Homeসাহিত্যআলিফা রিফাতের ‘ঘোবাশিদের বাড়ির ঘটনা’

আলিফা রিফাতের ‘ঘোবাশিদের বাড়ির ঘটনা’


আলিফা রিফাত (১৯৩০-১৯৯৬) মিশরের নারীদের জীবন, যৌনতা, ও ধর্মীয় অনুশাসন নিয়ে লিখেছেন। তার ছোটগল্প সংকলন ‘Distant View of a Minaret’ নারী-পুরুষের সম্পর্ক, ইসলামী সমাজের সাংস্কৃতিক বিধিনিষেধ ও নারীদের নানান অভিজ্ঞতা তুলে ধরে। তার লেখায় নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থাকলেও তিনি ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধাশীল দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রেখেছেন।

ছাদের ওপর লাল মোরগের ডাকে জিনাতের গাঢ় ঘুম ভেঙে গেল। ছাদের নিচে ঘুমাচ্ছিল সে। ঘোবাশিদের বাড়িটা গ্রামের একেবারে শেষ মাথায়। বাড়ির সামনের বিস্তৃত মাঠ নিকটবর্তী নদী আর রেললাইনে মিশেছে। 

লাল মোরগের ডাকের জবাব পাওয়া গেল আশেপাশের বাড়িগুলোর ছাদ থেকে। এরপর মোরগগুলো সম্মিলিত কলরব থামিয়ে দিল। তুঁত জঙ্গলের ভিতরের উঁচু মিনার থেকে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠ ভেসে এল— “ঘুমের চেয়ে নামাজ উত্তম।”

দুপাশে গাদাগাদি করে শুয়ে থাকা ছেলেমেয়েদের শরীরের উপর জিনাত হাতে বোনা কালিম টেনেটুনে ঠিকঠাক করে ঢেকে দিল। এবার সে বড় মেয়েটার কাঁধ ধরে ঝাঁকালো, “সকাল হয়ে গেছে, খোদার আরেকটা সকাল। নাইমা ওঠো, আজ হাঁটবার”

নাইমা গড়িয়ে চিত হলো। অলসভাবে আড়মোড়া ভাঙল। যেন হঠাৎ ঝটকা বাতাসের ঝাপটায় চমকে গিয়ে জিনাত চোখের সামনে ছড়িয়ে থাকা মেয়ের চেহারা খুটিয়ে দেখতে লাগল। নাইমা উঠে ধাতস্থ হলো। উরুর উপর জেলাবা টেনে দিল। নাইমার মুখটা গোলগাল। গালের হাড়ের গড়ন চমৎকার, ঘুমে আচ্ছন্ন চোখ দুটো ঘষল ও।

“তুমি বাজারে বেচার জন্য ভূট্টা নিয়ে যেতে পারবে মেয়ে, নাকি তোমার ভূট্টার ওজন তুলতে কষ্ট হবে?”

“অবশ্যই মা। তাছাড়া আমি ছাড়া এখানে আর কে আছে যে বাজারে যাবে?”

জিনাত পা টেনে টেনে উঠানের দিকে গেল। ওখানে সে অজু করল। নামাজ পড়ল। বসে থেকে আঙুল গুণে গুণে দোয়া পড়ল। বুঝতে পারল নাইমা ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। মুখ ঘোরাল, বলল— এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? গিয়ে চা বানাচ্ছ না কেন?”

জিনাত কোণের দিকে গেল। ঘোবাসি বস্তা ভরে ভরে ভূট্টা দানা মজুত করে রেখেছে। সে ভূট্টাগুলোকে পরিবারের খাবার হিসাব রেখে গিয়েছিল। একবছরের মেয়াদে চাকরি নিয়ে লিবিয়া গেছে সে। উড়োজাহাজের টিকিট নেয়ার পর করেছিল ওদের খাবার ব্যবস্থা।

“সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয়ই দূরে থাকার সময়েও তোমাকে নিরাপদে রাখবেন।” বিড়বিড় করে বলল সে। দুই ঊরুর মাঝে ভূট্টা মাপার কৌটা নিয়ে সে একটা বস্তার সামনে গোড়ালি উপর ভর দিয়ে বসল। মাপার কৌটাটা ভর্তি না হওয়া অবধি সে দুইহাত দিয়ে শস্যদানা তুলল। এরপর সে কৌটাটা একটা ঝুড়ির মধ্যে ঢেলে দিল। মুখের দিকে উড়ে আসা ভূট্টার ধুলায় দমবন্ধ হয়ে কাশি পেলো ওর, হাত নাড়িয়ে ধুলা সরিয়ে দিল। এরপর সে নিজের কাজ চালিয়ে গেল।

মেয়েটা বড় মাটির জালার দিকে হেঁটে গেল। জালার মুখের কাঠের ঢাকনাটা সরাল। মগ ডোবালো। মুখে পানি ছিটাল; আঙুলের ডগাগুলো ডুবিয়ে বেণি ঠিক করল, এরপর মাথায় রুমাল বেঁধে নিল। সে তার মায়ের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল—

“অনেক হয়েছে, তাই না মা? আমাদের এখন এই টাকা-পয়সার দরকার পড়ল কেন?”

জিনাত দুহাতের তালু দিয়ে দু-হাঁটুতে আলতো করে চাপড় দিয়ে ধুলো ঝাড়ল। মাথাটা সোজা করল।

“হামদানের বেতন দিতে হবে না? —নাকি সে বিনা পয়সায় আমাদের জন্য শিম চাষ করে দিয়েছে, এতো খাটনি করেছে শুধু মজা নেবার জন্য?”

নাইমা ঘুরে দাঁড়িয়ে জানালার তাক থেকে চুলা নামালো, ভূট্টার পরিত্যক্ত মোচাগুলো একটার উপর আরেকটা দিয়ে পিরামিডের মতো করে সাজাল, চুলায় আগুন দিল। চুলাটাকে মায়ের পাশে রাখল, মাটির জালা থেকে পানি এনে চায়ের পটটা ভরল এবং ওটাকে ঠেসে আগুনের মধ্যে বসিয়ে দিল। মায়ের পাশে হাঁটু ভাঁজ করে দু-পায়ের উপর বসল। দুজন নীরবে বসে রইল। কতক্ষণ পরে জিনাত বলল, “মহিষ বাচ্চা দেবার পর থেকে?”

“বাবা চলে যাবার পর থেকে।”

“তাহলে বলা যায়, উৎসবের খাবারের ঠিক পর থেকে, তাই না মেয়ে?”

নাইমা সম্মতিসূচক মাথা নাড়াল। এরপর সে মাথা নিচু করে ধুলোর মাঝে আঁকিবুকি কাটতে লাগল আঙুল দিয়ে।

“যাও, চা ফুটে ওঠার মধ্যে গিয়ে দেখে এসো মুরগী কতগুলো ডিম পেড়েছে।”

জিনাত আগুনের আলোকোজ্জ্বল শিখার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল। লকলক করে জ্বলতে থাকা আগুনের শিখার দিকে তাকিয়ে সে এক ধরনের প্রশান্তি অনুভব করে। ঘোবাশি চলে গেছে, আর যাবার আগে, বাচ্চাগুলো, ৩৫০ বর্গমিটার জমি এবং মহিষের সব দায়দায়িত্ব তার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে গেছে।

চলে যাবার আগের রাতে সে বলেছিল, “নাইমার দিকে খেয়াল রেখো। মেয়েটা বড় হয়ে গেছে।” তারপর সে তার হাতের তালু তুলে দোয়া করেছিল, “হে সৃষ্টিকর্তা, নবীর সম্মানের দোহাই লাগে, মেয়ের জন্য একটা খাটি রেশমের বিয়ের পোশাকসহ আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে এসো।”তখন জিনাত বলেছিল, “কথাগুলো যেন তোমার ঠোঁট থেকে সোজা বেহেস্তের দরজায় পৌঁছায় ঘোবাশি।”আগামী উৎসবের ভোজের আগে সে ফিরবে না। যখন সে ফিরে এসে পরিস্থিতি এতদূর গড়িয়েছে জানতে পারবে তখন কী হবে?

জিনাত হাতের তালু মাথার দুই পাশে রেখে বাতাস সামলে চুলার ছাইয়ে ফুঁ দিতে থাকল।

নিজের মনে ভাবতে লাগল, “কী অদ্ভুত, আজকালকার মেয়েরা কী ভীষণ। প্রত্যেক মাসের মাসিকের সময় মেয়েটা নিয়ম করে ন্যাকড়া ঝুলিয়ে রাখত, যেন কোনো সর্বনাশই হয়নি। আর এখন তার চারমাস চলছে, কিন্তু কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।”

নাইমা ফিরে এসে ডিম বাঁধা কাপড়টার গিঁট আলগা করল, দুটো ডিম আগুনে দিয়ে বাকিগুলো একটা থালায় রাখল। এরপর সে দুটো গ্লাস আর চিনির কৌটা নিয়ে এলো, এসব রেখে মায়ের পাশে বসল, মা তখনো ভাবনায় ডুবে আছে। আত্মগতভাবে বলল,

“তুমি কোনো উপায় বের করতে পারলে?”

নাইমা অসহায়ের মতো কাঁধ ঝাঁকালো।

“তোমার বাবা চলে গেছেন চার মাস হলো। এখনো কি কিছু করা যায় না?”

“কী লাভ? একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই তোমাকে আমার এই ঝামেলা থেকে বাঁচাতে পারে। মা, এটাই তো ভালো হয়, আমি যদি খাল থেকে কলসি ভরে পানি আনার সময়, আমার পা পিছলে যায় আর সব শেষ হয়?”

জিনাত দুহাত দিয়ে নিজের বুক চাপড়াল এবং মেয়েকে নিজের কাছে টেনে নিল। “এসব বাজে কথা বলো না, শয়তানের প্ররোচনায় কান দিও না। শান্ত হও। তোমার বাবা ফিরে আসার আগে আমাকে এর একটা সমাধান বের করতে দাও।”

জিনাত চা ঢালল। নীরবে চায়ে চুমুক দিল। গ্লাসটা সামনে রেখে ডিমের খোসা ছাড়িয়ে কামড় দিল।

নাইমা মুখোমুখি বসে চায়ের গরম গ্লাস আঙ্গুলে আঁকড়ে ধরে মাকে দেখতে থাকল।

বাইরে থেকে হাঁটবার নিয়ে আশাবাদী ও আগ্রহী মেয়েদের গলা ভেসে আসছে। পুরুষেরা একে অন্যকে কুশল বিনিময় করে মাঠের দিকে যাচ্ছে। এতসব কণ্ঠস্বরের মধ্যে হামদানের উচ্চহাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। সে এই ঘরটার চারপাশে থাকা ৩৫০ বর্গমিটার জমির দিকে মহিষ চড়াতে যাচ্ছে।

জিনাত বিড়বিড় করে বলল— “আল্লাহ তার বিচার করবেন, সে কত ভালো আছে, তার তো দুনিয়ার কোনো দুশ্চিন্তা নেই।”

নাইমা উঠে পড়ল এবং ওড়না দিয়ে মাথার উপর একটা গোলমতো বিড়া পাকালো ভূট্টার ঝুড়ি বয়ে নেবার জন্য। জিনাত ঘুরে দেখল যে মেয়েটা বাজারে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে। মেয়েটার জেলাবা ধরে টেনে তাকে বসিয়ে দিল।

দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শোনা গেল, তাদের প্রতিবেশী, উম-আল-খায়ের ডাকছে—

“আপনাদের সুস্বাস্থ্য কামনা করছি। নাইমা কি অন্যদিনের মতো বাজারে যাবে না জিনাত আপা? নাকি সে ঘুম থেকেই ওঠেনি এখনো?”

“বোন সে তার আত্মীয়দের বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছে।”

“আল্লাহ তাকে ভালোয় ভালোয় ফিরিয়ে আনুন।”

নাইমা কৌতুহলভরে মায়ের মুখের দিকে তাকাল, এর মধ্যে জিনাত মেয়ের মুখ চেপে রেখেছিল।

যখন উম্মে-আল-খায়েরের পায়ের আওয়াজ দূরে সরতে সরতে মিলিয়ে গেল, নাইমা ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি কী করতে চাইছ মা? তুমি আমাদের কোন আত্মীয়ের কথা বলছ?”

জিনাত উঠে গিয়ে নিজের কাপড়ের বাক্স হাতড়ে কিছু টাকা বাঁধা একটা রুমাল বের করে আনল, সঙ্গে কিছু পুরোনো রদ্দি কাপড়। টাকাগুলো নাইমার হাতের তালুতে রেখে নিজের হাত দিয়ে মেয়ের আঙ্গুলগুলো আলতো চেপে মুঠি বন্ধ করে দিল।

“এগুলো নাও— আমার সারাজীবনের সঞ্চয়।”

আবার বলল, “তোমার কাপড়চোপড় গোছাও, সোজা স্টেশনে গিয়ে কায়রোগামী টিকিট কাটো। কায়রো বিশাল শহর মেয়ে, ওখানে তুমি নিরাপত্তা খুঁজে পাবে এবং আল্লাহ তোমার প্রসবের সময় হওয়া পর্যন্ত কোনো না কোনোভাবে বাঁচিয়ে রাখবেন। এরপর গভীর রাতে কেউ যেন তোমাকে না দেখে ফেলে বা টের না পায় সেভাবে ওটাকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এসো।”

জিনাত নিজের জেলাবা তুলে দাঁতে আটকে রাখল। পুরোনো কাপড়গুলো নিয়ে নিজের তলপেট ও কোমরে পেঁচাতে লাগল।

নাইমা তার অদ্ভুত অবস্থা দেখছে।

“আর বাবাকে আমরা কী বলব?”

“এখন কথা বলার সময় নয়। স্টেশনে যাবার আগে এই ঝুড়িটা তুলতে আমাকে সাহায্য কর, যেন আমি বাজারে যেতে পারি। লোকজন আমাকে পোয়াতি অবস্থায় দেখতে পায়। যখন তোমার বাবা প্রবাস থেকে ফিরে আসবে, অবৈধ নাতির চেয়ে নিজের বৈধ ছেলের মুখ দেখাটাই তখন ভালো হবে, তাই নয় কি?” 

* জেলাবা : মাথায় টুপিওয়ালা হাঁটুর নিচ ও কব্জি পর্যন্ত লম্বা আলখাল্লা।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত