Homeসাহিত্যআমা আতা আইদুর ‘দক্ষিণের দমকা হাওয়া’

আমা আতা আইদুর ‘দক্ষিণের দমকা হাওয়া’


আমা আতা আইদু (জন্ম: ১৯৪০) ঘানার অন্যতম সাহিত্যিক ও নাট্যকার। তিনি আফ্রিকান নারীবাদী সাহিত্যের অন্যতম পথপ্রদর্শক। তার বিখ্যাত নাটক ‘Anowa ও Dilemma of a Ghost’ ঘানার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে নারীর ভূমিকা এবং উপন্যাস ‘Our Sister Killjoy’ আফ্রিকান অভিবাসী নারীদের অভিজ্ঞতা ও পশ্চিমা উপনিবেশবাদের প্রভাব নিয়ে রচিত। এছাড়াও তার ছোটগল্প সংকলন ‘No Sweetness Here’ আফ্রিকার সাধারণ মানুষের জীবনের বাস্তবতা তুলে আনে। তিনি ঘানার শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন।

ম্মা আসানা কোলা-বাদামগুলোর দিকে কিছুক্ষণ এক দৃষ্টে তাকিয়ে একবার থুক করে ছনের ঝুড়িটা তুলল। আবার ঝুড়িটা নিচে রাখল। এবার একটা বাদাম তুলে তাতে একটু দাঁত বসাল। বাদামটা ফেলে দিয়ে আবার থুক করল এবং কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। প্রথমে মনে হলো বাম কানের নিচ থেকে একটা তীক্ষ্ণ ব্যথা উপরের দিকে উঠে আসছে। তারপর তার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে গেল।

‘ঐ গাছগুলো আমাকে আরো দেখতে হবে’— সে ভাবল। মনে হলো চোখ দুটোর ঝাপসা হয়ে যাওয়াটা হয়ত বাতাসের ঠান্ডা ঝাপটার কাজ। মাথা নুইয়ে আবার বাদামগুলো দেখতে লাগল।

‘কখনোই বোঝা যায় না কোন শনির চোখ এই ভূমির ওপর লেগে যায়। যাক গে, এই পোড়া কপালের কামাই তাড়াতাড়ি তুলে নিতে হবে’।

বাড়ি ফেরার পথে সে তাকাল সেই ঘুটঘুটে গোলাকার ছায়ার মতো জায়গাটার দিকে যেখানে আগে কোলা-বাদাম রাখার খোড়লটা ছিল। আগের দিনে বছরের এই সময়টায় এ খোড়লগুলো জমানো বাদামে ফেটে পড়ার অবস্থা হতো। এগুলোর দিকে তাকালে তখন তেমন আনন্দের শিহরন হতো যেমন এক স্বামীর হয় তার নয় মাসের পোয়াতি বউয়ের পেটের দিকে তাকালে।

পোয়াতি আর আঁতুড়ঘর আর মৃত্যু আর যন্ত্রণা; আবার মৃত্যু…পোয়াতি নেই, তো জন্মও নেই আর মৃত্যুও নেই। তবে মৃত্যু একটাই যা সর্বত্র বিস্তৃত আর বেদনাও একটাই যা সর্বত্র বিস্তৃত।

বোন আমার, পারলে আমাকে একটা নতুন মৃত্যু দাও, আমি তোমাকে কান্নার কিছু আলাদা পানি দেব।

তার পেটের খোড়লটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে বোধ হলো, বাচ্চার থলিটা নড়ে উঠল এবং তাকে দরজার কাছে ঠেস দিয়ে বসে পড়তে হলো। কুড়িটা বছরে ফুসেনিই একমাত্র পেটে আসা সন্তান এবং একটাই জন্ম এই ঘরে। কুড়িটা বছরে প্রথম একটা বাবু আর সেটা ছেলে-বাবু। পুরোনো দিন হলে এমন বাচ্চা-বিয়ানো বউকে হরিণের মাংস খেতে দিলেও সেটা যদি প্রমাণ সাইজের চিত্রল হরিণের সুস্বাদু মাংস না হয়ে ডুইকার জাতের হতো তাহলে ডুইকারের রুঠা মাংস খেতে দেয়ার কারণে এটি বকার যোগ্য কাজ হতো। কিন্তু আজ হতচ্ছাড়া শিকারিরা সরকারের রিজার্ভ ফরেস্ট থেকে পর্যন্ত প্রমাণ সাইজের চিত্রল হরিণ দূরে থাক, ডুইকারগুলোও শেষ করে দিয়েছে। তাদের লোভের বলি হয়ে আজ ডুইকারগুলো পর্যন্ত দক্ষিণের রুচিবান গালের লোকমা হতে চলে গিয়েছে। 

সে আর কতদিন বা আগের কথা! সময় যে কীভাবে চলে যায়! বয়স যে কীভাবে চড়াও হয়! বয়স ঝেড়ে ফেলার আর কি কোনো সুযোগ নাতির মুখ ঘরে আসার পরে সম্ভব? নাতির মুখের জন্য আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া।

সে যখন ঘরে পৌঁছাল তখনো আগুনটা ভালোই জ্বলছে। ম্মা আসানা কোলা বাদামের ঝুড়িটা রাখল। ঘরের কোনের দিকে গলা বাড়িয়ে একবার দেখল। গাছের গুঁড়ির লাকড়ি যেটুকু আছে তাতে পরের সপ্তাহ পর্যন্ত চলে যাবে। সন্ধ্যার বাকিটা সময় সে ঠিক করতে থাকল পরের দিন বাজারে বিক্রির জন্য কী কী নেয়া যাবে।

মাগরিবের নামাজ শেষ হয়েছে। টাকাকড়িটুকু ঝুলিটায় রক্ষিত আছে। পুরো তৃণভূমিটা নিথর পড়ে আছে। হাওয়া ও ফুসেনি দুজনই ঘুমাচ্ছে। ম্মা বাহির ঘরের মূল দরজাটার কাছে আসল। দেখল বাইরের সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা। দরজাটা ভেজিয়ে দিল। কোনো মানুষ দেখা যাচ্ছে না, তবে শুকনো ঘাসের ওপর খসখসে পায়ের আওয়াজ এদিকটায় আসছে মনে হলো। ম্মা কান পাতল।

‘যদি হতো যে আমার হারিয়ে যাওয়া ঘরের লোকটা আসছে!’

অবশ্যই এটা তার হারিয়ে যাওয়া স্বামী নয়।

‘কে?’

‘আমি, আম্মা।’

‘বাবা, ঈসা?’

‘জি, আম্মা।’

‘ওরা তো ঘুমিয়ে পড়েছে।’

‘সেই ভেবেই আমি এখন আসলাম।’

তাদের কথা আর এগোচ্ছিল না কারণ তাদের মনের মধ্যে এ বিষয়ে একটি দ্বিধা চলছিল যে, জামাইর এই মুহূর্তে তার স্ত্রী হাওয়া ও পুত্র ফুসেনির কাছে যাওয়া ঠিক হবে কিনা। কেউ এ নিয়ে কথা বলছিল না, তবে বলার বাইরেই এটি বোঝা যাচ্ছিল। 

শাশুড়ি ম্মা আসানা বুঝলো দ্বিধার যুদ্ধে জামাইয়ের মনোবলের জয় হয়েছে অর্থাৎ সে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা বুঝেই শাশুড়ি ঘরের দরজাটা খুলে বের হলো এবং পিছনে জামাই ঈসাও বের হলো। তবে তারা হেঁটে হেঁটে অনেকদূর গেল না। বাড়ির বহির্দেয়ালের দুটো খুঁটির মাঝদিয়ে এক কোণায় গিয়ে দাঁড়াল। জামাইয়ের পিঠটায় একটু আরামের ঠান্ডা পায় ভেবেই এখানটায় গিয়ে দাঁড়ানো।

‘আম্মা, বাবা ফুসেনি ভালো আছে?’

‘হ, বাবা. ভালো আছে।’

‘আম্মা, ঠিক করে বলেন, বাবা ফুসেনির কোনো সমস্যা নেই তো?’

‘আরে বাবা, এত দুশ্চিন্তা করছ কেন? জন্মের পর দশ দিনও যায়নি। কেমনে বলব যে তার কোনো সমস্যা নেই। একটা তাজা-তাওয়ানা বড় মানুষও যদি নতুন একটা জায়গায় যায়…’

‘আম্মা।’

‘বল।’

‘না, কিছু না।’

‘বাবা, আমি তোমাকে কেমন যেন দেখছি আজ… ধর, তুমিও যদি এই বয়সে আরেকটা জায়গায় যাও, তুমি কি দুয়েকদিনের মধ্যেই বলতে পার যে, সে জায়গাটায় পুরো তোমার মানিয়ে গেছে, তুমি খুব ভালো আছ?’

‘না, তা তো বলা যায় না।’

‘তোমার কি সেখানকার খাবার দাবারের সাথে মানিয়ে নিতে কিছু সময় লাগবে না? তোমাকে কি সেখানে কিছু সময় নিয়ে দেখতে হবে না কোথায় ভালো পানি পাওয়া যায়, তোমার জন্য এবং তোমার ভেড়া-বকরিদের জন্য?’

‘জি, আম্মা।’

‘তাহলে ফুসেনির ব্যাপারে তুমি কীভাবে জানতে চাচ্ছ যে তার কোনো সমস্যা আছে কিনা? তার কাটা নাভিটা তাড়াতাড়িই ঠিক হচ্ছে। কেনই বা হবে না? আমি আল্লাহর রহমতে জীবনে যত নাভি কেটেছি কোনোটিতেই ইনফেকশন হয়নি। আমার নাতির নাভি কি আমি এমনভাবে কাটব যে তাতে ইনফেকশন হবে আর আমি তা চেয়ে চেয়ে দেখব? তবে তার খৎনাটার বিষয়ে আমি বলতে পারব না। মালাম ওটা খুব যত্নের সাথে করেছে। সুতরাং ওটাও খুব শিগগিরই ঠিক হয়ে যাবে। খৎনা থেকে ইনফেকশন হওয়ার ঘটনা তোমাদের বংশে নেই তো, তাই না?’

‘না, আম্মা, নেই।’

‘তাহলে চিন্তা কীসের এত? ফুসেনি অবশ্যই ভালো আছে, তবে কতখানি ভালো আছে সেটি আরো কিছুদিন পরে পুরোটা বোঝা যাবে।’

‘জি আম্মা। আম্মা?’

‘বল।’

‘আমি দক্ষিণে যাচ্ছি।’

‘কোথায় যাচ্ছো?’

‘দক্ষিণে।’

‘কতদূর?’

‘একেবারে সাগর অবধি। আমার মনে হয় আপনি ব্যাপারটা বুঝবেন।’

‘আমি কি কিছু বলেছি?’

‘না, বলেননি।’

‘তাহলে কেন আমার বোঝার কথা বলছ?’

‘দুঃখিত, ঠিক হয়নি।’

‘কী করবে সেখানে?’

‘কিছু একটা কাজবাজ খুঁজব।’

‘কী কাজ?’

‘জানি না।’

‘জান তুমি। তুমি ওখানে ঘাস কাটার কাজে যাচ্ছ।’

‘হয়ত।’

‘কিন্তু বাবা, এই ঘাস কাটার কাজে তুমি এত দূরে কেন যাবে? এ জাতীয় কাজ এখানটায় কোথাও করা যায় না? এই গ্রামেও তো তোমার বাবার জমিতে বা অন্যদের জমিতে এই কাজ করা যায়, তাই না?’

‘আম্মা, আপনি জানেন এ দুয়ের পার্থক্য আছে। এখানে আমি ঘাস কাটার কাজে নামলে মানুষ মনে করবে আমার মাথা ঠিক নেই। এছাড়াও, ওখানটায় ঘাস কাটার জন্য সরকার থেকে টাকা পাওয়া যায়।’

‘তা-ও, আমাদের এখানকার লোকেরা কিন্তু ঘাস কাটতে দক্ষিণে যায় না। এটা যায় আরো উত্তরের লোকেরা। উত্তরের বনবাদাড়ের মানুষেরা শুনেছি এই কাজে দক্ষিণে যায়। এই কাজ আমাদের না, বাবা।’

‘দেখুন, আম্মা। কতদিন গেল, কিছুই তো করতে পারিনি। আজ হাওয়া মা হয়েছে, আমার একটি ছেলে হয়েছে।’

‘আর এই সময় তুমি তাদের ছেড়ে দক্ষিণে ঘাস কাটতে যাচ্ছ।’

‘কিন্তু আম্মা, আমি ঘরে বসে থাকি আর বসে বসে দেখি ওরা উপোস করছে— সে কি ঠিক হবে? আপনি জানেন সবগুলো কোলা বাদাম এবার নষ্ট হয়ে গেছে। আর নষ্ট না হলেও ঐ থেকে কটা টাকা হতো? ফলে না গিয়ে কি উপায় আছে? আমাদের এই কোলা বাদামের দিন শেষ হয়ে গেছে। এর সুদিন আর কবে আসবে আমরা জানি না। ফলে এখন ঘরে বসে পচার চেয়ে বের হওয়াই ভালো।’

‘হাওয়া জানে?’

‘না, বলিনি।’

‘তুমি কি ওকে জাগিয়ে এই কথা বলতে এসেছ?

‘না।’

‘না বললেই ভালো।’

‘আম্মা, আমি আমাদুর কাছে সবকিছু রেখে গেলাম। সে কাল আসবে এবং হাওয়ার খোঁজখবর নেবে।’

‘আচ্ছা।’

‘কবে নাগাদ ফিরবা?’

‘ঈসা!’

‘জি, আম্মাা।’

‘কবে নাগাদ ফিরবা বলে আমরা ভাবব?’

‘জানি না, আম্মা, হয়ত আগামী রমজানে।’

‘আচ্ছা।’

‘আম্মা, চলি তাহলে।’

‘আল্লাহ তোমার সহায় হোন।’

‘নবিজির রহমতে ও দোয়ায় আপনারাও সবাই ভালো থাকুন।’

ম্মা আসানা সোজা তার বিছানায় চলে গেলেন। কিন্তু ঘুমুতে নয়। ঘুম তার আসবেই বা কীভাবে? সারাটা রাত তার চোখের দুপাতা একত্র হলো না।

‘আমার জামাইর বংশে খৎনায় নুনু পচনের দুর্নাম আছে? না, অবশ্যই না। না, বরং আমাদের বংশে খৎনায় মেয়েদের নুনু নষ্টের বিষয় আছে। না হয়, আমাদের মেয়েরা কেন তাদের স্বামীদের ধরে রাখতে পারছে না? আল্লাহ, এমন কেন হচ্ছে?’

‘কুড়ি বছর আগে। কুড়ির বছর বা তার চেয়েও বেশি… কুড়ি বছরেরও বেশি। ও আল্লাহ, তুমি আমাকে শক্তি দাও, নাহলে এই কথা আমি হাওয়াকে কীভাবে বলব?

‘নাকি এখন বাজারে যাব? বাজার থেকে এসে তারপর বলব? না। হাওয়া, হাওয়া, নিজের দিকে তাকিয়ে দেখ, হাত-পা ছড়িয়ে কেমন গাছের গুঁড়ির মতো শুয়ে আছিস। কোনো বাচ্চার মা এভাবে শুয়ে থাকে? হাওয়া, হাওয়া! না, আমি তোকে একা ফেলে যাব না। আরে এইভাবে মড়ার মতো শুয়ে থাকলে বাচ্চার কান্না কেমনে শুনবি?

‘আরো শোনো, ও আবার কী জিগ্যেস করছে! আরে, সূর্য উঠে দিন হয়ে গেছে সে অনেকক্ষণ। আমি তো ভাবছিলাম তুই মরেই আছিস। ঠান্ডা লাগলে কম্বলটা মুড়ি দিয়েই বস আর শোন তোর সাথে জরুরি কথা আছে।

‘হাওয়া শোন, ঈসা দক্ষিণে চলে গেছে।

‘আরে আমার দিকে এমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকার কী আছে? আমি বলছি যে, ঈসা দক্ষিণে চলে গেছে।

‘আরে কী সব জিগ্যেস করছিস? তোরে কীভাবে সাথে নেবে তোর এই কদিনের ছেলেসহ যে ছেলের এখনো নাভির ঘা শুকায়নি?

‘সে গতকাল রাতেই চলে গেছে।

‘আরে এইসব জানতে চাসনা কেন আমি তোকে ঘুম থেকে তুলিনি? তোকে ঘুম থেকে তুলে কী হতো? শোন, ঈসা বলল ও এখানে বসে বসে তোদের উপোস করতে দেখা বরদাশত করতে পারত না।

‘ও দক্ষিণে যাচ্ছে কোনো কাজবাজ খুঁজতে। আরে, হাওয়া, তুই উঠে কোনদিকে যেতে শুরু করলি? ঈসা কি তোর জন্য দরজায় দাঁড়িয়ে আছে? লোকজন চতুর্দিকে এখনো সবাই ঘুম থেকে ওঠেনি। তুই এমন কিছু করিস না যাতে আমাকে চিৎকার চেচামেচি করতে হয়…বাচ্চাদের মতো আচরণ করলে হবে? তোর একটি ছেলে আছে…কোথায় রওয়ানা দিতে চাচ্ছিস? স্থির হয়ে শোন, ঈসা চলে গেছে। সে রাতেই চলে গেছে যাতে তামালে থেকে খুব সকালে ছেড়ে যাওয়া সরকারি বাসটি সে ধরতে পারে।

‘আরে হাওয়া, কান্নাকাটি করিস না তো। কেঁদে কী হবে? স্বামী দূরে একটা কাজ খুঁজতে গেছে। কাঁদ, কাঁদ, যত পারিস কাঁদ, কারণ সে তো গেছে কাজবাজ খুঁজে রোজগার কারে আমাকে খাওয়াতে, তোদেরকে না, তাই না?

‘তুই কী যে বলছিস আমি বুঝি না।…দেখ, ছেলেটাকে ঘুম থেকে তুলে ফেলেছিস। ওরে মাই দে, বস আর আমি যা বলছি শোন।

‘শোন, আমি আরেকজনের কথা বলি যে একইভাবে তার সদ্যোজাত শিশুকে রেখে চলে গিয়েছিল।

‘সে ফিরে এসেছিল কিনা? না, সে আর ফিরেছিল না। তবে তুই প্রশ্ন করে জানতে চাস না, বরং আমিই তোকে সব বলছি।

‘সে সাধারণত যেতো আবার আসত। তারপর একদিন গেল আর ফিরে এলো না। এমনও না যে তাকে যেতে হয়েছিল বাকিদের মতো..

‘বাকিদের যেভাবে যেতে হয়েছিল তাকে সেভাবে যেতে হয়নি মানে বাকিরা যে কারণে সেনাবাহিনীতে নাম লিখিয়েছিল তার ঠিক সে কারণে সৈনিক হওয়ার দরকার ছিল না। তার বাবা তল্লাটের সবচেয়ে ধনী লোকটি ছিল না ঠিক। সে সংসারের বড় ছেলেটি ছিল না তাও ঠিক। তবে তার যেটুকু ছিল তা দিয়ে বিয়ের পর করে কেটে খেতে তার অভাব হতো না। কিন্তু সে কারো কথা শুনল না। সে কীভাবে বসে থাকবে আর দেখবে অন্য দশটি ছেলে তার চেয়ে সবকিছুতে এগিয়ে যাচ্ছে?

‘তাদের পোশাক ইস্ত্রিতে ভাঁজ হয়ে কী সুন্দর জ্বলজ্বল করত! এক কথায় তাদের দিকে তাকালে আনন্দে ও মুগ্ধতায় চোখ এমন স্থির হয়ে যেতো যে, ইচ্ছা করলে তুমি তাদের দিকে তাকিয়ে থেকেই চোখে সুরমা লাগাতে পারতে। তাদের জুতা আর তার বাজনার মতো আওয়াজ! সেনাবাহিনী মানে কী ভাবসাব আশা করি তুমি বোঝো। তারা যখন দক্ষিণ থেকে আসত মনে হতো পুরো এলাকা আনন্দে নড়ে চড়ে উঠছে। মায়েরা তাদের মেয়েদেরকে খালি পটাতে থাকত কী করে ভালো একজনের সাথে বিয়েতে এগিয়ে নেয়া যায়, আর বাবারা দৌড়ের ওপর থাকত বিয়ের কথা পাকাপাকি করার চেষ্টায়। তবে সবাই আল্লাহ আল্লাহ করতো মেমুনাতের মতো ঘটনা যাতে না হয়ে যায়। মেমুনাতের বাবা পণের গরু-ছাগল সবকিছু নেয়ার পরে মেমুনাত এক সেনার সাথে ফষ্টিনষ্টি করতে চলে গেল। তারপর সে কী কেলেঙ্কারি!

‘মেমুনাত কে? না, এই মেমুনাত তোর বান্ধবীর মা মেমুনাত নয়। এই মেমুনাত শেষপর্যন্ত এলাকা থেকে ভেগে গিয়েছিল। শুনেছি সে শহরে গিয়ে নষ্টা হয়ে অনেক টাকা কামিয়েছিল।

‘না, অনেক দিন তার কোনো খোঁজখবর নেই। মারাও হয়ত যায়নি। শুনেছি এরকম মহিলারা মরার সময় নাকি নিজ ভিটায়ই চলে আসে, আর সে এখনো আসেনি।

‘তবে আমরা ভিন্ন রকম ছিলাম। আমার বাবা আমাকে কোনো বাগদানের জন্য নিয়ে যাননি।

‘জানতে চাস কেন ‘আমরা’ বলছি? কারণ যার কথা বলছি সেই লোকটিই ছিল তোর বাবা। হা করে তাকিয়ে আছিস ক্যান? হা-রে বাবা, আমি তোর বাবার কথাই বলছি।

‘না। সে যে মারা মারা গেছে বলেছি তাও মিথ্যে নয়। শোন বলছি। সে দক্ষিণে গিয়েছিল বিবাহিত সৈনিক হিসেবে নিজের জন্যই একটি বাড়ি পেতে।

‘না, এটি সেইবারে নয় যে সে আর ফিরে আসেনি। সে ফিরে এসেছিল, তবে আমাকে নিয়ে যেতে নয়।

‘সে এসে জানতে চেয়েছিল আমরা যুদ্ধের কথা শুনেছি কিনা।

‘আমরা কি যুদ্ধের কথা শুনেছিলাম না? কৌটাজাত মাছ, কাপড়, কেরাসিন ইত্যাদি যে দুর্মূল্য হয়ে গিয়েছিল সে কি যুদ্ধের কারণে না?

‘বললাম আমরা শুনেছি। তবে আমরা প্রথমত মনে করেছিলাম ওগুলো দুষ্প্রাপ্য হচ্ছে কারণ ব্যবসায়ীরা ওগুলো আনছে না।

‘কিন্তু সে বলল ওগুলো দক্ষিণেও পাওয়া যাচ্ছে না।

‘কিন্তু কেন যুদ্ধ আমরা জানতে চাইলাম।

‘আরে তোমরা জার্মান লোকদের কথা শোনোনি? তার আর বেশি কথা বলার মতো সময় ছিল না। সে শুধু বলল দক্ষিণে তারা জার্মানদের নিয়ে অনেক আজেবাজে গান গাচ্ছিল।

‘আমরা কখন একত্রে যাচ্ছি দক্ষিণে? আমি জানতে চাইলাম।

‘সে বলল এই বিষয়ে বলতেই সে এসেছে। এখন আমাকে সে নিতে পারছে না। সে বলল, দেখ আমরা ইংরেজদের শাসনে আছি আর এখন সেই ইংরেজদের সাথে জার্মানদের যুদ্ধ চলছে।

‘আমি বললাম তাতে তোমার আর আমার কী? তাতে আমি কেন তোমার সাথে দক্ষিণে যেতে পারব না?

‘কারণ আমাকে যুদ্ধ করতে তাদের সাথে সাগরের ওপারে যেতে হবে— সে বলল।

‘আরেক দেশের যুদ্ধ করতে তুমি কেন যাবে?

‘বিষয়টা এত সরল না— সে উত্তর দিল।
‘আমরা তার কথা বুঝতে পারলাম না। ওর বাবাও আমাকে বলল— তুমি এখন যেতে পারবে না। আমার শ্বশুর আবার বলল— তুমি যেতে পারবে না কারণ এটা আমাদের গঞ্জা বা গ্রুনিশদের সাথে যে যুদ্ধ হয় তেমন কোনো যুদ্ধ নয়।

‘আমি এই ইংরেজটা চিনি, কিন্তু জার্মানটাকে চিনি না। যাই হোক তারা তাদের দেশে আছে, থাকুক।

‘আমার শ্বশুর কথা নিয়ে যেন খেলছিল এবং আমিও।

‘একজন সৈনিক মানে সে আদেশ পালন করবে— সে বলল।

‘আমি তোর বাবাকে অনেক জিনিস সাথে দিতে চাইলাম। কিন্তু সে বলল কয়েকটা কোলা বাদাম ছাড়া আর কিছুই নিতে পারবে না।

‘তারপর একদিন খবরটি আসল। প্রথমে সেটি আমার মাথায়ই ঢুকল না। তখন আসলে আমার মাথা বলতেই কিছু ছিল না। আমার সবকিছুই তখন আমার বাচ্চাদানিতে, আমার গর্ভাশয়ে। সেখানে তোর বয়স তখন মাত্র তিন দিন।

‘সেটা যেন কোনো খবর নয়, বরং এক খণ্ড আস্ত আগুন যা সরাসরি আমার পেটের খোড়লের মধ্যে ঢুকে পড়ছিল। মনে হচ্ছিল সে আগুনের হলকাটি সব পুড়িয়ে দিয়ে খালি উপরের দিকে উঠছে। মনে হল আমার গর্ভাশয় ছিঁড়ে, নাড়িভুঁড়ি গলিয়ে চিৎকারে পাগল বানিয়ে আগুনের হলকাটি আমার মাথায় গিয়ে ঢুকল।

‘তোর জন্মের সময় আমি বলেছিলাম তুই মেয়ে হওয়াতে আমার কিচ্ছু আসে যায় না। আল্লাহর সকল দানই রহমত। আর সে তো আসছে, সুতরাং আমাদের আরো অনেক ফরজন্দ হবে আর তার মধ্যে অনেকগুলো ছেলে থাকবে।

‘হাওয়া, তোর আসলেই ছিল এক কৈ মাছের প্রাণ, কারণ তুই যে কেমনে বেঁচে রইলি সেটা আমি নিজেও বুঝি না। তোর যখন মাত্র তিন দিন বয়স তখন কী এক কারণে জানি না, চৈত্র মাসের ছোট ডোবা নালার মতো আমার বুকের দুধটা শুকিয়ে একেবারে ঠনঠনে হয়ে গেল। আসলেই তর কৈ মাছের প্রাণ।

‘পরে লোকে বলছিল আমি যদি দক্ষিণে যাই এবং সরকারের কাছে যদি প্রমাণ দাখিল করতে পারি যে আমি তার বউ, তাহলে সরকারের কাছ থেকে আমি অনেক টাকা পাব।

‘কিন্তু আমি যাইনি। আমি তাকে চাচ্ছিলাম, তার লাশ মোড়ানো টাকায় আমার কোনো আগ্রহ ছিল না।

‘আমি কোনোদিন দক্ষিণ দেখিনি।

‘তুই ‘আহ’ বলছিস? শোন বাবা, আমি প্রায়ই বলি এই দুনিয়ার অনেক বয়স, আমরা যে দুনিয়াটা দেখছি এটা এর বুড়ো কাল, যৌবনের দুনিয়া আমরা কেউ দেখিনি। এই বুড়ো দুনিয়ায় ‘আহ’-এর কিছু নেই।

‘সরকারের লোকেরা আসছে যাচ্ছে আর বলছে সবকিছুতে মন্দা চলছে, তাই কৌটাজাত মাছ নেই, কাপড় নেই। আর এখন লোকে বলছে আমাদের ছেলেরা একদিন আমাদের জন্য ঐসব নিয়ে আসবে অনেক অনেক।

‘ঈসা দক্ষিণে গেছে কারণ সে তার বাচ্চা-বিয়ানো বউটার জন্য হরিণ, ডুইকার দূরে থাক একটু ছাগলের গোশতেরও ব্যবস্থা করতে পারছিল না কোথাও থেকে। ঈসা গিয়েছে যাতে অন্তত ফুসেনি তার বউয়ের পাশে থাকতে পারে এবং বউয়ের সাথে পেট পুরে গরুর গোশত খেতে পারে। এবং সে আসবে, জ্যান্ত ফিরে আসবে…হয়ত আগামী রমজানে নয়, হয়ত তার পরের রমজানে। বাবা, আমি তোকে শুধু অন্য একটা মানুষের গল্প শোনালাম, যে গিয়েছিল অন্য দেশের মানুষদের এক যুদ্ধে এবং সে আর ফিরে আসেনি।

‘আমি এবার বাজারে যাচ্ছি। তুই উঠে ফুসেনিকে একটু পরিচ্ছন্ন কর। আমি দেখি ঐ আধানষ্ট কোলাবাদামগুলো দিয়ে কী করতে পারি। চাল যা আছে তাতে আমাদের দুজনের চলে যাবে, তাই না?

‘ঠিক আছে। আজ যদি কোলা-বাদাম বেচা সব টাকা দিয়েও হয় কিছু নুনে শুকানো মাছ হলেও আনব। বড় একটাই আনতে চেষ্টা করব, যাতে আজকের একটা বেলা হলেও নোনা মাছের একটা ভালো সস আইটেম খাবারে রাখতে পারি।’





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত