Homeদেশের গণমাধ্যমে‘মান’ সব স্থাপনার জন্যই সমান

‘মান’ সব স্থাপনার জন্যই সমান


আজ ১৪ অক্টোবর, বিশ্ব মান দিবস। যাঁরা প্রতিনিয়ত নিজেদের কাজের মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ের মান এবং গুণ নতুন করে নির্ধারণ করছেন, তাঁদের সম্মান জানাতে এই দিবসটি পালন করা হয়। আমেরিকান সোসাইটি অব মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার্স, ইন্টারন্যাশনাল ইলেক্ট্রোটেকনিক্যাল কমিশনসহ বিভিন্ন সংস্থা এই দিবসটি ১৯৪৬ সাল থেকে পালন করে আসছে।

বিশ্ব মান দিবস উপলক্ষে প্রথম আলো ডটকম এবং বিএসআরএম যৌথভাবে আয়োজন করে বিশেষ টক শো: বজায় রাখছি স্ট্যান্ডার্ড, অবিরাম প্রতিবার। খন্দকার শামসউজজোহার উপস্থাপনায় অনুষ্ঠানে নির্মাণ খাতে মান রক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়।

এতে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ ইশতিয়াক আহমদ, ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. তারেক উদ্দিন এবং চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবদুর রহমান ভূইয়া।

ব্যক্তিগত আবাসনের ক্ষেত্রে নির্মাণের মান রক্ষা করা জরুরি কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে ড. সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ বলেন, ‘ব্যক্তিগত পর্যায়ে যে স্থাপনাগুলো তৈরি করা হয়, সেগুলোর মান একটা বড় প্রকল্পের মতো করেই রক্ষা করা উচিত। যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন ঝড়, ভূমিকম্পে বড় স্থাপনা যেভাবে আক্রান্ত হবে, সেভাবে ছোট স্থাপনাও আক্রান্ত হবে। সেখানে মান রক্ষা না করা হলে দেখা যাবে বড় প্রকল্পটি টিকে আছে; কিন্তু বাসাবাড়িগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’

সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ আরও বলেন, ‘ব্যক্তিগত পর্যায়ে স্থাপনার রক্ষণাবেক্ষণ হয়তো বড় প্রকল্পগুলোর মতো হয় না। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোয় মান নিশ্চিত করার জন্য সেল থাকে। এ জন্য ছোট স্থাপনার ক্ষেত্রে নির্মাণের সময়ই সব মান নিশ্চিত করে ফেলা উচিত।’

অধ্যাপক মো. তারেক উদ্দিনের সঙ্গে কথা হয় রডের গ্রেড নিয়ে। নন–গ্রেডেড এবং গ্রেডেড বারের মধ্যে পার্থক্য জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘গ্রেডেড রড বলতে বোঝায়, যেটার স্ট্যান্ডার্ড সেট করে দেওয়া হয়েছে, সেই অনুযায়ী তৈরি একটা রড। আর নন–গ্রেডেড হচ্ছে, যেটাতে মান নিশ্চিত করার কোনো দায় থাকে না। স্ক্র্যাপ গলিয়ে হয়তো রড বানিয়ে ফেলা হয়। একটা রড কীভাবে আচরণ করবে, সেটা তার মানের ওপর অনেকটাই নির্ভর করে।’

‘বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রতিটি মানুষই তার পণ্যের ক্ষেত্রে সচেতন থাকার চেষ্টা করেন। কিন্তু একজন মানুষ, যিনি ইঞ্জিনিয়ারিং বোঝেন না, তাঁর পক্ষে এটা কীভাবে সম্ভব? জাতীয় নির্মাণ কোড বা বিএনবিসি সম্বন্ধে তার কী ধরনের ধারণা থাকা দরকার?’ উপস্থাপকের এই প্রশ্নের জবাবে ড. মো. আবদুর রহমান ভূইয়া বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে একজন সাধারণ বাড়িমালিকের একটি কম্পিটেন্ট ডিজাইন এজেন্সির ওপর নির্ভরশীল থাকতে হবে। একজন ইঞ্জিনিয়ার এবং আর্কিটেক্ট সেই টিমে থাকবেন। বিএনবিসি নিয়ে তাঁদের মধ্যে সম্যক জ্ঞান থাকবে। এমন মানুষ নিয়ে যদি স্থাপনাটা ডিজাইন করা হয়, সেই ক্ষেত্রে বাড়ির মালিক আত্মবিশ্বাসী থাকবেন যে তাঁর ডিজাইনটা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হচ্ছে।’

মো. আবদুর রহমান ভূইয়া আরও বলেন, ‘দ্বিতীয় ধাপ হচ্ছে নির্মাণের ধাপ, যে ডিজাইনটা হলো, সেটা অনুযায়ী নির্মাণ সম্পন্ন হলো কি না। এ ক্ষেত্রেও মানের নিয়ন্ত্রণটা ভালোভাবে হওয়া উচিত। দক্ষ ব্যক্তিরাই এই জিনিসগুলো নিশ্চিত করবেন।’

ড. সৈয়দ ইশতিয়াক আহমদকে প্রশ্ন করা হয়, রি-বারের জন্য কোড নাকি স্ট্যান্ডার্ড—কোনটা জরুরি? উত্তরে তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন সংস্থা রড রি-বারের ক্ষেত্রে স্ট্যান্ডার্ড ঠিক করে দেয়, একটি টেকসই রড বানানোর জন্য কতটুকু কী কী থাকতে হবে, সেটা তারা ঠিক করে দেয়। কোড হচ্ছে কীভাবে পণ্যটি ব্যবহার করতে হবে, সেটার নির্দেশনা। স্ট্যান্ডার্ডটা বেশি জরুরি।’

ড. সৈয়দ ইশতিয়াক আহমদ আরও বলেন, ‘রডের মান নিশ্চিত করে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশে সংস্থা আছে। তারা ঠিক করে দেন রডের মধ্যে কোন এলিমেন্ট কী পরিমাণে থাকবে। সেটা মেনে যে রডটা তৈরি করা হয়, সেটা হচ্ছে মানসম্পন্ন রড।’

সাধারণ ক্রেতারা সেটা বুঝবেন কীভাবে? এ প্রসঙ্গে সৈয়দ ইশতিয়াক আহমদ বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে দেখতে হবে এই স্ট্যান্ডার্ডগুলো মেনে কোন কোম্পানিগুলো রড তৈরি করছে। যে কোম্পানিগুলোর ব্যাপারে আমরা জানি, তাদের পণ্যে লেখাই থাকে যে এটি স্ট্যান্ডার্ড মেনে তৈরি হয়েছে।’

অধ্যাপক ড. মো. তারেক উদ্দিনকে প্রশ্ন করা হয় নির্মাণকালে কোড বা স্ট্যান্ডার্ডের ক্ষেত্রে স্পেস, ওয়াস্ট ম্যাটেরিয়াল, রাস্টি রি-বার, রিংস, স্ট্রাপ, অ্যাঙ্গেলস, চ্যানেলস, স্কয়ার বার ইত্যাদি সম্পর্কে জানা কতটুকু প্রয়োজন?

মো. তারেক উদ্দিন বলেন, ‘অবশ্যই জানা থাকা প্রয়োজন। মরিচার কথা যদি বলি, রডের ক্ষেত্রে একটা পর্যায় পর্যন্ত মরিচা থাকে, এতে কোনো অসুবিধা নেই। এটার নির্দিষ্ট মানই আছে কত শতাংশ মরিচা থাকলেও সেই রডটি নিরাপদ। কিছু ক্ষেত্রে কংক্রিটের সঙ্গে মিশে যেতে এই মরিচা সাহায্যও করে।’

ড. মো. তারেক উদ্দিন আরও বলেন, ‘অ্যাঙ্গেল, চ্যানেল, স্কয়ার বার এগুলোরও নির্দিষ্ট স্ট্যান্ডার্ড আছে। এই স্ট্যান্ডার্ডগুলো মেনে কাজ করতে হবে।’

শামসউজজোহা এই পর্যায়ে প্রশ্ন করেন, বড় প্রকল্প নির্মাণে আন্তর্জাতিক মান অনুসরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কতটা সক্ষম? সে বিবেচনায় বিএসআরএমের সক্ষমতাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

অধ্যাপক ড. মো. তারেক উদ্দিন বলেন, ‘অবশ্যই বাংলাদেশের এই সক্ষমতা আছে। বাংলাদেশে যত বড় বড় স্থাপনা হয়েছে তার বেশির ভাগই দেশীয় উপকরণে নির্মিত হয়েছে। আমাদের দেশের পণ্যগুলো এখন ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড অনুয়ায়ী তৈরি হয়।’

অনুষ্ঠানের এই পর্যায়ে আলোচনা হয় ভূমিকম্প নিয়ে। প্রসঙ্গক্রমে উপস্থাপক প্রশ্ন করেন, ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় কি গ্রেডের রড ব্যবহার করা উচিত?

ড. মো. আবদুর রহমান ভুইয়া বলেন, ‘বাংলাদেশে সিসমিক হ্যাজার্ড অ্যানালাইসিসের মাধ্যমে চারটি জোনে আমরা পুরো বাংলাদেশকে ভাগ করেছি। এর মধ্যে সিলেট এবং চিটাগং একটু ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। সেই হিসাব করে বিএনবিসি তিন ধরনের রড ব্যবহার করার পরামর্শ দেয়—ক্যাটাগরি বি, সি ও ডি। এই ক্যাটাগরিতে বলে দেওয়া আছে, স্থাপনায় কী পরিমাণ কংক্রিট এবং রড কী ধরনের মিশ্রণে ব্যবহার করতে হবে।’

উপস্থাপক জানতে চান, সামগ্রিক নির্মাণের ক্ষেত্রে কীভাবে মান নিশ্চিত করা যেতে পারে? আর কেউ যদি খারাপ মানের রড ব্যবহার করেই ফেলেন, সে ক্ষেত্রে কী ধরনের ঝুঁকি থাকতে পারে?

উত্তরে অধ্যাপক ড. সৈয়দ ইশতিয়াক আহমদ বলেন, ‘যেকোনো সময় যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, সে ক্ষেত্রে একটা স্ট্যান্ডার্ড ম্যাটেরিয়াল খুব সুন্দরভাবে ধাক্কাটা হজম করে ফেলতে পারে। কিন্তু নন–স্ট্যান্ডার্ড ম্যাটেরিয়ালের ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো নিশ্চয়তা নেই।’

রডের গুণগত মান রক্ষার জন্য সেগুলোকে কোন পরিবেশে রাখা ভালো? এর উত্তরে ড. মো. তারেক উদ্দিন বলেন, ‘রডটাকে যখন আমরা স্টোর করব, তখন যদি একটু ড্রাই প্লেসে রাখি, তাহলে এটার হিউমিডিটি কম থাকবে। হিউমিডিটি যদি কম থাকে তাহলে এটাতে মরিচা পড়ার কোনো আশঙ্কা থাকবে না। আর রডগুলো স্তূপ করে রাখতে হবে আকার অনুযায়ী। সব একসঙ্গে না রেখে বিভিন্ন আকারের রড বিভিন্ন জায়গায় রাখা উচিত। আর যদি হালকা একটু সিমেন্ট রডের ওপর স্প্রে করে দেওয়া যায়, তাহলে এর “অ্যালকালাইটির” জন্য এতে মরিচা ধরবে না।’

নির্মাণে যথাযথ স্ট্যান্ডার্ড মেনে ম্যাটেরিয়ালস ব্যবহার হচ্ছে কি না, এ ব্যাপারটা ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজড হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিংয়ের (আইএইচবি) মাধ্যমে কীভাবে সহজে নির্ধারণ করা যায়? এ প্রসঙ্গে ড. মো. আবদুর রহমান ভূইয়া বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশে ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজড হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিংয়ের নীতিমালার চর্চা আছে। বিভিন্ন ধাপে এই প্রক্রিয়ায় মান নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এই ব্যাপারটা অনেক সহজও। এতে করে সর্বোচ্চ মান নিশ্চিত করা যায়। এটা অনুসরণ করা হলে তৃতীয় পক্ষ দ্বারা এটা নিশ্চিতও করতে হবে।’

নির্মাণের ক্ষেত্রে যথাযথ মান যাচাইয়ে দর্শকদের উদ্দেশে কিছু বলার আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে ড. মো. আবদুর রহমান ভূইয়া বলেন, ‘বিএনবিসির নীতিমালা মেনে যেন স্থাপনাটা হয়—এটা নিশ্চিত করতে হবে এবং কিছু সময় পরপর এই কোডটা রিভিউ করতে হবে। সব সময় আন্তর্জাতিক মানের উপকরণ আমাদের দেশেও যেন ব্যবহার করা হয়, সে বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে।’



Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত