রাজধানীর সাত সরকারি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধিভুক্ত করেন তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকী। ২০১৭-১৮ সেশন থেকে ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে তাদের ভর্তি শুরু হয়। এমন সিদ্ধান্তের পর থেকেই শুরু হয় ঢাবি শিক্ষার্থী ও সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মপরিচয়ের সংঘাত। দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে এটি। এছাড়া অধিভুক্তির ফলে বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হচ্ছে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদেরও। চলতি বছর আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের পর অধিভুক্তি বাতিল করে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি করে আন্দোলনে নামেন সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা।
২০১৯ সালে অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। কিন্তু সে সময় সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা সেটি চাননি, চায়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও। শুক্রবার (১ নভেম্বর) একই দাবিতে আবারও আন্দোলনে নেমেছে ঢাবি শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। পরিস্থিতি বিবেচনায় বলা যায়, অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে এবার দুপক্ষই একমত। তবে ঢাবি প্রশাসন বলছে, এ বিষয়ে অংশীজনদের সঙ্গে আরও আলোচনা প্রয়োজন।
অধিভুক্তি বাতিলে ঢাবি শিক্ষার্থীদের আল্টিমেটাম
৭২ ঘণ্টার মধ্যে রাজধানীর সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিল না করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অ্যাকাডেমিক ভবনে তালা দেওয়ার আল্টিমেটাম দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থীরা। শুক্রবার (১ নভেম্বর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি চত্বরে বিক্ষোভ সমাবেশ এ ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় ‘শোনো ভাই শোনো বোন, ঢাবির কোনও শাখা নেই’, ‘অধিভুক্তির বিরুদ্ধে ডাইরেক্ট অ্যাকশন’, ‘অধিভুক্তি বাতিল করো, ঢাবিকে মুক্ত করো’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে দেখা যায়।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বলেন, ২০১৯ সালে আমরা প্রথম সাত কলেজ অধিভুক্তি বাতিলের জন্য আন্দোলন করেছিলাম। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকার ও তৎকালীন ভিসি অধ্যাপক আখতারুজ্জামান আমাদের দাবি মেনে নেননি। এখন সাত কলেজের শিক্ষার্থীরাও আলাদা হতে চায়। তাহলে আবার কেন তাদের অধিভুক্তই রাখা হচ্ছে। আমাদের মেয়েদের জন্য হলে সিট নেই। মেয়েদের হল নির্মাণের চিন্তা না করে তারা কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর সাত কলেজের জন্য আলাদা ভবন করার কথা বলে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আশিকুর ইসলাম বলেন, আমরা দীর্ঘদিন থেকে সাত কলেজকে আলাদা করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জানিয়েছি। কিন্তু তাদের টনক নড়ছে না। গতকাল প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল ইসলাম বলেছেন, সাত কলেজকে নাকি ঢাবির অধিভুক্তই রাখা হবে। আবার তাদের জন্য নাকি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে আলাদা প্রশাসনিক ভবন করা হবে। আমরা তাদের স্পষ্ট করে জানিয়ে দিতে চাই, ঢাবি ক্যাম্পাসে যদি একটি ইটও গাঁথা হয়, সেটা হবে মেয়েদের হলের জন্য, অন্য কারও জন্য না।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বিরোধিতা
সাত কলেজের অধিভুক্তি নিয়ে বৃহস্পতিবার (৩১ অক্টোবর) প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবের আলাদা ভবন নির্মাণের বক্তব্য দেওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এর তীব্র বিরোধিতা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী আশরেফা খাতুন এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত নেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। কে কোন সিদ্ধান্ত দিলো তা দেখার সময় নেই। যে প্রশাসন ক্যাম্পাসে মিনিমাম নিরাপত্তা দিতে পারে না, পর্যাপ্ত সিট দিতে পারে না, রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ের জঞ্জাল সরাতে পারে না, সেই প্রশাসনের সিদ্ধান্ত গোনার সময় নেই। কাল (শুক্রবার) দেখা হবে দাবি আদায়ে। ২০১৯-এ পারি নাই ছাত্রলীগের জন্য, এবার কে ঠেকায় দেখি। প্রশাসন আর সরকারের তামাশায় এত মানুষ অনিশ্চয়তায় থাকবে না। অধিভুক্তি বাতিল চাই।’
হাসান মাহমুদ নামে ঢাবির এক শিক্ষার্থী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিল চাই। সাত কলেজও চায় না ঢাবির অধিভুক্ত থাকতে। ঢাবির স্টুডেন্টরাও চায় না সাত কলেজকে অধিভুক্ত রাখতে। তাহলে কাদের স্বার্থে সাত কলেজের অধিভুক্ত বহাল রাখা হচ্ছে? দ্রুত সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিল করা হোক।’
সাকিব হাসান নামে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমি মনে করি ৭ কলেজকে অধিভুক্তি থেকে বাতিল করাই ভালো হবে। ঢাবি শিক্ষকদের তো আমাদের খাতা কাটারই (মূল্যায়ন) সময় থাকে না, তাদের (সাত কলেজের শিক্ষার্থী) খাতা কাটবে কখন? ফলে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা সেশনজটে পড়ে যাচ্ছে। তাছাড়া তারা দাবি করছে, তাদের বিশ্ববিদ্যালয় করা হোক। এই দাবিও আমার কাছে যৌক্তিক মনে হয়েছে। যেহেতু আলাদা ক্যাম্পাস কিংবা ভবন নির্মাণ করতে হবে না, ফলে একটা খরচ বেঁচে যাবে। তাই অধিভুক্তি বাতিল করে তাদের আলাদা করা হোক।’
আলাদা ভবন নির্মাণের বক্তব্য ‘প্রেস সচিবের নিজস্ব’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধিভুক্তি বাতিল করে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ঢাকা কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থী আবদুর রহমান। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবের দেওয়া বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি জানান, সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের দাবি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়। সে জায়গায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকার ভিতরে কোনও ভবন মেনে নেওয়া হবে না। আমরা বেরিয়ে যেতে চাই। আমাদের পরিচয়ের যে সংকট তা নিয়ে আমরা আর ভুগতে চাই না।
প্রেস সচিবের দেওয়া বক্তব্য একান্তই তার দাবি করে আবদুর রহমান বলেন, আমাদের শিক্ষা উপদেষ্টা ও আসিফ মাহমুদ ভাইয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে। বৈঠকে তারা আমাদের বলেছেন, এ মুহূর্তে নতুন একটা বিশ্ববিদ্যালয় করা মানে সংকট তৈরি করা। কারণ তারা স্বল্পদিনের জন্য ক্ষমতায় এসেছেন। তারা জানিয়েছেন আমাদের সমস্যা সমাধানে কাজ করবেন। তবে নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয় দেওয়া সম্ভব নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে একটা নতুন করে ভবন তৈরি করার যেটা বলা হয়েছে এটা আসলে সত্য না। আমাদের বলা হয়েছে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে যত ধরনের সুবিধা আছে, তার মধ্যে শুধু ভিসি ছাড়া সব ধরনের সুবিধা সাত কলেজের জন্য দেওয়া হবে। এবং তার জন্য একটি প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ করা হবে, সেটা অবশ্যই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বাইরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে হলে আমরা কখনোই তা মেনে নেবো না। আমাদের সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা মানবে না, আমরাও মানবো না। অধিভুক্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও বাতিল চায়, আমরাও বাতিল চাই।
‘ঢাবি প্রশাসন সাত কলেজকে শোষণ করছে’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দীর্ঘদিন ধর সাত কলেজকে শোষণ করছে বলে দাবি করে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী আবদুর রহমান বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘদিন ধরে আমাদের শোষণ করে আসছে। এর জন্য অবশ্যই শিক্ষার্থীরা দায়ী নয়, দায়ী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। আমরা তাদের অধীনে আর থাকতে চাই না। আমাদের যে আত্মপরিচয়ের সংকট, অ্যাকাডেমিক সংকট, এসব আমরা কাটিয়ে উঠতে চাই। আমাদের এসব সমস্যা কীভাবে সমাধান করা যায় সে বিষয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা আন্তরিক রয়েছেন।
এই সমস্যা সমাধানে কমিটি করে দেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদের সঙ্গে তাদের আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, শিক্ষা উপদেষ্টা আমাদের বলেছেন, যদি কমিশন করে দেই তাহলে তারা দীর্ঘদিন সময় নেবে। এরপর হয়তো তারা গবেষণা করে সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারবেন না, শুধু সময় নষ্ট হবে। তাই সময় নষ্ট যাতে না হয়, সেজন্য কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়াও কীভাবে সমস্যার যৌক্তিক সমাধান করা যায়, সেটি নিয়েও বসবেন।
শনিবার সংবাদ সম্মেলন করবেন সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা
চলমান ইস্যু নিয়ে তারা আগামী শনিবার সংবাদ সম্মেলন করবেন বলে জানিয়েছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী আবদুর রহমান।
আন্দোলনের অন্যতম মুখপাত্র কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থী জাকারিয়া বারী সাগর বলেন, গতকাল শিক্ষা উপদেষ্টা ও ক্রীড়া উপদেষ্টার সঙ্গে আমাদের সাত কলেজ প্রতিনিধিদের বৈঠক হয়েছে। সেখানে তাদের তথ্য ও প্রেস সচিবের বক্তব্যের সঙ্গে কোনও মিল নেই। আমরা আগামীকাল ঢাকা কলেজ অডিটোরিয়ামে নিজেদের মধ্যে আলোচনায় বসবো এবং পরবর্তী করণীয় নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করবো।
আরও আলোচনা প্রয়োজন, বলছে ঢাবি প্রশাসন
উপদেষ্টার প্রেস সচিবের দেওয়া বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানতে পেরে এ বিষয়ে বিবৃতি দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এতে বলা হয়, সরকারি সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা একটি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সরকারি সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের দাবি করে আসছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মনে করে, সরকারি সাত কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনদের নিয়ে এ বিষয়ে আরও আলাপ-আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই এ ব্যাপারে একটি টেকসই ও শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব।
সাত কলেজে বিষয়ে নতুন প্রস্তাবের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের ইতোপূর্বে কোনও আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়নি জানিয়ে আরও বলা হয়, বিষয়টি জানার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে সংশ্লিষ্ট মাননীয় উপদেষ্টাসহ সরকারের বিভিন্ন উচ্চ মহলে আলাপ করেছে। সরকারও বিষয়টির জনগুরুত্ব বিবেচনা করে আন্তরিকতার সঙ্গে সাড়া দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীসহ প্রধান অংশীজনদের নিয়ে মন্ত্রণালয় পর্যায়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে (সম্ভাব্য তারিখ আগামী রবিবার) এ বিষয়ে একটি জরুরি বৈঠক আয়োজনের ব্যাপারে সরকার সম্মত হয়েছে।