Homeদেশের গণমাধ্যমেবাংলাদেশে অরাজনৈতিক সংবিধান-সংস্কারের উদ্যোগ: একটি নৈর্ব্যক্তিক পর্যালোচনা

বাংলাদেশে অরাজনৈতিক সংবিধান-সংস্কারের উদ্যোগ: একটি নৈর্ব্যক্তিক পর্যালোচনা


৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে, সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটা পদ্ধতির বিরুদ্ধে ব্যাপক ছাত্র বিক্ষোভের মুখে, যেটি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামে পরিচিত, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগ করেন। এ ঘটনার অব্যবহিত পরেই সংসদ ভেঙে দেওয়া হয় এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার শপথ গ্রহণ করে। তার পরপরই, বিভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট গোষ্ঠী সংবিধান সংস্কারের জন্য আহ্বান জানায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ০৬ অক্টোবর ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার একটি নয় সদস্যবিশিষ্ট সংবিধান সংস্কার কমিশন নিয়োগ দেয়। ইতোমধ্যে, রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন ১৯ অক্টোবর তারিখে প্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকারে জানান, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার পদত্যাগের কোনও দালিলিক প্রমাণ তার কাছে নেই। এর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ তাকে অবিলম্বে অপসারণের পাশাপাশি বর্তমান সংবিধান বাতিলের দাবি জানায়। অতঃপর, ৩১ অক্টোবর ২০২৪ ও ০৩ নভেম্বর ২০২৪ তারিখে সংবিধান সংস্কার কমিশন যথাক্রমে তার কর্মপরিধি ও কার্যপদ্ধতি প্রকাশ করে। এসব দলিল থেকে জানা যায়, কমিশন সংবিধান পুনর্লিখনসহ সব প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রদান করবে। গত ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে সংবিধান সংস্কার কমিশন সরকারের কাছে তাদের সংস্কারের সুপারিশ সংবলিত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

উপরোক্ত প্রেক্ষাপটে, বর্তমান প্রবন্ধে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে সংবিধান সংস্কারের উদ্যোগের ক্ষেত্রে অরাজনৈতিক মডেল অনুসরণ করার বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে, যদিও সাংবিধানিক আইন বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে গণপরিষদ বা অন্যান্য অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জনগণ তথা রাজনৈতিক অংশীজনদের অংশগ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। এ প্রবন্ধের মূল বক্তব্য হলো, সমসাময়িক সংবিধান সংস্কারের দাবি মূলত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামে পরিচিত একটি অরাজনৈতিক আন্দোলন থেকে উদ্ভূত, এবং সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক অংশীজনদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অধিকন্তু, এখন পর্যন্ত অভীষ্ট সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য কোনও নিবেদিত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের অনুপস্থিতি এই উদ্যোগের সম্ভবপরতা নিয়ে প্রশ্নের উদ্রেক ঘটায়। পাকিস্তান আমলে (১৯৬০-১৯৬২) আইয়ুব খানের সংবিধান-প্রণয়ন প্রকল্প এবং সাম্প্রতিক সময়ে চিলি, দক্ষিণ সুদান, আইসল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, আয়ারল্যান্ড এবং ইরাকের সংবিধান-প্রণয়ন সম্পর্কিত উদ্যোগ থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতার আলোকে, বর্তমান প্রবন্ধের উপসংহার হলো, আলোচ্য সংবিধান-সংস্কার উদ্যোগ অনেকটাই যেন গবেষণাগারে বিশেষজ্ঞ-নিয়ন্ত্রিত প্রক্রিয়ায় সংবিধান প্রণয়নের সঙ্গে তুলনীয়। এ প্রবন্ধে বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে ‘সংবিধান সংস্কার’ অভিব্যক্তি দ্বারা ‘সংবিধান সংশোধন’ বা ‘সংবিধান পুনর্লিখন’ অথবা উভয়টিকেই বোঝানো হয়েছে।

একটি অরাজনৈতিক প্রারম্ভ
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল হাইকোর্টের ৫ জুন ২০২৪ তারিখের একটি রায়ের প্রতিবাদে অরাজনৈতিক ছাত্র আন্দোলন হিসেবে। উক্ত রায়ের ফলে সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান বৈষম্যমূলক কোটা ব্যবস্থা, যা ২০১৮ সালের একটি নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে বাতিল করা হয়েছিল, পুনরায় কার্যকর করা হয়। শুরুতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একমাত্র দাবি ছিল কোটা বাতিলের সার্কুলার পুনর্বহাল করা। তবে আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে, যথা ০৭, ১৯, ২০ এবং ২১ জুলাই তারিখে আরও বেশ কিছু অতিরিক্ত দাবি উত্থাপন করা হলেও সংবিধান সংস্কার বা পুনর্লিখনের কোনও দাবি জানানো হয়নি। অবশেষে বিগত ৩ আগস্ট তারিখে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে শেখ হাসিনা এবং তার মন্ত্রিসভার পদত্যাগের পাশাপাশি ফ্যাসিবাদ নির্মূলের আহ্বান জানিয়ে এক দফা দাবি ঘোষণা করা হয়।
লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, জুলাই থেকে ৫ আগস্ট সময় পর্যন্ত, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে সংবিধান সংস্কার বা পুনর্লিখনের কোনও ধরনের দাবি বা প্রত্যাশা ব্যক্ত করা হয়নি। বিশেষ করে, এ আন্দোলনের মতাদর্শগত ক্রমবিকাশ (যা মূলত আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন দাবির মধ্য দিয়ে পরিস্ফুট হয়েছে) পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে সংবিধান সংস্কার বিষয়ক কোনও দাবি ৫ আগস্টের পূর্বে উত্থাপিত হয়নি। বরং, নাহিদ ইসলাম, যিনি আন্দোলনের একজন অন্যতম শীর্ষ সমন্বয়ক ছিলেন এবং বর্তমানে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, তিনি ৭ জুলাই ২০২৪ তারিখে কোটা সংস্কারের দাবির পক্ষে সংবিধানের দোহাই দিয়েছিলেন। এসব কিছু থেকে যে ইঙ্গিত পাওয়া যায় তা হলো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল সরকারি চাকরিতে নিয়োগ লাভের সুযোগের ক্ষেত্রে সংবিধানে বর্ণিত বৈষম্যবিরোধী বিধানের প্রয়োগ নিশ্চিত করা।
 
৫ আগস্টের পরবর্তী সময়ে সংবিধান সংস্কার বিষয়ক বিতর্ক প্রথমবারের মতো পরিলক্ষিত হয় সেপ্টেম্বরের শুরুতে, যখন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযম আত্মজ আবদুল্লাহিল আমান আজমী সংবিধান ও জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের আহ্বান জানান। উক্ত প্রস্তাবের বিপক্ষে ব্যাপক জন-প্রতিক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল জানান, জাতীয় সংগীত সম্পর্কে জনাব আজমীর বক্তব্য একান্তই তার ব্যক্তিগত মতামত এবং এর সঙ্গে তার দলের কোনও সম্পর্ক নেই। এ ঘটনার বেশ কিছু দিন পরে, অর্থাৎ শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির প্রায় তিন মাস পর, নভেম্বরের শুরুতে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক শীর্ষ সমন্বয়ক মাহফুজ আলম বলেন, ১৯৭২ সালের সংবিধান অব্যাহত রাখার প্রশ্নটি এক দফা ঘোষণার দিনই বাতিল হয়েছে। কারণ, সেখানে বলা হয়েছিল, ‘পুরোনো রাজনৈতিক বন্দোবস্ত আমরা খারিজ করছি, নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত চাই।’ তিনি আরও বলেন, নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত মানেই নতুন সংবিধান।

এমতাবস্থায়, ৫ আগস্টের পূর্বাপর ঘটনাবলি একত্রে বিবেচনা করা হলে প্রাথমিকভাবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে উদ্ভূত সংবিধান সংস্কারের দাবিটি অনেকটাই তাত্ত্বিক বা নীতিপ্রসূত বলে প্রতীয়মান হয়। এটা অনস্বীকার্য যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা, সরকার গঠন অথবা সংবিধানের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যেকোনও ধরনের সংস্কারের জন্য জনমত গঠন করার ক্ষেত্রে তা প্রথমে সমাজের কাছে স্পষ্টভাবে পৌঁছানো দরকার। রাজনীতি, সরকার ব্যবস্থা বা সংবিধানের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কার্যকর ও টেকসই সংস্কারের লক্ষ্যে জনসমর্থন সংগঠিত করতে হলে বিষয়টি সর্বপ্রথমে স্পষ্টভাবে জনগণকে অবহিত করা প্রয়োজন। কারণ, যেকোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অর্জনের সম্ভবপরতা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে ঐকমত্য ও সমঝোতা গড়ে তোলার ওপর নির্ভর করে– যার ভিত্তি হলো জনসমর্থন। অথচ সংবিধান সংস্কারের প্রসঙ্গটি উত্থাপনের পূর্বে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জনমত যাচাইয়ের কোনও উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ নেয়নি, এবং রাজনৈতিক দল কিংবা অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা বা মতবিনিময়ের মাধ্যমে জনসমর্থন অর্জনের জন্যও কোনও ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। খুব সম্ভবত, এ কারণেই সংবিধান সংস্কারের পদ্ধতি ও বিষয়বস্তু নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখন পর্যন্ত কোনও দৃঢ় ও অভিন্ন ঐকমত্য গড়ে ওঠেনি।

সংবিধান সংস্কারের প্রশ্নে বাংলাদেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো, যেমন- বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী (জামায়াত-ই-ইসলাম) এবং অন্যান্য দলসমূহ, যেমন- বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি (আরডব্লিউপিবি), বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, গণ অধিকার পরিষদ ইত্যাদির মধ্যে মতপার্থক্য স্পষ্টভাবে লক্ষণীয়। উদাহরণস্বরূপ, বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী সংবিধান পুনর্লিখনের ধারণা সম্পূর্ণভাবে বিরোধিতা করেছে। অন্যদিকে, বিএনপি এবং আরডব্লিউপিবি মনে করে, শুধুমাত্র নির্বাচিত সংসদই সংবিধান সংশোধন করার এখতিয়ার রাখে এবং সংবিধান সংস্কার কমিশনের দায়িত্ব শুধু সম্ভাব্য সংস্কারের বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করা। বিএনপি ও আরডব্লিউপিবি ব্যতীত অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর অভিমত হলো, ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার শুধু প্রয়োজনীয় কিছু সাংবিধানিক সংশোধনীর উদ্যোগ নিতে পারে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের এখতিয়ার প্রসঙ্গে আরেক উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টি এখন পর্যন্ত তাদের অবস্থান আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি (যদিও তারা কিছু সংস্কার প্রস্তাব কমিশনে জমা দিয়েছে)। উল্লেখ্য, শুধু দুটি রাজনৈতিক দল, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ এবং এবি পার্টি স্পষ্টভাবে সংবিধান পুনর্লিখনের আহ্বান জানিয়েছে।

বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়া এবং বর্তমান সংবিধান সংস্কারের প্রচেষ্টার মধ্যে তুলনা করলে জনমত গঠনের ক্ষেত্রে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। ১৯৬৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) জন্য পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে দাবি জানিয়ে আওয়ামী লীগের ছয় দফা কর্মসূচি ব্যাপক জনসমর্থন অর্জন করে এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তাদের নিরঙ্কুশ বিজয়ের ভিত্তি তৈরি করে।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কৃষক, শ্রমিক ও ছাত্রসহ আপামর জনসাধারণের অংশগ্রহণ এই সমর্থনকে আরও দৃঢ় ভিত্তি দিয়েছিল। ফলশ্রুতিতে, ১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে যখন সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়, তখন মৌলিক বিষয়গুলোতে ইতোমধ্যে বিস্তৃত জনমত গড়ে উঠেছিল।

বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, দক্ষিণ আফ্রিকার ১৯৯৬ সালের সংবিধানের সাফল্যের পেছনে সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় ব্যাপক জনমত সম্পৃক্ততাকে প্রায়ই একটি প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পক্ষান্তরে, ২০১৫-২০১৭ সময়কালে চিলির সংবিধান প্রণয়ন বিষয়ক প্রচেষ্টার ব্যর্থতার কারণ হিসেবে অনেক বিশেষজ্ঞ প্রণয়ন প্রক্রিয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণের অভাবকে অন্যতম বলে মনে করেন।
 
কমিশনের সুপারিশ প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক অংশীজনদের অনুপস্থিতি

বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি সংবিধান যুগপৎ রাজনৈতিক চুক্তি এবং আইনি বিধি-বিধানের সমষ্টি বিধায় এর পক্ষে যত বেশি সম্ভব রাজনৈতিক সমর্থন থাকা উচিত। আর এজন্য প্রয়োজন অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং দক্ষ খসড়া প্রণয়ন প্রক্রিয়া। অথচ, বর্তমান সংবিধান সংস্কারের উদ্যোগের দিকে তাকালে দেখা যাবে, সংবিধান সংস্কার কমিশন যে কার্যপদ্ধতি গ্রহণ করেছে তাতে পূর্বোক্ত জনমত যাচাইয়ের অভাবের কোনও প্রতিবিধান করা হয়নি। তদুপরি, সামাজিক ও রাজনৈতিক অংশীজনদের অন্তর্ভুক্তিহীনতা এবং কর্মসম্পাদনের সংক্ষিপ্ত সময়সীমা উক্ত কমিশনের গঠন ও কার্যপদ্ধতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের কর্মপরিধি নিরীক্ষা করলে এ পর্যবেক্ষণটির সারবত্তা প্রমাণিত হবে।
 
লক্ষণীয়, ৩১ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সংবিধান সংস্কার কমিশনের কর্মপরিধি অনুসারে বর্তমান সংবিধান পর্যালোচনাসহ জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনের লক্ষ্যে সংবিধানের সামগ্রিক সংশোধন, সংযোজন, বিয়োজন, পরিমার্জন, পুনর্বিন্যাস এবং পুনর্লিখন সংস্কারের অন্তর্ভুক্ত হবে। পরবর্তীতে, ৩ নভেম্বর ২০২৪ তারিখে, সংবিধান সংস্কার কমিশন তার কার্যপদ্ধতি উল্লেখ করে একটি প্রেস ব্রিফিং নোট প্রকাশ করে, যেখানে উল্লেখ করা হয়, কমিশন সংবিধান সংস্কার প্রসঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে লিখিত মতামত এবং প্রস্তাবনা আহ্বান করবে, তবে সরাসরি তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হবে না।

এছাড়া, তারা সংবিধান বিশেষজ্ঞ, আইনবিদ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, পেশাদার সংস্থার সদস্য, তরুণ বুদ্ধিজীবী এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধিদের কাছ থেকেও সংস্কার প্রস্তাব আহ্বান করেছে। ২৫ নভেম্বর ২০২৪ তারিখে সংবিধান সংস্কার কমিশন জানিয়েছে যে সংবিধান সংস্কার বিষয়ে তারা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ৪৭,০৯৭টি মতামত পেয়েছে এবং এ বিষয়ে ২৮টি সংস্থা, ২৩ জন সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, ৫ জন সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং ১০ জন তরুণ চিন্তাবিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছে। কিন্তু প্রাপ্ত সংস্কার প্রস্তাব যাচাই-বাছাই ও গ্রহণের ক্ষেত্রে কমিশন কী নীতি-পদ্ধতি অনুসরণ করেছে তা স্পষ্ট করা হয়নি। অর্থাৎ, অংশীজনদের মতামত গ্রহণ ও সুপারিশ প্রস্তুতের পুরো প্রক্রিয়ায় কমিশন একমুখী নীতি অনুসরণ করেছে।

প্রসঙ্গত, পাকিস্তানের ১৯৬২ সালের সংবিধান-প্রণয়নের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের সমসাময়িক সংবিধান-সংস্কারের পরিপ্রেক্ষিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ নজির হিসেবে পরিগণিত হতে পারে- যা প্রমাণ করে যে সংবিধান-প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর সরাসরি অংশগ্রহণ না করা কীভাবে সংবিধানের কার্যকারিতা এবং স্থায়িত্বের হানি ঘটায়। স্মর্তব্য, ১৯৫৮ সালে জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা পাকিস্তানের ১৯৫৬ সালের সংবিধান বাতিল করে সামরিক আইন জারি করেন এবং রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করে দেশের সব রাজনৈতিক দল ভেঙে দেন। কিন্তু তিন সপ্তাহের মধ্যেই জেনারেল আইয়ুব খান ইস্কান্দার মির্জাকে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজে রাষ্ট্রপতির পদ দখল করেন।

উল্লেখ্য, রাজনীতি, রাজনীতিবিদ, রাজনৈতিক দল এবং এমনকি জনমতের প্রতি আইয়ুব খানের আস্থাহীনতা বেশ সুবিদিত ছিল। রাজনৈতিক দল গঠনসহ সকল প্রকার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকাকালীন তিনি ১৯৬০ সালে নতুন সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের উদ্দেশ্যে এগারো সদস্যের একটি সংবিধান কমিশন গঠন করেন। ১৯৬২ সালের ১ মার্চ তারিখে পাকিস্তানে একটি নতুন সংবিধান জারি করা হয়। খসড়া সংবিধানের ওপর গণভোট গ্রহণের প্রাথমিক প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান শেষ পর্যন্ত তা পালন না করে স্বীয় ক্ষমতাবলে সংবিধানটি কার্যকর করেন।

আইয়ুব খানের একক কর্তৃত্ববলে জারিকৃত পাকিস্তানের ১৯৬২ সালের সংবিধান জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে ব্যর্থ হয়। এর ফলস্বরূপ, সমাজে ক্রমান্বয়ে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়, বিশেষ করে পূর্ব-পাকিস্তানে ব্যাপক রাজনৈতিক আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। সুতরাং, ১৯৬৯ সালে গণআন্দোলনের মুখে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে আইয়ুব খানের পদত্যাগের পর পাকিস্তানের ১৯৬২ সালের সংবিধান পরিত্যক্ত হওয়া কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা ছিল না। আইয়ুব খানের সংবিধান-প্রণয়ন প্রকল্পটি জনমতের তোয়াক্কা না করে এবং কোও প্রকার অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়া ছাড়াই সম্পন্ন হয়েছিল, যার ফলে একটি ব্যর্থ সংবিধানের জন্ম হয়। এক অর্থে এই ব্যর্থতা থেকে উদ্ভূত রাজনৈতিক সংকটই ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পতন ও পূর্ব-পাকিস্তানের স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে অভ্যুদয়ের কারণ হয়ে ওঠে।

অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক সময়ে চিলির সংবিধান-প্রণয়ন প্রক্রিয়া (২০১৫-২০১৭ এবং ২০১৯-২০২২) আইয়ুব খানের মডেলের তুলনায় অনেক বেশি জনপ্রতিনিধিত্বশীল হওয়া সত্ত্বেও খসড়া প্রণয়ন পর্যায়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যাপক অংশগ্রহণ না থাকার কারণে ব্যর্থ হয়েছিল। আইসল্যান্ডে ২০১০-২০১৩ সময়কালে সংবিধান-প্রণয়ন প্রচেষ্টার পরিণতি হলো এরকম আরেকটি জাজ্বল্য উদাহরণ, যা থেকে অনুধাবন করা যায়, সংবিধান-প্রণয়ন প্রক্রিয়া মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণের অভাবে কীভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে।

সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য নিবেদিত রাজনৈতিক দলের অনুপস্থিতি

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রস্তাবিত সাংবিধানিক সংস্কারের উদ্যোগ যে দেশের আইনি ও রাজনৈতিক কাঠামোতে মৌলিক পরিবর্তনের ইঙ্গিতবাহী, এতে কোনও সন্দেহ নেই। বৃহৎ কোনও রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা অর্জন অথবা টেকসই আর্থ-সামাজিক-আইনি সংস্কারের জন্য এর পেছনের সহায়ক শক্তিকে স্বীকৃত রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে সংগঠিত হতে হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেনি। বর্তমান পরিস্থিতিতে, যখন সংসদ কার্যকর নেই, তখন প্রস্তাবিত সাংবিধানিক সংস্কার চূড়ান্তভাবে গ্রহণের জন্য গণভোটের প্রয়োজন হতে পারে। এমতাবস্থায় সংবিধান সংস্কার প্রসঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর মতপার্থক্য বিবেচনা করলে সংস্কারের পক্ষে নিবেদিত রাজনৈতিক শক্তির গুরুত্ব সহজেই উপলব্ধি করা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, রাজনৈতিক মতানৈক্যের কারণে ১৯৪৬ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত গণভোটে ফ্রান্সের তদানীন্তন গণপরিষদ কর্তৃক অনুমোদিত খসড়া সংবিধানের প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ঘটনাটি উল্লেখ করা যেতে পারে। বলা হয়ে থাকে, এ কারণে তৎকালীন ফ্রান্সে নবগঠিত চতুর্থ প্রজাতন্ত্রের মেয়াদ স্বল্পস্থায়ী হয়েছিল।
 
উল্লেখ্য, সংবিধান সংস্কারের জন্য সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি থেকে ব্যাপক সমর্থন যেমন অপরিহার্য, তেমনি তা গৃহীত হওয়ার পর বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা অপরিসীম গুরুত্ব বহন করে। যদি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন একটি শক্তিশালী ও স্বীকৃত রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে সংগঠিত না হয়, তাহলে প্রস্তাবিত কোনও সাংবিধানিক সংস্কার সাময়িকভাবে গৃহীত হলেও শেষ পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত না হওয়ার ঝুঁকি থেকেই যাবে, কারণ ভবিষ্যতে যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন হবে তারা সেগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নাও নিতে পারে। ওপরের মন্তব্যটি নিছক কোনও অনুমান নয়, বরং এর বাস্তব তাৎপর্য বিদ্যমান। যেমন, স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরে গৃহীত দক্ষিণ সুদানের অন্তর্বর্তী সংবিধানে দেশটির যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর শাসন ব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি থাকলেও তা বাস্তবায়ন তদারকি করার জন্য কোনও শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান না থাকায় উক্ত প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন ব্যাহত হয়, যা কিনা দেশটিতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও সংঘাতকে বাড়িয়ে তোলে। আয়ারল্যান্ডে সংবিধান সংশোধন সম্পর্কিত সাংবিধানিক কনভেনশন (২০১২) ও সিটিজেনস অ্যাসেম্বলির (২০১৬) অধিকাংশ সুপারিশ বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণগুলো দলীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বলে মনে করা হয়।
 
একইভাবে, ইরাকের গোষ্ঠীগত ও ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে রাজনৈতিক অসহযোগিতা সে দেশের ২০০৫ সালের সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ বিধানগুলো বাস্তবায়নের পথে গুরুতর বাধা সৃষ্টি করেছে।
 
উপসংহার
 
বলা হয়ে থাকে একটি সংবিধানে রাষ্ট্র-পরিচালনা সম্পর্কিত বিষয়ে সমাজের সকল শ্রেণি কর্তৃক সমর্থিত মৌলিক সমঝোতার প্রতিফলন থাকা উচিত। বিভিন্ন দেশের সংবিধান প্রণয়ন বা সংস্কারের সাম্প্রতিক উদাহরণগুলো লক্ষ করলে টেকসই সাংবিধানিক সংস্কারের পেছনে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং রাজনৈতিক মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটায় এমন অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতির ভূমিকা থাকার বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়। অপরদিকে, বাংলাদেশের অনুসৃত অরাজনৈতিক সংবিধান সংস্কারের মডেল তুলনামূলক সাংবিধানিক আইনের পরিপ্রেক্ষিত থেকে ‘সচরাচর দেখা যায় না’ এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেয়।
 
আশ্চর্যের বিষয় হলো, এটা এমন একটি পশ্চাৎপদ প্রবণতার প্রতিফলন যা আইয়ুব খানের ১৯৬২ সালের সংবিধান-প্রণয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়ই সমালোচিত হয়েছিল—যা ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের নিজস্ব সংবিধান প্রণয়নের অভিজ্ঞতা এবং আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে অনুসৃত অংশগ্রহণমূলক সংবিধান প্রণয়ন বা সংস্কারের প্রক্রিয়া থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
 
উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালের সংবিধান একটি নির্বাচিত গণপরিষদ দ্বারা প্রণীত হয়েছিল যার ভিত্তি জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন। পক্ষান্তরে, বর্তমান সংবিধান সংস্কার কমিশনের কার্যপদ্ধতি ও কর্মপরিধি ঔপনিবেশিক আমলের আইন সংস্কার কমিশনগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়, যেমন সাইমন কমিশন, যার প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তীতে বহুল সমালোচিত ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন প্রণীত হয়েছিল।
 
পরিশেষে, রাজনৈতিক অংশীজনদের মধ্যে সংস্কার-পূর্ব মতৈক্যের অভাব এবং কমিশনের কার্যপদ্ধতিতে তাদের সক্রিয় ও ব্যাপক অংশগ্রহণের সুযোগ না থাকায় বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধান-সংস্কার উদ্যোগ গবেষণাগারের অভ্যন্তরে বিশেষজ্ঞ-নিয়ন্ত্রিত নির্মাণ প্রক্রিয়ার কথা মনে করিয়ে দেয়। ফলে, এ উদ্যোগের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এখন পর্যন্ত খুব সুনিশ্চিত নয় বলেই মনে হয়।
 
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত