Homeলাইফস্টাইলঈদের ছুটিতে অ্যাডভেঞ্চার

ঈদের ছুটিতে অ্যাডভেঞ্চার


দেশের তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে খাগড়াছড়ি একটি। এই জেলাকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধারও বলা হয়। ফলে এখানে পর্যটকদের যাতায়াত আছে বেশ। যোগাযোগব্যবস্থাও দারুণ। ঈদের লম্বা ছুটিতে হাতে তিন থেকে চার দিনের সময় নিয়ে গেলে প্রকৃতির চোখজুড়ানো রূপ দেখে আসা যাবে।

ভ্রমণ পরিকল্পনা সব ঠিকঠাক। যাব অচেনা-অজানা দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে। তাই দীঘিনালার বাসিন্দা রকি বিশ্বাসের সহযোগিতা নিলাম। তিনি সবুজ সংকেত দিলে এক বৃহস্পতিবার রাতের গাড়িতে ছুটলাম খাগড়াছড়ি। ভোরে সেখানে নেমে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে উঠে বসলাম চান্দের গাড়িতে। প্রায় এক ঘণ্টা পর মহাসড়ক ছেড়ে তাবাক্ষ গুহার দিকে এগোতে থাকল গাড়ি। পাহাড়ি পথ। কিছুটা অগ্রসর হতেই গাড়ি খাদে আটকে যায়। ঠেলা-ধাক্কা, নাকে দড়ি বেঁধেও গাড়ি এগিয়ে নেওয়া গেল না। খাদে আটকা অচল গাড়ি সচল করতে গিয়ে একটা ঘণ্টা বরবাদ। অতঃপর দুই পা-ই ভরসা।

হাঁড়ি-পাতিল, বাজারসদাইসহ ট্র্যকিং শুরু। প্রখর রোদ উপেক্ষা করেই ট্র্যাকিং চলছে। মাঝেমধ্যে ছায়াঘেরা কোনো গাছতলায় জিরিয়ে নিই। চলতে চলতে চোখে ধরা দেয় নীল আসমানে পেজা তুলার মতো শুভ্র মেঘের ভেলা, কখনোবা কালো মেঘের ঘনঘটা, ঢেউ খেলানো পাহাড়, জুমের ফসল, দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ অরণ্য, উঁচু-নিচু পাহাড়। নলখাগড়ার জঙ্গল। এ সবই সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রাণশক্তি। এই শক্তি বেড়ে দ্বিগুণ হলো যখন একটা সময় পুরোপুরি জংলি পথে ঢুকে গেলাম। সে এক রোমাঞ্চকর ব্যাপার-স্যাপার। সব মিলিয়ে প্রায় তিন ঘণ্টা হাইকিং-ট্র্যাকিং করতে করতে পৌঁছে যাই বড় মাইরুং ঝরনার ওপরে। গড়িয়ে যাওয়া টলটলে পানির ঝাপটা চোখেমুখে দিতেই সব ক্লান্তি উবে যায়।

ঝরনা দেখে সবাই দড়ি বেয়ে তরতর করে নেমে গেল পানিতে। ১১০ কেজির দেহ নিয়ে প্রায় ৮৫ ডিগ্রি খাঁড়া পাহাড়ের আনুমানিক ৪০ থেকে ৫০ ফুট নিচে নেমে এলাম। বড় মাইরুং ঝরনার ঠান্ডা পানি মন কেড়ে নেয়। বয়ে চলা ঝিরির পরিবেশ দেখতেও বেশ নৈসর্গিক। ঝরনার পানি রিমঝিম ছন্দ তুলে অবিরাম গড়িয়ে পড়ে। এর শীতল পানি চুম্বকের মতো দেহটাকে টেনে নেওয়ায় ইচ্ছেমতো ভিজতে থাকি। সবুজের গালিচায় মোড়ানো গহিন পাহাড়ের বুক চিরে জেগে থাকা বড় মাইরুং ঝরনা মন জিতে নেয়।

ওদিকে বন্ধুদের কেউ কেউ জঙ্গল থেকে লাকড়ি কুড়িয়ে আনে। কেউ বড় বড় পাথর বসিয়ে চুলা বানায়। রন্ধন কারিগরেরা আগুন জ্বালিয়ে রান্নায় ব্যতিব্যস্ত। বাঁশকোড়ল সংগ্রহ করতে যাওয়া স্থানীয় বগড়াছড়া পাড়ার তরুণীরাও আমাদের রান্নাযজ্ঞে হাত মেলায়।

অল্প কিছুদূর গেলেই কাঙ্ক্ষিত তাবাক্ষ গুহার দেখা মিলবে। কিন্তু না। এখনই যাচ্ছি না। আগে দুপুরের আহার সেরে নেওয়া হবে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই রেডি হয়ে যায় সাদা ভাত আর মুরগির তরকারি। আহ্ কী ঘ্রাণ! এই ঘ্রাণ কি তবে ঝরনার পানি দিয়ে রান্নার কারণে? তা যাই হোক, সবাই মিলে পেট পুরে খাই। খেয়েদেয়ে এবার ছুটলাম তাবাক্ষ।

তুয়ারিমারাইং ঝরনা

তুয়ারিমারাইং ঝরনা

অল্প কিছু দূর মাইরুং তৈসা ঝিরিপথ ধরে এগোতেই গুহামুখের দেখা মেলে। দেখেই কেমন যেন রহস্যময় লাগে। ভেতরে ঢুকলে না জানি কী হয়! কিন্তু আমাদের থামাবে কে? একে একে সবাই সরু গুহার ভেতরে ঢুকে পড়ি। একটা সময় পুরোই ঘুটঘুটে অন্ধকার আমাদের আচ্ছন্ন করে। তবু সঙ্গে নেওয়া টর্চের আলোয় আগাতে থাকি। তাবাক্ষর ভেতরটা ভয়ংকর অদ্ভুত সৌন্দর্যে ঘেরা। পাথুরে পাহাড়ের মাঝে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট এই তাবাক্ষ গুহাটর্চের আলোয় ওপরের দিকে তাকালে মনের মাঝে ভয়ানক শিহরণ জাগে। তাবাক্ষর পাথুরে ছাদজুড়ে যেন রহস্য খেলা করে। গুহার কিছু কিছু জায়গা মাত্র ১৭ থেকে ১৮ ইঞ্চি চওড়া। সেসব জায়গা দিয়েও কাতচিৎ হয়ে অবলীলায় ঢুকে পড়ছি।

তাবাক্ষ গুহার পথ।

তাবাক্ষ গুহার পথ।

দলের প্রত্যেকের মাথায় অদেখাকে দেখার নেশা চেপে ধরেছে। ভয়ডর সব তখন ছিল ফিকে। কথা একটিই, দেখতে হবে তাবাক্ষর শেষ পর্যন্ত। গুহার আঁকাবাঁকা পথে আগাতে আগাতে একটা সময় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় সুরু পথের মাঝে থাকা একখণ্ড পাথর। হয়তো পাথরটি পথ আগলে না রাখলে আরও কিছুটা দূর যাওয়া যেত। খানিকটা সময় পাথরের চিপাচাপা দিয়ে চোখ বুলিয়ে সেখান থেকেই ফিরতি পথ ধরি। সাংবাদিক অপু দত্তর রিপোর্ট অনুযায়ী, তাবাক্ষ গুহা প্রায় ১৬০ ফুট দীর্ঘ। এর উচ্চতা ৩০ ফুট। আর প্রায় সাড়ে তিন ফুট প্রশস্ত এই গুহা।

স্থানীয়রা তাবাক্ষ গুহাটিকে দেবতার গুহা নামেও ডাকে। ত্রিপুরা ভাষায় ‘তাবাক্ষ’ অর্থ বাদুড়ের গুহা। যারা যে নামেই ডাকুক না কেন, এর সৌন্দর্য অসাধারণ। নিঃসন্দেহে ভ্রমণপিপাসুদের তাবাক্ষ গুহা রোমাঞ্চিত করবে এটা নিশ্চিত। তাবাক্ষ মিশন শেষ করার পরেও যাদের সময় থাকবে, তারা ফেরার সময়ই যেতে পারেন তুয়ারী মারাইং।

এমন পথ পেড়িয়েই যেতে হয় তাবাক্ষ গুহা।

এমন পথ পেড়িয়েই যেতে হয় তাবাক্ষ গুহা।

এবার আমাদের গাইড মিল্টন ত্রিপুরার নির্দেশনা মতো ছুটলাম। পথে ব্রেক দিয়ে পেটে কিছু দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। সারা দিন কী পাব আর কোথায় খাব এই ভেবে। তাই গরম ভাত, ডিম, ভর্তা আর ডাল দিয়েই সকালের নাশতা সেরে নিলাম। এরপর ছুটলাম পিচঢালা আঁকাবাঁকা পথে। যেতে যেতে নয়মাইল ছাড়িয়ে কিছুটা এগিয়ে মাহেন্দ্রে ঢুকে যায় ইট সুরকির পথ মাইতুই পাড়ার দিকে। মনের ভেতরে বেশ ভালো লাগা কাজ করতে থাকে।

চারপাশ সুনসান নীরব অরণ্য। তার মাঝ দিয়ে চলে গেছে সরু পথ। আলহাজ মোস্তফা হাকিম বিদ্যানিকেতন ছাড়িয়ে সীমানাপাড়ায় পৌঁছে গাড়িতে ব্রেক পড়ল। এবার শুরু ঢেউ খেলানো পাহাড়ে হাইকিং ট্রেকিং। সঙ্গে জুমের ফসলের মন উদাস করা ঘ্রাণ। চলার পথে ছোট্ট একটি জুমঘরে খানিকটা সময় জিরিয়ে নেওয়া। মাঝেমধ্যে দূর থেকে দৈত্যকার গাছের ঘন অরণ্য দেখার মাঝে অদ্ভুত অনুভূতি দোল দেয়। এরকমভাবে প্রায় ঘণ্টাখানিক ট্রেকিং করার পর এক বিশাল খাদের কিনারায় গিয়ে থামতে হয়।

বড় মাইরুং ঝরনা

বড় মাইরুং ঝরনা

এবার চিকন চিকন সব বাঁশের ফাঁক গলে নামতে হবে। দেখতে এসেছি, দেখতে হবে। তাই লতাগুল্ম ধরে ধরে নেমে যাই। নামলাম তো ঠিকই, কিন্তু এর পরের দৃশ্য যে ভয়ংকর তা বুঝিনি। অনবরত পানি গড়িয়ে যাচ্ছে। প্রায় দেড় শ ফুটের ওপর থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি পাথর আর পাথর। ঠিক ওই জায়গাটা দিয়েই ১০ থেকে ১২ ফুট নিচে নামতে হবে। একটু এদিক-সেদিক হলেই চোখে আর কিছু দেখতে হবে না। কী আর করা, সঙ্গীদের সাহায্যে রশি বেয়ে নেমে পড়ি। নিখাদ এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি। লিখে বোঝানো মুশকিল। বুঝতে হলে যেতে হবে মায়াবি প্রকৃতির সান্নিধ্যে ঘেরা তুয়ারী মারাইং। সেখানে প্রকৃতি যেমন মায়াবি, তেমনি চরম প্রতিশোধপরায়ণ। যাক সেসব গুরুগম্ভীর কথা। বরং বাকি অংশের ট্রেইল নিয়ে গল্প করি।

তুয়ারী মারাইং ঝরনার দেখা পেতে আর খুব বেশি পথ ছিল না। যতটুকুনই ছিল শুধু পাথর আর পাথর। দুপাশে খাঁড়া উঁচু পাহাড়, তার মাঝ দিয়েই চলছিল আমাদের হাইকিং। প্রাচীন গাছগুলোর ডালপালা এমনভাবে একটা আরেকটার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল, যে কেউ প্রথম দেখায় ভূতুরে বাড়ির প্রান্তর মনে করে ভুল করতে পারে। ভ্রমণের আনন্দ ঠিক এই জায়গাটাতেই।

এমন অবারিত প্রকৃতি অপেক্ষা করছে আপনার জন্য।

এমন অবারিত প্রকৃতি অপেক্ষা করছে আপনার জন্য।

যেতে যেতে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ঝরনার দেখা মেলে। তুয়ারী মারাইং ঝরনার রূপ দেখব, নাকি এর পরিবেশের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য দেখব স্থির করা কিছুটা অসম্ভব হয়ে যায়। প্রায় ১০০ ফুট উঁচু থেকে ঝরনার পানির ধারা পতনের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য এখানে। মন মাতানো অনবরত ছন্দ তোলা রিমঝিম শব্দ। পানি পড়তে পড়তে ঝরনার সামনে খুব সুন্দর ক্যাসকেড তৈরি হয়েছে। সেখানে অবলীলায় সাঁতার কাটা যায়। ঝরনার ডান পাশের পাহাড়ের পাদদেশটা চমৎকার আকৃতির। যেন বিশাল একটি থালা। সম্ভবত এ কারণেই ঝরনার নামটা তুয়ারী মারাইং।

তুয়ারী অর্থ কুয়া বা কূপ আর মারাইং অর্থ থালা। অর্থাৎ কুয়ার থালা বা কুয়ার মতো থালা। এটি একটি ত্রিপুরা ভাষার শব্দ। সব মিলিয়ে তুয়ারী মাইরাং ঝরনা ও এর পাহাড়ের পাদদেশের ভৌগোলিক আকৃতিসহ এখানে যাওয়ার ট্রেইলটা অসাধারণ সুন্দর।

সতর্কতা

অ্যাডভেঞ্চার ভ্রমণে রশি, শুকনো খাবার ও পর্যাপ্ত পানিসহ প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র সঙ্গে নিতে হবে। গাইডের পরামর্শ ছাড়া কোনো পাড়া বা পাহাড়ের পথে যাওয়া যাবে না।

যাবেন যেভাবে

ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ি রুটে যেতে হবে বাসে। অথবা বাস, ট্রেন বা ফ্লাইটে চট্টগ্রাম গিয়ে সেখান থেকে খাগড়াছড়ি। ঢাকা থেকে বাসে ভাড়া ৫০০ থেকে ১২০০ টাকা। তাবাক্ষ যেতে হলে খাগড়াছড়ি শহরের শাপলা চত্বর থেকে চান্দের গাড়িতে ১৭ কিলোমিটার দূরত্বের দীঘিনালা উপজেলার আটমাইল নামক এলাকা হয়ে বড় পাড়া বা বগড়াছড়া পাড়া পর্যন্ত যেতে হবে। এরপর প্রায় দুই কিলোমিটার পাহাড়ি পথে ট্র্যাকিং করতে হবে। অবশ্যই স্থানীয় পাড়াগুলো থেকে গাইড নিয়ে যেতে হবে। নয়তো পথ হারানোর আশঙ্কা আছে। যাঁরা খাগড়াছড়ি শহর থেকে সরাসরি তুয়ারী মারাইং যেতে চান, তাঁরা বাসস্ট্যান্ড থেকে চান্দের গাড়ি বা মাহেন্দ্র কিংবা সিএনজিতে দীঘিনালার নয়মাইল এলাকার সীমানা পাড়া পর্যন্ত যাবেন। মাইতুই বা সীমানা পাড়া থেকে স্থানীয় গাইড পাওয়া যায়।

খাওয়া ও থাকা

সকালে বেরিয়ে গেলে দিনেই ঘুরে এসে শহরে থাকা যায়। তাবাক্ষ যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি ও শুকনো খাবার সঙ্গে নিতে হবে।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত