Homeদেশের গণমাধ্যমেসন্তানদের জন্ম কেবল রক্ত দেওয়ার জন্য নয়

সন্তানদের জন্ম কেবল রক্ত দেওয়ার জন্য নয়


কর্তৃত্ববাদী শাসকের পতন হলেও কর্তৃত্ববাদ চর্চা চলছেই। বন্ধ হয়নি অপছন্দ হলেই তাচ্ছিল্য করার প্রবণতা। কম–বেশি তা প্রায় সবদিকেই। নির্বাচন, সংস্কার, গণহত্যার বিচার নিয়ে বিএনপির সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তথা নাগরিক কমিটির বিরোধটা চরম পর্যায়ে নয়। কিন্তু, কোনো কোনো ছাত্রনেতার বক্তব্য, শব্দ বেশ আক্রমণাত্মক। বিএনপিকে ভারতমুখী, ফ্যাসিবাদের সহায়ক বলতেও ছাড়েননি তারা। মুখের ভাষার সঙ্গে তাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজও শোভনীয় নয়। প্রকারান্তরে যা আরেক ফ্যাসিবাদ। একত্মবাদের ছায়া স্পষ্ট।

বাংলাদেশের পাঁচ বা দশটা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ছাত্রদের গড়া জাতীয় নাগরিক কমিটিও যোগ হবে। এরইমধ্যে হয়েও গেছে। গণতন্ত্রের প্রশ্নে এটি ভালো দিক। বহুদল-বহুমত গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। সেখানে প্রশ্ন এসেছে, উপদেষ্টা পরিষদে ছাত্রদের ৩জন প্রতিনিধি থাকা নিয়ে। এতে কিংস পার্টির বদনাম হবে নতুন সংগঠনটির। সরকারের নিরপেক্ষতাও প্রশ্নবিদ্ধ হবে- এই মতামত ব্যক্ত করা সরকারের জন্য এবং নতুন দলের আয়োজকদের জন্যও একটি উত্তম পরামর্শ। কিন্তু, এটিকে নেতিবাচকভাবে নিয়ে যে রুক্ষতা দেখানো হলো তা বাজে দৃষ্টান্ত। এমনিতেই দিন দিন ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের গ্রহণযোগ্যতা ও আবেদন কমছে। নানা বদনামে পেয়ে বসেছে তাদের। যার টুকটাক মূলধারার গণমাধ্যমেও আসছে। স্যোসালমিডিয়ায় আরো বেশি।

মাত্র ক’দিন আগেও কী সম্মানিতই না হয়েছে তারা। পেয়েছে কতো না মিডিয়া কাভারেজ। বড় বা পুরনো পরিচিত দলের মূল নেতার চেয়ে কিশোর বয়সী ছাত্ররা কোথায় কী বলেছে তা গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে মিডিয়ার কাছে। কিছুদিন ধরে উল্টো নমুনা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সার্বজনীন রূপ হারাতে বসেছে। রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মীদের অনেকে এই প্লাটফর্ম ছেড়ে নিজেদের ঘরে চলে গেছে। কোথাও কোথাও জুলাই অভ্যুত্থানে জীবনের ঝুঁকি নেয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের কারো কারো মধ্যে ছাত্রলীগ হয়ে ওঠার প্রবনতা লক্ষনীয়। ময়মনসিংহে তাদের কয়েক সমন্বয়কের ভারতীয় চিনি ও জিরা চোরাচালান করতে গিয়ে ধরা পড়ার খবর গণমাধ্যমে বড় করেই এসেছে।

জাতীয় নাগরিক কমিটি জুলাই ফাউন্ডেশন সম্পর্কে যে অভিযোগ করেছে তা গুরুতর। তারা ফাউন্ডেশনকে যে চিঠি দিয়েছে তাতে দেখা গেছে ফাউন্ডেশন রাস্ট্র থেকে টাকা নিয়ে ইচ্ছেমতো ব্যয় করছে, আহত বা শহিদ পরিবারকে টাকা দিচ্ছে না, নাম বাদ দিয়ে দিচ্ছে- শহিদ পরিবারের সদস্যদের সাথে দুর্ব্যবহার করছে। এরইমধ্যে সারজিসফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক পদ ছেড়ে দিয়েছেন। বাংলামোটরে তাদের মধ্যে প্রকাশ্য গোলমাল বাধছে প্রায়ই। দেশের বড় দল বিএনপির সঙ্গে গায়ে পড়ে ঝগড়া বাধাচ্ছে। বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতা আছে। কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না বলে বদনামও আছে। কিন্তু বিএনপি এই সময়ে রাজনীতিতে দৃঢ়তা দেখিয়ে চলছে। হজমি শক্তিও বাড়িয়েছে।

গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্খা ডাইভার্ট করে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পরাজয়ের গ্লানি মুছতে আওয়ামী লীগের সব খারাপ কাজকে মুক্তিযুদ্ধের কাঁধে তুলে দিয়ে ৭১ এর বিপরীতে ২৪ কে দাঁড় করিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে মাটি চাপা দেবার পরিকল্পনা বিএনপি রুখে দিয়েছে। এর বিপরীতে আগস্ট আন্দোলনের ছাত্রদের সুনামের সাথে কিছু দুর্নাম যোগ হচ্ছে। দেশকে সাংবিধানিক ধারার বাইরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টার অভিযোগও এখন তাদের ঘাড়ে। জুলাই বিপ্লবের প্রক্লামেশন দিতে গিয়ে হোঁচট খেয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে ওটাকে একবার বলা হয়েছে বেসরকারি উদ্যোগ। পরে সরকারই এ ঘোষণার দায়িত্ব নিয়েছে। এর আগে, রাষ্ট্রপতির অপসারণের দাবি তুলে শিক্ষার্থীদের পিছু হটতে হয়েছে।

আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ চেয়েও সুবিধা করতে পারেনি। তারওপর কিংস পার্টি গঠনের তৎপরতার অভিযোগে সেই সার্বজনীনতা হারিয়েছে। আন্দোলন ও সরকার বিতাড়ন প্রশ্নে শ্রীলঙ্কা-তিউনিসিয়া-বাংলাদেশ বেশ প্রাসঙ্গিক। তিনটি অভ্যুত্থানের মধ্যেই বেশ মিল। পতিত এ তিন সরকারই ছিল চরম ফ্যাসিস্ট । নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দল নয়, তরুণদের দ্রোহে সামিল হয়ে সাধারণ মানুষ রাস্তায় আসে। শ্রীলংকায় ২০২২ সালে ঘটা অভ্যুত্থানের দুই বছরের মধ্যেই শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে স্থিতিশীল জায়গায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। অথচ, তিউনিশিয়ায় অভ্যুত্থানের সময় পেরিয়েছে এক যুগেরও বেশি।

এখনো অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ের অস্থিরতা থেকে বের হতে পারেনি তিউনিসিয়া। বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পাঁচ মাসেও জনজীবনে স্বস্তিদায়ক পরিবর্তন আসেনি। উন্নতি হয়নি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও। অর্থনৈতিক অবস্থা পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় সাফল্যের লক্ষণ নেই। গোতাবায়া রাজাপাকসে সরকারের পতনের সময় শ্রীলংকায় মূল্যস্ফীতির হার ছিল প্রায় ৬৭ শতাংশ। ডলার সংকটে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করা দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপদেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও তখন ৩ বিলিয়ন ডলারের নিচে।

আরো কিছু দলও মনে করে নির্বাচন বিলম্বিত করার উদ্দেশ্য কোনো দলকে মাঠ গোছানোর সুযোগ করে দেয়া, কাউকে দল গঠনের সুযোগ করে দেয়া। তাদের কারণে সরকারও সমালোচনার পাত্র হয়ে গেছে। প্রয়োজনে আবার রাস্তায় নামা, জীবন দেয়া- এসব হুঙ্কার শুনতে ভালো, কিন্তু কাম্য নয়। আবু সাঈদ-মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ-এ ধরনের স্লোগানে আবেগ থাকলেও যে কোনো মা-বাবার জন্য কলিজা কাঁপানো। বিবেকবান নাগরিকদের কাছেও গ্রাহ্য নয়। রক্ত অনেক গেছে। আর নয়। সন্তানদের জন্ম কেবল রক্ত দেওয়ার জন্য নয়।

দুই বছরের মধ্যেই তীব্র প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে সফলতার সঙ্গে ঘুরে দাঁড়ানোর নজির হয়ে দাঁড়িয়েছে শ্রীলংকা। মূল্যস্ফীতি নয়, বরং চলতি বছরের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত টানা তিন মাস মূল্য সংকোচনের দেখা পেয়েছে দেশটি। রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ৬ বিলিয়ন ডলারে। অর্থনীতির পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবেও শ্রীলংকা এখন বেশ স্থিতিশীল। দেশটির পার্লামেন্ট নির্বাচনে আনুরা কুমারা দিশানায়েকের বামপন্থী জোট ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার-এনপিপি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সব রাজনৈতিক দলকে দেশ গড়ার কাজে যুক্ত করতে পেরেছে। গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া তরুণ প্রজন্মও নিজ নিজ কাজে ফিরে গেছে।

বিপুল গণবিক্ষোভের মুখে ২০১১ সালের ১৪ জানুয়ারি তিউনিসিয়ার স্বৈরশাসক জাইন এল আবিদিন বেন আলির পতন ঘটে। ২৩ বছর ধরে ক্ষমতা আটকে রাখা এ শাসক দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। তরুণদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এ আন্দোলন পরিচিতি পেয়েছিল জেসমিন রেভল্যুশন বা জেসমিন বিপ্লব নামে। আরব বসন্তের সূচনাকারী সফল এ অভ্যুত্থানের এক দশকের বেশি সময় পেরোলেও তিউনিশিয়া এখনো দিশা খুঁজে পায়নি। অর্থনীতির পাশাপাশি রাজনীতিতেও স্থিতিশীলতা ফেরেনি।

অর্থনৈতিক সংকোচন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগ খরা, বেকারত্ব, দুর্বল রিজার্ভসহ নানামুখী চাপের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে তিউনিশিয়া। বেন আলির পতনের পর এখন পর্যন্ত দেশটির শাসনক্ষমতায় পরিবর্তন এসেছে চারবার। কোনো সরকারই জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। বেগতিক পরিস্থিতিতে জেসমিন বিপ্লবে নেতৃত্ব দেয়া তিউনিসিয়ান তরুণদের কিছু সংখ্যক নিগৃহিত হয়ছেন। অনেকে দেশ ছেড়েছেন। বাংলাদেশের শ্রীলংকার মতো ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষণ নেই। ছাত্ররা ঘরে ফিরে যাচ্ছে না। আবার তিউনিসিয়ার মতো না হলেও নমুনা ভালো হয়। রাজনৈতিক বোঝাপড়ার লক্ষণ নেই।

মাস কয়েক আগেও সহযোগিতা দেয়া রাজনৈতিক দলগুলো তাদেরকে আগের মতো আমল দেয় না। প্রতিপক্ষও ভাবে। সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় নির্বাচন ফিরে আসার মধ্য দিয়ে নির্বাচনী সংস্কারের প্রধান কাজটি হয়ে গেলেও ছাত্রদের কারণে সরকার ঢিলেমি করছে বলে তাদের মুরুব্বি দল বিএনপি।

আরো কিছু দলও মনে করে নির্বাচন বিলম্বিত করার উদ্দেশ্য কোনো দলকে মাঠ গোছানোর সুযোগ করে দেয়া, কাউকে দল গঠনের সুযোগ করে দেয়া। তাদের কারণে সরকারও সমালোচনার পাত্র হয়ে গেছে। প্রয়োজনে আবার রাস্তায় নামা, জীবন দেয়া- এসব হুঙ্কার শুনতে ভালো, কিন্তু কাম্য নয়। আবু সাঈদ-মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ-এ ধরনের স্লোগানে আবেগ থাকলেও যে কোনো মা-বাবার জন্য কলিজা কাঁপানো। বিবেকবান নাগরিকদের কাছেও গ্রাহ্য নয়। রক্ত অনেক গেছে। আর নয়। সন্তানদের জন্ম কেবল রক্ত দেওয়ার জন্য নয়।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।



Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত