জুলাই অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঐক্য তৈরি হলেও আন্দোলনের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়হীনতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনসহ বেশ কিছু বিষয়কে কেন্দ্র করে বিভক্তি তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, ছাত্রসংগঠনগুলো এখন মোটাদাগে দুই ভাগে বিভক্ত। একদিকে রয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও ইসলামী ছাত্রশিবির এবং অন্যদিকে আছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়নসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক ও বামপন্থী সংগঠনগুলো। এমন অবস্থায় দল ও সংগঠনগুলোর দেওয়া বিভিন্ন সংস্কার প্রস্তাবের যথাযথ প্রয়োগ না হলে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘাতের আশঙ্কা করছেন শিক্ষার্থীরা।
গত ডিসেম্বরে ডাকসুসহ ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচনের দাবি জানায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। জানুয়ারির শেষে কিংবা ফেব্রুয়ারির শুরুতে ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচন শুরুর দাবি জানিয়েছিল তারা। ডাকসুর সিদ্ধান্ত গ্রহণের সেই সভায় সব ছাত্রসংগঠনকে ডাকলেও ইসলামী ছাত্র শিবির ছাড়া সাড়া অন্যান্য ছাত্রসংগঠন দেয়নি। পরে ছাত্রদলের উদ্যোগে আয়োজিত এক সভায় অংশ নেন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, ইসলামী ছাত্র আন্দোলনসহ ২৮টি রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের শীর্ষ নেতারা। এসব সংগঠনের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, সেই বৈঠকে বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতে ‘যুগপৎ’ অথবা ‘ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম’-এর মাধ্যমে কর্মসূচির আলোচনা হয়েছে তাঁদের মধ্যে।
বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছাত্র সংসদ নির্বাচন ছাড়াও বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ডানপন্থী দল ও গোষ্ঠীর উত্থান, মব তৈরির প্রচেষ্টা, নারী ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রতি প্রোপাগান্ডা এবং প্রগতিশীল বিভিন্ন সংগঠনের গ্রাফিতি ও দেয়াললিখন মুছে ফেলাকে কেন্দ্র করে ডান ও বামপন্থী সংগঠনগুলোর মধ্যে একধরনের ‘শীতল যুদ্ধ’ শুরু হয়েছে। সম্প্রতি পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের ওপর ডানপন্থী স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টির হামলা, হামলার প্রতিবাদে বামপন্থী সংগঠনগুলোর বিক্ষোভে পুলিশের হামলা এবং বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ঢাবি সংসদের (একাংশ) সভাপতি মেঘমল্লার বসুর ‘লাল সন্ত্রাস’-সংক্রান্ত আলোচনা এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সিরাজ শিকদারের গ্রাফিতি নষ্ট করার মধ্য দিয়ে এই দ্বন্দ্ব আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দূরত্বও বেড়েছে ডানপন্থীদের সঙ্গে বামপন্থীদের।
ডাকসু নির্বাচনের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) প্রশাসন সম্প্রতি পৃথক তিনটি কমিটি গঠন করেছে। এসব কমিটি নির্বাচনের আচরণবিধি প্রণয়ন বা সংশোধন, ডাকসু ও হল সংসদের গঠনতন্ত্র সংশোধন বা পরিমার্জন এবং পরামর্শদানের কাজ করবেন। ইতিমধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রশিবিরসহ বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন ডাকসুর বিষয়ে বিভিন্ন সংস্কার প্রস্তাব প্রশাসনের কাছে দিয়েছে। সুনির্দিষ্ট তারিখ না বললেও প্রশাসন দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে আশাবাদী বলে জানিয়েছে। তবে সব রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের ঐকমত্যের ভিত্তিতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজন না হলে সংঘাতের আশঙ্কা করছেন অনেকেই।
এদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে ‘পরিবেশ পরিষদ’ গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের নেতারা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা জাকসু নির্বাচন বিভিন্ন সংস্কারের পর হতে হবে। সেই লক্ষ্যে সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করছে বিভিন্ন দল ও সংগঠন। সেখানেও ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়েছেন কেউ কেউ।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভক্তি প্রসঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্যসচিব আরিফ সোহেল আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিভিন্ন পথ ও মত থাকে। এখানে বিভিন্ন দলের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা যাচ্ছে, এটা আমরা সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক রাজনীতির লক্ষণ বলে মনে করি। পার্থক্যের চর্চা যেন শান্তিপূর্ণ এবং ইতিবাচক হয়, তা সবাইকে নিয়ে নিশ্চিত করতে হবে।’ অতি দ্রুত ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজন করা উচিত জানিয়ে তিনি বলেন, ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই ছাত্রসংসদ নির্বাচন করতে হবে। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রতি যে হুমকি, ডাকসুর ছাত্রনেতারা তার রক্ষক হবে বলে আমরা মনে করি।’
সার্বিক নিরাপত্তা ও পরিবেশ নিশ্চিত না করে নির্বাচনের আয়োজন করলে যেকোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে জানিয়ে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ঢাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ডাকসুর বিদ্যমান গঠনতন্ত্রে বড় ধরনের সংস্কার ব্যতীত নির্বাচন হলে শিক্ষার্থীদের চাহিদা বা প্রত্যাশা পূরণ হবে না। কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়ার লক্ষ্যে সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচন যেভাবে কোনো কার্যকর সংস্কার ছাড়া আয়োজন করা হয়েছিল, এই পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির পর অতীতের পুনরাবৃত্তি ঘটলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সেটি গ্রহণ না করার সম্ভাবনাই বেশি।’
ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক আজিজুর রহমান আজাদ বলেন, ‘ক্যাম্পাস প্রশাসন যদি শিক্ষার্থীদের মনোভাব বুঝে ছাত্র সংসদের রূপরেখা তৈরি করে, তাহলে ছাত্রসংগঠনগুলোর দ্বিমতের কোনো জায়গা থাকবে না। ক্যাম্পাস প্রশাসন যদি আমাদের সহযোগিতা চায়, আমরা করব। যদি আমাদের আরও ছাড় দিতে হয়, তা-ও দেব; তবুও আমরা চাই ছাত্র সংসদ নির্বাচনটা হোক।’
বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সৈকত আরিফ জানান, ছাত্র সংসদগুলোর গঠনতন্ত্রের গণতান্ত্রিক সংস্কার দরকার। তিনি বলেন, ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে সংস্কারের প্রস্তাব ছাত্রসংগঠনগুলো হাজির করেছে, সেই জায়গায় সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে সর্বোচ্চ সংস্কার লাগবে। ছাত্রদের আকাঙ্ক্ষার সর্বোচ্চ বাস্তবায়ন ছাড়া তাঁরা তা গ্রহণ করবেন না। ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রশ্নটি তাই সংস্কার প্রশ্ন থেকে আলাদা নয়।
ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিভক্তি না থাকলেও সংগঠনগুলোর নিজেদের মধ্যে সন্দেহ-অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন আরিফ। তিনি আরও বলেন, ‘শিক্ষার্থীরাও নিয়মিত নির্বাচন চায়, সেখানে বিভক্তির কিছু নেই। তবে কিছু ছাত্রসংগঠনের কার্যকলাপ পরস্পরের প্রতি সন্দেহ-অবিশ্বাস তৈরি করেছে, যার প্রভাব আমরা শিক্ষার্থীদের মধ্যেও দেখেছি।’ বিভাজন দূর করে সচেতনভাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনগুলোর নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দিকে এগোতে হবে বলে জানান তিনি।
মেঘমল্লার বসু আজকের পত্রিকাকে জানান, ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রশ্নে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনৈক্য প্রকাশ্যে এসেছে। এই মতানৈক্য অনেক আগেই সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, ক্যাম্পাসগুলোয় একধরনের মেরুকরণ সৃষ্টি হয়েছে। এখানে একদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও তার সঙ্গে জড়িত ছাত্রশিবিরের মধ্যে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে একটা মেরুকরণ তৈরি করবে; বাকি সংগঠনগুলো নানা ফর্মে এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনগুলো ঐকমত্যের ভিত্তিতে ছাত্র সংসদ আয়োজন করতে পারবে কি না, এমন প্রশ্নে মেঘমল্লার বলেন, ‘প্রশাসন এমনটাই করবে, এটা আশা করতে চাই। যদি তারা একতরফাভাবে করার চেষ্টা করে, তাহলে একটা প্রতিক্রিয়া তো ক্যাম্পাসগুলোয় পড়বেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে এখন স্থিতিশীল, এমন না। এখনো ক্যাম্পাসে পুলিশ ঢুকে হামলা করছে। এর মধ্যে যদি এমন ঘটনা আরও ঘটে, তবে ক্যাম্পাসগুলো ক্রমান্বয়ে আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে।’