রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলে জনমনে কিছুটা স্বস্তি দেখা দেয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সংস্কার করে ধীরে হলেও দেশ নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাবে, এমন আশাবাদের কথা শোনা যায়। এতে দেড় দশকের ভোটের খরা কাটবে এবং সরাসরি ভোটে নির্বাচিতদের নিয়ে নতুন সরকার গঠন হলে দেশের অবস্থা ভালো হবে—এমন আশায় বুক বাঁধে মানুষ। তবে সরকারের দুর্বলতা ও রাজনৈতিক পক্ষগুলোর বিবাদের মধ্যে সেই আশা কতটা পূরণ হবে, সে বিষয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন আছে।
শেখ হাসিনার সরকারের বিদায়ের পর থেকে সংবিধানসহ রাষ্ট্রব্যবস্থায় সংস্কার কীভাবে হবে, কারা করবে, সে বিষয়ে তীব্র মতভেদ প্রকাশ্যে আনছে রাজনৈতিক পক্ষগুলো। এই পক্ষগুলোর একটি জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আগামী শুক্রবার একটি নতুন দল মাঠে আনছে। দলের প্রধান হতে অন্তর্বর্তী সরকার থেকে পদত্যাগ করেছেন সরকারের প্রভাবশালী উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম।
সরকারে থেকে দল গঠনের বিষয়ে বরাবরই হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছে এ মুহূর্তে ভোটের মাঠের বড় শক্তিগুলোর একটি বিএনপি। নাহিদ সরকার ছাড়ার পর দলটির অনেক নেতা বলছেন, এ পদত্যাগ যথেষ্ট নয়।
নাহিদ পদত্যাগের পর তাঁকে পাশে নিয়ে তোলা ছবি দিয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমের ফেসবুক পোস্টের উল্লেখ করে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব লিখেছেন একদিন তিনি (নাহিদ) দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন। প্রেস সচিবের এই কথা যদি প্রধান উপদেষ্টারও কথা হয়ে থাকে, তাহলে নাহিদের পদত্যাগ যথেষ্ট নয়। এ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।’
২৬ বছর বয়সের নাহিদকে অন্যতম তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক চিন্তাশক্তির অধিকারী অভিহিত করে শফিকুল আলম বলেন, তিনি আগামী কয়েক দশকে দেশের রাজনীতিতে বড় নেতা হিসেবে আবির্ভূত হবেন।
বিএনপি নেতারা মনে করছেন, নাহিদ যে দলটির নেতৃত্ব দিতে যাচ্ছেন, সেটির কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ‘পদত্যাগ করে’ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে যাওয়ার পর থেকেই বিএনপির সঙ্গে কোন নির্বাচন আগে হবে এবং ভবিষ্যতের আইনসভার সদস্যরা কীভাবে নির্বাচিত হবেন, সে বিষয়ে মতভেদ দেখা দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক কমিটি (জানাক) ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের (বৈছাআ) মধ্যে। বিএনপি কিছু সংস্কার করে সরাসরি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেতে বলছে সরকারকে। অন্য তিন সংগঠন বলছে, জাতিসংঘের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আগে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য শেখ হাসিনার বিচার, তারপর গণপরিষদ নির্বাচন ও ভোটের আনুপাতিক হারে পরবর্তী আইনসভা গঠন করে সেখানে সংবিধান বদলানোর কথা।
ভোটের আগে আগে ঢাকাসহ সারা দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় রয়েছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ইসলামী ছাত্রশিবির ও এর সমমনা সংগঠনগুলো। খুলনার কুয়েটসহ কয়েকটি স্থানে সংঘর্ষ হয়েছে তাদের মধ্যে।
রাজনৈতিক শক্তিগুলোর বিবাদে জড়ানো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির বড় কারণ, এমনটা মনে করছেন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও। দেশে ‘অরাজক পরিস্থিতি’ বিরাজ করছে, এমনটা উল্লেখ করে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান গতকাল বলেন, ‘আমরা নিজেরা হানাহানির মধ্যে ব্যস্ত। একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারে ব্যস্ত। এটা একটা চমৎকার সুযোগ অপরাধীদের জন্য।’ সবাইকে সতর্ক করে গতকাল রাজধানীর মহাখালীতে রাওয়া ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘আপনারা যদি নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে একসঙ্গে কাজ না করতে পারেন, নিজেরা যদি কাদা ছোড়াছুড়ি করেন, মারামারি কাটাকাটি করেন, এই দেশ এবং জাতির স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে।’
অন্যদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, শাসনকাঠামোর ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা দুর্বল হওয়াতে সবাই যার যার আকাঙ্ক্ষা মেটানোর জন্য নেমে পড়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বীর আহমেদ গতকাল আজকের পত্রিকাকে বলেন, শাসনব্যবস্থার যে স্তম্ভগুলো, তার ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। অনেক অপরাধীকে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। অনেক অস্ত্র বেহাত হয়ে গেছে; সেগুলো আর ফিরিয়ে আনা যায়নি। এমন ব্যর্থতায় পরিস্থিতির অবনতি হওয়ারই কথা।
পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ দায়িত্ব দেওয়া ছিল, এমনটা উল্লেখ করে সাব্বীর আহমেদ বলেন, ‘তাঁরা কী করলেন? কতটা করলেন? যদি না করে থাকেন, কেন করলেন না, এমন প্রশ্ন তো জনমনে আছে।’
সরকারে থেকে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়ে সাব্বীর আহমেদ বলেন, সরকারে থেকে দল গঠন করা নতুন কিছু নয়। যাঁরা অভিযোগটি করেছেন, তাঁদের দল কীভাবে এসেছে, সেটা তাঁরা নিজেরা খুঁজে দেখতে পারেন।
দল কীভাবে গঠন হলো, সেটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই, এমন মন্তব্য করে অধ্যাপক সাব্বীর আহমেদ বলেন, কী উদ্দেশ্যে দলটি করা হচ্ছে, দলটির নেতাদের কথা ও কাজে মিল আছে কি না, এটা গুরুত্বপূর্ণ। কথা আর কাজে মিল না থাকায় অনেক দল হারিয়ে গেছে।
নির্বাচনের আগ পর্যন্ত দেশ সংকটে থাকার ঝুঁকি আছে, এমনটা মনে করেন এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। তিনি বলেন, পরিস্থিতি সামাল দিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই।
সব বড় দলকে এ নির্বাচনে আসার সুযোগ দেওয়া প্রয়োজন, এমনটা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের মতো বড় দলকে স্বাভাবিক রাজনৈতিক অবস্থা থেকে দূরে ঠেলে দিলে তারা ভিন্ন পথ খুঁজবে। এটা ঠিক হবে না।
গত ৫ আগস্টের পরিবর্তন যে আশাবাদ জাগিয়েছিল, রাজনৈতিক দলসহ অংশীজনেরা সতর্ক না হলে তার (আশাবাদ) বাস্তবায়ন মরীচিকায় পরিণত হওয়ার ঝুঁকি আছে, এমন হুঁশিয়ারিও জানিয়ে রাখলেন এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী।
অন্যদিকে, প্রতিবেশী ভারতসহ আশপাশের দেশগুলো এবং পশ্চিমা বিভিন্ন শক্তি বাংলাদেশের ওপর নজর রাখছে, এমনটা মনে করেন সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির।
‘পরিস্থিতি স্বস্তিকর মনে হচ্ছে না’, এমনটা উল্লেখ করে গতকাল আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘অপরাধ বাড়তে থাকলে বাইরের শক্তি যারা আছে, তাদের হাত দেওয়ার ঝুঁকি বাড়বে। দেশের ভেতরেও তাদের লোক আছে।’
মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারের প্রতি শুরু থেকেই মানুষের সমর্থন আছে, এটা উল্লেখ করে বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘মানুষ আশা করে যে তিনি নেতৃত্ব দেবেন। প্রশ্ন হচ্ছে তিনি কি (নেতৃত্ব) দিচ্ছেন না, নাকি দিতে চাচ্ছেন না।’
স্থানীয় রাজনীতিতে ধর্মীয় উগ্রবাদের প্রভাব বাড়ার ওপর পশ্চিমা বিশ্বের নজর আছে উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করা এই কূটনীতিক বলেন, মিসর ও তিউনিসিয়ায় ডানপন্থীদের উত্থানে ভালো কিছু হয়নি। এ বিষয়ে সতর্ক থাকা দরকার।