Homeসাহিত্য‘আয়না’ শিল্পী আবুল মনসুর আহমদ

‘আয়না’ শিল্পী আবুল মনসুর আহমদ


বাংলাদেশের জনজীবন ও সমাজ-সংস্কৃতি আবুল মনসুর আহমদের রচনার প্রধান বিষয়। বাংলাদেশের ভৌগোলিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করেই তিনি এদেশের বেশিরভাগ মানুষের কল্যাণ-চিন্তা ও কল্যাণ-আকাঙ্ক্ষায় নিয়োজিত থেকেছেন।

তার বিখ্যাত গল্পগ্রন্থ ‘আয়না’ বাঙালি মুসলমান জনগোষ্ঠীর সমাজ জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। ১৯২২ থেকে ১৯২৯ সালের মধ্যে এই গল্পগুলো রচিত। আবুল মনসুর আহমদ এ বিশ্বাসে স্থির ছিলেন, ‘সাহিত্য মানেই জীবনভিত্তিক সাহিত্য, জীবন মানেই জনজীবন।’[আবুল মনসুর আহমদ, আত্মকথা] আর এই জনজীবন হচ্ছে স্বকাল ও স্বসমাজের জনজীবন।

ভাষা একজন সাহিত্যিকের প্রধান ঐশ্বর্য। যে ভাষা-সম্পদ আবুল মনসুর আহমদের হাতে সহজসাধ্য ছিল। তিনি জানতেন ভাষার ম্যাজিক, ভাষার ক্যালকুলাস। একটি সচল ভাষারীতি তিনি সহজেই রপ্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যা তার স্বকীয়তায় উজ্জ্বল। আঙ্গিক কুশলতায়ও ঋদ্ধ।

এক অস্থির ও অনিকেত সময়ে সাহিত্য জগতে আবুল মনসুর আহমদের আবির্ভাব। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বাংলাদেশের বাঙালি মুসলমান জনগোষ্ঠীর সত্তার অন্বেষণ উনিশ ও বিশ শতকের প্রথমদিকে ছিল অনেকটাই পথভ্রষ্ট। ইতিহাসের নানা পর্বে বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মুসলমান নিজেকে আবিষ্কারে সচেষ্ট ছিল, অস্তিত্বের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছিল। এদেশের মুসলমান বারবার স্থির ও স্থিত হতে চেয়েছে। আবুল মনসুর আহমদের চিন্তা ও সাহিত্যচর্চার গোড়াপত্তন ঘটে সেই অস্থির সময়কালেই।

‘আয়না’গল্পগ্রন্থটি ওই সময়ের বাঙালি মুসলমান সমাজকে অধ্যয়ন করার যথেষ্ট সুযোগ করে দেয়। ‘আয়না’য় অস্থির, বিপথগামী, অব্যবস্থিত, সুযোগ সন্ধানী, প্রতিষ্ঠা পাগল, অস্তিত্ব সংকটে বিপন্ন ও অসহায় মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে। তারা ফিতনা-ফ্যাসাদ, কোলাহল-ক্যাওয়াজে নিমজ্জিত। তাদের মধ্যে পরস্পর-বিরোধী কর্মকাণ্ডের যথেষ্ট উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। একটু অভিনিবেশ সহকারে প্রত্যক্ষ করলে স্পষ্ট হবে, ‘আয়না’র প্রধান চরিত্রসমূহ, বিশেষত শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত চরিত্রসমূহ খুব বেশি অস্থির, দিকভ্রান্ত ও উদ্‌ভ্রান্ত। আধুনিক পাশ্চাত্য জীবন-যাপনে ও শিক্ষায় তারা কোনোভাবেই স্থির ও থিতু হতে পারছে না। তারা নানামাত্রিক অস্থিরতায় আক্রান্ত। উদাহরণ হিসেবে আমরা উল্লেখ করতে পারি, ‘হুজুর কেবলা’ গল্পের এমদাদ, ‘বিদ্রোহী সংঘ’গল্পের নায়ক এবং ‘লীডার-কওম’ গল্পের ইসমাইলকে। চরিত্রগুলো অস্বচ্ছ, অস্তিত্ব-সংকটে বিপন্ন। এসব চরিত্রসমূহ নিজেরা নিজেদেরকেই বুঝে উঠতে পারছে না। তারা কোথায় যেন একটা অবলম্বন খুঁজছে। কিন্তু পাচ্ছে না। তারা আবার আস্থা ও বিশ্বাসের সংকটেও ভোগে। তাদের কেউ কেউ অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থেকেও কোথায় যেন আত্মবিশ্বাসের অভাব, আত্মশক্তির অভাব এবং মনের কম জোর অনুভব করে।

আবুল মনসুর আহমদের গল্পের চরিত্রসমূহ কেউ হানাফ-মোহাম্মদী, কেউ আহলে হাদিস-হানাফি, কেউ মাইনর স্কুল-মাদ্রাসার মাস্টার-মৌলভি। এ-সমস্ত চরিত্র নানা বাইনারির ফাঁদে পড়ে দিকভ্রান্ত, দিশেহারা, অস্থির, বিদীর্ণ। বাঙালি মুসলমান সমাজের কুসংস্কারাচ্ছন্নতা, উন্মুল ও অনিকেত অবস্থাকে যোগ্যতার সঙ্গে ‘আয়না’র বিভিন্ন গল্পে উপস্থাপন করেছেন তিনি। তিনি দেশ-কাল-পাত্র, পরিবেশ-পরিস্থিতির প্রণোদনায় রচনা করলেও বিশুদ্ধ নান্দনিক প্রযত্ন তার ‘আয়না’গ্রন্থে গুঁজে দিয়েছে শিল্পিত পালক। ‘আয়না’ গ্রন্থে সমাজচেতনা ব্যক্তির প্রেক্ষণী থেকে সমাজ, দেশের, মনুষ্যত্বের ও মানবতার প্রেক্ষণীতে প্রদিক্ষণমুখর ও শিল্পজাগর।

সাতটি গল্পের সংকলন ‘আয়না’১৯৩৫ সালে প্রকাশিত হয়। আবুল মনসুর আহমদের ‘হুজুর কেবলা’ গল্পে পরশুরামের প্রভাব সহজেই লক্ষ্য করা যায়। পরশুরামে রহস্যের মাত্রা বেশি, বিষাদের মাত্রা কম। ‘আয়না’র সব গল্পেই সংকীর্ণতা-অজ্ঞতা-অন্ধতা-শঠতার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। আবুল মনসুর আহমদ সমাজের সংস্কার প্রত্যাশা করেছেন। সংস্কারের ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করে দেখিয়ে দিয়েছেন বিভিন্ন গল্পে, কিন্তু তা শিল্পকে ছাড়িয়ে যায়নি।

আবুল মনসুর আহমদের জীবন ও চিন্তার ক্রমবিকাশ সম্পর্কে যারা অবহিত, তাদের কাছে অজানা নয় যে,‘আয়না’র গল্পগুলো বাঙালি মুসলমান চরিত্র অঙ্কনের পাশাপাশি লেখকের ব্যক্তিগত জীবনের অস্থিরতা যেন একই মোহনায় এসে মিলিত হযয়েছে। বিজ্ঞজনের মতে, বাঙালি মুসলমান সমাজের ঘরে ফেরার কাল ত্রিশ ও চল্লিশের দশক। সে সময় প্রশস্ত হতে থাকে পাকিস্তান আন্দোলনের পথ এবং আন্দোলন যত গতি পেতে থাকলো, ততই বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি রাজনীতির দিকে অগ্রসর হতে থাকলো। নিজেদের জন্যে আলাদা একটি রাষ্ট্রের প্রয়োজন অনুভব করলো। আলাদা রাষ্ট্র দরকার? বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি তখন এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একবার অতীতের দিকে, ইতিহাসের দিকে তাকাতে থাকে, আর একবার বর্তমানে নিমজ্জিত হতে থাকে। বাঙালি মুসলমান তিলে তিলে অনুভব করলো নিজেদের বঞ্চিত হওয়ার বিষয়ে। তাদের সামনে ভেসে উঠলো বঞ্চনা ও আত্মবিস্মৃতির ইতিহাস। বাঙালি মুসলমান তখন নিজের দিকে তাকিয়ে নিজের স্বকীয়তা আবিষ্কার করতে চাইলো। তারা সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জোরদার হতে থাকলো। এসবের ভেতর দিয়েই বাংলাদেশের বাঙালি মুসলমান জনগোষ্ঠী নিজেদের সংজ্ঞায়ন করার চেষ্টায় সক্রিয় হয়ে উঠলো। এরই বড় আর আনুষ্ঠানিক নাম ‘পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ’। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে এই জাতীয়তাবাদ নির্ধারিত হয়েছে বলে মনে হলেও অন্তরালে সব চেয়ে বড় যে অর্থনৈতিক আর স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপার কার্যকর ছিল, তা ইতিহাসে গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়নি।

কাজী নজরুল ইসলাম ‘আয়না’র ভূমিকা লিখেছিলেন। সে ভূমিকার নাম দিয়েছেন ‘আয়নাফ্রেম’। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন- ‘এমনি আয়নায় শুধু মানুষের বাইরের প্রতিচ্ছবিই দেখা যায় কিন্তু আমার বন্ধু শিল্পী আবুল মনসুর যে আয়না তৈরি করেছেন, তাতে মানুষের অন্তরের রূপ ধরা পড়েছে। যে সমস্ত মানুষ হরেক রকমের মুখোশ পরে আমাদের সমাজে অবাধে বিচরণ করছে, আবুল মনসুরের ‘আয়না’র ভেতরে তাদের স্বরূপমূর্ত্তি বন্য ভীষণতা নিয়ে ফুটে উঠেছে।’

‘আয়না’ গ্রন্থে তিনি বাঙালি মুসলমান সমাজের ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনের মূঢ়তা নিয়ে রঙ্গ-ব্যঙ্গ করেছেন। ব্যঙ্গ রচনায় তিনি অযুত সাফল্য লাভ করেছেন। একজন শ্রেষ্ঠ ব্যঙ্গকার হিসেবে আবুল মনসুর আহমদ স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

আবুল মনসুর আহমদের ‘আয়না’র প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও পরিহাসপ্রিয়তা, তবে তা নিছক পরিহাস নয়।

সমসাময়িক পটভূমি নিজেই ‘আয়না’ গ্রন্থটি রচিত। আবুল মনসুর আহমদের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, সরস ভাষা, চরিত্র রূপায়ণে মুন্সিয়ানা ও অপূর্ব কৌশল, ঘটনার বর্ণনায় নাট্যকৌশল অবলম্বন, সমাজ সমীক্ষণের কারণে ‘আয়না’গ্রন্থটি বিশেষভাবে অতুলনীয়।

সাহিত্যকে ‘Interpretation of life’ বা মানব জীবনের জীবনভাষ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই আবুল মনসুর আহমদের ‘আয়না’ নিঃসন্দেহে ব্যঙ্গ-রসাত্মক গল্পগ্রন্থ হিসেবে সফল। তার তীর্যক ভাষা ও ভাষা শৈলীর কারণে ‘আয়না’ পাঠককে ঋদ্ধ করে।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত