‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ‘জাতীয় স্বাস্থ্য খাত সংস্কার প্রস্তাবনা (খসড়া) দিয়েছে বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন সংবাদ সম্মেলনে দলের ৩১ দফার স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রতিশ্রুতিকে সামনে রেখে তৈরি এই খসড়া তুলে ধরেন।
প্রস্তাবে বিএনপির পক্ষ থেকে তিন মেয়াদি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার (৪ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়।
স্বল্প মেয়াদি (১-৩ বছর) প্রস্তাবে বলা হয়েছে— ইউনিয়ন সাব-সেন্টার উন্নয়ন ও পর্যাপ্ত সংখ্যক ‘গ্রামীণ স্বাস্থ্য সহকারী’ নিয়োগ; উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সেবার গুণগত মান উন্নয়ন এবং কার্যকরী প্রাথমিক রেফারেল সেন্টার হিসেবে রূপান্তর, জিপি (জেনারেল ফিজিশিয়ান) অধীনে প্রত্যেক নাগরিককে একজন সরকারি রেজিস্টার্ড চিকিৎিসকের অধীনে রাষ্ট্রীয় খরচে সর্বোত্তম স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের পর্যায়ক্রমিক ব্যবস্থার প্রবর্তন; বিদ্যমান দ্বিতীয় (জেলা ও সদর হাসপাতাল) এবং তৃতীয় স্তরের বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা শক্তিশালীকরণ ও সঠিক রেফারেল সিস্টেম বাস্তবায়ন; কিডনি, ক্যানসার, হৃদরোগ, স্নায়ুরোগ চিকিৎসাসহ ২৪ ঘণ্টা হেল্পলাইন, জরুরিসেবা, দুর্ঘটনা পরবর্তী সেবা, দ্রুত রোগী স্থানান্তর ব্যবস্থাপনা; স্বাস্থ্যসেবায় ন্যায়বিচার, রোগী ও সেবা প্রদানকারীর জন্য সমতাভিত্তিক আইন প্রণয়ন; সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে চিকিৎসক ও রোগী সম্পর্ক উন্নয়নের কার্যকর ব্যবস্থাপনা, স্বচ্ছতা ও মিডিয়ার যথাযথ এবং ইতিবাচক ব্যবহার।
মধ্যমেয়াদি (১-৫ বছর) প্রস্তাবে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন জানান, স্বাস্থ্য কার্ড প্রবর্তন ও স্বাস্থ্য কার্ডের মাধ্যমে সুবিধা প্রবর্তন। দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা সক্ষম স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। স্বাস্থ্য শিক্ষা ও গবেষণা এবং আন্তর্জাতিক চাহিদা পূরণে সক্ষম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা এবং স্বাস্থ্য পর্যটন উপযোগী একটি আন্তর্জাতিক মানের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো নির্মাণ।
প্রসঙ্গত, বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে নানা প্রশ্ন ছিল। ওই সময়ের মার্কিন দলিলপত্রে তৎকালীন প্রভাবশালী সংশ্লিষ্টদের নিয়ে প্রতিবেদন দেওয়া হয়। যেগুলো পরবর্তী সময়ে উইকিলিকসে প্রকাশিত হয়।
সংবাদ সম্মেলনে মোশাররফ হোসেন বিগত ১৫ বছরের সরকারের সময়ে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি ও অনিয়ম প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন। খসড়া প্রস্তাবে ‘গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়’ পর্বে বলা হয়েছে— বিগত আওয়ামী শাসনকালে স্বাস্থ্য খাতে আর্থিক দুর্নীতি, অনিয়মসহ পদোন্নতি, বদলি, প্রশাসনিক দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতিসাধনের সঙ্গে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকে দলীয়করণের আবরণে আচ্ছাদিত করা হয়েছে। অবিচার ও অন্যায়ের প্রাবল্যে স্বাস্থ্য খাতের জনবলের পেশাগত দক্ষতার চরম ক্ষতি সাধিত হয়েছে৷ ফলে স্বাস্থ্যসেবায় জনগণের প্রত্যাশিত প্রাপ্তি বঞ্চিত হয়েছে; সমগ্র স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় তীব্র বিদেশমুখিতা সৃষ্টি হয়েছে; চিকিৎসক ও রোগীর সম্পর্কের হয়েছে অবনতি; স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলো হয়ে পড়েছে অনিরাপদ; সরকারি স্বাস্থ্যসেবার অধিক্ষেত্রে জনগণ উচ্চ মূল্যের বেসরকারি চিকিৎসা গ্রহণে বাধ্য হয়েছে।’
খন্দকার মোশাররফ বলেন, ‘এমতাবস্থায় প্রয়োজন সুষ্ঠু তদন্ত ও পর্যালোচনার মাধ্যমে দুর্নীতির নিরপেক্ষ অনুসন্ধান ও দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি বিধান।’
তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বাস্থ্য খাতে সংস্কারের উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। আমরা আমাদের প্রস্তাবনা উপস্থাপন করছি। তবে আমরা আশা করি না যে, তারা এসব প্রস্তাবনা বাস্তবায়ন করার সক্ষমতা রাখে, বা সেই সময় পর্যন্ত তারা থাকবে।’
খন্দকার মোশাররফ বলেন, ‘আমরা জাতির জন্যে এই প্রস্তাবনা উপস্থাপন করছি যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি এসব প্রস্তাবনা গ্রহণ করে, তাহলে ভবিষ্যতে জনগণের যে সরকার আসবে তারা সেগুলো বাস্তবায়ন করবে। আর যদি বিএনপিকে জনগণ পছন্দ করে আগামী নির্বাচনে সরকারে পাঠায়, তাহলে আমরা জনগণকে আশ্বস্ত করতে চাই যে, স্বাস্থ্য খাতের সংস্কারে আমাদের উপস্থাপিত সব কিছু বাস্তবায়ন করার চেষ্টা চালাবো।’
তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি, সব ক্ষেত্রেই সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া যা ক্রমাগত বিশ্লেষণ, মূল্যায়ন ও পরিশীলনের মাধ্যমে বাস্তবধর্মী ও প্রয়োগযোগ্যভাবে বাস্তবায়নই সফলতার মূল কথা। জনকল্যাণমুখী একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি সবার মতামতকে পুনঃমর্যাদা প্রদানের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে জনগণের কল্যাণে স্বাস্থ্য সংস্কার প্রস্তাবনা বাস্তবায়নে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।’
ছাত্র-জনতা বিপ্লবে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে ওই আন্দোলন আহতদের পর্যাপ্ত চিকিৎসার দ্রুত ব্যবস্থার দাবিও জানান খন্দকার মোশাররফ।
সংবাদ সম্মেলনে উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য অধ্যাপক ফরহাদ হালিম ডোনার, স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম এবং বিএনপির মিডিয়া সেলের সমন্বয়ক অধ্যাপক মওদুদ হোসেন আলমগীর পাভেল উপস্থিত ছিলেন।