দাবি আদায়ের জন্য কিছু লোক জোগাড় করে রাস্তা বন্ধ করা এখন রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। সত্য-অসত্য অভিযোগ তুলে মব দ্বারা মানুষকে আক্রমণ করা স্বাভাবিক বিষয় হয়ে গেছে। এমন অবস্থায় সভ্য রাজনৈতিক বিতর্ক করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আজ শনিবার এক সম্মেলনে এসব কথা বলেন প্রবীণ অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) ঢাকার ব্র্যাক সেন্টারে অষ্টম বার্ষিক অর্থনীতিবিদ সম্মেলনের আয়োজক। তিন দিনব্যাপী এ সম্মেলন ২১ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়।
গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারা চালুর বিষয়ে একটি অধিবেশনে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান বলেন, কেবল সাইনবোর্ড থাকলেই রাজনৈতিক দল হয়ে যায় না। প্রকৃত রাজনৈতিক দলের গণভিত্তি থাকে। দেশে গ্রামে গ্রামে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমর্থক আছে। জামায়াতের কোথাও কোথাও অবস্থান আছে। একটি দলকে নিষিদ্ধ করা হোক বা না হোক, এটিই বাস্তবতা। এখন আরেকটি দল গঠনের কথা বলা হচ্ছে। নতুন দলটির আসল পরীক্ষা হবে, যখন তারা নির্বাচনে বড় দলগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করবে।
টাকার-ক্ষমতা এখন রাজনীতিকে বেঁধে ফেলেছে, এমনটি উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে এখন কোনো তফাত নেই। জাতীয় সংসদের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত প্রত্যেকের আর্থিক স্বার্থ আছে। আওয়ামী লীগের ছেড়ে যাওয়া ব্যবসার জায়গাগুলো এখন অন্যরা দখল করেছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে গণতন্ত্র চর্চার জন্য সংস্কার কমিশনগুলো কী ব্যবস্থা নিচ্ছে, সে বিষয়ে তিনি প্রশ্ন তোলেন। রেহমান সোবহান বলেন, রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত করার মধ্য দিয়ে আমলাতন্ত্রকে অকার্যকর করে দেওয়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের দলীয় পরিচিতির কারণে একটি কার্যকর ও জবাবদিহিমূলক আমলাতন্ত্র অন্তর্বর্তী সরকারও পাচ্ছে না।
সিপিডির চেয়ারম্যান বলেন, ভোটে যাঁরা জেতে, তাঁরা সবকিছু নিয়ে নেন। এরপর আর্থিক সুবিধা হারানোর পাশাপাশি জীবনের নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়ার আশঙ্কায় তাঁরা ক্ষমতা ছাড়তে চান না। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দূরে সরিয়ে রাখতে বিচারব্যবস্থাকে ব্যবহার করা হচ্ছে। দলগুলোর যাঁরা ক্ষমতায় আসার কথা ভাবছেন, তাঁরা কী বিচার বিভাগকে স্বাধীনতা দেবেন?
সংস্কার একটি জটিল প্রক্রিয়া, এমনটি উল্লেখ করে তিনি বলেন, কী করে নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করা হবে, সেটি একটি বড় প্রশ্ন।
সম্মেলনের কয়েকটি অধিবেশনে বক্তারা বলেন, রাজনৈতিক দল ও সরকারগুলোর নীতিনির্ধারকদের কথা ও কাজে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মিল না থাকার কারণে দেশের মানুষের পাশাপাশি বিদেশিরাও বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থার ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না।
সিপিডির সম্মানিত ফেলো অধ্যাপক রওনক জাহান বলেন, নাগরিকদের ক্ষমতায়নের মাধ্যমে টেকসই রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। রাজনীতিকেরা ক্ষমতায় যাওয়ার আগে অনেক প্রতিশ্রুতি দেন। নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ক্ষমতায় গিয়ে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবেন, নাগরিকদের কাছ থেকে এমন আস্থা পাওয়া রাজনীতিকদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ সবাই ক্ষমতায় গেলে নিজেদের করা প্রতিশ্রুতিগুলোর কথা ভুলে যান।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. আলী রীয়াজ রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিটি পর্যায়ে জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা ও ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ না করে রাষ্ট্রপতি আসলে কিছু করতে পারেন না। এতে প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একটি অংশে পরিণত হন।
ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থায় তরুণদের স্থান দেওয়ার বিষয়ে অনেক কথা হচ্ছে। কিন্তু বয়সের বাইরেও ‘প্রান্তিক’ জনগোষ্ঠীকে স্থান করে দিতে হলে অন্য অনেক কিছু বিবেচনায় নেওয়ার আছে। যেমন নারী, জাতিসত্তা, ধর্ম ও জন্মস্থানসহ বিভিন্ন বিষয় বিবেচনায় নিয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে অংশীদারত্বমূলক করা যেতে পারে।
ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির কারণে মানুষ বিরক্ত, এমনটি তুলে ধরে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘মানুষ শান্তি চান। ন্যূনতম মর্যাদা চান। আর কিছু করার আগে যেন তাঁর মত নেওয়া হয়, এটি চান। এই মত তাঁরা ভোটসহ বিভিন্ন উপায়ে দিতে চান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন-অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ এম সাহান বলেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আপসে পৌঁছার সুযোগ থাকা দরকার। এ কারণে সংস্কার প্রস্তাব অনুযায়ী আইনসভার উচ্চকক্ষ গঠিত হলে সেই কক্ষকে কিছু ক্ষমতা ও এখতিয়ার দেওয়া দরকার।
বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিষয়ে একটি অধিবেশনে পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ চেয়ারম্যান ড. মাশরুর রিয়াজ বলেন, ‘শিল্পে বিদেশি বিনিয়োগের বিষয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা যা বলে থাকেন, তা বলতে হয় বলে বলেন। কথার সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল থাকে না।’