তিন বছর আগে ২৪ মার্চ মতিঝিল এজিবি কলোনি এলাকার একটি রেস্তোরাঁ থেকে মাইক্রোবাসে করে বাড়ি ফিরছিলেন মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপু (৫৫)। শাহজাহানপুরে ট্রাফিক সিগন্যালে আটকে থাকা অবস্থায় হামলাকারীরা মোটরসাইকেলে করে ঘটনাস্থলে এসে গাড়িতে থাকা টিপু ও তার সঙ্গীদের ওপর এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। এতে টিপু ও পাশের রিকশাযাত্রী কলেজছাত্রী সামিয়া আফরান জামাল প্রীতি (২২) গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। এছাড়া টিপুর গাড়িচালক মুন্না গুলিবিদ্ধ হন। আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ৩৩ জন নেতাকর্মীর নাম তদন্তে উঠে আসে। মামলার প্রধান আসামি সুমন শিকদার ওরফে মুসা ও মাসুম মোহাম্মদ আকাশসহ ৪ জন এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এরপর ২০২৩ সালের ৫ জুন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. ইয়াসিন সিকদার আদালতে চার্জশিট জমা দেন। প্রায় এক বছর পর ২০২৪ সালের ২৯ এপ্রিল মামলার চার্জ গঠন করে আদালত। পরে ওই বছরের ২১ মে থেকে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। ৯ মাস পর এখনও সেই বাদীর সাক্ষ্যে আটকে আছে মামলাটি। আদালতে সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর জানিয়েছেন, বাদীর সাক্ষ্য শেষ না হওয়ায় মামলার কাজ এগোচ্ছে না।
জানা গেছে, এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে এ পর্যন্ত ২৫ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এর মধ্যে ৩ আসামি বিভিন্ন সময় হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন। এ মামলায় গত বছরের ২০ জুন মামলার বাদী ফারহানা ইসলাম ডলি সাক্ষ্য দেন। ওই দিন আদালত জেরার জন্য ১৮ জুলাই দিন ধার্য করেন। তবে পরবর্তী সময়ে এ মামলায় কোনও সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি। বর্তমানে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৩-এ মামলাটি বিচারাধীন। সর্বশেষ গত ১৩ মার্চ এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য ছিল। তবে সাক্ষ্য দিতে কেউ আদালতে হাজির হননি। এ জন্য রাষ্ট্রপক্ষ সময় চেয়ে আবেদন করে। পরে আদালত আগামী ১৫ এপ্রিল সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য নতুন দিন ধার্য করেন।
এ মামলার আসামিরা হলেন—আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহম্মেদ মন্টু, ফ্রিডম মানিক ওরফে জাফর, প্রধান সমন্বয়কারী সুমন সিকদার মুসা, শুটার মাসুম মোহাম্মদ আকাশ, শামীম হোসাইন, তৌফিক হাসান ওরফে বিডি বাবু, ১০ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি মারুফ রেজা সাগর, ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক আরিফুর রহমান ওরফে ‘ঘাতক’ সোহেল, মতিঝিল থানা জাতীয় পার্টির নেতা জুবের আলম খান রবিন, হাফিজুল ইসলাম হাফিজ, হাবীবুল্লাহ বাহার কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক সোহেল শাহরিয়ার, মাহবুবুর রহমান টিটু, নাসির উদ্দিন মানিক, মশিউর রহমান ইকরাম, ইয়াসির আরাফাত সৈকত, আবুল হোসেন মোহাম্মদ আরফান উল্লাহ ইমাম খান, সেকান্দার শিকদার আকাশ, মতিঝিল থানা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক খাইরুল ইসলাম মাতবর, আবু সালেহ শিকদার, কিলার নাসির, ওমর ফারুক, মোহাম্মদ মারুফ খান, ইশতিয়াক আহম্মেদ জিতু, ইমরান হোসেন জিতু, রাকিবুর রহমান রাকিব, মোরশেদুল আলম পলাশ, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আশরাফ তালুকদার, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মারুফ আহমেদ মনসুর, রিফাত হোসেন, সোহেল রানা, ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক নেতা আমিনুল, সামসুল হায়দার উচ্ছল ও ১১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সভাপতি কামরুজ্জামান বাবুল।
মামলার সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালের ২৪ মার্চ রাত সোয়া ১০টার দিকে মতিঝিল এজিবি কলোনি এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপুকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ সময় গাড়ির পাশে রিকশায় থাকা সামিয়া আফরান প্রীতি (১৯) নামে এক কলেজছাত্রীও নিহত হন। এ ছাড়া টিপুর গাড়িচালক মুন্না গুলিবিদ্ধ হন। ওই দিন রাতেই শাহজাহানপুর থানায় নিহত টিপুর স্ত্রী ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সংরক্ষিত কাউন্সিলর ফারহানা ইসলাম ডলি বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেন। এতে অজ্ঞাতদের আসামি করা হয়।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, আইডিয়াল স্কুলে ভর্তি, এলাকায় আধিপত্য ও মতিঝিল এলাকার চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিরোধের জেরে হত্যা করা হয় টিপুকে।
আদালতে হাজির না হওয়ার ব্যাপারে বাদী ফারহানা ইসলাম ডলির সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
বাদী ফারহানা ইসলাম ডলির আইনজীবী গাজী জিল্লুর রহমান বলেন, পটপরিবর্তনের পর তিনি নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন। যে কারণে তিনি আদালতে এসে সাক্ষ্য দিতে ভয় পাচ্ছেন। এই সুযোগে আসামিরা জামিনে বের যাচ্ছে। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তিনি আদালতে এসে সাক্ষ্য দেবেন। আমরা ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করছি।
রাষ্ট্র পক্ষের বিশেষ জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর নিজাম উদ্দিন মাহমুদ বলেন, এ মামলার বাদীর সঙ্গে আমরা যোগাযোগের অনেক চেষ্টা করছি। কিন্তু ওনাকে কোনোভাবেই রিচ করতে পারছি না। কোনও নম্বরে কলও যাচ্ছে না। মামলায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাদীর সাক্ষ্য। বাদীর সাক্ষ্য পেলে অন্যদের সাক্ষ্য নেওয়া সহজ হয়। বাদীর নিরাপত্তার বিষয়ে তিনি বলেন, আদালত বাদীর নিরাপত্তা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। নিরাপত্তাহীনতার কোনও শঙ্কা দেখি না।