Homeসাহিত্যতায়েব সালিহের ‘খেজুরের হৃদয়’

তায়েব সালিহের ‘খেজুরের হৃদয়’


তায়েব সালিহ (১৯২৯-২০০৯) সুদানের অন্যতম প্রধান সাহিত্যিক। তিনি বিবিসির আরবি বিভাগে এবং ইউনেস্কোতে কর্মরত ছিলেন। উপনিবেশোত্তর পরিচিতি সংকট, সাংস্কৃতিক সংঘর্ষ ও অভিবাসী জীবনের টানাপোড়েন নিয়ে লেখা তার বিখ্যাত ছোট উপন্যাস ‘Season of Migration to the North’ বিশ্বসাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ রচনা হিসেবে স্বীকৃত। সুদানের গ্রামীণ জীবন ও সামাজিক বাস্তবতা নিয়ে লেখা তার গল্প সংকলন ‘The Wedding of Zein’।

বয়সটা ঠিক মনে নেই। আমি তখন বেশ ছোট। তবে মনে আছে, ঠাকুরদার হাত ধরে যখন বের হতাম, রাস্তার প্রায় প্রত্যেকটা লোক আমার হয় গাল টিপত নয় মাথায় হাত বুলিয়ে দিত। আমি তখন ভাবতাম, কই? এমনটা তো আমার ঠাকুরদাকে কেউ করে না! প্রায় সব জায়গায় আমি আমার ঠাকুরদার সঙ্গেই যেতাম। তবে একটা জায়গা বাদ দিয়ে। সকালবেলায় মসজিদে যেতাম কোরআন পাঠ করতে। কোরআন পড়তে আমি খুব ভালোবাসতাম। অন্যান্য বাচ্চারা যখন শিখতে বসে কান্নাকাটি করত, আমি তখন প্রত্যেকটা পাঠ মুখস্থ করে শেখের কাছ থেকে প্রশংসা কুড়োতাম। শেখ মাঝে মাঝেই মসজিদের অন্যান্য অতিথিদের সামনে আমাকে দাঁড় করিয়ে কোরআনের সূরাগুলি আবৃত্তি করে শোনাতে বলতেন, আর তারপর যা হয়, অতিথিরা আমার আদর করত। আমাদের জীবনের বেড়ে ওঠার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল তিনটি বিষয়— মসজিদ, নদী এবং বিস্তীর্ণ প্রান্তর। আমি মসজিদকে ঠিক যতটা ভালোবাসতাম, ততটাই ভালোবাসতাম নদীকেও। যখনই আমার কোরআন পড়া শেষ হতো অমনি স্লেট আর পেনসিল দূরে ফেলে দিয়ে দৌড়ে আসতাম মায়ের কাছে। কিছু একটা মুখে গুঁজেই ছুট লাগাতাম নদীর দিকে। নদী আমায় টানত। তার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ায় সে যে কী আনন্দ! ঠিক ততক্ষণ সাঁতার কেটে চলতাম যতক্ষণ না ক্লান্ত হই। আর তারপর! নদীর তীরে বসে তার বয়ে চলা দেখতাম। দেখতাম কীভাবে পূর্বদিকে বেঁকে বাবলাবনের ভিতর হারিয়ে গেল নদীটি। ওই যেখানে হারিয়ে গেল ঠিক সেখান থেকে শুরু হতো আমার কল্পনার জগৎ। নিশ্চয়ই ওই গাছপালার পিছনে বাস করছে সব বিশালকায় দৈত্য! তাদের লম্বা সাদা দাড়ি আর ভীষণ টিকালো নাক। ঠিক যেন আমার ঠাকুরদা। 

ঠাকুরদার একটা স্বভাব আমি খুব মন দিয়ে লক্ষ করেছি। অনেক প্রশ্ন নিয়ে যখন তার কাছে অনর্গল বকে চলতাম, তখন তিনি প্রত্যেকটি প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগে তার তর্জনীটি দিয়ে নাকের ডগা ঘষতে থাকতেন। ঠাকুরদার চেহারার ভিতর সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল তার সেই লম্বা সাদা ঘন নরম দাড়িটা। আমি অবাক হয়ে চেয়ে থাকতাম সেদিকে। আমার মনে হতো, পৃথিবীর সবচেয়ে সাদা ও সুন্দরতম বস্তু ছিল সেটা। তবে শুধু দাড়ি নয়, আমার ঠাকুরদাও ছিলেন বেশ লম্বা। প্রায় প্রত্যেকেই মাথাটা উঁচু করে ঠাকুরদার সঙ্গে কথা বলত। আমি এও দেখেছি, কোনো বাড়িতে ঢোকার মুখে ঠাকুরদা মাথা নিচু করে ঢুকতেন। ঠিক যেভাবে বাবলা ডালের নিচ দিয়ে ছলছল করে বয়ে যায় নদীটি। আমি ভীষণ ভালোবাসতাম ঠাকুরদাকে। মনে মনে চাইতাম, আমি যখন বড় হব তখন আমিও এমনই লম্বা হব আর রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাব রাজার মতন।

ঠাকুরদার সবচেয়ে পছন্দের নাতি ছিলাম আমি। এটা হওয়ারই ছিল। কারণ, আমার অন্যান্য ভাইবোনেরা খানিকটা বোকা গোছের, আর ওরা আমাকে বেশ বুদ্ধিমান হিসেবে মেনেও নিয়েছিল। আসলে আমি ঠাকুরদার মনের গতিপ্রকৃতি পড়তে পারতাম। ঠিক কখন ঠাকুরদার কথা শুনে আমায় হাসতে হবে, কখন চুপ থাকতে হবে আমি জানতাম। তার নামাজের সময়টাও ঠিক ঠিক মনে রেখে চাওয়ার আগেই এগিয়ে দিতাম জায়নামাজ। ভরে রাখতাম অজু করার জলের পাত্র। ঠাকুরদা তার অবসর সময়ে আমার কাছ থেকে কোরাআন শুনতে চাইতেন। আমিও সুর করে সুরা আবৃত্তির সময় লক্ষ করতাম তার মুখভঙ্গি, কেমন আবেগে তৃপ্ত হয়ে উঠছে।

মাসুদ, আমাদের এক প্রতিবেশী। একদিন ঠাকুরদাকে জিজ্ঞেস করলাম—“আমার মনে হয় তুমি মাসুদকে পছন্দ কর না।”

তর্জনী দিয়ে নাক ঘষতে ঘষতে ঠাকুরদা জবাব দিল—

“মাসুদ ভীষণ অলস। অলস লোকেদের আমি পছন্দ করি না।”

—“অলস! অলস মানুষ মানে কী ঠাকুরদা?”

 খানিকক্ষণ মাটির দিকে চেয়ে ঠাকুরদা চোখ ভাসালেন সামনে ছড়িয়ে থাকা বিস্তীর্ণ প্রান্তরের দিকে

—“এই যে মরুভূমির কিনারা থেকে নীলনদী পর্যন্ত জমিপথ বিস্তৃত, তুমি কি জান এর পরিধি কত? একশ ফেদ্দান। খেজুর গাছ, বাবলা গাছ, সায়াল গাছ, এই সব, সবকিছু ছিল মাসুদের বাবার। তারই উত্তরাধিকার সূত্রে মাসুদই ছিল এই সবকিছুর মালিক।”

ঠাকুরদা কথাগুলো বলে একটু থামলেন। আর সেই সুযোগে আমি তাকালাম আমার প্রিয় খেলার জায়গাটার দিকে। মনে মনে বললাম

—“আমার বয়েই গেছে। এই খেজুর গাছ আর ধূসর প্রান্তরের মালিক যেই হোক, আমি শুধু জানি এ হলো আমার কল্পনার ডানা মেলার জায়গা। আমার খেলার মাঠ।”

 ঠাকুরদা পুনরায় বলা শুরু করলেন

—“৪০ বছর আগে এ সবকিছুই ছিল মাসুদের। কিন্তু এখন, এর দুই তৃতীয় অংশের মালিক আমি।”

এই খবরটা শুনে আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। যা বাবা! আমি তো ভাবতাম সৃষ্টির সময় থেকেই এই জমির মালিক আমার ঠাকুরদা!

ঠাকুরদা বলে চললেন—

“আমি যখন এই গ্রামে পা রেখেছিলাম তখন এক টুকরো জমিও আমার ছিল না। মাসুদ তখন সবচেয়ে ধনী। কিন্তু এখন পাশা পুরো পাল্টে গেছে। আমার বিশ্বাস, মাসুদের মৃত্যুর আগে ওই বাকি জমিটুকুও আমি হজম করে নেব।”

জানি না কেন, আমি অদ্ভুত ভয় পেলাম। ঠাকুরদার কথাগুলো কেমন আতঙ্কিত করে তুলল আমায়। হঠাৎ মাসুদের জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে। মনে মনে যেন চাইছি। ঠাকুরদা যে কথাগুলো বললেন, সেগুলো যেন মিথ্যে কথা হয়। নিজের অজান্তেই কখন ঠাকুরদার সঙ্গে মাসুদের তুলনা করে চলেছি আমি। ভেসে উঠছে মাসুদের মুখ। কি সুন্দর গান গায় সে! কত পবিত্র তার হাসিটা! কলকল স্রোতে নদীর বয়ে চলার মতো সেই হাসির আওয়াজ! কই? আমার ঠাকুরদাকে তো আমি কখনো হাসতে দেখিনি!

—“মাসুদ কেন তার জমি বিক্রি করেছিল?”

—“নারী”

ঠাকুরদা এমনভাবে শব্দটা উচ্চারণ করল যেন মনে হলো ‘নারী’ ভয়ানক কিছু একটা।

—“মাসুদের অনেকগুলো বিয়ে। সে যতবার বিয়ে করেছে, ততবার আমার কাছে জমির কিছু অংশ বিক্রি করেছে।”

আমি মনে মনে মাসুদের বউয়ের সংখ্যা গুনতে থাকলাম। ৯০টা তো হবেই। কিন্তু হঠাৎ মনে পড়ল, মাসুদের তিনজন বউকে তো আমি দেখেছি! কী দরিদ্র দশা তাদের! ছেঁড়া কাপড়, খোঁড়া গাধা আর শত দীর্ণ জেলাবা। এমন সময় দেখতে পেলাম মাসুদ আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। ঠাকুরদা ও আমি একে অপরের দিকে তাকালাম।

—“খেজুর পাড়া হবে আজ। আপনি আসবেন না?”

 আমার যেন মনে হলো মাসুদ চায় না ঠাকুরদা যাক। কিন্তু ঠাকুরদাকে দেখলাম তিনি প্রায় লাফ মেরে উঠে দাঁড়ালেন। তার চোখ দুটো মুহূর্তের মধ্যে জ্বলজ্বল করে উঠল। আমার হাত ধরে ঠাকুরদা এগিয়ে চললেন মাসুদের খেজুর গাছগুলির জমিতে।

কেউ একজন ঠাকুরদাকে একটা টুল এগিয়ে দিল। ষাঁড়ের চামড়া দিয়ে তৈরি সে টুল। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। প্রচুর লোক সেখানে। আমি প্রায় সবাইকে চিনি। কিন্তু, আমার চোখ মাসুদের দিকে। সবার থেকে আলাদা হয়ে এক কোণে দাঁড়িয়ে সে। যদিও তারই খেজুর সব। কিন্তু তার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। মাঝে মাঝে অবশ্য তাকাচ্ছে গাছের দিকে, তবে ঠিক তখন, যখন অনেক উঁচু থেকে খুব জোরে খেজুরের থোকাগুলো মাটিতে পড়ছে। যে ছেলেটা লম্বা ছুরি দিয়ে একের পর এক খেজুরের থোকা কেটে চলেছে, হঠাৎ তার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল মাসুদ

—“সতর্ক হও। খেয়াল রাখ। হৃদয়টাকে কেটে ফেল না।”

মাসুদের কথাটা যেন হাওয়ায় ভেসে থাকল। কেউ তোয়াক্কাই করল না। ছেলেটি সমান জোরে একের পর এক থোকা কেটেই চলল। এতটা উপর থেকে পড়ছে সেগুলো যেন মনে হচ্ছে আকাশ থেকে নেমে আসছে সব। আমার কানের ভিতর বেজে চলেছে মাসুদের সেই আর্তনাদ। হৃদয়। হৃদয়ের ধুকপুকুনির শব্দ। খেজুর গাছের হৃদয়…একদিন আমি একটা ছোট খেজুর গাছের ডালপালা নিয়ে খুব খেলছিলাম। সেই সময় মাসুদ আমায় দেখতে পেয়ে বলেছিল

—“মানুষের যেমন কষ্ট হয়, আনন্দ হয়, ব্যথা লাগে। খেজুর গাছেরও ঠিক তেমনই আনন্দ হয়, কষ্ট হয়, ব্যথা লাগে।”

কথাগুলো মনে পড়তেই যেন খেজুর গাছগুলোর ধুকপুকুনি শুনতে পেলাম আমি। লজ্জায় কুঁকড়ে গেল শরীরটা।

ফিরে তাকালাম মাঠ ভর্তি খেজুরের থোকাগুলোর দিকে। সেখানে তখন পিঁপড়ের মতো লোকের ভিড়। তারা খেয়েই চলেছে একের পর এক। স্তূপাকৃতি খেজুর সেখানে পড়ে। লোকেরা একে একে থলি ভর্তি করতে শুরু করল। এক-দুই-তিন-চার…ত্রিশখানা থলে। ভিড় এখন আর নেই। শুধু দাঁড়িয়ে রয়েছে ব্যবসায়ী হুসেন, আমাদের জমির পূর্ব দিকের অংশের মালিক মুসা এবং আরো দুজন লোক। এই দুজনকে আমি চিনি না। ঠাকুরদা ঘুমিয়ে পড়েছেন। হালকা নাক ডাকার শব্দ শোনা যাচ্ছে। আর ওদিকে, মাসুদের দিকে তাকিয়ে দেখি, তার হাবভাবে কোনো পরিবর্তন নেই। একটা খড়ের শিষ চিবিয়ে চলেছে একজন অসহায় সর্বহারা মানুষ।

ঘুম ভাঙল ঠাকুরদার। উঠেই তিনি এগোতে থাকলেন খেজুরের থলেগুলোর দিকে। পিছন পিছন হুসেন, মুসা এবং আরও দু’জন। মাসুদও আসছে সেদিকেই। খুব মন্থর সে গতি। যেন মনটাকে পা দিয়ে ঠেলে ঠেলে নিয়ে আসছে কেউ। থলেগুলোর চারপাশে গোল হয়ে চলল পর্যবেক্ষণ। দু-একটা মুখে পুরে তার স্বাদও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলো। আমার হাত ভরে গেল খেজুরে। ঠাকুরদা দিলেন। আমি খাচ্ছি। মাসুদ কী করছে? দুহাত ভর্তি খেজুর নাকের একদম কাছে এনে প্রাণ ভরে তার ঘ্রাণ নিচ্ছে মাসুদ। আর তারপর, সেগুলো আবার ফিরিয়ে দিচ্ছে থলের ভিতরে। শুরু হলো ভাগাভাগি। হুসেন নিল দশখানা থলে। মুসা নিল পাঁচখানা। বাকি দুজন ব্যক্তি মাথাপিছু নিল পাঁচখানা করে। আর আমার ঠাকুরদা নিল পাঁচখানা থলে। মাসুদের শূন্য দুটো হাত, দিশেহারা দৃষ্টি, বেশ বোঝা যাচ্ছে, হিসেবটা সে একেবারেই বোঝে না। ঠাকুরদা থলেগুলো তুলে নিতে নিতে জানালেন

—“এখনো পঞ্চাশ পাউন্ড ধার বাকি আছে তোমার। আমি পরে এ নিয়ে কথা বলছি।”

হুসেনের সহকারী এসে থলেগুলো চড়িয়ে দিল গাধার পিঠে। ওই দুজন ব্যক্তি উট এনেছে। তাদের পিঠেও চাপল থলের বোঝা। চেঁচিয়ে উঠল একটা গাধা। ব্যথার অভিযোগ শোনাল একটা উটও। ঠিক জানি না কখন, মাসুদের একেবারে পাশে সরে এসেছি আমি। আমার হাত দুটো ওর স্পর্শ খুঁজছে যেন। মাসুদ কাঁদছে। কান্নার ভেতর কেমন একটা চিৎকার। ঠিক যেমন পাঁঠা কাটার সময় হয়, তেমন। আমার বুকের ভিতরটা এত ব্যথা করছে কেন? আমি দৌড়ে সেখান থেকে সরে আসি খানিকটা। ঠাকুরদা ডাকছে। অস্বস্তি হচ্ছে। তবুও এগিয়ে গেলাম সেই দিকে। সেইসময় হঠাৎ আমার মন বলে উঠল, ভালোবাসা নয়, ঠাকুরদাকে তুমুল ঘৃণা করি আমি। তবে আমি বুদ্ধিমান। লুকিয়ে রাখব সেই অনুভূতি।

ধীরে ধীরে একা, একলা হয়ে এগিয়ে চললাম আমার পছন্দের নদীর কাছে। তীরে বসে আঙুল ঢোকালাম গলার ভিতর। সবটুকু-সবটুকু খেজুর বেরিয়ে না আসা পর্যন্ত আমি শান্তি পাচ্ছি না।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত