বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মনে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার যে আকাঙ্ক্ষা দীর্ঘদিন ধরে সৃষ্টি করেছিলেন, তার সফল পরিণতি ঘটে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে। ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে প্রদত্ত ভাটের শতকরা ৭৫টি ভােট পাওয়া আওয়ামী লীগের প্রাণভ্রমরা বঙ্গবন্ধু যে অসহযোগের ডাক দিয়েছিলেন তাতে শুধু বাংলাদেশের সাধারণ জনগণই নয়, তৎকালীন প্রশাসন, বিচার বিভাগ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যবৃন্দ এবং ব্যবসায়ী মহলও যোগ দিয়েছিল। ফলে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর হামলা ও গণহত্যার মুখে বঙ্গবন্ধু যখন ২৫ মার্চ রাতে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন তখন তার প্রতি জনগণের অকুণ্ঠ ও অবাধ সমর্থন আর নিরঙ্কুশ নির্বাচনী ম্যান্ডেট ছিল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের কোনো পর্যায়েই সেসব দেশের মূল নেতারা গোটা জনগোষ্ঠীর ওপর এমন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হননি বললেই চলে। গান্ধী, নেহেরু, মাও, হো-চি-মিন, বেনবেল্লা, নত্রুমা, নায়ারেরে এমন কি নেলসন ম্যান্ডেলার পক্ষেও এত বিশাল ম্যান্ডেট ছিল না। আর ঐ কারণেই পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেছিল। ফলে, একজন ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে মুক্তিযুদ্ধ হয়, দেশ স্বাধীন হয় এবং তাঁর নামেই বাংলাদেশ সারাবিশ্বে পরিচিতি পায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে দেশে ফিরে এলেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। এবার তিনি তাঁর স্বপ্নের সােনার বাংলা গড়ে তুলবেন! কিন্তু, দেশে ফিরে তিনি দেশকে কীভাবে পেলেন?
এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ছিনিয়ে আনা বাংলাদেশ তখন সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। নয় মাসব্যাপী দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর পোড়ামাটি নীতির শিকার বাংলাদেশ তখন প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামোহীন একটি ভূখণ্ড মাত্র। দেশের রাষ্ট্রীয় কোষাগারে বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল ছিল শূন্য, সমস্ত দেশীয় মুদ্রা বা নোট পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল। দেশে অভ্যন্তরীণ ব্যবসা বাণিজ্য সব লণ্ডভণ্ড এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের সূত্রসমূহ ছিল বিচ্ছিন্ন, শিল্পকারখানা ছিল বন্ধ এবং অনেক ক্ষেত্রে অকেজো করে রাখা, এদেশের শিল্প সম্পদের প্রায় ৪৭ শতাংশ পরিত্যক্ত, ডাক বিভাগ বন্ধ, তার বিভাগ। প্রায় অচল, অসংখ্য ব্রিজ-কালভার্ট ধ্বংসপ্রাপ্ত, মাইন পুঁতে রাখার কারণে। নৌবন্দরগুলো ছিল অচল। ফলে, যোগাযোগ ব্যবস্থা কার্যত অচল হয়ে পড়েছিল। যুদ্ধের কারণে কৃষি উৎপাদনও যথাযথ হতে পারেনি। দেশে কার্যক্ষম কোনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছিল না। ছিল না কোনো প্রতিরক্ষা ও অর্থনৈতিক বিষয়ে কেন্দ্রীয় পরিকল্পনাকারী সংগঠন। আর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া গেল প্রায় এক কোটি ভারতে আশ্রিত বাংলাদেশী, আর দুই কোটি গৃহহীন নাগরিক। এর পাশাপাশি সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশটির জন্য প্রয়োজনীয় ছিল আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির। যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত বাংলাদেশের কোন কোন খাতে কি রকম ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছিল তা সংক্ষিপ্ত আকারে নিম্নে তুলে ধরা হলো-
কৃষিক্ষেত্র
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ফসল উৎপাদন স্বাভাবিকভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। পাকিস্তানি সৈন্যরা এসময় কয়েক লাখ হালের বলদ ও গাভি জবাই করে তাদের খাদ্য চাহিদা মিটিয়ে ছিল। কখনো কখনো স্থানীয় দালালদের সহযোগিতায় ফসলের ক্ষেত নষ্ট করে ও গৃহস্থের সঞ্চিত খাদ্যশস্য পুড়িয়ে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করেছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। আর পরাজয়ের পূর্বেই তারা সরকারের গুদামে মজুদ খাদ্যশস্য, শস্যবীজ, সার, কীটনাশক ওষুধ ও মাঠের গভীর অগভীর নলকূপ ধ্বংস করেছিল। আরও উল্লেখ্য যে, পাকিস্তানি শাসনামলে এ অঞ্চলের জন্য ভূমি উন্নয়ন ও সেচ কার্যক্রম বিষয়ক কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় ১৯৭১ সালে এখানকার ৭৪ শতাংশ চাষযোগ্য জমি ছিল এক-ফসলি এবং ২৬ শতাংশ জমি ছিল দো-ফসলি ও তিন ফসলি। এছাড়াও, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও জলসেচের ব্যবস্থাও ছিল যতসামান্য। যুদ্ধের ফলে কৃষকের মূলধন ঘাটতি ছিল আরও বড় একটি সমস্যা।
যোগাযোগ ব্যবস্থা
যুদ্ধকালে ২৭৪টি সড়ক সেত, ৩০০টি রেল সেতু, ৪৫ মাইল রেল লাইন ধ্বংসপ্রাপ্ত এবং ১৩০ মাইল রেল লাইন আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ১৫০টি রেলের পণ্য ও যাত্রীবাহী বগি ও কয়েকটি ইঞ্জিন অকেজো হয়, ইঞ্জিন ও বগি মেরামত কারখানাগুলো ধ্বংস করা হয়, সরকারি শত শত বাস ও ট্রাক এবং বেসরকারি অসংখ্য বাস-ট্রাক ধ্বংস করা হয়। নৌ পরিবহন ব্যবস্থায় আরও বিপর্যয় নেমে আসে। প্রায় ৩ হাজার মালবাহী নৌকা, শতকরা ৮৫টি জলযান, মাল পরিবহনের সরকারি কার্গোগুলো ব্যবহার অনুপোযোগী ছিল। চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দরে মাইন পুঁতে রাখায় বন্দর দুটি অকার্যকর হয়ে পড়েছিল। এছাড়া, অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের জন্য কোন যাত্রীবাহী বিমান ছিল না। উপরন্তু, দেশের বিমানবন্দরগুলোর রানওয়েরও ক্ষতি সাধন করা হয়েছিল পরিকল্পিতভাবে।
শিক্ষাব্যবস্থা
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ১৮ হাজার প্রাইমারি স্কুল, ৬ হাজার হাই স্কুল ও মাদ্রাসা, ৯০০ কলেজ ভবন এবং এসব স্থাপনার প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র চেয়ার, টেবিল, বেঞ্চ প্রভৃতি পুড়িয়ে দেয়। যুদ্ধকালে শিক্ষাকার্যক্রম কার্যত বন্ধ থাকে। এসময় শিক্ষকদের বেতন প্রদান বন্ধ থাকে। এর বাইরে নতুন দেশের উপযোগী পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও প্রকাশ করা, মুক্তিযুদ্ধে শহিদ অগণিত শিক্ষকের শূন্য পদগুলো নিয়োগের মাধ্যমে পূরণ করা সরকারের জন্য আশু করণীয় হয়ে পড়ে।
বিদ্যুত ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা
যুদ্ধকালে, বিশেষ করে আত্মসমর্পণের প্রাক্কালে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী সারাদেশের বিদ্যুত সাবস্টেশনগুলো ধ্বংস করে দেয়। বিদ্যুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও বিদ্যুতের পোলগুলো নষ্ট করে দিয়ে যায়। টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবনগুলোর ট্রাঙ্ক ব্যবস্থা নষ্ট করে, প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র পুড়িয়ে দিয়ে তারা দেশের অভ্যন্তরে এবং বিদেশের সাথে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে যায়। এই ব্যবস্থা সচল করার জন্য কমপক্ষে ৫ হাজার টেলিফোন সেট, ৩১টি ট্রাঙ্ক লাইন পুনঃস্থাপন এবং ১ হাজার দক্ষ টেলিফোন কর্মী দরকার ছিল। এছাড়া, সরকার যখন দায়িত্ব গ্রহণ করে তখন গোডাউনগুলোতে বিদ্যুতের খুঁটি, বিদ্যুতের তার ও টেলিফোনের তার কিছুই মজুদ ছিল না।
শরণার্থী পুনর্বাসন ও খাদ্য সংকট
যুদ্ধকালে ভারতে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১ কোটি শরণার্থী, দেশের অভ্যন্তরে উদ্বাস্তু হওয়া কয়েক লক্ষ পরিবারকে পুনর্বাসিত করা সরকারের জন্য এক বিশাল চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়ে। একই সময়ে দেশে খাদ্য ঘাটতি ছিল প্রায় ৪০ লাখ টন। দায়িত্ব নিয়ে সরকার খাদ্যগুদামে মাত্র ৪ লাখ টন খাদ্য মজুদ। পান। দেশে ফেরত আসা শরণার্থী, প্রায় ৯০ হাজার পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দী, প্রায় সোয়া লাখ ভারতীয় সৈন্য এবং আটককৃত প্রায় ৬০ হাজার দালাল ও রাজাকারদের জন্য খাদ্য সরবরাহ করা সরকারের জন্য বিশাল দুশ্চিন্তার। কারণ হয়ে দাঁড়ায় ধ্বংসপ্রাপ্ত অন্যান্য অবকাঠামো যুদ্ধের ফলে দেশের মানুষের প্রায় ৪৩ লক্ষ বসতবাড়ি, প্রায় ৩ হাজার সরকারি বেসরকারি অফিস, প্রায় ১৯ হাজার গ্রাম্য হাট-বাজার ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক অবস্থা
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পরাজয়ের মুখে ব্যাংকগুলোতে থাকা কাগজের নোটগুলো পুড়িয়ে দেয়, গচ্ছিত সোনা লুট করে, প্রয়োজনীয় নথি ও কাগজপত্র পুড়িয়ে ফেলে। ব্যাংক ও বীমার বাইরে শিল্প কলকারখানাগুলোর ক্ষেত্রেও একই অবস্থা বিরাজ করছিল। শিল্প কারখানাতে উৎপাদন প্রায় বন্ধ ছিল, বিদেশি বাণিজ্যের সকল সূত্র নষ্ট করে দেওয়া হয়। শিল্প-কারখানাগুলাের মধ্যে যেগুলা নষ্ট করা হয়েছিল সেগুলো পুনরায় চালু করার মতো স্পেয়ার পার্টস ও কাঁচামাল ছিল না। তাছাড়া, এসব ক্ষেত্র পুনর্গঠনের জন্য প্রয়োজন ছিল বহুসংখ্যক দক্ষ কৃষিবিদ, প্রকৌশলী, ব্যাংকার, ব্যবসায়ী, দক্ষ কারিগর ও শ্রমিক। উল্লেখ্য যে, সামরিক প্রশাসনের মতো বেসামরিক প্রশাসনেরও অধিকাংশ শীর্ষপদ পাকিস্তানি ও অবাঙালি ব্যক্তিবর্গের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ফলে, নতুন দেশে দক্ষ প্রশাসক, দক্ষ কর্মীর অভাব দেখা দেয়।
উল্লিখিত ক্ষয়-ক্ষতির বাইরে বঙ্গবন্ধুর সরকারের সামনে আরও কিছু জটিল এবং একই সাথে দ্রুত সমাধান প্রয়োজন এমন কিছু সমস্যা উপস্থিত হয়। নিম্নে এগুলো উপস্থাপন করা হলো।
১. সদ্য স্বাধীন দেশের সরকারের হাতে কোনো সংবিধান ছিল না, বরং ছিল উপনিবেশিক আইন ব্যবস্থা। ফলে, একটি গণমুখী ও যুগোপযোগী সংবিধান জাতির কাছে উপস্থাপন করা ছিল সরকারের আশু কর্তব্য।
২. মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন, আহত ও শহিদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারগুলোকে আর্থিক সাহায্য সহযোগিতা প্রদান করা।
৩. যুদ্ধফেরত মুক্তিযোদ্ধা, দেশীয় দালাল ও রাজাকার, আল বদর, আল শামসসহ অন্যান্য গোষ্ঠী ও ব্যক্তির কাছে থাকা অস্ত্র উদ্ধার করা।
৪. মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দালালদের বিচারের আওতায় আনা।
৫. বাংলাদেশে অবস্থানরত ভারতীয় সৈন্যদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানাো । পাকিস্তানে আটক প্রায় ৪ লাখ বাঙালি জনগোষ্ঠীকে নিজ দেশে ফিরিয়ে আনা।
৭, স্বাধীন, সার্বভৌম রা হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠনের (জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ, বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য সংস্থা) সদস্যপদ লাভ করা এবং দেশ পুনর্গঠনের জন্য জরুরি ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক সাহায্য-সহযোগিতা অনুদান প্রাপ্তি নিশ্চিত করা।
এছাড়া, দেশবিরোধী সকল কার্যক্রম যেমন, চোরাচালান, প্রতি বিপ্লবী ও হিংসাত্মক রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র প্রভৃতি মোকাবেলা করে একটি স্থিতিশীল রাষ্ট্রব্যবস্থার গোড়াপত্তন করা ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ। এক্ষেত্রে স্মর্তব্য যে, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার প্রাকালে বাঙালি জাতির মধ্যে যে আশা-আকাঙ্ক্ষার বীজ বুনেছিলেন তা পূরণ করার একটি নৈতিক দায়িত্ব তার আগে থেকে ছিলই। কিন্তু, এটা অবশ্যই স্বীকারযোগ্য যে, রাতারাতি এসব সমস্যার সমাধান এত সহজসাধ্য কোনো ব্যাপার ছিল না।