোন এমনকি অনধিকার চর্চাকারী একেবারে বাড়ির গা-লাগোয়া প্রতিবেশীগণ তার বড় হয়ে ওঠার সময়টায় দিনরাত এই উপাখ্যান শুনিয়ে গেছে।
তুমি তো বাইচান্স জন্মানোর সুযোগ পেয়েছো।
এই বাক্যটা জাদুমন্ত্রের মতো শুধু ঘুরে ঘুরে এসেছে জীবনে।
তার বয়স তখন এত কম ছিল যে নিজের আবেগ ও প্রতিক্রিয়াকে ঠিক বুঝে উঠতে পারত না, কিন্তু এই বাক্যটার মধ্যে যে ভীতিকর শীতলতা মিশে ছিল সেটা সে খুব পরিষ্কারভাবে অনুভব করতে পারত। সে প্রায় না জন্মাতে জন্মাতে জন্মগ্রহণ করে ফেলেছে। যেরকমটা তার পাওয়ার কথা ছিল, পৃথিবী মোটেই তার জন্য সেরকম ছিল না। এটা শুধু একটা সম্ভাবনা থেকে যায় যে, নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে অগুনতি পরিবর্তনশীলতা মিশ্রণের সুযোগ দিয়ে, একটি ভঙ্গুর বুদ্বুদ (না জন্মানো ভ্রূণ) যেটা এত সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে একত্রিত হয়েছিল। একদিন বিকেলবেলা, মায়ের আমুদে আনন্দিত অতিথিদের বিদায় দেবার পর, সে বাড়ির সামনের জায়গাটাতে উবু হয়ে বসে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল যে, জমানো গোধূলি তার উঠানটাকে ঢেকে ফেলেছে। সে তার মনোচিকিৎসককে বলল, সে কীভাবে দমচাপা নিঃশ্বাসে এবং কুঁজো হয়ে যাওয়া কাঁধ নিয়ে ওখানে বসেছিল, সে অনুভব করছিল সেই শীর্ণ, ক্ষীণ, বিস্তৃত একস্তরিক পৃথিবীকে অন্ধকার গিলে ফেলল।
মনোচিকিৎসক ভাবল, এই সবকিছুই খুব মজার।
“জীবনকে বোঝার জন্য তোমার বয়স খুব কম ছিল, এবং স্বাভাবিকভাবেই তখন স্বাধীন জীবন-যাপনের প্রশ্নই আসে না, এছাড়া প্রতিবার তোমাকে শুনতে হয়েছে জন্ম না হওয়ার কত কাছাকাছি ছিলে তুমি, এতে তুমি বার বার নিরাপত্তাহীনতার বোধ করেছ, মনে হচ্ছিল যেন তোমার অস্তিত্বের পুরোটাই মুছে ফেলা হচ্ছিল। কিন্তু তুমি তোমার যৌবনকালে বেড়ে উঠেছ চমৎকারভাবে এবং এখন এসব বিষয়ের মুখোমুখি হওয়ার মতো যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসীও হয়েছ। এখন তোমাকে ভয় পেতে হবে না। এখন তোমাকে লজ্জায় দুঃখে সংকুচিত হতে হবে না। এখন তোমার কথা বলার মতো যথেষ্ট অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তোমার কাঁধ সোজা কর এবং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে দৃঢ়তার সঙ্গে নিজের জায়গা করে নাও।”
কিন্তু সে জানত, যদি সে এই যুক্তি অনুসরণ করে চলে, তার বাকী জীবন অনেক যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে যাবে, এই প্রশ্নের জবাব পেতে গিয়ে, যে প্রশ্ন ক্রমাগত তার ভঙ্গুর ভারসাম্যকে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে— সেই চিরকালীন প্রশ্ন, সত্যিই কি তার অস্তিত্বের কোনো দাবিদার আছে এই পৃথিবীতে!মনোচিকিৎসকের স্পষ্ট সুন্দর উপসংহারের মধ্যে এমন কিছু ছিল যা ঠিক মনে হচ্ছিল না। সে এখনো অনেক বেশি জায়গা দখল করতে চায় না, এটা সে বিশ্বাস করে না যে ভয়ের ক্রীতদাস হয়ে অথবা স্বাভাবিকভাবে সে যে সব পরিস্থিতির মুখোমুখি হয় সেগুলোকে সে অবদমন করে।
কাউন্সেলিং ক্লাস মসৃণভাবে এগিয়ে গেল, মাস পাঁচেক পরে, তার কণ্ঠস্বর জোড়ালো হওয়ার বদলে সে আরও নিশ্চুপ হয়ে গেল, মনো চিকিৎসককে সত্যি সত্যিই আহত মনে হল। আমি বুঝেছি, বলল সে, “বুঝতে পারছি, তুমি কী পরিমাণ কষ্ট পাচ্ছ। তোমার মায়ের মারা যাবার কয়েকদিনের মধ্যেই তোমার বাচ্চার কাস্টডি লড়াইয়ে হেরে যাওয়া তোমার জন্য ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক হয়ে পড়েছে। গত কয়েকমাস ধরে বাচ্চাটাকে কাছে না পেয়ে না জানি তুমি কত অসহ্য যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে যাচ্ছ। আমি বুঝতে পারি। নিজের মধ্যে এত যন্ত্রণার ভার সহ্য করা তোমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠেছে এটা তুমি বুঝতে পারছ।”
মনোরোগ চিকিৎসকের কণ্ঠের ফলাও করা ব্যগ্র সহানুভূতি তাকে বিস্মিত করলো। তাঁর কাছে যেটা সবচেয়ে অসহ্য মনে হল তা হলো মনোরোগ চিকিৎসকের দাবি, যে, ‘তিনি তাকে বুঝতে পেরেছেন।’
এটা এত সহজ সত্য নয়।
ভদ্রমহিলা এটা এক নির্মল নিশ্চিততার সঙ্গেই জানত।
নীরবতা, নীরব প্রশ্রয়, এগুলোকে মুড়ে রাখে, অপেক্ষা করতে থাকে।
সে তার কলম তুললো এবং সামনে রাখা কাগজে পরিষ্কার করে লিখল, না এটা এত সহজ নয়।
গ্রিক ভাষায় লিখলেন:
ভোগা বা কষ্ট পাওয়া
শেখা
“এই দুটো ক্রিয়াপদ ‘কষ্ট পাওয়া’ এবং ‘শেখা’। খেয়াল করে দেখেছো, এগুলো কী করে অভিন্ন হয়ে গেছে? সক্রেটিস এখানে এই শব্দদুটোয় শ্লেষ প্রয়োগ করে কীভাবে এই দুটো আলাদা কাজকে অভিন্নভাবে চিহ্নিত করেছেন!”
ষড়ভুজ পেন্সিলটার শিস যেটাকে সে অন্যমনস্কভাবে তার কনুইতে ঠেকিয়ে রেখেছিল। তার টান টান চামড়ায় ঘষে, সে বোর্ডে লেখা শব্দদুটোকে নিজের খাতায় টুকে নিল। প্রথমে সে গ্রিক বর্ণমালা ব্যবহার করে শব্দ দুটো লিখল, এরপর বহু চেষ্টা করেও এর অর্থদুটো নিজের ভাষায় লিখতে পারল না। এর বদলে সে নিজের বাম হাতের মুষ্টি তুলল এবং তার নির্ঘুম চোখে ঘষতে লাগল। সে গ্রীকভাষার শিক্ষকের নিস্তেজ চেহারাকে দেখতে থাকল। সে হাতে চক আঁকড়ে ধরে আছে, তার মাতৃভাষার অক্ষরগুলো শুষ্ক রক্তরেখার মতো কিন্তু সাদা রঙের, ব্ল্যাকবোর্ডের সমতলে পার্থক্য তৈরি করছে।
নারীটি তার সামন ডেস্কে খুলে রাখা বইয়ের উপর ঝুঁকে পড়ল। এটা প্লেটোর রিপাবলিকের একটা দ্বিভাষিক আকারে বেশ মোটাসোটা বইয়ের সংস্করণ, যেটার মধ্যে খাঁটি গ্রিক ভাষা ও কোরিয়ান ভাষার অনুবাদ আছে। তার কপালে ঘামের একটা ফোটা গ্রিক বাক্যগুলো মধ্যে গড়িয়ে পড়ল। পুনঃব্যবহারের জন্য নবায়িত মোটা খসখসে কাগজের উপর ঘামের ফোটাটা পরে সে জায়গাটা ভিজে ফুলে উঠল।
“যা হোক আমরা এই ক্রিয়াপদের যুগলকে শুধু শব্দের খেলা হিসেবে দেখতে পারি না। যেহেতু সক্রেটিসের সময় থেকে শেখার আক্ষরিক অর্থ ছিল যন্ত্রণা। এমনকি এটাও বলা হয় যে, সক্রেটিস নিজেও এত শব্দ ব্যবহার করে একথা ভাবতে পারেননি, এই চিন্তাগুলো প্লেটোর মতো চিন্তকের মাধ্যমেই প্রণীত হয়েছিল।”
বৃহস্পতিবার, গ্রিক ভাষা শেখার ক্লাসের জন নারীটি তার ব্যাগ নিজের প্রয়োজনের চেয়ে একটু আগেই গুছিয়ে ফেলেছিল। ভাষা শিক্ষা একাডেমির স্টপেজের কয়েকটা আগের একটা স্টপেজে সে নেমে যায় এবং একাডেমির দিকে হাঁটতে থাকে। পীচরাস্তা বিকেলের তাপ বিকিরণ করেই যাচ্ছে, এমনকি দালানগুলোর ছায়ায় ছায়ায় সাৎ করে ঢুকে পরে কৌশল করে হেঁটেও তার পুরো শরীর মুহূর্তের জন্য ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে গেল।
দোতালায় ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই দেখতে পেল গ্রিক ভাষার শিক্ষক তার আগে আগে হেঁটে যাচ্ছে। সে সহজাতভাবে তার হাঁটার বেগ থামাল। এমনভাবে তার নিশ্বাস ধরে রাখল যেন এতটুকু শব্দও তৈরি না হয়। অন্য কারো উপস্থিতি টের পেয়ে শিক্ষক ভদ্রলোক মাথা ঘুরিয়ে ঘাড়ের উপর দিয়ে তাকালেন এবং মৃদু হাসলেন। এ হাসি সে হাসি যার মধ্যে আন্তরিকতা জবুথুবু ভাব এবং সমর্পণ মিশে আছে, এবং এটাও স্পষ্ট যে স্যার এখুনি তাকে অভিবাদন জানাতে যাচ্ছেন। এরপরই শিক্ষক আচমকা নিজেকে সংবরণ করে নিলেন। ঐদিনের পর থেকে, যখনই তাকে করিডোরে বা সিঁড়িতে গ্রিক ভাষার শিক্ষকের কাছ ঘেঁষে চলতে হয়, স্যার আর তাকে দেখে হাসেন না, কিন্তু চোখ দিয়ে দুর্বলভাবে অভিবাদন জানান।
যখন সে তার মাথা তুলল, মনে হল যেন অনুজ্জ্বল আলো ভরা ক্লাসরুমটি হঠাৎ করে উজ্জ্বল আলোয় ভরে গেছে, যেটা তাকে অস্থির করে ফেলল। সে ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে তাকাল, বোর্ডটা এই ব্রেকের সময়টায় ফাঁকা। শিক্ষক মহাশয় কাপড়ের ডাস্টার দিয়ে বোর্ডটি মুছে ফেলেছেন, কিন্তু মুছেছেন হালকাভাবে, তাই গ্রিক পাণ্ডুলিপির খণ্ড খণ্ড ছাপ এখনো সেখানে রয়ে গেছে। সে একটা বাক্যের এক তৃতীয়াংশ লেখা পড়তেও পারছে। এবং চকের গুড়ার একটা নোংরা প্রলেপ লেগে আছে বোর্ডে, দেখে মনে হয় যেন ইচ্ছাকৃতভাবেই এটা করা হয়েছে, মনে হচ্ছে যেন ওটাকে কোনো বোর্ড ব্রাশ দিয়ে ঘষা হয়েছে।
নারীটি আবার বইয়ের উপর ঝুঁকে পড়ল। একটা গভীর শ্বাস নিল, এবং তার নিজের শ্বাস-প্রশ্বাসের পার্থক্য শুনতে লাগল। কথা বলার ক্ষমতা হারানোর পর থেকে তার কখনো কখনো এমন মনে হয়, তার নিশ্বাস গ্রহণ এবং ফেলার শব্দও যেন কথা বলারই অনুরূপ। এরা যেন নীরবতাকে কণ্ঠস্বরের মতোই প্রবলভাবে নাড়িয়ে দিতে পারে তার এরকমই মনে হয়েছিল যখন সে তার মায়ের জীবনের শেষ মুহূর্তটার সাক্ষী হয়েছিল। কোমায় যাবার পর থেকে তার মা যতবার পূর্ণ গরম নিশ্বাস ছাড়ত, নীরবতা যেন এক পা পেছাতো। এবং যখন সে নিশ্বাস গ্রহণ করত, মনে হত যেন অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দেওয়া শীতল নীরবতা এমনভাবে চিৎকার করছে, যেন ঐ চিৎকার তার মায়ের শরীরের ভিতর শোষিত হচ্ছে।
নারীটি পেনসিলটা আঁকড়ে ধরল এবং এইমাত্রই যে বাক্যগুলো পড়েছে সেগুলোর দিকে সরু চোখে তাকাল। সে এখন এর প্রত্যেকটা অক্ষরকে খোঁচাতে পারে। যদি সে পেনসিলে শিস দিয়ে চাপ দেয় এবং একটা লম্বা ছেঁড়া দাগ তৈরি করতে পারে, সে একটা শব্দের মাঝে ছিদ্র করতে পারে না, পুরো একটা বাক্যকেই ছিঁড়ে ফেলতে পারে।
সে ছোটো ছোটো কালো অক্ষরগুলোর দিকে তাকাল। মোটা ধূসর কাগজের উপরে সুস্পষ্টভাবে ফুটে আছে, অক্ষরগুলোর ভিন্ন ভিন্ন ধ্বনি নির্দেশক চিহ্নগুলো ঠিক যেন কতগুলো পোকা, যে পোকাগুলো তাদের পাখাগুলো কোঁচকাচ্ছে আবার ছড়িয়েও দিচ্ছে। ছায়ার মধ্যে একটা জায়গা, অস্পষ্ট এবং বোধগম্যতায়ও ভীষণ জটিল। একটা বাক্যে প্লেটো তখন আর তরুণ নেই, থেমে থেমে এগোনোর কথা ভাবে। কোনো ব্যক্তির পার্থক্যহীন কণ্ঠস্বর, যার চেহারা তার হাতের আড়ালে লুকানো।
সে শক্ত করে হাতের পেনসিলটা চেপে ধরল। সাবধানতার সঙ্গে নিশ্বাস ছাড়লো। তার আবেগ বাক্যটিতে প্রকট হয়ে ওঠে। যেন চকের চিহ্ন অথবা শুকনো রক্তের একটি ধারা। সে এটাকে সহ্য করে।
নারীটির শরীর তার দীর্ঘকালীন মৌনতার সাক্ষ্য বহন করছে। শরীরটা আদতে যা তার চেয়েও কঠিন অথবা ভারী দেখায়। তার পায়ের ছাপ, তার বাহু ও হাতের নাড়াচাড়া দীর্ঘ, তার কাঁধ এবং তার মুখের গোলালো রেখা— সব সীমাবদ্ধ হয়ে যায় স্পষ্ট শক্তিশালী পরিধিতে। কিছুই ঝরে পরে না, কিছুই এই সীমা অতিক্রমও করে না।
সময় নিয়ে আয়নায় নিজের চেহারা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার মত নারী কখনোই সে ছিল না, কিন্তু এখন ঐ চিন্তাটাকে বোধাতীত বলে মনে হয়। আমরা প্রত্যেকে নিজেদের জীবনে যে মুখমণ্ডলকে কল্পনা করি, সে মুখকে অবশ্যই আমাদের স্বকীয় হতে হবে। কিন্তু একবার সে তার মুখকে কল্পনা করা বন্ধ করে দিলে, দেখতে পেল, সময় পার হওয়ার সাথে সাথে এটা অবাস্তব বলে মনে হচ্ছে। যখন সে কোনো জানালার কাচ অথবা আয়নায় নিজের মুখের ছায়া দেখে, নিজের চোখদুটোকে খুব ভালোভাবে পরীক্ষা করে।
চোখের ঐ স্বচ্ছ মনি দুটোই যেন তার আপাত অপরিচিত চেহারার সঙ্গে একমাত্র সংযোগসূত্র রক্ষা করে।
কখনো কখনো তার নিজেকে একজন মানুষের চেয়ে অনেক বেশি, একধরনের পদার্থ বলেই মনে হয়, একটা নিরেট অথবা চলন্ত তরল পদার্থ। যখন সে গরম ভাত খায়, তার মনে হয় সে নিজেও ঐ ভাত হয়ে গেছে। এবং যখন সে নিজের মুখ শীতল জলে ধোয়, তখন ঐ শীতল জল আর নিজের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। একই সঙ্গে সে এটাও জানে যে, সে ভাতও নয়, পানিও নয়, বরং কোনো কঠোর নিরেট বস্তু, যেটা অন্য কোনো বস্তু, জীবন অথবা অন্য কোনোকিছুর সঙ্গে কখনো মিলে যেতে পারে না। এই বরফায়িত নীরবতার ভিতর থেকে শুধু এই মানেটুকুকেই সে উদ্ধার হতে দেখে, তার যত শক্তি ছিল, কিছু একটা যেন তার সেই সমস্ত শক্তিকে নিয়ে গেছে, সেটা কী ঐ শিশুটা, যে শিশুটার সঙ্গে সে দু’সপ্তাহ অন্তর একটা রাত কাটানোর অনুমতি পায় এবং ঐ মৃত গ্রিক শব্দগুলো, যেগুলোকে সে তার হাতে আঁকড়ে ধরা পেনসিল দিয়ে কাগজের উপর খোদাই করে লিখছে।
একজন নারী মাটিতে শুয়ে আছে।
সে পেনসিলটা নিচে রাখল, ওটা ঘামে ভিজে চিটচিটে হয়ে গেছে। হাতের তালু দিয়ে সে কপালের রগের পাশে সেঁটে থাকা ঘামের বিন্দুকে মুছে নিয়েছিল।
৫.
“মা, ওরা বলে দিয়েছে, সেপ্টেম্বর মাসের পর থেকে আমি আর এখানে আসতে পারব না।”
গত শনিবার রাতে এই কথাগুলোয় সতর্ক হয়ে সে এক দৃষ্টিতে নিজের ছেলের দিকে তাকিয়ে ছিল। বাবুটা যেন আরও বড় হয়ে গেছে, মাত্র দু’সপ্তাহের ব্যবধানে, তাকে দেখতে শুধু লম্বা লাগছে না, বরং আগের চেয়ে বেশ রোগাও লাগছে। তার চোখের পাপড়ি লম্বা এবং পাতলা। তার নরম সাদা গালের উপরে চিবুকের দিকে নামা ঢালু ভাঁজ স্পষ্ট, যেন কলম দিয়ে টেনে এঁকে রেখেছে কেউ।
“আমি যেতে চাই না। আমার ইংরেজি ভাষায় দখলও অতোটা ভালো না। ওখানে যে ফুপি থাকে, আমার সঙ্গে তো তার কখনো দেখাই হয় নি। বাবা বলেছে, আমাকে পুরো একবছরের জন্য সেখানে যেতে হবে। আমি এখানে সবেমাত্র কত কষ্টে কয়েকজন বন্ধু বানালাম, এখন আবার আমাকে এখান থেকেও চলে যেতে হবে?’
মা শুধু বাচ্চাকে গোসল করালো এবং বিছানায় শুইয়ে দিল, বাচ্চার চুল থেকে আপেলের মৃদু ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়তে থাকল। তার গোল গোল বড় চোখে নিজের চেহারা দেখতে পেল। বাচ্চার মুখটাও নিজের চোখের প্রতিফলনে দেখতে পেল, এবং বাচ্চার সে চোখের মধ্যেও মা নিজের চোখ দেখতে পেল … এটা যেন প্রতিফলনের এক অনন্ত ধারাবাহিকতা।
“মা, তুমি কি বাবাকে বলতে পারো না, তুমি কি বাবাকে একটা চিঠি লিখতে পারো না, আমি কি আবারও এখানে তোমার সঙ্গে থাকতে আসতে পারি না।”
বাবুটা হতাশায় অস্থির হয়ে দেয়ালের দিকে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে পড়ল। এবং মা তাকে হাতের মধ্যে নিয়ে নিজের মুখোমুখি ফেরাল।
“আমি আসতে পারি না? আমি ফিরে আসতে পারি না? কেন পারি না মা?”
সে আবার দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে ঘুরে গেল। “দয়া করে লাইট নিভিয়ে দাও। আলো এতো উজ্জ্বল থাকলে আমি কী করে ঘুমাব?”
মা উঠে গিয়ে সুইচ বন্ধ করল। ল্যাম্পপোস্টের আলো নীচতলার জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকে উজ্জ্বলতা ছড়াচ্ছে, তাই অন্ধকারের মধ্যে শীঘ্রই সে নিজের ছেলের অবয়ব দেখতে পেল। স্পষ্ট। তার কপালের মাঝে একটা গভীর কুঞ্চন। মা কপালের উপর হাত বুলিয়ে সমান করে দিল ভ্রুকূটিটা। সে আবারও ভ্রুকুটি করল। বাচ্চাটা তার চোখদুটো শক্ত করে বন্ধ করে আছে, এমনকি তার শ্বাসপ্রশ্বাসও চেপে ধরে নিঃশব্দ হয়ে আছে।
জুন মাসের শেষ রাত্রির অন্ধকারে, পানিজমা ঘাস এবং বৃক্ষরসের ঘ্রাণ পরিত্যক্ত খাবারের সঙ্গে মিলেমিশে গেছে। ছেলেটাকে যথাস্থানে নামিয়ে দিয়ে, বাসে চড়ে মধ্য সিউলের ভিতর দিয়ে সে প্রায় দু-ঘণ্টার পথ হেঁটে গিয়েছিল। দুপুরের ঔজ্জ্বল্যের মতো, কোনো কোনো রাস্তা অনেক বেশি আলোকসজ্জিত, সে রাস্তাগুলোয় ধোঁয়া উড়ছিল, আর একটানা বেজে যাচ্ছিল উচ্চস্বর গানবাজনা, অন্যান্য রাস্তাগুলো ছিল অন্ধকার, কিন্তু আঁধার ফিকে হয়ে আসছে, রাস্তার বিড়ালগুলো ময়লা ভর্তি ব্যাগগুলোকে দাঁত দিয়ে ছিঁড়ছে এবং ভদ্রমহিলার দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে।
তার পা একটুও ব্যথা করেনি। সে ক্লান্তও হয়নি। লিফটের সামনেটা ম্লান আলোয় উদ্ভাসিত, সে দাঁড়াল এবং নিজের ঘরের সামনের দরজার দিকে দেখল, যে দরজা দিয়ে এখন সে হয়ত ভিতরে ঢুকবে, বিছানার দিকে যাবে হয়ত ঘুমাবে। সে ঘুরে দালানটার পিছনের দিকে চলে গেল, গ্রীষ্মের রাত্রির মৃদুগন্ধের মধ্যে বাইরে বেরিয়ে পড়ল, সেই সব ঘ্রাণ, যেগুলো একদা জীবন্ত ছিল— এখন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সে খুব দ্রুতগতিতে হাঁটতে লাগল, শেষ পর্যন্ত তার গতি যখন দৌড়ানোতে পৌঁছাল, সে বাড়ির কেয়ার টেকারের বাংলোর সামনের একটা পাবলিক ফোন বুথের ভিতরের নিজেকে ছুঁড়ে ফেলল, ট্রাইজারের পকেটে যত কয়েন পেল, সবগুলোকে সে তুলে নিল মুঠি ভরে।
সে একটা কণ্ঠস্বর শুনল। “হ্যালো?” নারীটি তার মুখ খুলল। সে জোরে একটা নিশ্বাস ফেলল। সে নিশ্বাস গ্রহণ করল, এবং আবার নিশ্বাস ফেলল।
সেই একই কণ্ঠস্বর আবারও বলল, “হ্যালো?” নারীটির হাত এমনভাবে থরথরিয়ে কাঁপতে লাগল যে সে ফোনের রিসিভার দৃঢ়মুষ্ঠিতে আঁকড়ে ধরল।
তাকে নিয়ে যাবার স্বপ্ন তুই কীভাবে দেখতে পারিস? অত দূরদেশে? আর এতো দীর্ঘসময়ের জন্য? বেজন্মা কোথাকার? তুই একটা হৃদয়হীন বেজন্মা?
নারীটির দাঁতে দাঁত লেগে ঠকঠকিয়ে শব্দ হতে লাগল এবং যতক্ষণ না সে তার শক্ত হয়ে আঁকড়ে ধরা আঙুলগুলো থেকে ফোনের রিসিভারটা ছাড়িয়ে নিচে রাখতে পারল ততক্ষণ পর্যন্ত কাঁপতে থাকল। সে দ্রুত নিজের গালে নিজের হাতের ঝাপট করে লাগাল। সে নিজে নিজেকে সজোরে চড় মারতে যাচ্ছিল। সে নিজের ওষ্ঠের উপরের ও নাকের নিচের মধ্যভাগের টোলে হাত ঘঁষল, নিজের চোয়াল আর মুখেও ঘঁষল, কেউ তার কণ্ঠরোধ করে নেই।
তার কথা বলার ক্ষমতা চলে যাবার পরে, ঐ রাতে সে নিজেকে ভালোভাবে আয়নায় দেখল। সে ভাবল, যে সে নিশ্চয়ই ভুলভাবে দেখেছে, যদিও সে এই ভাবনাটাকে শব্দে রূপ দিতে পারল না। নিশ্চয়ই তার চোখ এতটা নির্মলও নয় যে সে চোখ দিয়েই ভাবনাকে শব্দে রূপ দেবে।
চোখদুটো থেকে যদি রক্ত অথবা পুঁজ অথবা ধূসররঙা কাদা গড়াত তাতে সে বরং কম বিস্মিত হতো।
তার মধ্যে যে ঘৃণা বহুদিন আগে থেকে লাভার মতো ফুটছে তা এখন ক্ষতে রূপ নিয়েছে, এবং যে যন্ত্রণার ঢেউ তার মধ্যে প্রায়ই ওঠে তা এখন ফুলে উঠছে এমন একটা যন্ত্রণাদায়ক ফোস্কার মতো যেটা ফাটবে না। কিছুতেই নিরাময় হবে না। কোন কিছুরই শেষ হবে না।
৬.
“এই পৃথিবী সুন্দর এবং ক্ষণস্থায়ী, তাই না?” গ্রিক ভাষার শিক্ষক বললেন। “কিন্তু ক্ষণস্থায়ী এবং সুন্দর হওয়া সত্ত্বেও, প্লেটো চেয়েছেন শাশ্বত সুন্দর।” ম্লান-সবুজ লেন্সের পিছন থেকে শিক্ষক তার শান্ত দৃষ্টি ফেললেন। তিনি সরাসরি নারীটির স্বচ্ছ চোখের দিকে তাকালেন। শিক্ষার্থীরা আজ বিশেষভাবে অমনোযোগী থাকার কারণে, প্রায় দশমিনিট ধরে তিনি আজ ব্যাকরণ বোঝানোর পরিবর্তে লেখার বিষয়বস্তু বোঝাচ্ছেন। একটা পর্যায়ে এসে, এই সকল পাঠের ক্লাসগুলো গ্রিক ভাষা এবং দর্শন শিক্ষার মধ্যে শিথিল হয়ে পড়ে।
“কিছু মানুষ যদিও সুন্দর জিনিসে বিশ্বাস করে, কিন্তু ওটার সৌন্দর্যে বিশ্বাস করে না, প্লেটো এ ধরনের লোকদের স্বপ্নমগ্ন বলেছেন, এবং এটা বিশ্বাস করিয়েছেন যে কোনো ব্যক্তি উপযুক্ত যুক্তিবিচারের মধ্য দিয়ে প্ররোচিতও করতে পারবে। তার পৃথিবীতে, সবকিছুই এমন উল্টে যেতে পারে। তাই বলতে হয়, তিনি এটাকে বিবেচনা করেছেন যে, তিনি স্বপ্নমগ্ন নয়, জেগে আছেন। যিনি, বরং, বাস্তবতার সৌন্দর্যে বিশ্বাস না করে, পরম সৌন্দর্যকেই শুধু বিশ্বাস করেন, যেটা বাস্তব জীবনে পুরোপুরি অস্তিত্বহীন।”
নারী তার ডেস্কে বসেছিল, বরাবরের মতোই অনড়। দীর্ঘসময় একইভাবে বসে থেকে তার পিঠ ঘাড় এবং কাঁধ জমে শক্ত হয়ে গিয়েছিল। সে নিজের লেখার খাতাটি খুলল এবং বিরতির আগে লেখা বাক্যগুলোকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। বাক্যগুলোর মাঝের ফাঁকা জায়গায় সে কিছু লিখল। বিশেষ্য পদের অবনমনে সে গভীর অধ্যবসায়ে বাক্যগুলোর ফর্মটাকে জটিল করে সমাধান করাও দেখল; এবং নিজের ঠোঁট ও জিহ্বা নড়াচড়ায় আকুল অবস্থায় দেখার জন্য অপেক্ষা করতে থাকল, যে কখন প্রথম শব্দটা ঠোঁট ও জিহ্বার অভিঘাতে বেরিয়ে আসবে।
একজন নারী মাটিতে শুয়ে আছে
গলার মধ্যে জমা বরফ
চোখে পৃথিবী
“এটা কী ?” দর্শনের ছাত্রটি, যে তার সঙ্গে সবসময় একই সারিতে বসে, জিজ্ঞাসা করল। লেখার খাতার দিকে দেখাল। যেখানে ভদ্রমহিলা অসম্পূর্ণ বাক্যে প্রাচীন গ্রিক ভাষায় “একজন নারী মাটিতে শুয়ে আছে,” কে অনুসরণ করে লিখে ফেলেছে, যেটা আগের ক্লাসে তাদের শেখা একটি উদাহরণ বাক্য ছিল। নারীটি বিক্ষুব্ধ হল না, তাড়াতাড়ি করে খাতাটা বন্ধও করল না। নিজের সমস্ত শক্তি জড়ো করল এবং তরুণ ফিলোসফির ছাত্র ভাষাশিক্ষা সহপাঠীর দিকে এমন চোখে তাকাল যেন সে বরফের গভীরে দেখছে।
“এটা কী কবিতা? গ্রিকভাষায় লেখা কবিতা?”
জানালার পাশে বসা পোস্ট গ্রাজুয়েটের ছাত্রটি ঘুরে নারীটির দিকে তাকাল, তার মুখ কৌতূহল খচিত, ঠিক সেই সময়ে গ্রিকভাষার শিক্ষক বিরতি শেষে শ্রেণিকক্ষে ফিরে এলেন।
“স্যার?” দর্শনের ছাত্রটি কোরিয়ান ভাষায় শিক্ষককে সম্বোধন করল, সে তখন দুষ্টুভাবে হাসছে। “দেখেন, সে তো গ্রিক ভাষায় কবিতা লিখে ফেলেছে।”
পিলারের পিছনে রাখা সিটে বসে থাকা মধ্য-বয়সী ভদ্রলোক ঘুরে এলেন নারীটিকে দেখার জন্য, তার অভিব্যক্তিতে একধরনের প্রশংসাসূচক বিস্ময়, এবং তিনি আনন্দ হাস্যে মুখর হলেন। শিক্ষকের হাসির শব্দে চমকে উঠে, নারীটি তার লেখার খাতা বন্ধ করল। সে শূন্যচোখে দেখল শিক্ষক তার চেয়ারের দিকে এগিয়ে আসছে।
“সত্যি? আমি যদি চট করে একবার দেখে নিই, আপনি কি কিছু মনে করবেন?”
নারীটিকে তার শিক্ষকের কথায় মনোনিবেশ করার জন্য বেশ মানসিক চাপ নিতে হবে, যেন সে কোনো বিদেশি ভাষার পাঠোদ্ধার করছে। সে স্যারের চশমার দিকে তাকাল, চশমার কাচ এত পুরু যে তার উঁচুনীচু অবতলে তার চোখ দুটো সাঁতার কাটতে লাগল। এক মুহূর্তের মধ্যে সে পরিস্থিতি বুঝে ফেলল, এবং মোটা ভারী পাঠ্যবই, তার লেখার খাতা, ডিকশনারি এবং পেনসিল বাক্স তার ব্যাগে তুলে নিল।
“না, সীটেই বসে থাকুন দয়া করে। আপনার লেখা আমাকে দেখাতে হবে না।”
নারীটি উঠে দাঁড়াল, কাঁধে তুলল ব্যাগটাকে, নিজেকে খালি চেয়ারগুলোর সারির ভিতর দিয়ে ঠেলে এগিয়ে নিল, এবং দরজার দিকে চলতে থাকল।
জরুরি প্রয়োজনের জন্য বাইরে যাবার দরজার সামনে, যে দরজাটা সোজা সিঁড়ির দিকে গেছে, কেউ একজন পিছন থেকে তার হাত টেনে ধরে থামাল। সচকিত হয়ে, সে ক্ষিপ্রবেগে চক্রাকারে ঘুরে গেল। এই প্রথমবারের মতো সে তার শিক্ষকের চেহারা এত কাছ থেকে দেখল। তার অনুমানের চেয়েও ভদ্রলোক খাটো, এখন তো আর সে ক্লাসরুমের একেবারে সামনে রাখা প্লাটফর্মের উপরে দাঁড়িয়ে নেই, এবং অদ্ভুতভাবে তার চেহারাটা অনেক বয়স্ক মনে হচ্ছে।
“আমি আপনাকে অস্বস্তিতে ফেলতে চাইনি।”
একটা দীর্ঘশ্বাস বুকে টেনে নিয়ে শিক্ষক কাছে এগিয়ে এলেন। “আপনি কী…আমি কী বলছি তা আপনি হয়ত শুনতে পাচ্ছেন না?” ভদ্রলোক তার হাত তুলে একটা ভঙ্গি করলেন। বেশ কবার তিনি একইরকম ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গি করলেন, এবং যেন নিজেকে বোঝাতে চেয়ে স্থবিরভাবে এই কথাগুলো বললেন : ‘আমি দুঃখিত। আমি এটা বলতে বেরিয়ে এসেছি, আমি দুঃখিত।”
নারীটি স্থির দৃষ্টিতে বোবার মতো তার দিকে তাকিয়ে থাকল, স্যারকে আরেকবার নিশ্বাস নিতে দেখল এবং অব্যাহত ও জোরালোভাবে অনবরত কাঁদুনি গাইতে দেখল : “আমাদের কথা বলতে হবে না। আপনাকে কোনো কথার জবাবও দিতে হবে না। আমি ভীষণ দুঃখিত। আমি দুঃখিত, এটা বলার জন্য আমি ক্লাসরুম থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেছি।”
তখন তার বাচ্চার বয়স ছিল ছয়।
একবারের জন্য এটা ছিল একটা নির্মল রবিবারের সকাল, বাচ্চার সঙ্গে কিছুক্ষণ অর্থহীন খুনসুটির পরে, সে তার ছেলেকে বলল যে, তারা নিজেদের জন্য প্রকৃতির উপাদান নির্ভর সবচেয়ে মিলে যায় এমন বিষয় অনুসারে নিজেদের নাম দেবে। তার ছেলে এই খেলাটা পছন্দ করল। নিজের নাম দিল ‘জ্বলজ্বলে জঙ্গল’ এরপর সে মায়েরও নামকরণ করল। সন্দেহাতীতভাবে নামটা মায়ের সঙ্গে একেবারে খাপ খেয়ে গেল।
“ঘন হয়ে ঝরা তুষারের দুঃখ।”
“কী?”
“এটা তোমার নাম মা।”
কী বলতে হবে বুঝতে না পেরে, মা ছেলের স্বচ্ছ চোখের গভীরে উঁকি মারল, মনে হল যেন সে ঘন দানার তুষারের ঝরে পড়া দেখছে, তাই সে অনেক শক্ত করে চোখ বন্ধ করে ফেলল। মায়ের বন্ধ চোখের ভিতরে কোনো তুষারপাত দেখা যাচ্ছে না। না দেখা যাচ্ছে বড় বড় চমকানো ষড়ভূজাকৃতি স্ফটিকাকার তুষারপাত, পাখির হালকা পালকের মতো মোলায়েম তুষার কণাও দেখা যাচ্ছে না। গভীর বেগুনি সমুদ্র নয়, সাদা পর্বত চূড়াার মতো হিমবাহও নয়।
রাতটি শেষ হওয়া অবধি কোনো শব্দ বা রং ছিল না। সবকিছু পুরু বরফে ঢেকে গিয়েছিল। এমন তুষারপাত যা ঠিক যেন সময়ের মতো, সময় জমে গিয়ে ফাটল ধরে, তার অনমনীয় শরীরের উপর অবিরাম বসে যায়। সে শিশুটা তার পাশে থাকে, সে আর সেখানে নেই। বিছানার শীতল পাশটিতে অনড় হয়ে শুয়ে আছে, সে তার ছেলের উষ্ণ চোখের পাতায় চুমু খেয়ে স্বপ্নকে ডাকে, বার বার ডাকে।
৭.
একমুখী একলেনের রাস্তাটি মোটররাস্তার হট্টগোলের পাশাপাশি একটা যুতসই প্রশস্ততাসহ সামনে চলে গেছে। নারীটি এই রাস্তার ফুটপাত ধরে হাঁটতে থাকে। প্রচুর লোকজন যে এ রাস্তা ধরে চলাফেরা করে এমন নয়, তাই হয়ত পরিষদ কোনোভাবে এটাকে উপেক্ষা করছে। ফুটপাতের টাইলসের ফাটলের ভিতর থেকে দৃঢ়ভাবে বেড়ে উঠছে ঘাসের চাপড়া। একটা দেয়ালের পাশের সমতল জায়গায় লাগানো একাশিয়া গাছগুলোর কালো ঘন শাখাপ্রশাখা একটা অন্যের দিকে বাহুর মতো ডালগুলো বাড়িয়ে আছে। আর্দ্র রাত্রির বাতাসে নিষ্কাশিত ধোঁয়ার কুয়াশা ঘাসের ঘ্রাণের সঙ্গে মিলেমিশে গেছে। রাস্তার কাছাকাছি এলে, যেভাবে তীক্ষ্ণধার স্কেটস বরফের উপর কেটে কেটে বসে ঠিক তেমনই, গাড়ির ইঞ্জিনের গর্জন তার কর্ণকূহরকে যেন ফালি ফালি করে দিচ্ছে। তার পায়ের পাতার কাছে ঘাসের মধ্যে, একটা ঘাসফড়িং ধীরে ধীরে কেঁদেই চলেছে।
এটা অদ্ভুত।
এটা এমন, যেন ঠিক এরকম একটা রাত্রির মত রাতের অভিজ্ঞতা সে আগেও যাপন করেছে।
মনে হচ্ছিল যেন এরকমই লজ্জা ও অবমাননার বোধে মুড়িয়ে সে আগেও এই রাস্তা দিয়ে হেঁটেছে।
তখনও তার মুখে ভাষা ছিল, কাজেই তখনকার আবেগগুলো সুস্পষ্ট ও শক্তিশালী ছিল।
কিন্তু এখন তার মধ্যে কোনো ভাষা নেই। শব্দ এবং বাক্যগুলো তাকে ভূতের মতো অনুসরণ করছে, তার শরীর থেকে মুছে গিয়ে, তার কান এবং চোখের দৃষ্টির মাঝে কাছাকাছি কোথাও অবস্থান নিয়েছে।
ঐ দূরত্বের জন্য ধন্যবাদ, যে কারণে কোনো আবেগই অত নিবিড় হয় না, যে আবেগ তার থেকে একটা দুর্বলভাবে সেঁটে থাকা স্যালো টেপের মতো খসে পড়ে।
সে শুধু দেখে। সে দেখে, এবং সে যা দেখে সে সবের কোনোটাকেই ভাষায় অনুবাদ করে না। তার চোখের ভিতর থেকে বস্তুগুলোর ছবি, তাদের নড়াচড়া, ওঠানামা করা, অথবা তার প্রত্যেকটা পদক্ষেপের সাথে সময়ে মুছে যাওয়া, কখনো অনুবাদ করা ছাড়াই। এরকম একটা গ্রীষ্মের রাতে, বহুদিন আগে সে একটা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করেই উচ্চস্বরে হাসতে শুরু করেছিল।
সে তেরদিন বয়সী কুঁজোপিঠ চাঁদটাকে দেখে হা হা করে হেসেছিল।
এটা ভেবে যে, একজনের বিষণ্ন মুখমণ্ডলের সঙ্গে চাঁদটার মিল আছে, এটার গোলালো নিমজ্জিত গর্তকে দেখে মনে হচ্ছে যেন এসব সেই একজনের গোপন হতাশা, সে উচ্চস্বরে হেসে উঠেছিল।
যেন তার শরীরের ভিতর এই কথাগুলো প্রথমে উচ্চ হাসিতে ফেটে পড়েছিল, এবং ওটা ছিল সেই হাসি, যেটা তার পুরো মুখমণ্ডলে ছড়িয়ে গিয়েছিল।
ঐ রাত্রে যখন গ্রীষ্মের অয়নকাল পেরিয়ে সেই তাপ এসে পৌঁছেছিল, এখন যেমন, অন্ধকারের পিছনে ইতস্তত সরে যাচ্ছে।
ঐ রাতটা ছিল অনেকদিন আগের একটা রাত, আবার ততো আগের কোনো রাতও ছিল না, তার ছেলে সামনে সামনে হাঁটছিল, একটা বিরাট শীতল তরমুজকে কোলে করে সে ছেলেকে অনুসরণ করছিল।
তার কণ্ঠস্বর ছিল স্নেহপূর্ণ, কারণ সে কণ্ঠ মনোরম হয়ে বাইরের দিকে ছড়িয়ে পড়ে অন্তত সামান্য কিছুটা স্থানে ব্যাপ্ত হওয়ার চেষ্টা করছিল।
তার ঠোঁটদুটোতে দাঁতে দাঁত ঘষার কোনো চিহ্ন ধরা পড়েনি। তার চোখও তখন রক্তবর্ণ হয়ে ওঠেনি।
[কোরিয়ান ভাষা থেকে গল্পটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন দেবরাহ স্মিথ এবং এমিলি ইয়ে ওন। নিউইয়র্কার পত্রিকায় গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০২৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি।]