সম্ভবত ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাস। আমরা তখন গোকুলনগর ট্রানজিট ক্যাম্পে শীতে কাঁপছি। অপেক্ষা করছি কখন মুক্তিযুদ্ধে প্রশিক্ষণের জন্য ট্রানজিট ক্যাম্প ছেড়ে ট্রেনিং ক্যাম্পে যেতে পারব, ট্রেনিং নিয়ে বন্দুক হাতে দেশে যাব, যুদ্ধ করব। অন্যদিকে পাকিস্তানি বাহিনী তখন একের পর এক হার মানছে। প্রতিদিন ভারত থেকে দলে দলে মুক্তিযোদ্ধারা দেশের ভেতরে ঢুকছেন। আমরা ট্রানজিট ক্যাম্পে বসে থাকতে থাকতে অধৈর্য হয়ে পড়ছি।
এ রকম সময় ট্রানজিট ক্যাম্পের বদ্ধ জীবন আমাদের জন্য মোটেও কাম্য ছিল না। আমি ছিলাম ক্যাম্পের কনিষ্ঠ সদস্যদের একজন। এই কারণে আমাদের ক্যাম্পের প্রধান কঠিন কঠোর ব্রহ্মচারীর মতো দৃঢ়চেতা কমরেড জ্ঞান চক্রবর্তী আমাকেই একটি কঠিন দায়িত্ব দিয়েছিলেন। সেই দায়িত্বটি হচ্ছে, দুপুরবেলায় লাইন করে যখন সবাই খাবারের বাসনটি নেবে, তখন সেই লাইনে টিকিট বিতরণের দায়িত্ব আমার। ফলে প্রতিদিন সবাইকে টিকিট দিয়ে আমার খেতে খেতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যেত। কিন্তু বয়স আমার কম ছিল বিধায়, বয়স্ক ক্যাম্প–সাথিরা ধৈর্য ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতেন। ভাবতেন এই বাচ্চাই যখন এতক্ষণ অপেক্ষা করছে, আমরা কেন পারব না।
আমরা তখন খোলা ময়দানে বাঁশের চাটাইয়ের ওপর বসে দুপুরের ভাত বিকেলে খেতাম। রাতেও হ্যাজাকের আলোতে ময়দানেই খাওয়া চলত, সুশৃঙ্খল লাইনে দাঁড়িয়ে একই পদ্ধতিতে। গভীর রাতে পোকামাকড় এসে ভাতের থালায় পড়লে, আমরা সেটাই কড়মড়িয়ে খেতাম এবং মধ্যবিত্ত কমরেডরা একে অপরকে ঠাট্টা করে বলতাম, ‘প্রোটিন’ খাচ্ছি। আমাদের প্রতি বেলা আহার বরাদ্দ ছিল খুবই সামান্য, সকালে দুটি আটার রুটি ও এক চামচ বুটের ডাল। দুপুরে মাপা এক কাপ ভাত এবং এক হাতা ‘ঘ্যাঁট’ নামের বিচিত্র এক তরকারি। ঘ্যাঁট হচ্ছে যা কিছু শাকসবজি, কচুঘেঁচু সংগৃহীত হয়েছে, তার সম্মিলিত এক রূপ। রাতেও দুপুরের মতন একই খাবার।