এক নিবন্ধে নিজের পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার, বিষণ্নতা এবং জীবনে ভারসাম্য খোঁজার অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন বিবিসির বিশেষ প্রতিবেদক ফার্গাল কীন। তাঁর দীর্ঘ পথচলায় পাওয়া শিক্ষা শুধু গুরুতর মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগতে থাকা মানুষদের জন্যই নয়, বরং জীবনে সামান্য আনন্দের খোঁজে থাকা সবার জন্যই প্রাসঙ্গিক।
ফার্গাল লিখেছেন—প্রায় দুই বছর আগে একটি মুহূর্ত তাঁকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছিল। তিনি এক প্রিয়জনের সঙ্গে আয়ারল্যান্ডের ওয়াটারফোর্ড কাউন্টির আর্ডমোরের কুরাঘ সমুদ্র সৈকতের পূর্ব প্রান্তে হাঁটছিলেন। শৈশব থেকেই এটি ছিল তাঁর খুব পছন্দের একটি স্থান। তাঁরা দুজন একটি নদীর পাশে গিয়ে থেমেছিলেন। নদীটি আর্ডমোর উপসাগরে গিয়ে মিশেছে।
নদীর প্রবাহ আর তীরে ঢেউয়ের ধাক্কার শব্দ ভেসে আসছিল ফার্গালের কানে। কিন্তু হঠাৎ করেই ডানা ঝাপটানোর শব্দ বাতাস কাঁপিয়ে দিল। ব্রেন্ট হাঁসের একটি ঝাঁক ক্লিফের ওপর দিয়ে উড়ে গেল। আর এই দৃশ্যটা দেখেই এক বিহ্বল অনুভূতি হলো ফার্গালের। কৃতজ্ঞতায় হেসে উঠলেন তিনি।
গত ১৫ জানুয়ারি সেই ঘটনাটি আবারও মনে পড়লে ফার্গাল ভাবলেন—‘আহা, এটাই বোধ হয় সুখের অনুভূতি!’
যে দিনটিতে সেই স্মৃতি ভেসে এল, উত্তর গোলার্ধের হিসেবে সেই দিনটি ছিল ‘ব্লু মানডে’। বিবেচনা করা হয়, এটি বছরের সবচেয়ে বিষণ্ন দিন।
সেই বিষণ্ন দিনেই দিনেই কি-না অতীতের একটি সুন্দর সুখের স্মৃতি মনে পড়ল ফার্গালের! একজন পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারে ভোগা ব্যক্তি হিসেবে তিনি অবশ্য ভালো করেই জানেন, দুঃখের জন্য কোনো নির্দিষ্ট দিনের প্রয়োজন হয় না।
২০২৩ সালের মার্চে একটি আবেগঘন সংকট কাটিয়ে উঠেছিলেন ফার্গাল। সে সময় তাঁর মনে হয়েছিল, যেন তিনি বারবার নিজের সঙ্গেই লড়াই করেছেন। তিনি বিষণ্নতা, ভয়, রাগ এবং অস্বীকারের সঙ্গে দীর্ঘদিন যুদ্ধ করেছেন। এসবের জন্য ৯০-এর দশকের পর থেকে বেশ কয়েকবারই তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। ত্যাগ করেছেন মদ্যপানের অভ্যাসও। কিন্তু ২০১৯ সালে পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারের কারণে তিনি বিবিসির আফ্রিকা এডিটরের পদও ছেড়ে দিয়েছিলেন।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, মানুষের মস্তিষ্ক স্বাভাবিকভাবে নেতিবাচকতার দিকে ঝুঁকে থাকে। ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ব্রুস হুড ‘হ্যাপিনেস সায়েন্স’ নিয়ে কোর্স পরিচালনা করেন। তবে তিনি বলেন, পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারের মতো মানসিক সমস্যাগুলোর ক্ষেত্রে সাধারণ কৌশলগুলো সব সময় কার্যকরী নাও হতে পারে।
ফার্গালের পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার প্রথমবার ধরা পড়ে ২০০৮ সালে। যুদ্ধের রিপোর্টিং এবং শৈশবের কঠিন অভিজ্ঞতা এর প্রধান কারণ ছিল। কিন্তু চিকিৎসা, থেরাপি এবং সহমর্মী মানুষদের সঙ্গ তাঁকে সাহায্য করেছে।
সুখ নিয়ে ভাবার দীর্ঘ বছর পর এখন ফার্গালের মনে হয়, সুখের আসলে কোনো গোপন রহস্য নেই। এটা চারপাশে ছড়িয়ে আছে। কিন্তু এটা দৈনন্দিন জীবনের সহজাত বিষয় নয়। এটি কাজের মাধ্যমেই অর্জন করতে হয়।
যে কাজ ক্লান্তি ও বিষণ্নতায় নিয়ে গিয়েছিল, তার পরিবর্তে ফার্গাল মনোযোগ দিয়েছেন এমন কাজে, যা তাঁকে শান্তি এনে দেয়। মনকে শান্ত রাখার জন্য তিনি এখন অনেক কিছুই করেন, এমনকি কবিতাও পড়েন। প্রিয়জনদের সঙ্গে বেশি সময় কাটান, তাঁদের কথা শোনেন। এমনকি ছোটখাটো গৃহস্থালির কাজগুলোও তিনি মনোযোগ দিয়ে করেন।
ফিনল্যান্ডের দার্শনিক ফ্র্যাঙ্ক মার্টেলা বলেন, ‘অন্যদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করুন এবং নিজেকে জানুন। ছোট ছোট সহৃদয় কাজগুলোও গুরুত্বপূর্ণ।’
মার্টেলার কথাই শুধু নয়, ফার্গালের বন্ধু এবং পরামর্শদাতা গর্ডন ডানকান একসময় তাঁকে বলেছিলেন, ‘তুমি তোমার কল্পনার চেয়েও শক্তিশালী।’ এই কথাটিতে আজও অনুপ্রেরণা খোঁজেন তিনি।
ফার্গালের কাছে সুখ মানে প্রিয়জনদের ভালোবাসা, একটি সুন্দর সকাল, আর জীবনের প্রতি কৃতজ্ঞতা। বিবিসির নিবন্ধটিতে তিনি লিখেছেন—আমার মতো যারা বিষণ্নতায় বা মানসিক কষ্টে ভুগছেন, তাদের জন্য আমি বলব, সুখের পথে হাঁটা কখনো বন্ধ করবেন না।