Homeদেশের গণমাধ্যমেভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে প্রতারণা, সর্বস্ব হারাচ্ছেন বিদেশ যেতে ইচ্ছুকরা

ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে প্রতারণা, সর্বস্ব হারাচ্ছেন বিদেশ যেতে ইচ্ছুকরা


দিনাজপুর সদরের আলতাফ হোসেন। অভাব-অনটন দূর করার আশায় বিদেশ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ঢাকায় আসেন আত্মীয় রেজোয়ানের বাসায়। এরপর রেজোয়ান ও আলতাফ মিলে ইরাক যাওয়ার উদ্দেশ্যে পরিবারের জমি বিক্রি করে আরএস লিংকারস নামে একটি ট্রাভেল এজেন্সির মালিক মোশারফকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা দেন। দ্রুত ভিসা দেওয়ার আশ্বাস দেন মোশারফ। মোশারফের কথায় বিশ্বাস রেখে আলতাফও পরিবারের অভাব-অনটন কাটানোর স্বপ্ন দেখেন। টাকা দেওয়ার পর মাসের পর মাস চলে যায়। মোশারফের কথায় আর আস্থা রাখতে পারেন না আলতাফ। ফিকে হয়ে যায় তার বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন।

এবার টাকা ফেরত চান আলতাফ ও রেজোয়ান। কিন্তু মোশারফ আর টাকা ফেরত দেন না।

এভাবে কেটে যায় আরও ৬ মাস। সবশেষ টাকা ফেরত না পাওয়ায় চলতি বছরের মার্চ মাসে উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি জিডি করেন আলতাফ ও রেজোয়ান। এখন পর্যন্ত টাকা উদ্ধারে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। সম্প্রতি আলতাফ ও রেজোয়ানের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।

ভুক্তভোগী আলতাফ হোসেন বলেন, ‘অনেক আশা নিয়ে বিদেশ যাওয়ার জন্য ঢাকায় এসে টাকাগুলো দিয়েছি। কিন্তু আজ আমার কেন এমন হলো। সহজে বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু সে এমন প্রতারণা করবে বুঝতে পারিনি।’

কথাগুলো বলতে গিয়ে কান্না ধরে রাখতে পারেন না আলতাফ। ‘অনেক কষ্ট করে জমি বিক্রি করে একসঙ্গে সব টাকা দিয়েছি। কিন্তু আজ আমি দুই কূলই হারিয়েছি। আমার পরিবারের এখন পথে বসার অবস্থা’, বলছিলেন তিনি।

শুধু আলতাফ-রেজোয়ানই নয়, রাজধানীতে এই ধরনের নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের প্রতারকরা বিদেশ যেতে ইচ্ছুক গ্রামাঞ্চলের সহজ-সরল লোকজনের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছে। সর্বস্ব বিক্রি করে ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় বিদেশ যেতে ইচ্ছুক ব্যক্তিরা এদের খপ্পরে পড়ে পথে বসছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে এ ধরনের প্রতারণার শিকারদের কোনও পরিসংখ্যান না থাকলেও দিন দিন এটি বেড়ে চলেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর উত্তরা, কাকরাইল ও পল্টন এলাকায় এ ধরনের অন্তত অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা বিদেশ যেতে ইচ্ছুক লোকদের সঙ্গে এমন প্রতারণা করে আসছে। গ্রামের দরিদ্র তরুণ-যুবকরা রাজধানীতে এসে এসব প্রতারকের বিরুদ্ধে কিছু করতে না পারায় বহাল তবিয়তে থাকছেন তারা।

জানা যায়, উত্তরা এলাকায় আরএস লিংক নামে প্রতিষ্ঠানের নামে বিদেশ যেতে ইচ্ছুক লোকজনের সঙ্গে প্রতারণা করে কয়েক কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন মোশারফ। বর্তমানে আত্মগোপনে রয়েছেন তিনি। প্রতিদিন লোকজন এই মোশারফের খোঁজে উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরে তার অফিসে আসতো। আর এ কারণে কিছু সন্ত্রাসী ভাড়া করে নিজের অফিস স্থানান্তর করেন মোশারফ।

একই রকম প্রতিষ্ঠানের নাম করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে জেএস ট্রাভেলস অ্যান্ড টুরস, ইস্টার্ন বিজনেস লিমিটেড নামে আরও দুটি প্রতিষ্ঠান। ইস্টার্ন নামের এই প্রতিষ্ঠানের মালিক ওয়ালিউল্লাহ মালয়েশিয়া, হংকং ও সিঙ্গাপুর পাঠানোর নাম করে বিদেশ যেতে ইচ্ছুকদের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। বর্তমানে তিনি দেশে থাকেন না। স্ত্রী, পুত্র, কন্যা নিয়ে সপরিবারের মালয়েশিয়া রয়েছেন বলে জানা গেছে।

এদিকে দিন দিন এ ধরনের প্রতারণা বেড়ে যাওয়ায় বিষয়টি নিয়ে পুলিশও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ এ ধরনের ভুয়া প্রতিষ্ঠানের তালিকা তৈরির কাজ শুরু করেছে। নামসর্বস্ব ও অনুমোদনবিহীন এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যারা প্রতারিত হয়ে থানায় জিডি দায়ের করেছেন, তাদের অভিযোগ নিয়ে কাজ শুরু করেছে গোয়েন্দা পুলিশ।

পুলিশ সূত্র জানায়, গত ৫ অক্টোবর বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর নামে অর্থ আত্মসাৎকারী প্রতারক চক্রের দুই সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। তারা হলেন আলমগীর হোসেন ও জান্নাতুল ফেরদৌস।

মতিঝিল জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার হুসাইন মুহাম্মদ ফারাবী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ভুক্তভোগী হামিদুল ইসলাম পল্টন মডেল থানায় একটি প্রতারণার মামলা করেন।’

মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়—মো. হামিদুল ইসলামের সঙ্গে ব্যবসায়িক সূত্রে পরিচয় হয় মো. আলমগীর হোসেনের। তার সঙ্গে রোমানিয়া, তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, দুবাই, কানাডা, লিথুনিয়া ও সৌদি আরবে ৩৪ জন লোক পাঠানোর কথা চূড়ান্ত হয়। একপর্যায়ে বিভিন্ন সময়ে ৫৪ লাখ ৪৭ হাজার টাকা দেন ভুক্তভোগী। টাকা নিয়ে অভিযুক্তরা ১১ জনকে সৌদি আরব পাঠালেও কথা অনুযায়ী শ্রমিকরা কাজ পায়নি। তাছাড়া ২৩ জনকে জাল ভিসা দেয়। হামিদুল ইসলাম তাদের প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরে পল্টন মডেল থানায় মামলাটি করেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা তাদের গ্রেফতার করেছি।

এ রকম প্রতারণার শিকার হলে থানায় অভিযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন পুলিশের এই কর্মকর্তা।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (ক্রাইম ও অপারেশন) রফিকুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যারা বিদেশ যাওয়া নিয়ে প্রতারিত হয়েছেন, তাদের মধ্যে যারা থানায় অভিযোগ দিয়েছেন, তাদের নিয়ে কাজ করছে পুলিশ। পাশাপাশি ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে নানা তথ্য নিয়ে প্রতারকদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। হয়তো অল্প সময়ের মধ্যেই এ ধরনের প্রতারকদের গ্রেফতার করা সম্ভব হবে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর অতিরিক্ত মহাপরিচালক শাহ্ আবদুল তারিক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কেউ যাতে বিদেশ যাওয়া নিয়ে প্রতারণার শিকার না হন, সে জন্য বিভিন্ন ধরনের সচেতনমূলক কাজ করে আসছে সরকার। গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন স্থানে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান প্রচার করা হচ্ছে। এরপরও কেউ কোনও দালালের মাধ্যমে ভুয়া প্রতিষ্ঠানে গিয়ে প্রতারণার শিকার হলে সেটি অনাকাঙ্ক্ষিত।’

তিনি আরও বলেন, ‘যেসব ভুয়া প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে লোকজন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থানায় মামলা করেছেন— সেগুলো নিয়ে তদন্ত হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।’

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিস-বায়রা’র যুগ্ম মহাসচিব ফখরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এ ধরনের ভুয়া প্রতিষ্ঠানের কারণে অনেক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আমরা এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ জানাই।’





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত