প্রথম যখন আমি হান কাং-এর ‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’ বইটা হাতে নিলাম, তখন ঠিক কী আশা করছিলাম, তা এখন আর মনে নেই। আটলান্টায় আমার বাসার কাছেই ছোট্ট এক বুকস্টোর আছে—হাফ প্রাইজ বুকস। সেখানকার কর্মীরা বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ, তাদের পছন্দগুলোর প্রশংসা করতে হয়। যখন দেখলাম তাদের একজন এই বইটা সাজিয়ে রেখেছেন আর ছোট্ট এক নোটে লিখেছেন, “ভয়ঙ্কর, অতিপ্রাকৃত, ভুলতে না পারা যায় এমন”—ভাবলাম, ঠিক আছে, এটা পড়ে দেখি। তাছাড়া, এই বইটা ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজও জিতেছে। আর আমি এমন বইয়ের প্রতি বরাবরই আকৃষ্ট, যেগুলো একটু অদ্ভুত, অস্বস্তিকর গণ্ডি বেষ্টিত।
শিরোনামটা—দ্য ভেজিটেরিয়ান—দেখে প্রথমে মনে হবে এটা হয়ত পশুর অধিকার বা নিরামিষ ভোজনের ওপর কোনো দার্শনিক বই। কিন্তু যতই পড়তে থাকলাম, বুঝতে পারলাম এটা মূল গল্পের সামান্য একটা অংশ মাত্র। মূলত এই বইটা সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা বিষয় নিয়ে— বিচ্ছিন্নতা বা অ্যালিয়েনেশন। আর এই বিচ্ছিন্নতার গভীরে যাওয়ার জন্য লেখক এমন একটা পথ বেছে নিয়েছেন, যা পাঠককে ভাবনার জালে আটকে ফেলে।
গল্পের কেন্দ্রে রয়েছেন ইয়ং-হাই নামের এক নারী, যিনি হঠাৎ করেই এক রাতে একটি ভয়ানক দুঃস্বপ্ন দেখে মাংস খাওয়া বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন। ঘরের সমস্ত মাংস ফেলে দিয়ে, তিনি ঘোষণা করেন যে তিনি আর কোনোদিন মাংস খেতে পারবেন না। এটা একদম সহজ একটা সিদ্ধান্ত মনে হলেও, আসলে এর মধ্য দিয়েই তার জীবনে এক অদ্ভুত নির্বাসন শুরু হয়। গল্পটা তিনটি ভিন্ন ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলা হয়েছে—তার স্বামী, দেবর, এবং বোনের চোখে আমরা তার ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার ঘটনাগুলো দেখি। মজার ব্যাপার হলো, পুরো বইজুড়ে ইয়ং-হাইয়ের নিজের স্বরটা কিন্তু অনুপস্থিত। তার মনের ভেতরে আমরা সরাসরি ঢুকতে পারি না। এই দূরত্বই পুরো গল্পটাকে আরও বেশি ভয়ঙ্কর আর অস্পষ্ট করে তুলেছে।
কাহিনী যত এগোয়, ততই স্পষ্ট হয় যে ইয়ং-হাইয়ের মাংস খাওয়া ছেড়ে দেওয়া আসল সমস্যার মূল বিষয় নয়। এটি আসলে তার আরও গভীর কোনো বিচ্ছিন্নতার বহিঃপ্রকাশ। তার পরিবার এবং বন্ধুরা তার এই সিদ্ধান্তকে অদ্ভুত ভাবে গ্রহণ করলেও, আমরা পাঠক হিসেবে বুঝতে পারি যে এটা তার মনের গভীর থেকে উঠে আসা কোনো কিছু। এই অনুভূতিটা আমাকে কিছু ক্লাসিক বইয়ের কথা মনে করিয়ে দেয়—যেমন সিলভিয়া প্লাথের ‘দ্য বেল জার’ বা শার্লট পারকিন্স গিলম্যানের ‘দ্য ইয়েলো ওয়ালপেপার’। কিন্তু সবচেয়ে বড় তুলনা যেটার সাথে টানতে পারি, সেটা হলো হারম্যান মেলভিলের ‘বার্টলবি, দ্য স্ক্রিভেনার’। সেই গল্পটিতেও একজন ব্যক্তি কোনো স্পষ্ট কারণ ছাড়াই ধীরে ধীরে সমাজের সমস্ত চাহিদা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়। ‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’-এর মতো এখানেও প্রধান চরিত্রের আচরণ অজানা, আর সেই অজানাটা পাঠককে ভাবায়।
গল্পটা পড়তে পড়তে আমার জীবনের এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা মনে পড়ল। কয়েক বছর আগে, আমাদের এক পারিবারিক ডিনারের সময়, এক আত্মীয় হঠাৎ করেই ঘোষণা করলেন যে তিনি আর কোনোদিন মাংস খাবেন না। সবার মুখ থমকে গেল। “কেন?” কেউ একজন জিজ্ঞেস করল। তার উত্তর ছিল অদ্ভুত সরল, “আমি আর পারছি না।” আর কোনো ব্যাখ্যা দিলেন না। আমরা সবাই কিছুদিনের মধ্যে ভুলে গেলাম, কিন্তু সেই মুহূর্তের অস্বস্তিটা রয়ে গেল। ঠিক যেমন ‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’ আমাকে দিয়েছিল—একটা অনুভূতি, যে কিছু একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা থেকে যাচ্ছে, কিন্তু সেটা ধরা পড়ছে না।
হান কাং-এর লেখার ধরন একেবারে মসৃণ ও চমৎকার। খুব সহজ ভাষায় গভীর কথা বলেন তিনি। এটা আমাকে একটু হরুকি মুরাকামির লেখার কথা মনে করিয়ে দেয়, তবে সেটা শুধুমাত্র তারা দুজনেই এশীয় লেখক বলে নয়, বরং তাদের লেখায় সেই অদ্ভুত সরলতাটাই আমাকে টানে। ‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’ এমন এক ধরনের লেখা, যেখানে বাস্তব আর অতিপ্রাকৃত একসাথে মিলেমিশে গেছে। এটা একটা বড় পাওয়া, কারণ বাস্তব জীবনও তো প্রায়ই এমন হয়—অস্বাভাবিক আর সাধারণের মাঝে দোদুল্যমান।
এই বইয়ের সবচেয়ে ভালো দিক হলো, এটা সহজে ব্যাখ্যা করা যায় না। এটা আপনাকে একেবারে ঠিক কী ঘটছে তা জানায় না। অনেক গল্প বা সিনেমার মতো এর স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই যে, “এই কারণে সে এমন করছে।” এর পরিবর্তে, গল্পের মধ্যে একটা অস্পষ্টতা থেকে যায়। আর এই অস্পষ্টতাই আমার কাছে এটাকে সত্যিকার অর্থে জীবনঘনিষ্ঠ করেছে। আমাদের চারপাশেও তো এমন অনেক মানুষ আছে, যাদের আচরণ আমাদের বোধগম্য নয়, এবং অনেক সময় এর কোনো উত্তরই থাকে না।
যদি আপনি এমন বই পছন্দ করেন, যেগুলো ধীরে ধীরে আপনার মনের মধ্যে গেঁথে যায়, যেগুলো তাড়াহুড়ো করে নিজেকে ব্যাখ্যা করে না, তাহলে ‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’ আপনার জন্য। এই গল্পটা ধীরে ধীরে আপনাকে গভীরে নিয়ে যাবে, অস্বস্তি দেবে। বইটি পড়ে আপনি হতাশ হবেন না। এটি আপনার বইয়ের তালিকায় এমন কিছু যুক্ত করবে, যা আপনাকে নতুন করে ভাবাবে।