ইউরোপের যেকোনো বড় নগরী থেকে বিমানে মাত্র দুই ঘণ্টার পথ ফ্রান্সের দক্ষিণে ছবির চেয়ে সুন্দর একটি শহর—তুলুজ। প্যারিস থেকে ৭০০ কিলোমিটার বা ৪৪০ মাইল দক্ষিণে এই শহরের আরেক নাম গোলাপি শহর। শেষ বিকেলের মিষ্টি রোদ যখন গারোঁন নদীর তীরে প্রাচীন ইমারতগুলোর গোলাপি রঙের ইটের ওপর ঠিকরে পড়ে, তখন একধরনের উজ্জ্বল গোলাপি আভা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। সৃষ্টি হয় মোহনীয় পরিবেশ। অনেকে মনে করেন, এ কারণে শহরটির নাম গোলাপি শহর।
আকাশ পরিষ্কার থাকলে এখান থেকে দেখা যাবে আরও দক্ষিণে স্পেন ছুঁয়ে পিরেনিজ পর্বতমালার তুষারাচ্ছাদিত অসংখ্য চূড়া। বরফ গলা স্বচ্ছ পানির ধারা নিয়ে পিরেনিজ-কন্যা গারোঁন নদী এই শহরের বুক চিরে চলে গেছে, মিশেছে অতলান্তিকের (আটলান্টিক) নোনাপানিতে। ইউরোপের মানুষের আকাশ ও মহাকাশ জয়ের সূচনা এই তুলুজ থেকেই হয়েছিল। আজও তাই তুলুজ ইউরোপের বিমান এবং মহাকাশবিজ্ঞান, প্রযুক্তির তীর্থস্থান তথা রাজধানী। মহাকাশ গবেষণা ও এয়ারবাস নির্মাণের মূল কেন্দ্র এই শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত এবং বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কারণে তুলুজ ইউরোপের সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্র। এ শহরে রয়েছে পর্যটকদের পছন্দের অনেক দর্শনীয় স্থাপনা ও স্থান।
প্লাস ক্যাপিতল
এই নগরের প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে প্লাস ক্যাপিতল। নগরীর হৃদয়ের ধুকপুকানি এখানে এলেই অনুভব করা যাবে। উৎসব, আনন্দ, দুঃখ-বেদনা আর অসন্তোষ প্রকাশে নাগরিকেরা এই প্রশস্ত ও উন্মুক্ত জায়গায় সমবেত হন। এখানেই দেখা মিলবে ৮০০ বছরের প্রাচীন দৃষ্টিনন্দন প্রাসাদসম ভবনের। বর্তমানে ভবনটিতে রয়েছে পৌরপ্রধানের সভাকক্ষ ও থিয়েটার। স্থাপত্য সৌকর্যের অন্যতম নিদর্শন এই ভবন বাদ দিয়ে তুলুজকে কল্পনা করা যায় না। ভবনটির প্রথম তলায় রয়েছে মনোরম বেশ কয়েকটি প্রশস্ত মহল।
নামকরা শিল্পীদের ভাস্কর্য ও বিশাল আকৃতির বেশ কিছু চিত্রকর্ম। জাঁকজমকের প্রতীক ফরাসিরা এর নাম দিয়েছে সাল দেজ ইলুস্ত, অর্থাৎ রংমহল। শিল্পীর রঙের জাদুকরি ছোঁয়ায় রংমহলের দেয়াল এমনকি মাথার ওপরের ছাদ পর্যন্ত প্রাণবন্ত হয়েছে জীবনের প্রতিচ্ছবি ও ইতিহাসের স্পন্দনে। তুলুজে এসে নান্দনিক রংমহল না দেখে ফিরে গেলে অনেকটা অদেখা থেকে যাবে এ শহর। ক্যাপিতল ঘিরে রয়েছে বেশ কিছু রেস্তোরাঁ, ক্যাফে ও বার। এখানে নগরীর ব্যস্ত মানুষেরা ভিড় জমায়, পানপাত্র হাতে অকারণ আলস্যে সময় কাটায় গল্পে, আড্ডায়।
যাঁদের হাতে সময় কম, তাঁরা এই ভবনের ঠিক পেছনে পর্যটন অফিসে গিয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য পেয়ে যাবেন। সুহাসিনী ক্লারা আপনাকে চমৎকার ইংরেজিতে সব বলে দেবে। বলে দেবে ছাদখোলা বাসে চড়ে অল্প সময়ে নগরীর কোন কোন দর্শনীয় স্থান দেখা যাবে, সেসব তথ্য।
স্যাঁ সারনা গির্জা
ক্যাপিতলের কাছাকাছি স্যাঁ সারনা গির্জা। বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পাওয়া রোমানদের নির্মিত ইউরোপের সর্ববৃহৎ প্রাচীন গির্জাটি সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রায় হাজার বছর পার করেও টিকে আছে। স্থাপত্যকলায় চিত্তাকর্ষক শতাব্দীপ্রাচীন প্রায় দেড় ডজন গির্জা রয়েছে তুলুজে। প্রাচীন গির্জার সংখ্যায় ইউরোপে রোমের পরে তুলুজের স্থান।
নদীর নাম গারোঁন
ক্যাপিতল থেকে হেঁটে পৌঁছানো যায় গারোঁন নদীর তীরে। তীর ধরে হেঁটে যেতে যেতে চোখে পড়বে পোঁ নাফ, অর্থাৎ নতুন সেতু। প্রায় ৪০০ বছরের পুরোনো হলেও প্রাচীন মানুষদের এই সৃষ্টিকর্ম আজও নতুন। একটু এগিয়ে গেলে চোখে পড়বে ভাস্কর্য সুষমামণ্ডিত বিশাল এক ভবন, ফ্রান্সের নামকরা চারুকলা অনুষদ। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে এখানে আসেন বহু কৃতী শিল্পী। রৌদ্রোজ্জ্বল বিকেলে নগরীর মানুষেরা নদীর তীরে ভিড় জমায় খানিকটা প্রশান্তির জন্য।
ক্যানাল দ্যু মিডি
প্রায় সাড়ে ৩০০ বছর আগে ২৫০ কিলোমিটার বা ১৫৫ মাইল লম্বা এই খাল খনন করা হয়। ১২ হাজার শ্রমিকের ১৫ বছরের পরিশ্রমে খালটির মাধ্যমে ভূমধ্যসাগর ও অতলান্তিক মহাসাগরকে সংযুক্ত করা সম্ভব হয়েছিল। ফলে সে সময়ে বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলে সময় ও দূরত্ব অনেক কমে এসেছিল। এমন বিশাল কর্মকাণ্ড ছিল অসম্ভবকে সম্ভব করার মতো বিস্ময়কর। খালটি ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পেয়েছে।
সিতে দ্য লেস্পাস
অর্থাৎ মহাকাশ নগরী। মহাকাশকে সাধারণ মানুষের চোখের সীমানায়, জ্ঞানের আয়ত্তে আনার সব ব্যবস্থা করা হয়েছে এখানে। এখানে দেখা যাবে ইউরোপের সবচেয়ে বড় উল্কাপিণ্ড, বেশ কিছু পুরোনো কৃত্রিম উপগ্রহ। প্রবেশ করা যাবে প্রথম স্পেস স্টেশন মিরে। চাঁদের দেশে হেঁটে বা গাড়িতে ঘুরে বেড়ানোর অনুভূতি এবং আরও অনেক কিছু। প্রেক্ষাগৃহের ৩৬০ ডিগ্রির পর্দায়, ত্রিমাত্রিক ছায়াছবিতে মহাকাশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা হবে মনে রাখার মতো। তুলুজের অন্যতম আকর্ষণ এই মহাকাশ নগরী।
জাদুঘর
জাদুঘরের শহর তুলুজে ডজনখানেক জাদুঘর রয়েছে। এগুলোর মধ্যে প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘরে দেখা যাবে প্রাণিকুলের বিচিত্র মেলা, ৭৭ প্রজাতির প্রাণীর কঙ্কাল, চাঁদের মাটি এমনকি প্রাচীন মানুষের মমি। যন্ত্রের জাদুঘরের মেশিনঘরে দেখা মিলবে মানুষের তৈরি দানবাকৃতির যন্ত্র, ঢাউস আকৃতির বৃশ্চিক-কন্যা এবং মাকড়সার। যন্ত্রদানবদের জীবন্ত আচরণ ছোট-বড় সবার মনে সৃষ্টি করে বিস্ময়। পাইওনিয়ার জাদুঘরে রয়েছে বিমানে আকাশ জয়ের সূচনালগ্নে যেসব দুঃসাহসী মানুষ জীবন বাজি রেখে বিপজ্জনক অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের প্রামাণ্য নিদর্শন। অন্যদিকে আরেকটি জাদুঘর, অ্যারোস্কোপিয়াতে বিমান প্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতির ধারণা পাওয়া যাবে। একটি আস্ত কনকর্ড বিমান রয়েছে এখানে। সর্বকালের দ্রুতগামী বাণিজ্যিক বিমান কনকর্ড এবং সবচেয়ে বড় বিমান এয়ারবাস-৩৮০ তুলুজেই নির্মাণ করা হয়েছিল। এগুলো প্রথম তুলুজের আকাশে ডানা মেলেছিল।
এ শহরে রয়েছে ডজনখানেক ভারতীয় রেস্তোরাঁ এবং বহু কাবাব ঘর। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক ও কর্মচারীদের প্রায় সবাই বাংলাদেশের। পাতালরেল, বাস, মেট্রো মিলিয়ে চমৎকার পরিবহনব্যবস্থাও আছে। ইউরোপের একমাত্র শহর তুলুজে রয়েছে সাধারণ মানুষের যাতায়াতের জন্য কেব্ল কার সার্ভিস।
শহরের প্রধান সড়কটি পথচারী এবং সারি সারি স্থলপদ্মগাছের দখলে। ফুলের সৌরভে তুলুজ শহরের পথে পথে হেঁটে বেড়ালে ভ্রমণের নেশা লাগবেই, এড়ানো যাবে না।