সাহিত্য বিভাগের আয়োজনে নির্ধারিত প্রশ্নে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন কবি মাহফুজা অনন্যা। তিনি প্রকৃতি, প্রেম, বিরহ, দেশকাল ও সমসাময়িক বিষয় নিয়ে কবিতা লেখেন। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে ‘সােনালি অসুখ’ ও ‘কামার্ত নগরের কামিজ’ উল্লেখযোগ্য।
বাংলা ট্রিবিউন: কোন বিষয় বা অনুভূতি আপনাকে কবিতা লিখতে অনুপ্রাণিত করে?
মাহফুজা অনন্যা: পৃথিবী যাকে দূরে সরিয়ে রাখে, কেউ তাকে সহ্য করে না, বুঝতে চায় না। প্রতি পদে তাকে হোঁচট খেয়ে চলতে হয়। এই চলা বা যাপনের মধ্যে যে বিষয়গুলো আমার কাছে বৈচিত্র্যময় মনে হয়, সেগুলোকেই কবিতার বিষয়ের জন্য বেছে নিই। যে কথা কাউকে বলতে পারি না, কারো বোঝাও সম্ভব নয়। যা খুব একাকী কথা, গহিনের কষ্ট, না বলা সুখের অনুভূতি, এগুলোই কবিতার মতো করে লিখে ফেলি। এককথায় মানুষের ভিতরের অমানুষসুলভ আচরণ আমাকে কবিতা লিখতে বাধ্য করে।
বাংলা ট্রিবিউন: আপনি কী ধরনের থিম বা বিষয় নিয়ে কবিতা লিখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?
মাহফুজা অনন্যা: সমসাময়িক বিষয় আমাকে খুব নাড়া দেয়। লেখার বিষয় হিসেবে বেশিরভাগ সময় মানুষ ও নাগরিক জীবন, হতাশা, প্রেম, জীবনবোধ, যুদ্ধ ও দেশভাবনা প্রাধান্য পায় আমার লেখায়। কেন জানি, প্রকৃতির চেয়ে মানুষের কথা লিখতে আমার বেশি ভালো লাগে৷ কারণ, প্রকৃতির সবকিছুই সাজানো গোছানো, মানুষই যত এলোমেলো, মানুষের মধ্যেই যত অসংগতি, পৃথিবীতে মানুষ সেরা জীব হলেও, মানুষই বেশি অসম্পূর্ণ মনে হয় আমার কাছে, এ পৃথিবীতে মানুষ সবচেয়ে সুন্দর আবার মানুষই সবচেয়ে অনিরাপদ বলে মনে করি৷ তাই মানুষ নিয়ে, মানুষের মন বা মনোজগত নিয়ে বেশি লেখা হয়।
বাংলা ট্রিবিউন: আপনি তাৎক্ষণিক অনুপ্রেরণায় লেখেন, নাকি ধীরে ধীরে শব্দ সাজান?
মাহফুজা অনন্যা: তাৎক্ষণিক তাড়নায় লিখি। হয়ত কোনো একটা গুরত্বপূর্ণ কাজ করছি, হঠাৎ মাথার মধ্যে কয়েকটি শব্দ এসে ঘাঁ দেয়। যদি মনে করি, হাতের কাজ সেরে ঐ শব্দগুলো পরে ধরবো, যত্ন করে বসাবো পাশাপাশি, উপর নিচ, কিন্তু ততক্ষণে তা দূরে পালিয়ে যায়। আবার যদি তাৎক্ষণিক তাড়নায় লিখে ফেলি, তা হয়ে যায় একটি কবিতা। এভাবে প্রতিদিন অনেক কবিতা হারিয়ে ফেলি, কারণ কাজ না করলে খাবো কী? এই শহরে এসেছি ক্ষুধার তাড়নায়, আর পৃথিবীতে ক্ষুধাও একটি মহান কবিতা।
বাংলা ট্রিবিউন: আপনার কবিতার ভাষা ও শৈলী কীভাবে বেছে নেন?
মাহফুজা অনন্যা: ভাষা ও শৈলী শব্দ দুটিকে আমি খুব গুরুত্ব দিই। এই দুটি শব্দ একজন কবি বা লেখককে পৃথিবীর হাজার হাজার কবি বা লেখক থেকে আলাদা করে চিনিয়ে দেয়। গতানুগতিক শব্দ ও প্রয়োগের রীতি নিয়ে আমি খুব ভাবি। খুব গা বাঁচিয়ে লেখার চেষ্টা করি, যাতে আমার লেখা অন্য কোনো কবি বা লেখকের মতো না হয়ে যায়, এতে অবশ্য আমাকে কবিতার জন্য অনেকের চেয়ে বেশি সময় দিতে হয়, তবুও চেষ্টা করি সবার মধ্য থেকে একজন মাহফুজা অনন্যা হতে।
বাংলা ট্রিবিউন: কোন কোন কবির প্রভাব আপনার লেখায় আছে?
মাহফুজা অনন্যা: প্রভাব ‘আছে’বললে ভুল হবে, তবে একসময় ছিল। আমার দ্বিতীয় কবিতার বই “কামার্ত নগরের কামিজ”যখন লিখি, তখন কিছু কবিতায় জীবনানন্দ দাশের প্রভাব ছিল। অর্থাৎ সেসময় জীবনানন্দ দাশকে আমি দিন-রাত চর্বণ করতাম। নিজেই যখন টের পেলাম, তখনই নিজেকে কাটিয়ে ওঠার প্রতিশ্রুতি দিলাম। এরপর থেকে জীবনানন্দ দাশ কেন, আর কোনো কবির লেখা, শব্দ, বাক্যের কোনো প্রভাব আমার কাছ ঘেঁষতে পারে না। এখন আমি আরও অনেক কবিকে পড়ি, আল মাহমুদ, শামসুর রাহমান, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, আবুল হাসান, আবিদ আজাদ কিন্তু আর কারো কবিতা আমাকে প্রভাবিত করতে পারে না, কারণ এখন আমি প্রতিনিয়ত মাহফুজা অনন্যাকে ধরতে ব্যস্ত থাকি।
বাংলা ট্রিবিউন: কথাসাহিত্যের চর্চা করেন? এ চর্চা আপনার কবিতায় কতটুকু প্রভাব রাখে?
মাহফুজা অনন্যা: কথাসাহিত্যের চর্চা করি গত দুই বছর থেকে। আসলে সাহিত্যের একটি শাখায় কাজ করে অন্য শাখা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা রাখা যায় না। প্রথম থেকে আমার কবিতার বই বের হয়েছে, কবিতা নিয়েই কাজ করেছি বেশি। আমার মোট ৬টি কবিতার বই, একটি উপন্যাস। এবার বইমেলায় প্রথমবারের মতো গল্পগ্রন্থ “সীসার পালক”আসছে, ‘শব্দশিল্প’ প্রকাশনী থেকে। বইটিতে ৩টি পর্ব রয়েছে। জীবন, প্রেম, ও রক্তাক্ত জুলাই শিরোনামে। মোট ১৩ টি গল্প রয়েছে।
যেহেতু কবিতা নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছি, এটুকু বুঝেছি যে, প্রতিটি কবিতায় এক বা একাধিক গল্প থাকে। পাঠক বুঝুক আর না বুঝুক, কবি জানে কবিতার কী মানে। এভাবেই গল্প ও কবিতা একে অপরের অংশ, অর্থাৎ কবিতায় যা আড়াল থাকে, সেই আড়ালটুকুই গল্প হয়ে ওঠে।
বাংলা ট্রিবিউন: আপনার প্রথম কবিতার বই সম্পর্কে কিছু বলুন। প্রথম বই প্রকাশের অনুভূতি কেমন ছিল?
মাহফুজা অনন্যা: প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয় “সোনালি অসুখ”। এ বইয়ের কবিতাগুলো বেশিরভাগ প্রেমের। না, কবিতাগুলো দিয়ে বই করবো এমন ভেবে লিখিনি। ২০০৯ সাল। আমি তখন একটি গ্রুপ কোম্পানিতে এডমিন সেকশনে জব করি। প্রচুর কাজের চাপ ছিল। তারমধ্যেও আমার কবিতা আসতো। হঠাৎ করে লেখা আসতো। তাৎক্ষণিকভাবে লেখাটি আমি ফেসবুক টাইমলাইনে শেয়ার করতাম। এভাবে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে, আমার কিছু পাঠক তৈরি হয়। তারা একসময় আমাকে বলল—আমার লেখা বই তারা পড়তে চায়। শুরু হলো আগের লেখাগুলো সংরক্ষণ। এভাবেই আমার প্রথম কবিতার বই প্রকাশ হয় ২০১৮ সালে এবং ২০১৯ এর বইমেলায় একাত্তর প্রকাশনীর ব্যানারে। প্রথম বই প্রকাশের ঘটনা আমার জীবনে বিরল একটি আনন্দের ঘটনা যা অবিস্মরণীয়।
বাংলা ট্রিবিউন: সমকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক ঘটনা কি আপনার কবিতায় প্রভাব ফেলে? যদি ফেলে, তবে কীভাবে তা প্রকাশিত হয়?
মাহফুজা অনন্যা: আমার কাছে সমকাল খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সমকালীন সমস্ত ঘটনা হতে পারে তা সামাজিক, রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক সেসব সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা রাখার চেষ্টা করি। কারণ, এইসব ছাই উড়িয়ে খোঁজার চেষ্টা করি কবিতা বা গল্পের বিষয় নামক অমূল্য রতন। অবশ্যই সমসাময়িক বিষয় আমার কবিতার প্রধান উপজীব্য।
কবিতার বিষয় যদি হয় সমসাময়িক ঘটনা তাতে উপমা রূপক বা চিত্রকল্পের প্রয়োগ খুব হিসেব করে করতে হয়। কারণ খেয়াল রাখতে হয় যে, উপমা বা রূপকের কারণে মূল ঘটনা বা বিষয়টি যেন দুর্বল না হয়ে যায়। তাছাড়া দেশ ও যুদ্ধের কবিতা সরাসরি শব্দের প্রয়োগ বা শ্লোগানধর্মী হলেই ভালো হয় বলে মনে করি।
বাংলা ট্রিবিউন: পাঠকদের মন্তব্য আপনার লেখায় কোনো পরিবর্তন আনে?
মাহফুজা অনন্যা: পাঠকের জন্য আজ আমি কবি বা লেখক। কিন্তু এমন নয় যে, আমি পাঠকের জন্য নিজের নিজের চিন্তার স্বাধীনতাকে ছোট করে আনবো। অনেক সময় হয়, আমার লেখা পাঠক বুঝতে পারে না বলে অভিযোগ করেন। কিন্তু আমি মনে করি, একজন মানুষকে মানুষ বুঝতে পারে না বলেই সে একজন কবি, সাধারণ মানুষের চিন্তার থেকেও যিনি অগ্রসর থাকেন, তাকে কজন বুঝতে পারে? পৃথিবীতে এমন অনেক কিছুই আছে যা সবার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়, তবে চেষ্টা করলে অনুভব করা যায়। ইদানীং অনুভব করার মতো পাঠক পাই না খুব একটা। না, আমি কখনো পাঠকের মন মতো আমার লেখাকে পরিবর্তন করতে পারবো না। হ্যাঁ, তা যদি হয় অতি অগ্রসর তাহলে মেনে নেবো।
বাংলা ট্রিবিউন: ভবিষ্যতে কী ধরনের কবিতা লিখতে চান? নতুন কোনো ধারা বা শৈলীতে কাজ করার ইচ্ছা আছে কি?
মাহফুজা অনন্যা: কবিতা নিয়ে আমার ভাবনা সহজ কিছু নয়। আমি যেমন কবিতায় কখনো গণিত, কখনো ফিজিক্স, কখনো কেমিস্ট্রি, কখনো পরিসংখ্যান, কখনো সমাজবিজ্ঞান, কখনো রাষ্ট্রনীতি, কখনো বাংলা, কখনো গার্হস্থ্য, কখনো জীববিদ্যা, কখনো ইংরেজি, কখনো ধর্ম, কখনো দর্শন বিষয়ের শব্দ ব্যবহার করি, কবিতাকে ম্যাজিকের মতো খেলাই, যদিও এসব শব্দ প্রয়োগের জন্য অবশ্যই আমাকে সমস্ত সাবজেক্টের পরিভাষা ও শব্দের অর্থ সম্পর্কে পড়াশোনা করতে হয় এবং প্রয়োগবিধি নিয়ে ভাবতে হয়। আমি চাই কবিতাকে যারা শুধু বাংলা বিষয়ের বলে দাবি করে, তারা জানুক কবিতার কোনো নির্দিষ্টতা নেই। কবিতা সকল মানুষের, সকল বিষয়ের, সকল ভাষাভাষীদের জন্য অবাধ এক সেতু। কবিতাকে শুধু বাংলা শব্দের প্রয়োগে সীমাবদ্ধ করে নয়, সকল বিষয়ের শব্দ দিয়ে কবিতাকে পৃথিবীর করে ভাবতে চাই।
আমি নতুনত্বে বিশ্বাসী। নতুনত্ব আমাকে খুব টানে। জীবনযাপন থেকে শুরু করে সবকিছুতেই আমি বৈচিত্র্যতায় বিশ্বাসী। কবিতায় নতুনত্ব একটি চ্যালেঞ্জ। যদিও তাতে পাঠক হারানোর ভয় থাকে, তবুও আমি ব্যক্তিগতভাবে চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করি। এজন্য কবিতার যত নতুন ধারা ও শৈলীই নির্মিত হোক না কেন, আমি তা নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী।