Homeদেশের গণমাধ্যমেবিয়ের প্রলোভনে শারীরিক সম্পর্ক শাস্তিযোগ্য অপরাধ: ন্যায়বিচার পরিপন্থি

বিয়ের প্রলোভনে শারীরিক সম্পর্ক শাস্তিযোগ্য অপরাধ: ন্যায়বিচার পরিপন্থি


নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের সংশোধনের খসড়া আইনের চূড়ান্ত অনুমোদন হয়েছে ২০ মার্চ। উক্ত আইনে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সংশোধন এসেছে মর্মে পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পেরেছি।
 
এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো- “বিয়ের প্রলোভনে যৌন মিলন”-কে- অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে শাস্তির জন্য আইন করা হয়েছে। যদিও অপরাধটি  প্রকৃত অর্থে “কী করলে অপরাধ হবে?”- তার ব্যাখ্যা নেই। অর্থাৎ কেউ বিয়ের কথা কথা বলে, যৌন মিলন করার সাথে সাথেই অপরাধ সংঘটিত হয়? নাকি পরবর্তীতে বিয়ের প্রতিশ্রুতি পালন না করলে অপরাধ হবে? এসব ব্যাখ্যা অনুপস্থিত। এই বিষয়ে পরিষ্কার করে আইনে বলা হয়নি।
 
একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী বিয়ের প্রলোভন দিলেই শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়বে আর এক্ষেত্রে তার পুরুষ সঙ্গীটির ৭ বছর পর্যন্ত জেল হবে। এরকম অবিবেচনামূলক বিধান কীভাবে আইন প্রণেতারা সম্মতি দিয়েছেন তা একেবারেই বোধগম্য নয়।
 
এখানে একজন নারীকে নির্বোধ, পুতুল হিসেবে বোঝানো হচ্ছে!  যিনি কোনও পুরুষের প্রলোভনে পড়ে যৌন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। অথচ এ ধরনের সম্পর্কে “Contributorry Participation” থাকে। রাষ্ট্র যদি চায় কেউ প্রণয়ের কিংবা শারীরিক সম্পর্কে না জড়ায়, তবে আইন করে প্রেম করা বন্ধ করে সবাইকে শাস্তির দেওয়ার ব্যবস্থা করুক। শুধু একপক্ষকে শাস্তি দেওয়া ন্যায়বিচার পরিপন্থি।

অনেক প্রণয়ের সম্পর্ক নারীরাও ভেঙে দেয়। একজন নারী যদি প্রণয়ের সম্পর্কে জড়িয়ে পরবর্তীতে বিয়ের প্রতিশ্রুতি ভেঙে অন্য কোনও ব্যক্তিকে বিয়ে করেন, তবে তার পুরুষ সঙ্গীটি কি পারবেন আইনের দ্বারস্থ হয়ে উক্ত নারীর বিরুদ্ধে ধর্ষণ কিংবা অন্য কোনও মামলা করতে? উত্তর হচ্ছে- ‘না’। তবে, এমন ধরনের বৈষম্যমূলক আইন কীভাবে যৌক্তিক?

২০২০ সালের জানুয়ারিতে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট নাইম আহমেদ বনাম রাষ্ট্র মামলায় একই ধরনের রায় দেন। মামলার ঘটনা হলো- আসামি নাইম আহমেদের সাথে এক বিবাহিত নারীর প্রেম ছিল। ওই নারীর স্বামী ও সন্তান ছিল। তাদের মাঝে শারীরিক সম্পর্ক হয়। একপর্যায়ে উক্ত নারী অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। আসামি নাইম ওই নারীকে বলেন সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তাকে বিয়ে করবেন। সেই নারী তার স্বামীকে তালাক দিয়ে সন্তান-সন্ততি ফেলে এসে আসামি নাইমকে বিয়ে করার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। এর মধ্যে আসামি পালিয়ে যান এবং বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানান। পরে ওই নারী তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে মর্মে দাবি করে মামলা করে দেন। দায়রা আদালত নাইমকে ১০ বছরের কারাদণ্ড, ৫ হাজার টাকা জরিমানা ও ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদানের আদেশ দেন। বোম্বে হাইকোর্টে আপিল করলে হাইকোর্ট সাজা কমিয়ে ৭ বছর করেন, কিন্তু জরিমানার অঙ্ক একই রাখেন। নাইম সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট উক্ত নারী তার নিজের দায়িত্ববোধ ও নৈতিকতা ভুলে স্বেচ্ছায় নিজ সম্মতিতে আসামি নাইমের সাথে শারীরিক সম্পর্ক করেছেন বলে রায় দিয়ে নাইমকে ধর্ষণের অভিযোগ থেকে খালাস দিয়ে দেন।

মনোয়ার হোসেন বনাম রাষ্ট্র মামলায় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট রায় দেন যে, যদি কোনও ব্যক্তি ১৬ বছরের বেশি বয়সী কোনও নারীর সঙ্গে বিয়ের প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে এবং তা পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে হয়, তাহলে তা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে না। আদালত আরও উল্লেখ করেন যে প্রতিটি মামলার পরিস্থিতি এবং সম্পর্কের প্রকৃতি অনুযায়ী বিষয়টি মূল্যায়ন করা প্রয়োজন।

বিয়ের প্রতিশ্রুতি দেওয়া বা তা রক্ষা করা একটি নৈতিক এবং সামাজিক বিষয় হতে পারে, কিন্তু তা আইনগতভাবে অপরাধ হিসাবে বিবেচনা করে শুধুমাত্র প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করার কারণে তা অপরাধ হিসাবে গণ্য করা কোনোভাবেই ন্যায়সঙ্গত নয়। সম্পর্কের টানাপোড়েন, ব্যক্তিগত মতপার্থক্য বা পরিস্থিতির পরিবর্তনের কারণে বিয়ের প্রতিশ্রুতি পূরণ না করাকে অপরাধ হিসাবে গণ্য করা অযৌক্তিক এবং অসাংবিধানিক।

এই আইন পাস হলে সমাজে ব্ল্যাকমেইলিং বেড়ে যাবে। সমাজে হানাহানি বাড়বে। বিয়ের প্রলোভনে শারীরিক সম্পর্ক একের অধিকবার হয় বা বারবার হয়। ফলে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী যখন ইচ্ছা তখন মামলা করতে পারবেন। এমনকি, প্রেম বিচ্ছেদের ১০ বছর পরেও তিনি মামলা করতে পারবেন।
 
পুরুষ শোষণের হাতিয়ার হবে এই আইন। দেখা যাচ্ছে, এই আইনের ফলে অফিসের নারী সহকর্মী তার বসের বিরুদ্ধে, নারী ক্লায়েন্ট তার আইনজীবীর বিরুদ্ধে, ছাত্রী তার শিক্ষকের বিরুদ্ধে, অর্থাৎ যেকোনও নারী এই আইনকে ব্যবহার করে আদালতে বা থানায় নারী নির্যাতনের মামলা করতে পারবে। অনেক নারী এই আইনকে টাকা আয়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবেন। কারণ নারীর পরিচয় প্রকাশ করা যাবে না, প্রকাশ হবে আসামির পরিচয়। ফলে, দুষ্কৃতকারীরা আড়ালে থেকে এই মামলাকে তার উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ব্যবহার করতে পারবে। ফলে, থানায় থানায় চলতে পারে মামলা বাণিজ্য। যে কারও প্রাক্তন তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়ে আসবে। এভাবে পুরুষ প্রজন্ম ব্ল‍্যাকমেইলের শিকার হবে, যা তাদের আরও প্রতিশোধপরায়ণ করবে এবং নারী বিদ্বেষী করবে, যা একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থার অন্তরায়।
 
উপরন্তু, নারী নির্যাতনের মামলা হু হু করে বাড়বে। ২০২৫ সালে এসে, এই ধরনের আইন নাগরিক অধিকার পরিপন্থি এবং অসাংবিধানিক।

লেখক: সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত