নিকট অতীতে এমনটা ঘটেছে, সেটি এখন আর কেউ মনে করতে পারছেন না। যেমনটা ঘটলো শনিবার (২ নভেম্বর) সন্ধ্যায় বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের শিল্পচর্চার কেন্দ্রবিন্দু শিল্পকলা একাডেমিতে।
এদিন সন্ধ্যার পর পূর্ব সূচি মতে মঞ্চে চলছিলো দেশ নাটকের তথা বাংলাদেশ মঞ্চ ইতিহাসের অন্যতম প্রশংসিত ও জনপ্রিয় নাটক ‘নিত্যপূরাণ’-এর ১২৭তম প্রদর্শনী। এদিন অন্তত ২৫ মিনিট পার হলো নাটকটি মঞ্চায়নের। এরমধ্যে সরাসরি মঞ্চে উঠে পড়লেন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক কিংবদন্তি ড. সৈয়দ জামিল আহমেদ। তিনি বিনয়ের সঙ্গে শো বন্ধ করতে বললেন। জানান, তার অপারগতার কথা। চেয়ে নেন, ক্ষমা।
তিনি বলেন, ‘আমি অনেক চেষ্টা করেছি। এতক্ষণ যুদ্ধ করেছি। আমি লজ্জিত। ক্ষমাপ্রার্থী। এখন নাটকটি কনটিনিউ করলে উত্তেজিত জনতা এসে আগুন লাগিয়ে দেবে। তখন আরও মারাত্মক আকার ধারণ করবে।’
এভাবেই ইতিহাসের বুকে নাম উঠে গেলো পৌরাণিক গল্পে গাঁথা মাসুম রেজার অমর সৃষ্টি দেশ নাটকের ‘নিত্যপূরাণ’। অনেকে বলছেন, একই সঙ্গে সৈয়দ জামিল আহমেদের নামটিও উঠে গেলো ইতিহাসের পাতায়। দুটো পাতাই নেতিবাচক অর্থে।
এবার ইতিহাসের পাতা থেকে ফেরা যাক বর্তমানে, কেন এভাবে প্রদর্শনের মাঝে থামাতে হলো নাটকটিকে। যারা নাটকটি দেখেছেন, তারা জানেন। যারা জানেন না, তাদের জন্য বলা; এটি কোনও ধর্মীয় বা রাজনৈতিক বিষয়ের নাটক নয়। এটি মূলত পৌরাণিক প্রেমের গল্প। যার সঙ্গে রাষ্ট্রের কোনও অংশের বিরোধের সুযোগ নেই। তবুও কেন এমন ঘটনা ঘটলো?
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় দেশ নাটকের ‘নিত্যপূরাণ’ প্রদর্শনী শুরুর কিছু আগে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার ব্যানারে একদল তরুণ অবস্থান নেয় মূল ফটকে। তারা নাট্যশালায় আগতদের প্রবেশে বাধা দেয়া শুরু করেন। জানাতে থাকেন, দেশ নাটক’র অধিকর্তা এহসান আজিজ বাবু ফেসবুকে দেশবিরোধী নানা প্রচারণা ও বর্তমান সরকার প্রধানসহ অন্যান্য উপদেষ্টাদের ব্যঙ্গাত্মক কার্টুন প্রকাশ ও রাজাকার আখ্যা দিয়ে আসছেন।
মূলত এ কারণেই প্রতিবাদ জানাতে এসেছেন তারা। তারা আলটিমেটাম দেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এহসান আজিজ বাবুকে দল থেকে বহিষ্কার করে বিচারের আওতায় আনাতে হবে। পাশাপাশি শিল্পকলা একাডেমিকে এ ধরণের দলকে হল বরাদ্দ দেয়া থেকে বিরত থাকার জন্য হুঁশিয়ারি দেয়া হয়।
তাদের অব্যাহত প্রতিবাদ আর দর্শক প্রবেশে বাধা দান ও বিচারের দাবির প্রেক্ষিতে একপর্যায়ে দেশ নাটকের দল প্রধান কামাল আহমেদ প্রতিবাদকারীদের সাথে দেখা করেন। এহসান আজিজ বাবুকে ৩ দিনের মধ্যে বহিষ্কারের আশ্বাস দেন। এরপর প্রতিবাদকারীরা সাময়িকভাবে তা মেনে নিয়ে আজকের প্রদর্শনী বাতিলের দাবি জানায়। এসময় একটি প্রতিবাদী ব্যানার জাতীয় নাট্যশালার ফটকে ঝুলিয়ে দেন তারা।
এরপর প্রতিবাদকারীদের শান্ত করতে সেখানে যুক্ত হন শিল্পকলার মহাপরিচালক সৈয়দ জামিল আহমেদ। তিনি বহুভাবে চেষ্টা করেন বোঝানোর। কিন্তু চলমান প্রদর্শনী বাতিলের দাবিতে প্রতিবাদ অব্যাহত থাকে। অবশেষে সহিংসতা এড়াতে মহাপরিচালক নাটকটির প্রদর্শনী বন্ধ করতে বাধ্য হন।
এদিকে এমন ঘটনায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুমুল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। ভাইরাল হয়েছে সৈয়দ জামিল আহমেদের নতজানু ভিডিও। যেখানে তিনি বলছিলেন তার যুদ্ধের কথা। বলছিলেন আগুনের ভয়ের কথা।
দেশ নাটকের অন্যতম সদস্য নাজনীন হাসান চুমকি এই ঘটনার প্রেক্ষিতে বললেন, ‘একটি থিয়েটার, একাধিক মানুষের সমন্বয়ে থিয়েট্রিক্যাল কার্যক্রম পরিচালনা করে। অথচ, আজ যা হলো, তাতে মনে হচ্ছে থিয়েটার ব্যক্তিকেন্দ্রিক।’
প্রদর্শনীর মাঝেই নাটক বন্ধ করলেন সৈয়দ জামিল আহমেদ:
বলা দরকার, এর আগে ২০১৬ সালের জুলাই মাসে তীরন্দাজের নাটক ‘কণ্ঠনালীতে সূর্য’কে ঘিরে কাছাকাছি একটি ঘটনা ঘটেছিল। সেদিন নাটকটি মঞ্চায়ন শুরুর আগমুহূর্তে বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কারণ নাটকটি শুরুর আগে ‘সুন্দরবনের ওপর রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরূপ প্রভাব’ বিষয়ে আলোচনার কথা ছিল। কিন্তু আলোচনার বিষয়ে আগাম অনুমতি না নেওয়ায় তীরন্দাজ নাট্যদলের প্রদর্শনী বন্ধ করে দেয় শিল্পকলা একাডেমি। এ ঘটনায় নাট্যাঙ্গন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিলো তখন।