জন্মই যার আজন্ম ভুল, তাঁর নাম আসিফ নজরুল
সাব্বির খান
নির্বাসিত কবি দাউদ হায়দারের কবিতার বিখ্যাত লাইন আছে, ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’। ছোটবেলায় এটা ট্রাকের ডিজেলের টাংকির ওপরে লেখা থাকতে দেখেই প্রথম এই শব্দগুচ্ছের সঙ্গে পরিচয় আমার। দেশে থাকতেও ট্রাকে যথাস্থানে এটা লেখা থাকতে দেখেছি। এখনও লেখা থাকে?
জনাব মোঃ নজরুল ইসলাম জন্ম থেকে জ্বলেননি। পুড়ে খাঁটি হয়েছেন এমন নজিরও নেই। তবে নানান আলোচনার জন্ম দিতে দিতেই আজকের আসিফ নজরুল হয়েছেন। সেসব আলোচনার মধ্যে তাঁর ত্যাগের চেয়ে সুবিধাবাদিতা বেশি, তাঁর পরিশ্রমের চেয়ে অর্জন বেশি, বাস্তবতার চেয়ে মিথ বেশি এবং সত্যের চেয়ে মিথ্যা অনেক বেশি। সেই আলোচনাই করবো এখানে।
তাঁর জন্ম ১৯৬৬ সালে হলেও কাটায় কাটায় মাত্র ১৪ বছর বয়সেই এসএসসি পাশ করেন। সাংবাদিকতার ফাঁকেই ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে তিনি বিসিএস পাশ করে ম্যাজিস্ট্রেট পদে যোগ দিয়েছিলেন। সেবার তিনি দ্বিতীয় হয়েছিলেন, তাঁর রেজিস্ট্রেশন নম্বর ছিল ডি১-১২৯৯৯। আজকাল অবশ্য বিসিএস নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন ও সন্দেহ, তখনও ছিল? যাহোক, সেই ব্যাচের সম্ভবত সবাই অবসরে চলে গেছেন। অথচ তিনি যদি বিসিএসের অ্যাডমিন ক্যাডারের চাকরি কন্টিনিউ করতেন তাহলে তাঁর জুনিয়ররা অবসরে চলে গেলেও তিনি এখনও চাকরিরত থাকতেন। ৯ম ব্যাচ দূরের কথা, মাঝখানের প্রায় সবাই এবং ১৩তম ব্যাচও এখন অবসরের পথে। অথচ তিনি চাকরিতে থাকলে আরও দুই বছর চাকরি করতে পারতেন। ভাবা যায়? অথচ ক্যাম্পাসে যারা তাঁর ১/২/৩ ব্যাচ জুনিয়র, তারাও ইতোমধ্যে সরকারী চাকরি থেকে অবসরে চলে গেছেন, কিন্তু তাঁর বয়স এখনও মাত্র ৫৮! এটা কিভাবে সম্ভব হলো? বয়স লুকানো নাকি এতে কোন ভেজাল আছে তা আল্লাহ মালুম। আসিফ নজরুল, জন্মই তাঁর আজন্ম ভুল কিনা তা পাঠক বিবেচনা করুন!
১৯৮২ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে ১৯৮২-৮৩ সেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। তাঁর ব্যাচ ১০ম ব্যাচ হিসেবে পরিচিত। অনার্সে বেশ কয়েকজন প্রথম শ্রেণি পেলেও তিনি দ্বিতীয় শ্রেণি পান। তবে মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণি পান। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে মাস্টার্সের চেয়ে অনার্সের ফলাফলকে বেশি গুরুত্ব দেয়ার অলিখিত নিয়ম। তাঁর ব্যাচে দুটিতেই প্রথম হয়েছিলেন শামসুদ্দোহা নামে একজন ভদ্রলোক। যিনি সম্প্রতি এনবিআরের সদস্য হিসেবে অবসরে গেছেন। আসিফ নজরুল অ্যাডমিন ক্যাডারের চাকরি ছেড়ে বিচিত্রায় সাংবাদিকতায় ফিরেন। বিএনপি ক্ষমতায় এলে সাংবাদিকতা ছেড়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন। চবিতে তখন তাঁদের হাত ধরেই বিভাগটি চালু হয়েছিল। কিছুদিন পরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দরখাস্ত করেন। প্রভাষক পদে অভিজ্ঞতার মূল্য অনেকটা পাত্রী হিসেবে বিবাহিত নারীর মতোই বিবেচনা করা হয়। আইন বিভাগে ১০ম ব্যাচের কেউ শিক্ষক হলে সেটা শামসুদ্দোহা হবেন, এটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু ইতোমধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে যোগ দিয়েছেন কুখ্যাত স্বাধীনতা বিরোধী ও শিক্ষক অধ্যাপক ড. এরশাদুল বারী। বারীর আস্থাভাজন হয়ে উঠেন আসিফ নজরুল। কী জাদুবলে তা জানা যায় পরে। জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সকল দলিল দস্তাবেজ ছিল আসিফ নজরুলের হেফাজতে, তিনি সকল দলিল বারীর কাছে হস্তান্তর করেন। এরপরেও সমস্যা রয়ে যায়। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বি শামসুদ্দোহাও আবেদনকারী। এবার তিনি দ্বারস্থ হন গোলাম ফারুক অভির। অভিকে নিয়ে লেখা উপন্যাস ইতোমধ্যে বেরিয়েছে। অভি ১৯৯২ সালের মে মাসে কারাগারে গেলেও অনুসারী মাস্তানরা তখনও ক্যাম্পাসে প্রবল প্রতাপশালী। অভির নির্দেশে অনুসারীরা নিরীহ শামসুদ্দোহাকে পাকড়াও করে, আবেদনপত্র প্রত্যাহার করতে বলে। এই ভয়ে শামসুদ্দোহা আর ইন্টারভিউ বোর্ডে হাজির হননি। আসিফ নজরুলেরও শিক্ষক হতে আর বাধা থাকে না। এই হলো আসিফ নজরুল, জন্মই যার আজন্ম ভুল!
এরশাদুল বারীর কারণে অনেক ভালো ও গুণী ছাত্ররা শিক্ষক হতে পারেননি। আইন বিভাগের ১১তম ব্যাচের রানা নামের একজন ছিলেন, খুব ভালো রেজাল্ট থাকলেও এরশাদুল বারী তাঁকে ইন্টারভিউ বোর্ডে পর্যন্ত ডাকেননি। পরে অস্ট্রেলিয়ায় চলে গিয়েছিলেন, এখন প্রয়াত। আরেকজন আনোয়ার জাহিদ, খুবই ভালো রেজাল্ট কিন্তু পরিণতি রানার মতোই। ফলাফল বিদেশ চলে গেছেন।
অবশ্য আসিফ নজরুল পিএইচডি করেছেন খুব ভালো প্রতিষ্ঠানে। ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের সোয়াস, অর্থাৎ স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ থেকে। এখানেও স্কলারশিপের রেফারেন্স দিয়েছেন এরশাদুল বারী। ১৯৯৪ সালে তিনি যখন পিএইচডি করতে লন্ডন যান তখন গণআদালতের সাথে সম্পৃক্ত থাকায় জাহানারা ইমামসহ ২৪ জনের নামে রাস্ট্রদ্রোহের মামলা ঝুলছিল। সবার ওপরে হুলিয়া জারি করেছিল সরকার। অথচ হুলিয়া মাথায় নিয়েও আসিফ নজরুলের দেশত্যাগে কোন সমস্যা হয়নি, কারণ জামায়াতের সাথে গোপন আপস। মজার ব্যাপার, গণআদালতে নির্ধারিত আইনজীবী উপস্থিত হতে না পারায় সাংবাদিক আসিফ নজরুলকেই আসামী গোলাম আজমের আইনজীবী নিযুক্ত করা হয়েছিল। চরিত্র ও নীতির সাথে কাকতাল বটে! এই হলো জামায়াতুল-এরশাদুল-নজরুল, জন্মই যাদের আজন্ম ভুল!
১৯৯৯ সালে পিএইচডি করার পরে দেশে ফিরেন। জামায়াত-বিএনপি জোট আমলে সহকারী প্রোক্টর ছিলেন। ২০০৪/৫ সালের দিকে দ্য ডেইলি স্টারে তাঁর প্রমোশনের অনিয়ম নিয়ে নিউজ করেছিল তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও প্রচলিত নিয়ম ভঙ্গ করে এবং তাঁর চেয়ে অধিকতর যোগ্যদের বাদ দিয়ে তাঁকে প্রমোশন দিয়েছিল জোট সরকারের ভিসি ফায়েজের প্রশাসন। এটাই আসিফ নজরুল, জন্মই যার আজন্ম ভুল!
ছাত্রজীবনেই সাংবাদিকতায় নাম লেখান। সম্ভবত মোজাম্মেল বাবুর সম্পাদিত পূর্বাভাস পত্রিকার মাধ্যমে। পূর্বাভাস ভেঙ্গে ও বিচিত্রা থেকে বেরিয়ে মিনার মাহমুদের নেতৃত্বে যাত্রা করলো বিচিন্তা। পরে অবশ্য বিচিন্তা ভেঙ্গে প্রিয় প্রজন্ম হয়েছিল। নজরুল ইসলাম বিচিন্তায় যোগ দিলেন। নজরুল বলেই ডাকা হতো। কিন্তু এটা পছন্দ করলেন না মিনার মাহমুদ, তিনি নাম বদলে নতুন নামকরণ করলেন আসিফ নজরুল। সেই থেকে তিনি আসিফ নজরুল, যার জন্মই আজন্ম ভুল!
এরশাদ সরকার বিচিন্তা বন্ধ করে দিলে শাহরিয়ার কবিরের মাধ্যমে আসিফ নজরুল বিচিত্রায় যোগ দেয়। বিচিত্রাতেই দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে নিয়ে কাভার স্টোরি করেছিলেন তিনি, যা অনেকেই পড়ে থাকবেন। আসিফ নজরুলের প্রথম উপন্যাস ‘নিষিদ্ধ কয়েকজন’-এর ভূমিকায় শাহরিয়ার কবীর সম্বন্ধে লিখেছেন, ‘আমার জীবনের অনেক সাফল্যের সূচনা এই বিশাল হৃদয়ের অসাধারণ মানুষটির হাত দিয়ে।‘ আজ অসুস্থ শাহরিয়ার কবীর বিনা অপরাধে কারাগারে, আর আসিফ নজরুল সরকারের আইন উপদেষ্টা। জ্বি হ্যাঁ, তিনিই আসিফ নজরুল, জন্মই যার আজন্ম ভুল!
এরশাদের পতনের আগে থেকে লিখতে শুরু করা উপন্যাস ‘নিষিদ্ধ কয়েকজন’ লেখা শেষ হয় এরশাদের পতনের পরে। ঢাকা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে কেন্দ্র করে নিষিদ্ধ কয়েকজন লিখেছেন, সেই ঘনিষ্ঠ বন্ধু গোলাম ফারুক অভির অনেকখানি অবদান আসিফ নজরুলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবার পেছনে। এটার পরপরই ১৯৯২ সালে আসিফ নজরুল ‘ক্যাম্পাসের যুবক’ নামে আরেকটি উপন্যাস লিখেছিলেন। এটিও আইন অনুষদে তাঁর একব্যাচ জুনিয়র একজন জাসদ ছাত্রলীগের নেতাকে উপজীব্য করে লেখা। গত বইমেলাতেও একটি উপন্যাস বের করেছেন, ‘আমি আবু বকর’ ক্যাম্পাসেরই একজন নিহত ছাত্রকে উপজীব্য করে লেখা। আসিফ নজরুল, কলম কিন্তু নির্ভুল!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পরে ছাত্রীর সঙ্গে প্রেম করেন। প্রেম এর আগেও করেছেন কিনা জানি না, কিন্তু সেটাই ছিল প্রথম বিয়ে। অল্পদিনেই ছাড়াছাড়ি। দ্বিতীয়বার কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের কন্যা শীলা আহমেদের পাণি গ্রহণ করেন। এটাও বেশিদিন টিকেনি। তৃতীয়বার বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচীর সাথে। শীলা আহমেদও নতুন বর জুটিয়ে নেন। জোট আমলে দিনেদুপুরে দৈনিক বাংলার মোড়ে সার্জেন্ট আহাদকে সন্ত্রাসীরা গুলি করে খুন করলে রোকেয়া প্রাচী বিধবা হন। বিধবা রোকেয়া প্রাচীকে গৃহিণী করে ঘরে তোলেন আসিফ নজরুল। রোকেয়া প্রাচীর মারফতেই খবর বেরোয় আসিফ নজরুল বরাবরই পরনারীর সাথে সম্পর্ক রাখেন ও গড়েন এবং স্ত্রীকে শারীরিক নির্যাতন করেন। ফলে এটাও টেকসই হয়নি। অপরদিকে শীলা আহমেদের দ্বিতীয় সংসারও ভেঙ্গে যায়। তাঁদের বৈবাহিক দৃশ্যের আপাতত শেষ অংকে দেখা যাচ্ছে আসিফ নজরুল ও শীলা আহমেদ পুনরায় সংসার শুরু করেছেন। চূড়ান্ত শেষ দৃশ্য দেখার জন্য জাতিকে অপেক্ষা করতে হবে। সম্প্রতি ফাঁস হওয়া অডিও রেকর্ডে মনে হচ্ছে অভ্যাস যায়নি। কারণ তিনি আসিফ নজরুল, জন্মই যার আজন্ম ভুল!
আসিফ নজরুলের লেখালেখি, রাজনৈতিক অবস্থান, পেশাগত জীবন, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন, শতধারায় প্রবাহিত। এক্ষেত্রে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদও তাঁর কাছে নস্যি। সংবিধান বিতর্ক ১৯৭২: গণপরিষদের রাষ্ট্রভাবনা’ নামে ২০২২ সালে একটি একটি বিশ্লেষণমূলক বই লিখেছেন। বইটির ভূমিকাতে লিখেছেন, ‘গণপরিষদ দলিলের পাতায় পাতায় উদ্বৃত্ত আছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নেতাদের ইতিহাসবোধ আর রাষ্ট্রভাবনা।‘ হিসেব করে দেখলাম প্রায় দেড় বছর আগে লেখা বইটিতে যে ভূমিকা তিনি লিখেছেন, তার সঙ্গে সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের কথা ও কাজের বিশাল ফারাক। বিশেষ করে সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠনের মাধ্যমে তা আরও স্পষ্ট হয়ে সামনে এসেছে। অর্থাৎ, তিনি যা লিখেন তা মানেন না। মানবেন কেন? কারণ তিনিই আসিফ নজরুল, জন্মই যার আজন্ম ভুল!
তাঁর দ্বিচারিতা ও অনৈতিকতা নিয়ে এরকম অগণিত গদ্য লেখা যাবে। কিন্তু একটাও তাঁকে পুরোপুরি রেপ্রেজেন্ট করতে সক্ষম হবে না। বিকজ, তিনি আসিফ নজরুল, জন্মই যার আজন্ম ভুল!