Homeসাহিত্যআনিহিতার আকাঙ্ক্ষা

আনিহিতার আকাঙ্ক্ষা


একটা মেয়েবাবুর মা হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল সে। বয়ঃসন্ধির শুরু থেকেই কি? ঠিকঠাক বলা যাচ্ছে না। তবে বেশ অল্পবয়সেই। দশ কিংবা এগারোয় প্রথম ঋতুপাতে ভয়ে বিহ্বল তাকে মা সাহস জুগিয়েছিল এই বলে, তুই খুব উর্বর। একদিন যখন বাচ্চা জন্ম দিবি, দেখবি আমাকে ছাড়িয়ে গেছিস। কীভাবে নিজের মাকে ছাড়িয়ে যাবে সে? কারণ তার বাচ্চা হবে সুন্দর স্বাস্থ্যের অধিকারী। দু’গালে ফুটে বেরুবে আপেলরঙা লালিমা। বড় চোখ দুটিতে খেলা করবে গভীর কুয়ায় চাঁদের আলো।

সে, যার নাম আনিহিতা, কবি পিতার শখ করে রাখা নামের শ্যামাঙ্গী মেয়ে, নয় মাসের চর্চার পর একদিন ফট করে বাচ্চা জন্ম দেবে। ছেলেবাবু। তখন প্রগাঢ় হতাশায় রাগী স্বামীপ্রবরের সমুখে অসুখের দোহাই দিয়ে পরিশ্রান্ত হয়ে হাসপাতালের সাদা বেডে ঘুমিয়ে থাকার অভিনয় করবে সে। আর ভেতরে ভেতরে গুঁমড়ে মরবে। ছেলেকে কোলে নেবার কোনো উদ্যম আমরা দেখব না। আধুনিক বিজ্ঞানের বরাতে জন্মের আগেই যেখানে জেনে যাওয়া যায় গর্ভফলের লিঙ্গ, সেখানে সে একরকম যুদ্ধ করেই নিজেকে এবং পরিবারকে বিরত রাখবে আগাম সত্যসন্ধানে। যদি পেটের সন্তান ছেলে হয়, তবে পেটের অন্ধকারেই হয়ত মেরে ফেলবে সে। তার চেয়ে জন্মাক। সত্য জন্মানোর আগ পর্যন্ত এই এক আনিহিতার দেহমনে বিরাজ করবে থকথক উত্তেজনা। শুঁয়োপোকার আবরণ থেকে প্রজাপতি ফোঁটার মতো উত্তেজনা।

জামানার সমস্ত পুরুষের প্রতি আনিহিতার ঘৃণার উৎস নিশ্চয় একটি নয়। অজস্র। সে হিসেবে নিজের বাবাকে নিয়েও তার বিবমিষা থাকার কথা। লোকটা আদতে কোমল-কাব্যিক পুরুষ হলেও কয়েকটি পরকীয়া প্রেম করে আনিহিতার মাকে বেশ খানিকটা দুঃখ দিয়েছে। অবশ্য এ সংক্রান্ত বেদনা ছাড়া আনিহিতার মা স্বামীর সংসারে বলা যায় সুখেই আছে। কবি বরের কাছ থেকে পেয়েছে মধুর ব্যবহার, মৌলিক চাহিদার পর্যাপ্ত নির্বাণ, মেয়েলি অবকাশ নিশ্চিতের জন্য বেতনভুক কাজের মানুষ। আর কী চাই? কিন্তু মানুষের, বিশেষ করে নারীদের, মনেরও অধিক এক বস্তু থাকায়, পুরুষের কাছে চাওয়ার থাকে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম অনেক কিছু। ব্যাটালোকেরা সেসব বুঝতে চায় না বলে সভ্যতার শুরু থেকে অভিযোগ করে আসছে—নারীদের মন বড় দুর্বোধ্য। বড় জটিল।

এক্ষেত্রে আনিহিতার চিকিৎসক ছোট চাচার ভাষ্য হচ্ছে, মেয়েদের মনের জটিলতা-ফটিলতা বলে কিছু নাই। সব হরমোনের খেলা। ইস্ট্রোজেন স্পাইক করলে ভালো লাগা, মন্দ লাগার অনেকগুলো শেড তাদের আচরণে ক্রমাগত দেখা দেয়—এই আর কি।

বাবাকে আনিহিতা রেয়াত করেছিল, কেননা তিনি ছিলেন মেয়ের একমাত্র নৈতিক সমর্থনকারী, পুরুষবিদ্বেষ সংক্রান্ত চিন্তাভাবনার। বলতেন, আসলে পুরুষের কোনো কাজ নাই। পুরুষ হচ্ছে গুড ফর নাথিং। কেবল ওই এক ফোঁটা তরলের বড়াই করে টিকে আছে এরা। জগতে এতগুলো যুদ্ধে যে লাখ লাখ মানুষ খুন হয়েছে, তার প্রায় সমস্তটার দায় কিন্তু পুরুষেরই। পুরুষ ঘোরে ধ্বংসের ফিকিরে, আর নারী স্থির থাকে সৃষ্টিশীলতায়।

খাবার টেবিলে তখন দাঁতের নিচে টোস্ট বিস্কুটের কুড়মুড় শব্দ বাড়িয়ে ছোট চাচা প্রতিবাদ করতেন, ভুল বকছ ভাইয়া। এই পুরুষই কিন্তু আইফেল টাওয়ার গড়ে, কবিতা লেখে, সুর তোলে ,সিনেমা বানায়। আবার ভালোও বাসে। জগতের সৃষ্টিশীল কাজের নব্বই ভাগই তো পুরুষের।

বাবা মৃদু হেসে বলতেন, বোকা, এইসবই আমাদের ছদ্মবেশ। ভান। আড়াল সরালে দেখবি ধ্বংস করার ইচ্ছা ছাড়া আর কিছু নাই।

একটা মেয়েবাবু হবার পঞ্চাশ শতাংশ সম্ভাবনা থাকায় এবং মায়ের জোরাজুরি কিংবা ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলে আনিহিতা এক সুদর্শন কর্পোরেট কর্তাকে বিয়ে করবে। কর্তার সবকিছুই ভালো, কেবল রাগী হবে কিছুটা। আর থাকবে বউয়ের সঙ্গে প্রতিরাতে অবারিত সংগম করার আকাঙ্ক্ষা (সময় পেলে দিনেও)। আনিহিতার মনমেজাজ কোনো কোনো রাতে ঠিকঠাক না থাকলে হয়ত সঙ্গমে প্রত্যক্ষ সাড়া দিতে পারবে না। গাঁইগুঁই করবে। বলবে, সামির আজকে থাক না—উঃ—গতকাল কেয়া ফাঁস নিল— উঃ আঃ আস্তে—মনটা ভীষণ খারাপ সামির—বউয়ের ওপর উপগত হয়ে দীর্ঘক্ষণ নিম্নাঙ্গ আন্দোলিত করতে থাকা সামির তরল ঢালার আগেই বিরক্তি ঢেলে বলবে, চুপ মাগি!

একুশতম জন্মদিনের সকালে আনিহিতার বাবা আত্মজাকে হাজার পাঁচেক টাকা দিয়ে বলেছিলেন, আজ সারাদিন কেবল তোর নিজের। যেভাবে ইচ্ছা খরচ করবি, যেখানে ইচ্ছা যাবি। রাত বারোটার আগে ফিরে আসলেই হবে।

আনিহিতা ভীতি নিয়ে বলেছিল, কিন্তু মা— সেটা আমি ম্যানেজ করে নিব।

ঠিক এরকম অনেকগুলো কারণেই পুরুষ হওয়া সত্ত্বেও, কিছু ক্ষেত্রে মাকে কষ্ট দেওয়া সত্ত্বেও, আনিহিতা বাবাকে ঘৃণা করে উঠতে পারেনি কখনও। বাড্ডা থেকে বাসে চেপে শাহবাগ এসেছিল সে। তারপর হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে চায়ের টঙে বসে থাকল ঘণ্টা দুয়েক। দেখল জনস্রোত, লাল দোতলা বাস, রাজু ভাস্কর্যের মাথায় বসে থাকা নিঃসঙ্গ কাক কিংবা ক্রিমসন রোডে মুড়ে থাকা পলাশ গাছ।

হঠাৎ বৃষ্টি নামল। তড়িঘড়ি করে ছুটে যাত্রী ছাউনির দিকে যেতে থাকা এক দম্পতির বাচ্চাটার হাত থেকে বাতাসে ছিটকে উড়ে গেল একটি ঝিলমিল বেলুন।

এ সময় ভিজে জবজবে হয়ে রাজু ভাস্কর্যের আড়াল থেকে হাতে একগুচ্ছ সাদা, কালো ও হলুদ গোলাপ নিয়ে মন্থরপায়ে হাঁটতে হাঁটতে আনিহিতার দিকে এলো এক কিশোরী। এসে তার পাশে বসল। ওর নাম সুরাইয়া। ফুল বেচে। মাঝে মাঝে উদাস মন নিয়ে এখানে আনিহিতা যখন আসে, তখন মেয়েটার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। দশ টাকার ফুল সে ওর কাছ থেকে একশ টাকা দিয়ে কেনে। সুরাইয়ার কালো গোলগাল মুখে একটি চাপা নাক আর এক জোড়া জলপাইরঙের চোখ আনিহিতার কাছে বড্ড মায়াবী লাগে।

একুশতম জন্মদিনে আনিহিতা কালো বিড়ালের মতো ভেজা মেয়েটিকে আড়ং থেকে ড্রেস কিনে দিল। সে ড্রেস ট্রায়াল রুম থেকে পরিয়ে ওকে নিয়ে পিজ্জাবার্গে গিয়েছিল খেতে। এরপর দুজনে একটা হলিউড সাইফাই সিনেমা দেখল সিনেপ্লেক্সে। খেলো দামি আইসক্রিম। নানাবিধ বিনোদনের ভাগীদার করে রাত বারোটার আগে ওকে নিয়ে বাসায় ফিরেছিল আনিহিতা। মেয়েটাকে সে জিজ্ঞেস করেছিল, তুই যে আমার বাসায় এলি, তোর মা টেনশন করবে না?

সুরাইয়া বলে, মা ভাইগে গিছে আরেক বিটা ধইরে। ছোট ভাই ছাড়া আমার আর কেউ নাই। সুরাইয়াকে এক মগ গরম চকলেট শেক খেতে দিয়েছিল আনিহিতা। খেয়েটেয়ে বারণ না মেনে নিজেই ধুয়ে রাখতে গিয়ে সুরাইয়া মগটার হাতল ভেঙে ফেলল। মা বকলো আনিহিতাকে, কোত্থেকে নিয়ে এলি এ মেয়েকে? এ তো অপয়া!

একটা সামান্য মগ ভুল করে ভেঙেছে। এতেই অপয়া হয়ে গেল তোমার কাছে! হুম।ওর চোখের রং সুবিধার লাগছে না। সুরাইয়া পর্দার আড়াল থেকে গলা বাড়িয়ে মুখ মলিন করে শুনল। তখন আনিহিতা কাছে ডেকে ওর ফ্যাকাশে বাদামি চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে আদুরে গলায় বলে, আয় আমরা এখন ঘুমাব।

নিজের বেডরুমে সে সুরাইয়াকে নিয়ে শুলো। কিন্তু ভোর রাতে টয়লেটে যাবার কথা বলে মেয়েটা কোথায় যে চলে গেল, আর ওর টিকিটিও দেখা গেল না। এ ঘটনার পর একটি মেয়েশিশু জন্মদানের আকাঙ্ক্ষা আনিহিতার আরো অনেকটা বাড়ে।

আনিহিতার মনের আশা পূরণ হবে না, তা আমরা ইতোমধ্যেই জেনেছি। নিজের নবজাতক ছেলেকে রাগী বরের চাপে প্রথম প্রথম স্তনের দুধ খাওয়ালেও, একসময়, দুই মাসের মাথায়, সে বুকের তরল শুকিয়ে যাওয়ার কথা বলবে। মিথ্যে না। আসলেই তা ঘটবে। কেননা, মানুষ মন থেকে কিছু চাইলে পুরো দুনিয়া নাকি তা দেয়ার জন্যে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়! বাচ্চাটা হবে ধবধবে সাদা। মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুল। শরীর টিংটিঙে রোগা। শুরুর দিকে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর চেষ্টা থেকে আনিহিতা তার ছেলে সন্তানকে মেয়েশিশুর পোশাকে সাজাবে, কিন্তু শাশুড়ির নিত্য বকাবকি আর তিনবছরের মাথায় বাচ্চার নাকের নিচে কালো গোঁফের রেখা দেখে সে উদ্যমহীন, আতঙ্কিত এবং হতাশ হয় উঠবে।

আনিহিতা সম্পূর্ণরূপে হাল ছেড়ে দিলে বাচ্চার দেখভালের সমস্তটা নিজের ঘাড়ে তুলে নেবে শ্বাশুড়ির বিধবা বোন।

বাচ্চা হবে বুদ্ধিমান; মায়ের ভালোবাসা না পেয়ে তাই সে হতাশ হবে না। বাগানের পোকামাকড়, কুকুরী জানকি এবং ডানাভাঙা একটি কাকাতুয়া—এই শিশুটিকে এন্তার সঙ্গ দেবে। জন্মের চারবছরের মধ্যে মানবভাষা অনেকটা রপ্ত করে সে ছড়া বানাবে— “জানকি খায় পোকার গু/মানুষ খেলে হাডুডু/আমার মায়ের নাই বুবু/ আমি হব হালাকু।”

শিশুটির বয়স যখন ছয় হবে, ততদিনে সে তৃতীয় ক্লাসের ছাত্র এবং ভরপুর মেধার কারণে ইশকুলের সবার চোখের মণি। বয়সের চেয়ে গাঢ় পরিপক্বতা তার আসবে; তবু সে একদিন করে বসবে অভাবনীয় এক ছেলেমানুষি কাজ। ডিসেম্বরের যেকোনো শীত বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে সে ঢুকবে মায়ের ঘরে। মা আরামে ভাতঘুমে ডুবন্ত, কিন্তু শিশুটির দু-দিন ধরে সর্দির অসুখ, নাক দিয়ে অনবরত গড়াতে থাকবে শিকনি। হঠাৎ আনিহিতার ঘুম ভেঙে যাবে। এই কুৎসিত কর্মকাণ্ড দেখে সে হঠাৎ রেগে গিয়ে ছেলের বামগালে দিয়ে বসবে বন চটকানা। চটকানার জোর সহ্যসীমার অধিক হওয়ায় এই বুদ্ধিদীপ্ত মানবশিশুটি মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। আর অজস্র ব্যথাতেও তার কান্না পাবে না অবশ্য।

কিন্তু একটা ব্যাপারে আমরা নিঃসন্দেহ যে—বয়সের চেয়েও বেশি পরিপক্বতা ধারণ করায় এ ঘটনার পর থেকে শূন্যতার এক নিঃসঙ্গ হুদহুদ পাখি শিশুটির বুকে বাসা বাঁধবে।

এর কয়েকমাস পর আনিহিতার ছেলেশিশু এক ঝলমলে রোদের সকালে স্কুল পালিয়ে একা একা পাবলিক লাইব্রেরিতে যাবার পথে ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে মারা যাবে। আস্ত থাকবে না একটাও টিংটিঙে হাড়গোড়। লাল রক্তের স্রোত গড়াতে গড়াতে ড্রেনের কালো পানিতে মিশে সন্ধ্যার আকাশের মতো বেগুনি হয়ে উঠতে থাকবে। লাশভর্তি মর্গে চলে গেলেও এক অফিস ফেরত কেরানি বাচ্চাটার আইডিকার্ড থেকে ঠিকানা নিয়ে আসবে বাসায়। উঁচু গলায় খবর শোনাবে রেডিওর মতো, আপনাদের বাচ্চাটা মারা গেছে। একদম স্পট ডেড।

শুনে শিশুটির বন্ধু কথা বলা কাকতাড়ুয়াও বারান্দা থেকে চেঁচিয়ে উঠবে, বাচ্চাটা মারা গেছে! স্পট ডেড! কুকুরী জানকি ছুটে আসবে, ঘাউ ঘাউ! গাঁক গাঁক! বাগানের কমলা গাছ থেকে একটা গুবরে পোকা ঘরে উড়ে আসবে আওয়াজ তুলে, শো-শো-শোও। আর সব শুনে আনিহিতা রহমান, যার স্বপ্ন ছিল একটি মেয়েবাবুর মা হওয়ার, আচমকা হাউমাউ করে কেঁদে উঠবে।

হয়ত আনিহিতা কেঁদে উঠবে না, যদি তার স্বপ্ন কিংবা দুঃস্বপ্নটি ভেঙে যায়, আর ঘুম থেকে জেগে উঠে বিছানার পাশে রাখা বেড টি খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে সে।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত