জুলাই গণ-অভ্যুত্থান নতুন স্বপ্নের জন্ম দিয়েছে। তরুণেরা জানান দিয়েছেন নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের প্রত্যয়। এ জন্য দরকার সুসংগঠিত রাজনীতির। জাতীয় নাগরিক কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে এত দিন সে প্রস্তুতিই চলছিল। অবশেষে গতকাল শুক্রবার আত্মপ্রকাশ করল জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।
গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়ন জাতীয় নাগরিক পার্টির অন্যতম লক্ষ্য বলে জানিয়েছেন দলের আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম। দলের ঘোষণাপত্র পাঠের মধ্য দিয়ে নতুন এই রাজনৈতিক দলের ঘোষণা দেন তিনি। জনগণের অধিকারভিত্তিক রাষ্ট্র পুনর্গঠনের লক্ষ্যে দল ঘোষণার কথা জানিয়ে নাহিদ জোর দিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশে ভারত বা পাকিস্তানপন্থী কোনো রাজনীতি হবে না। আমরা বাংলাদেশকে সামনে রেখে রাজনীতি ও রাষ্ট্র নির্মাণ করব।’
গতকাল সন্ধ্যার পর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর মঞ্চ থেকে প্রথমে জাতীয় নাগরিক পার্টির নাম ঘোষণা করেন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নিহত ইসমাইল হোসেন রাব্বির বোন মিম আক্তার। পরে আহ্বায়ক হিসেবে মো. নাহিদ ইসলাম ও সদস্যসচিব হিসেবে আখতার হোসেনের নাম ঘোষণা করেন তিনি। এরপর আংশিক কমিটির নাম ঘোষণা করেন সদস্যসচিব আখতার হোসেন।
এনসিপির আত্মপ্রকাশ উপলক্ষে গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতেই মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর সংসদের পাশে পূর্বমুখী করে মঞ্চ নির্মাণ করা হয়। মঞ্চের সামনে দুই হাজার চেয়ার রাখা হয় জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নিহত ও আহতদের পরিবার, রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত কূটনৈতিক প্রতিনিধিদলের জন্য। গতকাল সকাল থেকেই জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্যরা অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হন। জুমার নামাজের পর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে মিছিল সমাবেশস্থলে আসতে শুরু করে।
বেলা ৩টা পর্যন্ত মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অবস্থান নেয় তারা। তবে এরপরই নেতা-কর্মীদের চাপ বাড়ে, তাঁদের অবস্থান খেজুরবাগান মোড় পর্যন্ত চলে আসে। মিছিলে আগতদের অধিকাংশই ছিলেন তরুণ-তরুণী। তবে বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষকেও দেখা যায়। কয়েকটি মিছিলে ঘোড়ার গাড়ি, বাদ্যযন্ত্রের দলও দেখা যায়। জনসভায় আসা নারী ও পুরুষদের জন্য ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের দুটি মোবাইল টয়লেট ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা হয়।
মিরপুর থেকে আসা মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘দেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ভিড়ে জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সূচনা হচ্ছে। নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তে নিজেকে শামিল করতে এসেছি।’
আবু ইউসুফ মাসুদ নামের আরেকজন বলেন, ‘দেশে তরুণদের মাধ্যমে নতুন রাজনৈতিক দল তৈরি হচ্ছে। এর মাধ্যমে মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা, তার বাস্তবায়ন হোক, সেটিই চাই।’
মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর ফুটপাতে বসে কথা হয় অটোরিকশা ব্যবসায়ী মধ্যবয়সী আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে। নতুন দলের আত্মপ্রকাশ দেখতে একাই উপস্থিত হয়েছেন। নতুন রাজনৈতিক দলের প্রত্যাশার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আশা করি, নতুন রাজনৈতিক দল দুর্নীতিমুক্ত দেশ ও সুশাসনের জন্য কাজ করবে। আর তাঁদের রাজনীতি হওয়া উচিত ক্ষমতার জন্য নয়, ন্যায়ের জন্য। অ্যাজেন্ডা নিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারলেই তাঁরা সফল হবেন।’
গতকাল বিকেল ৪টা ১৫ মিনিট থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে দলের আত্মপ্রকাশের কর্মসূচি শুরু হয়। শুরুতে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন, গীতা, বাইবেল, ত্রিপিটক পাঠ করা হয়। সাড়ে ৪টার দিকে গাওয়া হয় জাতীয় সংগীত। এরপরই জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বক্তব্য দেন।
জাতীয় পতাকা মাথায় বেঁধে বক্তব্য শুরু করেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ‘তুমি কে, আমি কে, বিকল্প, বিকল্প’ স্লোগানটি তুলে ধরে তিনি বলেন, বিকল্পের জায়গা থেকে নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে।
বিভাজনের রাজনীতির মাধ্যমে বাংলাদেশকে দুর্বল করে রাখার ষড়যন্ত্র হয়েছিল উল্লেখ করে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘সেই ষড়যন্ত্র জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সবার ঐক্যের মাধ্যমে ভেঙে দিয়েছি। আজকের মঞ্চ থেকে শপথ—বাংলাদেশকে আর কখনো বিভাজিত করা যাবে না। বাংলাদেশে ভারতপন্থী ও পাকিস্তানপন্থী রাজনীতির ঠাঁই হবে না। আমরা বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থকে সামনে রেখে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে রাজনীতি ও রাষ্ট্র বিনির্মাণ করব।’
পরে দলের ঘোষণাপত্র তুলে ধরেন আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। সেখানে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের সূচনা বলে উল্লেখ করেন তিনি। গণতান্ত্রিক নতুন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সব সম্ভাবনার অবসান ঘটানোর আহ্বান করা হয়। তিনি বলেন, ‘দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন আমাদের অন্যতম প্রাথমিক লক্ষ্য। আমাদের দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রে জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষায় শক্তিশালী প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। ভেঙে পড়া রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুনরায় গড়ে তোলা এবং তাদের গণতান্ত্রিক চরিত্র রক্ষা করাই হবে আমাদের রাজনীতির অগ্রাধিকার। এর মধ্য দিয়েই কেবল আমরা একটি পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হতে পারব।’
নতুন নেতৃত্ব জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসরদের বিচার করতে সক্ষম হবে জানিয়ে সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘৫৪ বছর পর আমরা সেই সুযোগ পেয়েছি। একটি নতুন সংবিধানের বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। তরুণেরা স্বপ্ন দেখে, আগামীর বাংলাদেশ নতুন সংবিধানের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি জানাই।’
সামান্তা শারমিন বলেন, ‘বাংলাদেশে গত ৫৩ বছরে আমাদেরকে একটি বাইনারি রাজনীতিতে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। আমরা রাষ্ট্র পুনর্গঠনের কথা বলছি। জুলাই অভ্যুত্থানের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে এই উদ্যোগ আমাদেরকে নিতে হবে। বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলার মতো কোনো রাজনৈতিক দল এ মুহূর্তে বাংলাদেশে নেই। এ দেশের মানুষ দুর্নীতিবিরোধী, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজমুক্ত একটি সমাজ চায়। বাংলাদেশের খেটে খাওয়া মানুষের কথা বলবে—এমন একটি রাজনৈতিক দল চায়।’
নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ যখন মুক্তির অপেক্ষায় ছিলেন, আমরা তখন আমাদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি। আমি বলতে চাই, তরুণেরা বাংলাদেশের রাজনীতির একটি অপরিহার্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছেন।’
হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘গত ৫ আগস্টের মধ্য দিয়ে আমরা দুঃশাসনের কবর রচনা করেছি। সংসদে কে যাবেন, তা নির্ধারণ করবে দেশের খেটে খাওয়া জনতা। ক্ষমতার মসনদে কে বসবেন, তা নির্ধারণ করবে এই ভূখণ্ডের মানুষ। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে আমরা সচল করে গড়ে তুলব। বিভাজনের পরিবর্তে একতার রাজনীতি গড়ে তুলব। প্রবীণদের অভিজ্ঞতা এবং তরুণদের অকুতোভয়ের মিথস্ক্রিয়ায় আমরা নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ করব। কামার বা কুমারের ছেলে যোগ্যতার ভিত্তিতে এ দেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন।’
সারজিস আলম বলেন, ‘যারা বড় রাজনৈতিক দল রয়েছে, তারা যদি ছোট দলকে এগিয়ে যেতে না দেয়, তাহলে আবার একটি স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হতে পারে। খুনি হাসিনাকে দেখে যেন আমরা সে শিক্ষা নিতে পারি। আমরা দেশ এবং জাতিকে সবার ওপরে রেখে যেন নতুন ও সাম্যের বাংলাদেশ গঠন করতে পারি।’
আব্দুল হান্নান মাসউদ বলেন, আগামীর বাংলাদেশ হবে গণতন্ত্রের বাংলাদেশ। তরুণদের নেতৃত্বে দলদাসমুক্ত বাংলাদেশ। আর কখনো নির্বাচনের আগে ও পরে সংঘর্ষে প্রাণহানির ঘটনা ঘটবে না। দলমত-নির্বিশেষে সবাই একসঙ্গে বসবাস করার সুযোগ পাবে।
অধিকার আদায়ের জন্য মাঠে নামা মানুষের ওপর যেন আর রক্তপাত না হয়, এমন প্রত্যাশা জানিয়ে জুলাইয়ে নিহত ছয় বছরের শিশু জাবির ইব্রাহিমের বাবা নওশের আলী বলেন, ‘এ দেশে ১৯৭১, নব্বই আর এই চব্বিশে রক্তক্ষরণ হয়েছে, জুলাই বিপ্লবের পর সে রক্তক্ষরণ আমরা চাই না। আমি চাই, আমার দেশ যেন এই দলের কাছে নিরাপদ থাকে।’
এদিকে এনসিপির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা আকবর খান, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের জেনারেল সেক্রেটারি মাওলানা জালাল উদ্দিন আহমেদ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন্দ, হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির আহমদ আলী কাসেমী, বিকল্পধারা বাংলাদেশের নির্বাহী সভাপতি মেজর (অব.) আবদুল মান্নান, বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম, খেলাফত মজলিসের নেতা আহমেদ আবদুল কাদের, লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব সাখাওয়াত হোসেন রাজী, ডেভেলপমেন্ট পার্টির চেয়ারম্যান এ কে এম আজহারুল ইসলাম, এবি পার্টির নেতা দিদারুল আলম প্রমুখ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া কূটনীতিকদের মধ্যে ঢাকায় ভ্যাটিকান সিটির রাষ্ট্রদূত কেভিন এস রেন্ডাল, পাকিস্তান হাইকমিশনের কাউন্সেলর কামরান ধাঙ্গাল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।