বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গনে একজন সাহসী এবং একেবারে আলাদা চরিত্রের অধিকারী শিল্পী হিসেবে পরিচিত নিশাত আনজুম। তিনি শুধু দেশের প্রথম নারী হেভিমেটাল গিটারিস্ট হিসেবে পরিচিত নন, বরং ‘দ্য মেটাল কুইন’ নামেও খ্যাতি অর্জন করেছেন। সংগীতের প্রতি তার গভীর ভালোবাসা, সংগ্রাম এবং একরোখা স্বপ্ন তাকে এক অনন্য অবস্থানে নিয়ে এসেছে।
২০১৪ সালে তিনি হাতে গিটার তুলে নেন। তার কাছে গিটার শুধু একটি বাদ্যযন্ত্র নয়, এটি ছিল তার আত্মপ্রকাশের মাধ্যম, যেখানে তিনি মেটাল মিউজিকের শক্তি অনুভব করতে শুরু করেন। সেই সময়ই তিনি প্রভাবিত হন জনপ্রিয় হেভিমেটাল ব্যান্ডগুলো, যেমন ‘ল্যাম্ব অব গড’, ‘লিংকিং পার্ক’, এবং ‘গ্রিন ডে’-এর সংগীত থেকে। নিশাত বললেন, ‘এ ব্যান্ডগুলোর গান ছিল আমার প্রেরণা। গিটার বাজানোর শুরুটা হয়েছিল সেলফ টিউটর হিসেবে।’
তবে তার সংগীতের পথচলা সহজ ছিল না। মেটাল মিউজিক, বিশেষ করে একজন নারী গিটারিস্ট হিসেবে এ ধারায় প্রতিষ্ঠা পেতে অনেক বাধা পেরোতে হয়েছে তাকে। পরিবার এবং আত্মীয়দের সমালোচনা, সমাজের কটাক্ষ—এ সবকিছুই তাকে থামাতে পারেনি। একসময় যখন তিনি ক্লাস কিংবা কলেজের পরীক্ষা উপেক্ষা করে গিটার শিখতে ছুটতেন, পরিবারের সদস্যরা তাকে ভিন্নভাবে দেখতেন। ‘মেয়ে হয়ে কেন ছেলেদের জন্য জ্যামিং করতে যাবে?’—এমন প্রশ্নও শুনতে হয়েছিল তাকে। তবে নিশাত হার মানেননি, বরং নিজের ইচ্ছাকে শক্তিশালী করে তোলে।
নিশাতের সংগীতের পথচলা আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ২০২০ সালে, যখন তিনি তার প্রথম অ্যালবাম ‘রাইজ’ প্রকাশ করেন। এটি ছিল শুধু তার পেশাদারি জীবন শুরু নয়, বরং একটি নতুন সংগীত আন্দোলনের সূচনা। এ অ্যালবামটি শ্রোতাদের মনে একটি শক্তিশালী প্রভাব ফেলেছিল এবং তাকে ‘দ্য মেটাল কুইন’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। কিন্তু শুধু সংগীতেই থেমে থাকেননি নিশাত। তিনি এখন তার জীবনের দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘বয়কট’ নিয়ে ভীষণ এক্সাইটেড। নিশাত বলছিলেন, ‘এটা আমার জন্য একটি নতুন অধ্যায়। এ অ্যালবামের প্রতিটি গানই আমার অভ্যন্তরীণ অভিব্যক্তি।’ তবে এ অ্যালবামের মুক্তি নিয়ে তার আনন্দ কিছুটা ম্লান হয়েছে। কারণ, বর্তমানে তিনি তার পরিবারের কাছ থেকেও বয়কটের শিকার।
নিশাতের জীবনে সংগীত যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি তার ব্যক্তিগত জীবনেও কিছু কঠিন অধ্যায় রয়েছে। একবার প্রেমে পড়েছিলেন, কিন্তু সেই সম্পর্কের ব্যর্থতার পর তিনি নিজেকে পুনরায় আবিষ্কার করেছেন। নিশাত বলেন, ‘একবার প্রেমে পড়েছিলাম, কিন্তু সেই কষ্ট আর ফিরে পেতে চাই না।’ এ মন্তব্যে তার জীবনের কঠিন মুহূর্তগুলোর প্রতিফলন দেখা যায়, যখন তিনি অত্যন্ত আবেগপ্রবণ ছিলেন, কিন্তু এখন তার জীবন একেবারে অন্য পথে এগিয়ে চলছে। বলেন, ‘আমি এখন শুধু ভালো থাকতে চাই, সুস্থ থাকতে চাই। পরিচিতি, খ্যাতি—এগুলো আমাকে এখন আর টানে না।’
নিশাত আরও বলেন, ‘মেটাল মিউজিকের মধ্যে এক ধরনের শক্তি আছে, যা আপনার মনের সব অনুভূতি প্রকাশ করে। আমি যখন রাগ, দুঃখ কিংবা ভালোবাসা অনুভব করি, তখন সেই অনুভূতিগুলো আমার সংগীতের মধ্যে প্রকাশ পায়।’ এটি নিশাতের মনের গভীরতার প্রমাণ, যেখানে সংগীতের মাধ্যমে তিনি নিজের অনুভূতি ও বাস্তবতা প্রকাশ করেন।
এখন নিশাতের কাছে সংগীতের চেয়েও বড় কিছু হয়ে দাঁড়িয়েছে জীবনযাপন। তার পরিকল্পনা খুব সহজ—‘ভালো থাকতে চাই, সুস্থ থাকতে চাই এবং জীবনকে সুন্দরভাবে উপভোগ করতে চাই।’ সংগীত তার জন্য একরকম আত্মোদযাপন, যা তাকে তার অভ্যন্তরীণ শান্তি এবং শক্তি প্রদান করে। তবে ভবিষ্যতে তিনি আরও নতুন কাজ নিয়ে আসতে চান। নিশাত বলেন, ‘অ্যালবামগুলো যেমন প্রকাশিত হয়েছে, তেমনি সামনে আরও ভালো কিছু আসবে।’