‘তুমি যে আমার, ওগো তুমি যে আমার’, ‘রাত ঘুম ঘুম ঝিকিমিকি তারা, এই মাধবী রাতে আসেনি কেউ কভু আর জীবনে আমার’, ‘এই রাত তোমার আমার শুধু দুজনার’—মৃদু আওয়াজে এমন সব গান বেজে চলছে সুচিত্রা সেনের শোবার ঘরে; আঙিনায় ফুলের বাগানে জন্মদিনের কেক কাটার পর শুরু হয়েছে আলোচনা সভা। এমনি নানা আয়োজনে আজ রোববার পাবনায় পালিত হলো বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের ৯৪তম জন্মবার্ষিকী। দিনটিকে উদ্যাপন করতে বেলা ১১টায় পাবনা শহরের হেমাসাগর লেনে সুচিত্রা সেনের পৈতৃক বাড়িতে শুরু হয় আয়োজন। সুচিত্রা সেনের ভাস্কর্যে পুষ্প অর্পণ, কেক কাটাসহ নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হয় সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদের উদ্যোগে। এ ছাড়া পাবনার আরও কয়েকটি সাংস্কৃতিক সংগঠন কেক কাটাসহ নানা কর্মসূচি পালন করে। সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ডা. রামদুলাল ভৌমিকের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নরেশ মধু, স্থানীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি এ বি এম ফজলুর রহমান, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ফরিদুল ইসলাম খোকন, ফজলুল হক সুমন প্রমুখ।
তৎকালীন বৃহত্তর পাবনায় ১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল জন্ম নেন সুচিত্রা সেন। তাঁর পারিবারিক নাম ছিল রমা দাশগুপ্ত। শহরের গোপালপুর মহল্লার হেমসাগর লেনের একতলা পাকা পৈতৃক বাড়িতে কেটেছে তাঁর শৈশব ও কৈশোর। বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত পাবনা মিউনিসিপ্যালিটির স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পদে চাকরি করতেন। মা ইন্দিরা দাশগুপ্ত ছিলেন গৃহিণী। শহরের মহাকালী পাঠশালায় (বর্তমানে টাউন গার্লস হাই স্কুল) পড়ালেখা শেষে স্থানীয় পাবনা বালিকা বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন সুচিত্রা। নানা অনুষ্ঠানে গান গাওয়া ও থিয়েটারে তিনি অভিনয়ের দক্ষতা দেখান।
পাবনার মেয়ে রমা ১৯৪৭ সালে বিশিষ্ট শিল্পপতি আদিনাথ সেনের পুত্র দিবানাথ সেনের বধূ হয়ে সংসারজীবন শুরু করেন। তাঁদের একমাত্র কন্যা মুনমুন সেনও একজন খ্যাতনামা অভিনেত্রী। বিয়ের আড়াই বছরের মাথায় ১৯৫২ সালে ‘শেষ কোথায়’ নামের একটি বাংলা সিনেমায় প্রথম অভিনয় করেন সুচিত্রা। যদিও শেষ পর্যন্ত সিনেমাটি মুক্তি পায়নি। ১৯৫৩ সালে নায়িকা হয়ে তাঁর অভিনীত প্রথম সিনেমা ‘সাত নম্বর কয়েদি’ মুক্তি পায়। ১৯৫৩ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ৩৫ বছর সুচিত্রা সেন একটানা বাংলা সিনেমায় অভিনয় করেন। স্বামী দিবানাথ সেনের আপত্তি থাকলেও সুচিত্রা সেন মনের তাগিদে নিজেকে অভিনয়ে জড়িয়ে রাখেন। সাত নম্বর কয়েদির পরিচালক সুকুমার দাশগুপ্তর সহকারী পরিচালক নীতিশ রায় সিনমা মুক্তির সময় রমা নাম বদলে তাঁর নাম দেন ‘সুচিত্রা সেন’। সুচিত্রা সেন বাংলা ৫৬টি ও সাতটি হিন্দি মিলে মোট ৬৩টি ছবিতে নায়িকা হয়ে অভিনয় করেছেন। উত্তম কুমারের সঙ্গে জুটি হয়ে ব্যাপক আলোড়ন তোলেন। ১৯৭৮ সালে তিনি দীর্ঘ ২৫ বছরের অভিনয়জীবন ছেড়ে অন্তরালে চলে যান।

১৯৫৫ সালে তিনি ‘দেবদাস’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার জেতেন, যা ছিল তাঁর প্রথম হিন্দি ছবি। ১৯৬৩ সালে ‘সাত পাকে বাঁধা’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে সুচিত্রা সেন সিলভার প্রাইজ ফর বেস্ট অ্যাকট্রেস জয় করেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী, যিনি কোনো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছিলেন। ভারত সরকারও তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মান দেন। ২০০৫ সালে তাঁকে দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কার দেওয়ার প্রস্তার রাখলে তিনি জনসমক্ষে আসতে চাননি বলে তা নেননি। ২০১২ সালে তাঁকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সর্বোচ্চ সম্মান বঙ্গবিভূষণ দেওয়া হয়।