চায়ের কথা শুনলেই মন কেমন প্রশান্তিতে ছেয়ে যায়, তাই না? তবে চায়ের আছে অনেক ধরন— গ্রিন টি, লাল চা, দুধ চা, লেবু চা, মশলা চা আরও কত কি! এর মধ্যে আবার অনেকে পছন্দ করেন ধোঁয়া ওঠা গরম চা, অনেকে গরম চা ঠান্ডা করে খেতে পছন্দ করেন আবার কেউ ভালোবাসেন বরফ দেওয়া চা। এমন হরেক রকমের পছন্দের কথা বলতে গিয়ে এবার ভাবনায় ঘুরছে, গরম চা না কি ঠান্ডা চা— কোনটা স্বাস্থ্যের জন্য বেশি উপকারী।
গরম চা না কি ঠান্ডা চা, কোনটা শরীরের জন্য ভালো— এই আলাপে দুবাইয়ের ক্লিনিক্যাল ডায়েটিশিয়ান শ্যামা চ্যাটার্জির কাছ থেকে জানা গেল বিভিন্ন রকম চায়ের ভিন্ন ভিন্ন সব উপকারিতার কথা।
গরম চা
কাজের ভীষণ চাপ, সারা দিনের পরিশ্রমে প্রচণ্ড ক্লান্তি কিংবা তীব্র শীতে ঠান্ডায় জমে যাওয়া— এমন সময় এক কাপ গরম চা যে শান্তি এনে দেয়, তা বলে বোঝানো মুশকিল।
ক্লিনিক্যাল ডায়েটিশিয়ান শ্যামা বলছেন, গরম চা হলো আরামদায়ক সঙ্গী। ভারী খাবারের পর এই চা পান হজমে সহায়তা করে। শরীর গরম রাখে এবং পেশি শিথিল করতে সাহায্য করে। আর যদি এতে সুগন্ধি থাকে, তাহলে তো কথাই নেই—মন শান্ত করতে একদম পারফেক্ট।

এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা যদি খুঁজতে যাই তাহলে ২০১৮ সালে দ্য ইউরোপিয়ান জার্নাল অব নিউট্রিশনে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায়, গরম পানীয়, যেমন—গ্রিন টি বা ব্ল্যাক টি, রক্ত সঞ্চালনে গতিশীলতা আনে এবং ঠান্ডা পানীয়ের তুলনায় শরীরে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট শোষণ বাড়াতে সাহায্য করে।
ডায়েটিশিয়ান শ্যামা চ্যাটার্জি আরও বলেন, গরম চা সাধারণত মানসিক প্রশান্তি এনে দেয়। গরম চা পানে ভালো ঘুম হয়। দিনের শেষে শরীর ও মন শান্ত করতে সাহায্য করে গরম চা।
গরম পানিতে গ্রিন টি ফোটালে এতে থাকা ক্যাটেচিন, বিশেষ করে ইপিগ্যালোক্যাটেচিন গ্যালেট (ইজিসিজি) বেশি পরিমাণে বের হয়। ইজিসিজি হৃদযন্ত্রের জন্য ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। আর ক্যামোমাইল টি হালকা গরম পান করা সবচেয়ে ভালো বলে মনে করেন ডায়েটিশিয়ান শ্যামা। এতে মন শান্ত হয়।
আইসড টি
সতেজতা আর অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের মিশেলে এক কাপ আইস টি গ্রীষ্মের এই দিনগুলোতে শরীর-মন ঠান্ডা করে দেয়। শ্যামা চ্যাটার্জি বলছেন, আইসড টির নিজস্ব কিছু গুণ আছে।
গরম আবহাওয়ায় শরীরকে হাইড্রেটেড রাখতে সাহায্য করে আইসড টি। যারা গরমের সময় গরম চা খেতে পারেন না, তাদের জন্য আইসড টি ভালো বিকল্প। এই চায়ের সঙ্গে বিভিন্ন ফল, হার্বস (ভেষজ) মিশিয়ে বিভিন্ন স্বাদে তৈরি করে পান করা যায়।
জার্নাল অব ফুড সায়েন্সে প্রকাশিত একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, চা ঠান্ডা করলে কিছু অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের মাত্রা কমে যেতে পারে, তবে যদি আইসড টির ক্ষেত্রে চা ৬-৮ ঘণ্টা ধরে ঠান্ডা পানিতে ভেজানো থাকে, তাহলে এতে থাকা পলিফেনল বেশ উপকারী পর্যায়ে যায়।
শ্যামা চ্যাটার্জি বলেন, আইসড টি সাধারণত অনেকে বেশি পরিমাণে পান করে, যা পানির প্রয়োজন মেটাতে কাজ করে।
যেসব আইসড টি আপনার প্রতিদিনের সঙ্গী হতে পারে—
১. হিবিসকাস টি: রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে।
২. লেবু দিয়ে ব্ল্যাক টি: হজমে সহায়তা করে এবং ভিটামিন সি-এর বাড়তি সুবিধা দেয়।
৩. হোয়াইট টি: ঠান্ডা বা গরম যেভাবেই পান করা হোক না কেন, এটি হালকা ও সতেজতাদায়ক।
গরম বা ঠান্ডা—চায়ের ক্ষেত্রে তাপমাত্রা কি সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ?
গরম বা ঠান্ডা দুই ধরনের চায়েরই আলাদা আলাদা উপকারিতা আছে। তবে এ কথাও সত্যি, চা কীভাবে বানানো হচ্ছে, সেটা চা গরম না ঠান্ডা এর চেয়ে বেশি জরুরি। চায়ের গরম বা ঠান্ডা পরিবেশনের চেয়ে চা ফোটানোর সময় ও পানির গুণমান চায়ের উপকারিতার ওপর অনেক বেশি প্রভাব ফেলে।
গরম চা সাধারণত ফুটন্ত বা প্রায় ফুটন্ত পানিতে বানানো হয়, যার ফলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান দ্রুত বের হয়ে আসে। সেগুলো হলো—
ক্যাফেইন: শক্তি বাড়ায়।
থিয়ানিন: মনোসংযোগ বজায় রাখতে সাহায্য করে, আবার শান্তভাবও আনে।
ক্যাটেচিন: শক্তিশালী অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, যা হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্যের সঙ্গে যুক্ত এবং শরীরের ফ্যাট কমাতে সাহায্য করে।
উচ্চ তাপমাত্রায় এসব উপাদান দ্রুত বের হয় বলে গরম চায়ের স্বাদ হয় অনেক বেশি ঘন ও শক্তিশালী, আর যারা স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে চা পান করেন, তাদের জন্য এটা বেশ উপকারী।
অন্যদিকে, ঠান্ডা চা তৈরি হয় ঠান্ডা পানিতে সাধারণত ৬–১২ ঘণ্টা চা-পাতা ভিজিয়ে রেখে। এই ধীর ও মৃদু পদ্ধতির কারণে চায়ের গঠনেও কিছু পার্থক্য আসে—
১. ক্যাফেইনের পরিমাণ কম থাকে, ফলে পেট ও স্নায়ুতন্ত্রে চাপ কম পড়ে।
২. অম্লতা কম, যেটা অনেকেই সহজে হজম করতে পারেন।
৩. ফ্ল্যাভোনয়েড বেশি মাত্রায় সংরক্ষিত থাকে, বিশেষ করে হালকা ধরনের চা যেমন হোয়াইট টি বা উলং টি-তে।
ঠান্ডা চায়ের স্বাদ যেমন মসৃণ, তেমনি আরও বেশি রিফ্রেশিং ও হাইড্রেটিং—বিশেষত তাদের জন্য, যাদের কাছে গরম চা একটু বেশি তীব্র লাগে।
তবে চা আপনি কোন উদ্দেশ্যে পান করছেন, তার ওপর নির্ভর করে বাছাই করতে পারেন—
১. অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট চাই? গরম গ্রিন টি হতে পারে ভালো সঙ্গী।
২. হাইড্রেশন দরকার? বরফ ঠান্ডা হার্বাল ইনফিউশন টি একদম পারফেক্ট।
৩. চাপ কমাতে চান? গরম বা ঠান্ডা— ক্যামোমাইল চা ভালো কাজ দেবে।