সম্প্রতি দেশে ঘোড়ার মাংস বিক্রির বিষয়টি বেশ আলোচনায় এসেছে। গাজীপুরের হায়দ্রাবাদ এলাকায় ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা কেজি দরে ঘোড়ার মাংস বিক্রি করার খবর সোশ্যাল মিডিয়াসহ একাধিক সংবাদমাধ্যমে এসেছে।
এসবের মধ্যে, ভারত থেকে বাংলাদেশে গরুর আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গরুর মাংসের দাম বেড়ে গেছে এবং এ কারণে দেশের মানুষ ঘোড়ার মাংস খাওয়া শুরু করেছে— এমন দাবিতে একটি প্রতিবেদন (আর্কাইভ) ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আজতক বাংলার
ইউটিউব চ্যানেলে সোমবার (১৭ মার্চ) প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনটির শিরোনামে লেখা, ‘ভারত গরু দিচ্ছে না, বাংলাদেশিরা খিদেতে রাস্তায় ঘোড়ার মাংস খাচ্ছে।’
প্রতিবেদনটি আজকে মঙ্গলবার (১৮ জুলাই) বিকেল ৩টা পর্যন্ত ১ লাখ বার দেখা হয়েছে এবং এতে ১ হাজার ১০০ রিয়েকশন পড়েছে।
সত্যিই কি সম্প্রতি ভারত থেকে বাংলাদেশে গরুর আমদানি কমে যাওয়ায় গরুর মাংসের দাম বেড়ে গেছে? আর এই কারণে দেশের মানুষ ক্ষুধার তাড়নায় ঘোড়ার মাংস খাওয়া শুরু করেছে? এই প্রশ্নকে সামনে রেখে প্রকৃত পরিস্থিতি জানার চেষ্টা করে আজকের পত্রিকার ফ্যাক্টচেক বিভাগ।
ভারত থেকে বাংলাদেশে গরু আমদানি বন্ধের বিষয়ে প্রাসঙ্গিক কি–ওয়ার্ড সার্চ করে ডয়েচে ভেলেতে ২০২২ সালের ৮ জুলাই তারিখে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশে ভারতীয় গরু রপ্তানি বন্ধ করে দেয়।
তবে এর পরবর্তী সময়ে সরকারিভাবে ভারত থেকে দেশে গরু আমদানি করার তথ্য গুগলে সার্চ করলে সংবাদমাধ্যমগুলোতে পাওয়া যায়নি।
তবে বিগত সময়ের কোরবানির ঈদে সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে অবৈধ ভাবে গরু আসার প্রতিবেদন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
গরুর মাংসের দাম কি সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে?
এই বিষয়ে অনুসন্ধানে প্রথম আলোতে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পবিত্র রমজান উপলক্ষে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ঢাকা শহরসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ১ থেকে ২৮ রমজান পর্যন্ত সুলভ মূল্যে মাছ, মাংস, দুধ ও ডিম বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই কর্মসূচিতে প্রতি কেজি গরুর মাংস ৬৫০ টাকা দরে বিক্রি করা হবে।
আজকের পত্রিকায় গত ৯ মার্চ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রমজান মাস শুরুর সময় থেকেই রাজধানীসহ সারা দেশের বাজারগুলোতে গরুর মাংসের দাম বেড়েছে। তবে দাম বাড়া সত্ত্বেও রোজায় মাংস কেনার প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। যার কারণে মাংসের দোকানগুলোতে গরুর মাংসের চাহিদা আগের তুলনায় অনেকটাই বেড়েছে।
প্রতিবেদনটি থেকে আরও জানা যায়, রোজার আগে প্রতি কেজি গরুর মাংস ৭০০-৭৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। তবে এখন অধিকাংশ বাজারে গরুর মাংসের দাম ৭৫০–৮০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
ঠিক এক বছর আগে অর্থাৎ ২০২৪ সালের মার্চ মাসে গরুর মাংসের কেমন দাম ছিল সেই বিষয়ে অনুসন্ধানে সে বছরের ১১ মার্চ তারিখে বাংলানিউজ টুয়েন্টিফোরে একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সেই সময়ে গরুর মাংস প্রতি কেজি ৭৫০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।
২০২৪ সাল ও ২০২৫ সালের বাজারে প্রতিকেজি গরুর মাংসের দামের তুলনা করলে এই দুই বছরের বাজারে ৫০ টাকার পার্থক্য দেখা যায়। আবার কিছু বাজারের ক্ষেত্রে এ দুই বছরে দামের তেমন কোনো পার্থক্য দেখা যায়নি।
এরপর আজকের পত্রিকার ফ্যাক্টচেক বিভাগ আগের বছরগুলোর গরুর মাংসের দামের খোঁজ করে।
২০২৪ সালের ১৫ মার্চ বিবিসি বংলার একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এই প্রতিবেদনের প্রতিবেদক সেদিন ঢাকার বিভিন্ন এলাকার বাজার ঘুরে দেখতে পান বেশিরভাগ জায়গাতেই গরুর মাংস ৭৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছিল।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, জানুয়ারিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গরুর মাংসের দাম ৬৫০ টাকা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। তবে নির্বাচনের পর ঢাকায় গরুর মাংস ৫৯৫, ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা দামে বিক্রি হয়েছে।
মাংসের এমন দামের তারতম্য হওয়ার কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে মাংসের গুণগত মান, ব্যবসায়ীদের কেজি দরে মাংস কিনে এনে আবার বিক্রি ও সিন্ডিকেটের কথা উল্লেখ করা হয়।
বিবিসি বাংলায় ২০২৩ সালের ২৯ মার্চের আরেকটি প্রতিবেদনে কনজিউমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) বরাতে উল্লেখিত বিগত বছরের গরুর মাংসের দাম সম্পর্কিত তথ্য জানা যায়।
২০২১ সালে গরুর মাংসের কেজিতে গড় দাম ছিল ৫৯৮ টাকা, ২০২২ সালে ছিল ৬৮৮ টাকা এবং ২০২৩ সালে ছিল ৭৫০ টাকা।
বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোরে ২০২৩ সালের ২৪ নভেম্বর বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির এক গবেষণাপত্রের বরাত দিয়ে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৪ সালে ভারতে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশে গরু না পাঠানোর সিদ্ধান্তে দেশে গরুর মাংসের চাহিদা পূরণ বিশেষ করে কোরবানির সময় পশু পাওয়া যাবে কি না এ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। তবে এই সিদ্ধান্তের পরবরতী সময়ে ঢাকা শহরের চারপাশসহ বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে গরুর খামার তৈরি হতে থাকে। ধীরে ধীরে সারা বছরের চাহিদা পূরণে সক্ষম হয়ে ওঠে বাংলাদেশ।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, ২০১৪ সালে দেশে গরুর মাংস ২৭৫ টাকায় কেজিপ্রতি গড় দামে বিক্রি হতো। আর ২০১৮ সালে কেজিপ্রতি ৪৩০ টাকা, ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত ৫৫০ টাকা, ২০২২ সালে ৭০০ টাকা এবং ২০২৩ সালে প্রায় ৮০০ টাকা।
বাংলাদেশে গরুর মাংসের বর্তমান অবস্থার বিষয়ে অনুসন্ধানে ২০২৪ সালের ২৮ এপ্রিল দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। এ থেকে জানা যায়, ২০২৪ সালের কোরবানির ঈদে দেশে গবাদিপশুর কোনো ঘাটতি পড়বে না এবং চাহিদার তুলনায় গবাদিপশুর বেশি যোগান আছে বলে জানান তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী।
২০২৪ সাল ছাড়াও বিগত বছরগুলোতে যেমন: ২০২৩, ২০২২, ২০২১, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে গরু–ছাগলে স্বয়ংসম্পূর্ণ মর্মে সরকারি পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়। বিষয়টি কিছুটা সত্যতাও পাওয়া যায় কোরবানির ঈদের সময়। বিগত কয়েক বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে, কোরবানির পশুর হাটে অনেক পশু অবিক্রিত থেকে যাচ্ছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের চলতি বছরের হিসাব অনুযায়ী, বছরে মাংসের চাহিদা ৭৬ লাখ টন। আর দেশের খামারে উৎপাদন হচ্ছে ৯২ লাখ টন।
কিন্তু এরপরও মাংসের দাম বেশি থাকার কারণ সম্পর্কে খামারিরা বলছেন, পশুর খাবার ও উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় মাংসের দাম কমছে না। আমদানিকারকেরা বলছেন, মাংস আমদানি করা হলে ৫০০ টাকা কেজিতে দেওয়া সম্ভব। কিন্তু প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর আমদানিতে আগ্রহী নয়। এ নিয়ে খামারিদেরও আপত্তি আছে।
তার মানে বিগত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশ গরু–ছাগলে স্বয়ংসম্পূর্ণ। সুতরাং ভারত থেকে গরু আমদানি বন্ধ হয়েছে বলে দেশে মাংসের সংকটে মানুষ ঘোড়ার মাংস খেতে শুরু করেছে এমন নয়।
তবে এটি সত্য যে, অভ্যন্তরীণ নানা কারণে দেশে গরুর মাংসের দাম বেড়েছে। সেই সঙ্গে মাংসের ক্রয়ক্ষমতাও বেড়েছে, সেটি মাংসের দোকানগুলোর সামনে ভিড় দেখলেই বোঝা যায়। ঘোড়ার মাংস খাওয়ার প্রচলন বাংলাদেশে কখনোই ছিল না। সম্প্রতি বিষয়টি ভাইরাল হয়েছে। গাজীপুরে প্রতি শুক্রবার তিন–চার সপ্তাহ ধরে শুধু একটি দোকানে ঘোড়ার মাংস বিক্রি করা হচ্ছিল। বিভিন্ন এলাকা থেকে উৎসুক মানুষ গিয়ে মাংস কিনতেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুরুতে বিনা মূল্যে ঘোড়ার মাংস দিয়েছেন বিক্রেতা। ধীরে ধীরে দাম বাড়ানো হয়েছে। অনেকে শখের বশে ঘোড়ার মাংস কিনেছেন। দেখা গেছে, ক্রেতাদের মধ্যে স্থানীয়দের চেয়ে দূর-দূরান্ত থেকে আসা মানুষই বেশি।
ঘোড়ার মাংস বিক্রির উদ্যোক্তা গাজীপুর মহানগরের হায়দ্রাবাদ এলাকার নুরুল্লাহ মামুন গণমাধ্যমকে জানান, দিন দিন চাহিদা বেড়েছে। শুরুতে একটু দুর্বল ঘোড়ার মাংস ২৫০ টাকা কেজি বিক্রি করেছেন, পরে ভালো মানের ঘোড়ার মাংসের দাম বাড়িয়েছেন।
এ নিয়ে ধর্মীয় বির্তকও শুরু হয়েছে। পরে অবশ্য স্থানীয় প্রশাসন ঘোড়ার মাংস বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে। বিক্রেতার লাইসেন্স নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। তিনি সিটি করপোরেশন থেকে মাংস বিক্রির লাইসেন্স নিয়ে বেআইনিভাবে ঘোড়ার মাংস বিক্রি করেছেন বলে জানিয়েছেন আজকের পত্রিকার গাজীপুর প্রতিনিধি।