হাসান মাহমুদ টিপু
জনতার চোখে “উনি তো বলে গেলেন না..” শিরোনামে মানবজমিনের সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সাথে মাননীয় রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ চুপ্পুর কথোপকথন পড়লাম। এরপর মতিউর রহমান চৌধুরীর ইউটিউবে একটা সাক্ষাতকার শুনলাম। আইন উপদেষ্টা প্রফেসর আসিফ নজরুলের বক্তব্যও শুনলাম।
১. মতিউর রহমান ২০০৭ সালের ওয়ান ইলেভেন থেকে নিয়ে ২০২৪ এর গণ অভ্যুত্থান বা বিপ্লব পর্যন্ত সময়কালে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন রাজনৈতিক, কুটনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে একটা বই লিখবেন। তার ধারাবাহিকতায় তিনি রাষ্ট্রপতির সাথে দেখা করেন। এই দুইজন একসময় ইত্তেফাকে কলিগ ছিলেন। মতিউর রহমানের আগ্রহ ছিল রাষ্ট্রপতির সাথে দেখা করে শেখ হাসিনার ছেলে জয়ের “আমার মা পদত্যাগ করেনি” বক্তব্যটা ক্রস চেক করে পদত্যাগ পত্র দেখা। এর আগে মতিউর রহমান বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ে ধর্না দিয়েও কোথাও পদত্যাগ পত্রের হদিস পান নাই। তাই রাষ্ট্রপতির কাছে জিজ্ঞেস করেন যে উনি পদত্যাগ পত্র পেয়েছেন কীনা। রাষ্ট্রপতি ব্যাপারটা স্পষ্ট করে বলেন যে তিনি পদত্যাগ পত্র দেখেন নাই। বিভিন্ন জায়গায় চেয়েও পান নাই। এটাও বলেছেন যে এটা একটা মিমাংসিত বিষয়। এটা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির কিছু নাই কারণ সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের কাছে রেফারেন্স পাঠান এবং প্রধান বিচারপতির কাছ থেকে “সরকার গঠনে বাঁধা নাই” পরামর্শ নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনে সম্মতি দিয়েছেন এবং শপথ পড়িয়েছেন। পুরো ব্যাপারটাই সংবিধান সম্মতভাবেই হয়েছে।
২. এই সাক্ষাতকার প্রকাশ হয়েছে ১৯ অক্টোবর ২০২৪! প্রফেসর আসিফ নজরুল ২১ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলনে এসে বলেন, “আমার কথা হচ্ছে রাষ্ট্রপতি যে বলেছেন, উনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ পত্র পান নাই। এটা হচ্ছে মিথ্যাচার এবং উনার শপথ লঙ্ঘনের শামিল। কারণ উনি ৫ আগস্ট রাত ১১ টা বিশ মিনিটে পিছনে তিন বাহিনীর প্রধানকে নিয়ে জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষনে বলেছেন যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী উনার কাছে পদত্যাগ পত্র জমা দিয়েছেন এবং উনি তা গ্রহণ করেছেন।”
প্রথমেই বলে নেই সরকারের একজন আইন উপদেষ্টা হয়ে দেশের সর্বোচ্চ আসনের মানুষকে “মাননীয়” শব্দটা ব্যবহার না করাটা শিষ্টাচার বহির্ভূত হয়েছে। এটা কাম্য নয়। এটাকে অসদাচরণ হিসেবেও গণ্য করা যেতে পারে।
তারপর আমার স্যার বললেন, “এটা মিথ্যাচার ও উনার শপথ লঙ্ঘনের শামিল”! এর পিছনে উনি যুক্তি দিয়েছেন ৫ই আগস্টে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ। স্যারের ওয়ালে রাষ্ট্রুপতির ভাষণটা পোস্ট করেছেন। রাষ্ট্রপতি তার ভাষণে বলেছিলেন, “প্রিয় দেশবাসী। আসসালামু আলাইকুম। আপনারা জানেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এবং আমি তা গ্রহণ করেছি।” এই যে “আপনারা জানেন” দিয়ে উনি বুঝিয়েছেন দেশের মানুষ ইতোমধ্যেই জানে যে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। দুপুরে সেনাপ্রধান ওয়াকারুজ্জামান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে বলেই দিয়েছিলেন যে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু কিভাবে পদত্যাগ করেছেন সেটা স্পষ্ট করেন নাই তখন। একইভাবে রাষ্ট্রপতিও ভাষণে স্পষ্ট করে বলেন নাই যে শেখ হাসিনা তার কাছে এসে পদত্যাগ পত্র জমা দিয়েছেন কীনা।
৩. ইউটিউব ভিডিওতে মতিউর রহমান চৌধুরীর কাছে জিজ্ঞেস করা হয়, “আপনার কাছে কী মনে হয়েছে রাষ্ট্রপতি মিথ্যাচার করেছেন”? উমি স্পষ্ট বললেন, “রাষ্ট্রপতি মিথ্যাচার করেন নাই।রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগ পত্র থাকলে উনি দেখাতেন।” আমরা প্রতিবেদনে দেখতে পাই যে রাষ্ট্রপতি সেনাবাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যাক্তির কাছে, জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়ের কাছে , উপদেষ্টাদের কাছে শেখ হাসিনার পদত্যাগ পত্র চেয়েছেন এবং কেউ দিতে পারেননি। উনি আরো বলেছেন যে সকাল ১০ টার সময় প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে ফোন করে জানানো হয় যে প্রধানমন্ত্রী তার সাথে দেখা করবে। কিন্তু আধা ঘন্টা পরেই সেটা বাতিল করা হয়। দেশের সকল মানুষের মতো রাষ্ট্রপতিও দেখলেন শেখ হাসিনা গণভবন থেকে হেলিকপ্টারে করে চলে গেলেন। তারপর সেনা প্রধানের ভাষণ শুনলেন এবং জানলেন তারা রাষ্ট্রপতির সাথে দেখা করতে যাচ্ছেন। এখানে মিথ্যাচারের কিছু হয়নি। যা ঘটেছে উনি তাই বলেছেন। মতিউর রহমান চৌধুরী আরো পরিষ্কার করে বলেছেন যে রাষ্ট্রপতি যদি এখন মিথ্যাচার করেই থাকেন তার মানে পদত্যাগপত্র উনার কাছে আছে এবং সেটা গায়েব করেছেন কিন্তু সাথে সাথে বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ে সেটার কপি আছে। আসিফ নজরুল বা উপদেষ্টা পরিষদ সেটা দেখিয়ে বলুক যে এইযে পদত্যাগপত্রের কপি। এরকম অভিযোগ করার আগে আসিফ নজরুলকে ভাবা উচিৎ ছিল এটা তার উপর আসবে। এখন আমরা পদত্যাগ পত্র দেখতে চাইবো।
৪. আসিফ নজরুল রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যাক্তির কাছ থেকে দুইবার দুইরকমের কথাকে মিথ্যাচার বলেছেন। ভাষণে রাষ্ট্রপতি বলেছেন, “আমি গ্রহণ করেছি”! এটুকুকে মিথ্যাচার করার কথা বলা যেতে পারে। আমি গ্রহণ করেছি মানে হলো তার অফিস গ্রহণ করেছে। এবার আসল ঘটনা বলি। রাষ্ট্রপতি আওয়ামীলীগ সরকারের মনোনিত। উনি নিজেও আওয়ামীলীগের রাজনীতি করতেন। উনার পিছনে তিন বাহিনীর প্রধানকে দেখতে পেয়েছি আমরা। কিন্তু সামনে কী ছিল তা দেখতে পাইনাই। এরকম অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তার দলের প্রধানকে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছে আর তার উপর প্রেশার থাকবে না এটা পাগলেও বুঝে। আর রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিনের ভাষণ ইনি নিজে লিখেন না। কেউ লিখে দেয় আর উনি পড়েন। তাই আসিফ নজরুলের মিথ্যাচার ও শপথ লঙ্ঘন অভিযোগটা হাস্যকর। সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ফেসবুকে লিখেছে যে শেখ হাসিনা মৌখিকভাবে পদত্যাগ করেছে। বিক্ষোভ মিছিলের কারণে রাষ্ট্রপতির কাছে লিখিত পদত্যাগ দিতে পারে নাই। একই উপদেষ্টা পরিষদের দুইজন দুই রকম কথা বলছেন। কে মিথ্যাচার করছে আসলে?
৫. আসিফ নজরুল দুইদিন পর সংবাদ সম্মেলনে আসছেন ভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে। বেশ কিছুদিন ধরে গুঞ্জন চলছে সেনা প্রধানকে পদত্যাগ করানোর ব্যাপারে। সেনাপ্রধানকে সরাতে পারে একমাত্র রাষ্ট্রপতি। একটা অনুমানের কথা শুনেছি, রাষ্ট্রপতিকে উপদেষ্টাদের কেউ সেনাপ্রধানকে পদত্যাগ করানোর কথা বলার পর সেটা তিনি সেনাপ্রধানকে জানিয়ে দিলে সেই প্ল্যান ভেস্তে যায়। সেনাপ্রধানকে সরাতে গেলে নতুন রাষ্ট্রপতির দরকার হবে। সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করা খুব কঠিন কাজ। একমাত্র পার্লামেন্ট পারে এই কাজ করতে। শারিরীক এবং মানসিকভাবে অক্ষমতা প্রমাণ করা গেলে এবং অসদাচরণ করেছেন বা সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন প্রমান করতে পারলে একটা সুযোগ তৈরি হবে রাষ্ট্রপতিকে সরানোর। আসিফ নজরুলের তাই “মিথ্যাচার” এবং “শপথ লঙ্ঘন” অভিযোগ নিয়ে হাজির হয়েছেন। আসিফ নজরুল স্যার আজ রাষ্ট্রপতির ব্যাপারে এটা বলছেন, কিন্তু কয়েকদিন আগে তার কলিগ তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ যখন বললো, “এই সরকার বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনক মনে করে না”, তখন কিছুই বলে নাই। নাহিদ এই কথা বলে সংবিধান লঙ্ঘন করেছে এবং তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করে চুপ থেকেছেন। নাহিদের “এই সরকার” বলা মানে আসিফ নজরুলসহ সবাই। তার মানে পুরো উপদেষ্টা পরিষদ সংবিধান লঙ্ঘন করেছে। এখন সংবিধান লঙ্ঘনের কথা বলতে আসলে আগে নাহিদের প্রসংগে বলতে হবে। রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে গেলে আগে নাহিদসহ অন্যান্য উপদেষ্টার বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
৬. মাহফুজ, নাহিদ, আসিফের তাত্ত্বিক গুরু ফরহাদ মজহারের আজকের লেখাটা ইন্টারেস্টিং। আসিফ মাহমুদের “মৌখিকভাবে পদত্যাগ করেছেন” কথাটাকে ভুয়া বলে বলছেন যে সবসময় প্রেসিডেন্টের কাছে পদত্যাগ করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। তাই তিনি বারবার পদত্যাগপত্র দেখতে চেয়েছেন কিন্তু কখনোই সেটা দেশবাসিকে দেখানো হয় নাই। এই সরকারকে অবৈধ সরকার বলে আসছেন তিনি একদম শুরু থেকেই। তিনি আসিফ নজরুলের উদ্দেশ্যে বলেন তার আজকের কর্মকান্ড একটা সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লবের দ্বার খুলে দিয়েছে। তার ভাষ্য হলো “পদত্যাগ নিয়ে নাটক কম করো পিয়”!
৭. অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার পতন ঘটিয়ে সংবিধান অনুসারে বিপ্লবী সরকার গঠন করার পর যে সাংবিধানিক শুন্যতা তৈরী করেছে এই সরকার তা ভয়ংকর আকার ধারণ করেছে। মজহার বারবার বলেছে শেখ হাসিনার নিয়োগকৃত রাষ্ট্রপতির কাছে বঙ্গভবনে শপথ নেওয়াটা ভুল ছিল, তার সাথে আমিও কিছুটা একমত। যেহেতু সংবিধান অনুসারে শুরু করেছে এখন সংবিধান পুরোটা মেনেই এই সরকারকে চলতে হবে। একটু মানবো, আরেকটু মানবো না, এরকম করে লেজে গোবরে করে ফেলা এই সরকার তার গ্রহণযোগ্যতা একের পর এক হারাচ্ছে। ফরহাদ মজহারের যাবতীয় ক্ষোভ আসিফ নজরুলের উপর। বোঝা গেল তার উপরই যাবতীয় ক্ষোভ ঝাড়ছেন তার কথা মতো সরকার গঠন না করায়। উনার ভাষ্যমতে যে আইনী জটিলতা তৈরি করেছে এই সরকার তার থেকে উত্তরণের পথ আপাতত জানা নাই।
আমার খালি জলের গানের দুইটা লাইন মনে পড়ে:
“উড়ছি কেন, কেউ জানেনা যাচ্ছি কতদূর?
আজন্ম এক পাপের বোঝা কাঙ্খিত ভাঙচুর।”
অক্টোবর ২১, ২০২৪
অটোয়া, কানাডা