Homeদেশের গণমাধ্যমেমিতিয়ার ভালোবাসা ।। অধ্যায়ー৯

মিতিয়ার ভালোবাসা ।। অধ্যায়ー৯


ইভান আলেক্সিভিচ বুনিন রাশিয়ান কবি ও ঔপন‌্যাসিক, যিনি রুশ সাহিত্যে প্রথম নোবেল পুরস্কার পান ১৯৩৩ সালে। ম‌্যাক্সিম গোর্কি বুনিনকে রাশিয়ার জীবিত লেখকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম বলে বিবেচনা করেছিলেন। রোমান্টিক গতিময়তায় লেখা তার ‘মিতিয়াস লাভ’ উপন্যাসটি যৌবনের প্রেমবোধ ও অনুভব নিয়ে সরল, নিরীহ ও বিয়োগান্ত এক মনোগ্রাহী লেখা। সাধারণকে অসাধারণে পরিণত করার গোপন রহস্য ও নিপুণ গদ‌্যময়তা ইভান বুনিনের লেখার অন‌্যতম বৈশিষ্ট‌্য। ‘মিতিয়াস লাভ’ ফরাসি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন, ম‌্যাডেলিন বয়েড এবং বইটির ভূমিকা লিখেছেন আর্নেস্ট বয়েড।

এই প্রথমবারের মতো সে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মতো, পরিপূর্ণ স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে লাগল। এমনকি তার মা-ও তাকে অন‌্যভাবে দেখা শুরু করল। কিন্তু সবচেয়ে যে বিষয়টি অন‌্যতম প্রধান তা হলো তার চেতনায় অনুভূত হওয়া এই জায়গাটিকে ঘিরে তার প্রথম ভালোবাসা ও শৈশব ও ক‌ৈশোরের নানা রকম চাওয়া, এসব কিছু নিয়েই সে নতুন জীবনে প্রবেশ করল। এই ভালোবাসাটার জন‌্যই সে বড় হয়েছিল, আরো পরিপক্ব হয়েছিল। মনে হচ্ছিল, এই ভালোবাসাটির জন‌্যই সে জন্মমুহূর্ত থেকে অপেক্ষা করেছিল। খুব শিশু বয়সেই গভীর ও রহস্যময় কিছু অনুভব তার মধ্যে জাগ্রত হয়েছিল। এই বসন্তের এক দিনেই, সে স্মরণ করছিল একটি গন্ধের স্মৃতি যা বাগানের ভেতর লাইলাক ঝোপের পাশ থেকে ভেসে এসেছিল। সে দাঁড়িয়ে ছিল এক যুবতী নারীর গা ঘেঁষে। যতদূর মনে পড়ে, গন্ধটি ছিল তার নার্সের গায়ের গন্ধ। হঠাৎ করেই যেন পৃথিবীটা এক স্বর্গীয় আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছিল। সম্ভবত, তা ছিল নার্সের মুখমণ্ডলের সৌন্দর্য, বা সম্ভবত, আঁটো হয়ে থাকা অ‌্যাপ্রোন দিয়ে ঘেরা তার সুডৌল স্তনের সৌন্দর্য। মনে হচ্ছিল, মায়ের জঠরে সন্তান যেভাবে নড়ে ওঠে সেভাবে এক উষ্ণ বিদ‌্যুতপ্রবাহ তার শরীরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে তাকে সেভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল। সেটা ছিল একটি স্বপ্নের মতো অনুভূতি।

কিন্তু শৈশবের এরকম আরো কিছু অভিজ্ঞতা তার হয়েছিল, কৈশোরের প্রথম দিকে, হাইস্কুলে কাটানোর সময়টিতে। ঠিক সেই সময়টিতে সে এক অন‌্যধরনের আকর্ষণ বোধ করত, যা পৃথিবীর অন‌্য কিছুর সঙ্গে মেলানো যাবে না। সে আকর্ষণ বোধ করত কিছু ছোট ছোট শিশুদের প্রতি যারা তাদের মায়েদের হাত ধরে শিশুদের পার্টিতে আসত। ছোট ছোট মেয়েরা যারা তাদের ছোট্ট ছোট্ট পোশাক, ছোট্ট মাথার উপরে ঝুটি বাঁধা চুল নিয়ে আনন্দে ঘুরে বেড়াত, তাদের দেখে তার মধ্যে এক ধরনের বুভুক্ষ কৌতূহল তৈরি হতো। পরের দিকে, তাদের জনপদের প্রধান শহরের একটি ছোট হাই স্কুলের মেয়ের প্রতি তার সচেতন আকর্ষণ বজায় ছিল পুরো হেমন্তকাল জুড়ে। মেয়েটি তার বাগানের দেয়ালের পেছনে সন্ধ‌্যার সময়ে মাঝে মাঝে একটি গাছে চড়ত। তার প্রাণবন্ততা, নিরীহ দুষ্টুমি, তার গোল করে বাঁধা চুল, ময়লা ছোট ছোট হাত, তার হাসি, তার জোরে জোরে কথা বলা, এসব তার মধ্যে এমন একটি উপচে পড়া প্রভাব তৈরি করতো যে, সে সারাদিনই তার কথা ভাবতে থাকত। নিজের অতৃপ্ত ইচ্ছেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে অসমর্থ হয়ে কখনো কখনো সে বিষণ্ন থাকত, কখনো বা কাঁদত। কিছুদিন পর এই অনুভবগুলো আপনাআপনিই চলে যেত, এবং একসময় ভুলেও যেত। মিতিয়া তখন আবার অন‌্যদের প্রতি আকর্ষণবোধ করতে থাকত। এই আবেগগুলো ছিল ক্ষণস্থায়ী এবং খুব সতর্কতার সাথে গোপনীয়। স্কুলের নাচের পার্টিতে তার যে-সব সূক্ষ্ণ, গোপন দেহবোধ ছিল, তা ছিল সবসময়ই তীক্ষ্ণ আনন্দ ও তীব্র দুঃখবোধের। যখন সে মাত্র দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, তখন তার চেয়ে উঁচু ক্লাসের ষোলো বছরের এক ছাত্রীর সঙ্গে প্রায় প্রেম হয়ে গিয়েছিল। লম্বা, কালো চুলের মেয়েটি, যার চোখের ভ্রূ ছিল খুব কালো। জীবনে প্রথমবার সে মেয়েটির নরম গাল শুধু একবার স্পর্শ করেছিল। এবং সে অনুভব করেছিল এক স্বর্গীয় শিহরন, যা সে প্রথম আলাপে কারো সঙ্গে তেমন অনুভব করেনি, ঠিক সেই রকম। ঠিক এই রকমটা সে কাতিয়ার সময়েও কখনো এমনভাবে অনুভব করেনি। ষোলো বছরের মেয়েটির সাথে সেই অনুভবের অভিজ্ঞতা সেখানেই শেষ হয়ে গিয়েছিল, এবং একসময় সে তা ভুলেও গিয়েছিল। তারপর মিতিয়া দীর্ঘদিন নিজেকে শারীরিকভাবে নির্জীব অনুভব করছিল, আর তার মন ছিল নানা স্বপ্ন আর ছবিতে পরিপূর্ণ।
মিতিয়া দেখছিল, বসন্তের অবহেলা ও মনোমুগ্ধকারী প্রভাব দুটোই তার আত্মাকে অধিকার করে ফেলেছে। কাতিয়ার সাথে দেখা হওয়ার আগে পর্যন্ত তার সমস্ত জীবন, যে আকর্ষণ অনুভব করছিল, তার স্বপ্ন, তার আশা, সবকিছুই ছিল উদ্বিগ্নতা ও অলীক চিন্তার পাঁচমিশালী মাত্র।

তার জন্ম হয়েছে এই মফস্বল শহরেই, আর সে এখানে বড়ও হয়েছে কিন্তু বসন্তের দিনগুলি সে শহরেই কাটিয়েছিল। একমাত্র গত বছরের আগের বছরে তার ব্যতিক্রম ঘটেছিল। যখন সে ইস্টারের সময় বাড়িতে এসে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, তখন পুরো মার্চ মাস ও এপ্রিলের কিছু সময় আরোগ‌্যলাভের জন‌্য সে বাড়িতে কাটিয়েছিল। এটি ছিল তার খুবই স্মরণীয় সময়। পনেরো দিন সে শয্যাশায়ী ছিল, আর বিছানায় শুয়ে থেকে জানালা দিয়ে দেখেছিল আকাশ, পাহাড়ের উঁচুতে থেমে থাকা বরফ, বাগান, গাছের গুড়ি, আর গাছের শাখা প্রশাখা যা প্রতিদিন পরিবর্তিত হচ্ছিল দিন বড় আর উষ্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। সে বাইরে তাকিয়ে দেখছিল, সকাল, সূর্য তার কিরণ ঢেলে দিচ্ছিল, এত আলোয় রুমটা গরম হয়ে উঠেছিল। উষ্ণতার কারণে মাছিরা জীবন ফিরে পেয়েছিল, আর তারা জানালার শার্সিতে হামাগুড়ি দিচ্ছিল। তার পরের দিন দুপুরবেলায় সূর্যটা ছিল অন‌্যদিকে, এবং সে জানলা দিয়ে দেখছিল নীলচে সাদা বরফ আর আকাশটা যেন মার্বেলের মতো নানা রঙে বিভক্ত। সেখানে একটি অনেক বড় সাদা মেঘ দেখা যাচ্ছিল গাছের শীর্ষের ভিতর দিয়ে। পরের দিন সারা আকাশটায় ছিল স্তূপ স্তূপ জমে থাকা মেঘলা মেঘ, গাছের বাকলের আদ্রর্তা উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল, জানালার উপরে টুপটুপ করে পরছিল বরফগলা জলবিন্দু। এটা তার জন‌্য মোটেই ক্লান্তিকর ছিল না, বরং সে উল্লসিত হয়ে উঠেছিল বরফের এই গলে যাওয়ার অনুভবে। তারপর কুয়াশা আর বৃষ্টি উষ্ণ হয়ে এলে, আর কিছুদিনের মধ্যে বরফ গলে অদৃশ‌্য হয়ে যাচ্ছিল, সেই বরফগলা জল নিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল ছোট্ট খাল যা বাগানের মধ্যে দিয়ে জমির ভেতরে যেয়ে পড়েছিল। বরফ সরে যেয়ে যে কালো কালো মাটি দেখা যাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল, তার মাঝেও আনন্দের সঞ্চার হচ্ছে।
মিতিয়ার মনে পড়ল মার্চের শেষের দিকে, তার অসুস্থতার প্রথমদিকে, সে তখনো ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতে পারত। সে বেড়াতে যেত, খড় আচ্ছাদিত প্রান্তরে, মাঠগুলো ছিল কালচে, তখন পর্যন্ত চাষ করা হয়নি, কিছু কিছু জায়গাতে কর্ষণ করা হয়েছে, ওট বোনা শুরু হয়েছে মাত্র। মাটিগুলো তখনো তার আদিশক্তিতে কালো ও ভারী হয়েছিল। সে ঘোড়ায় চড়ে খড় পেরিয়ে ও কর্ষিত জমি পেরিয়ে এক দূরের উপত্যকা যে বন আছে সেখানে চলে গিয়েছিল। পরিষ্কার বাতাবরণের মধ্যে সে দেখতে পেয়েছিল বিস্তীর্ণ মাঠের নানা বৈচিত্র্য, তার খোলা জায়গাগুলো, ছোট জায়গাগুলো, কিছু দৃশ্যমানতা আর কিছু বিস্তৃতি। তারপর সে উপত্যকার দিকে গেল। ফসল ছাড়িয়ে নেবার পর গতবছরের পাতারা যে পাতার মোটা কার্পেট তৈরি করেছে, তার ঘোড়ার খুরের নিচে সেই পাতাদের মর্মরধ্বনি বাজছিল। কোথাও তারা শুকিয়ে খড়ের রঙের হয়েছিল, কোথাও কোথাও ছিল ভেজা আর বাদামি। সে পাতায় আচ্ছাদিত নালাটি পেরিয়ে গিয়েছিল, যেখানে বরফের গলে যাওয়া জল তখনো প্রবাহিত হচ্ছিল। সেখানে গভীর সোনালি রঙের পাখিগুলো বের হয়ে আসছিল, মনে হচ্ছিল যেন তার ঘোড়ার খুরের ভিতর থেকে পাখিগুলো বের হয়ে আসছে। সে যখন উপত‌্যকায় পৌঁছল, মনে হচ্ছিল এক নির্মল বাতাস তার সাথে সাক্ষাতের জন‌্য এলো, এবং তার ঘোড়াটি তখন লাফ দিয়েছিল বিজয়ীর মতো। সে লাফ দিয়েছিল স্যাঁতস্যাঁতে খড়ের উপর আর কর্ষিত কালো জমির উপর। ঘোড়াটি শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছিল জোরে জোরে, গন্ধ শুঁকছিল এবং চমৎকার বন‌্যশক্তির প্রকাশ করছিল হ্রেষা ধ্বনি দিয়ে।

এই বসন্ত তার কাছে কী বারতা নিয়ে আসেーবিশেষ করে সেদিনের সে মাঠের ভেতরে কাটানো দিনটিতে? এতে যা বোঝা যাচ্ছে তা হলো, বসন্তই হচ্ছে তার সত্যিকারের প্রথম ভালোবাসা। সেই সময়টাতেই সে প্রতিমুহূর্তেই কারো না কারো সাথে ভালোবাসায় জড়িয়ে থাকছিল। ওই সময়েই হাই স্কুলের সব মেয়েদের সে ভালোবেসেছিল এবং শুধু তাই নয়, যত মেয়ে সে দেখেছিল পৃথিবীতে সবাইকেই সে ভালোবাসতে পেরেছিল সেই সময়টাতেই। ঈশ্বর! এত দিন পরে এসে কত দূরে মনে হচ্ছে সেই সময়গুলো। কত ছোট্ট একটা নিরীহ বালক ছিল সে, হৃদয় ছিল তার দুঃখগুলো নিয়ে, তার আনন্দগুলো নিয়ে, তার স্বপ্নগুলো নিয়ে, একেবারেই সহজ সরল। সবকিছুই ছিল কত নিরীহ, কত সরল, কত সহজ! এখন সেই নিরীহ বালকটির প্রতি তার নিজেরই কেমন যেন দুঃখ আর করুণা বোধ হচ্ছে। এখন তার লক্ষ্যহীন, মেকি ভালোবাসা যেন সেই সকল আশ্চর্য স্বপ্নের এক স্মৃতি।
কিন্তু এখন কাতিয়া যেন ওই সবকিছুর মধ্যেই বিরাজ করে, কাতিয়াই যেন তার সবটুকু ধারণ করে। কাতিয়াই, যেন সমস্ত পৃথিবীতে মূর্ত হয়ে আছে। চলবে





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত