বহু বছর পর আমাদের সামনে একটা সুযোগ এসেছে বাংলাদেশে “ট্রমার রাজনীতির” দুষ্ট চক্র বন্ধ করার। গত ৫৩ বছরে আমাদের দেশে কোনও সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। যা তৈরি হয়েছে, তা হলো ট্রমার সংস্কৃতি। ট্রমার সংস্কৃতি বলছি কারণ, এক দল জুলুম করে আরেক দল মজলুম হয়। যে দল ক্ষমতায় যায় সে জুলুম করে। আর ক্ষমতার বাইরে থাকা দলকে অত্যাচার ও বৈষম্যের জীবন কাটাতে বাধ্য করা হয়, যা মানুষের মনে ঘৃণা ও প্রতিশোধের জন্ম দেয়। শেষমেশ, যখন মজলুম জালিমকে সরিয়ে ক্ষমতায় আসে, তখন ক্ষমার পরিবর্তে ঘৃণা ও প্রতিশোধই প্রধান হয়ে দাঁড়ায়।
জালিম তখন নতুন করে মজলুম হয়, আর পুরনো মজলুম হয়ে ওঠে নতুন জালিম। যেই জালিম হয়, সেই দেশ শাসন করে রক্ষা করতে নয়, বরং পুরনো ট্রমা পুনরুৎপাদন করতে। এই ট্রমার পুনরুৎপাদন বছরের পর বছর চলে আসছে। নেতা বদলায়, কিন্তু ট্রমা আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়ে যাই। তৈরি হয় ট্রমার সংস্কৃতি ও রাজনীতি।
গত ৫৩ বছরে বাংলাদেশকে ৫ জন মানুষ দোর্দণ্ড প্রতাপে শাসন করেছেন। শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা। এদের মধ্যে দুই জন (মুজিব ও জিয়া) নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। বাকি তিন জনের মধ্যে দুই জন ক্ষমতা ছাড়ার পর জেলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এরশাদ সাহেব তো প্রায় গৃহবন্দি অবস্থায় মারা গেছেন। আর খালেদা জিয়া, চরম অসম্মানের সঙ্গে জেলে বন্দি ছিলেন, চিকিৎসা থেকেও বঞ্চিত হয়েছেন, একমাত্র জীবিত সন্তানকে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দেখার সুযোগ পাননি। সর্বশেষ জন অর্থাৎ হাসিনা ক্ষমতা ধরে রাখতে হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছেন। অবশেষে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। যদি না পালাতেন, তাকেও হয়তো হত্যা করা হতো—এমন ধারণা একেবারে অমূলক নয়।
এটা প্রমাণ করে, আমাদের দেশে সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি হয়নি। ক্ষমতাধারী মাত্রই জুলুমবাজ হয়ে ওঠে, আর ক্ষমতার বাইরে থাকলেই মজলুম হয়। আমরা প্রতিবার মজলুমের অধিকারের কথা বলি, কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে আবার জুলুম করি। দরদ ও দায়িত্বের রাজনীতি আমরা গ্রহণ করি না। দরদ ও দায়িত্ব বলতে বোঝাচ্ছি, ট্রমার পুনরুৎপাদন বন্ধ করে মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও দায়িত্বশীল আচরণ। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষকে ফ্যাসিবাদী চিন্তা থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা, এবং সমাজে ভারসাম্য তৈরি করা—যেখানে নতুন করে কেউ মজলুম হবে না, বৈষম্য থাকবে না। দায়িত্বের রাজনীতি মানে, সমস্যার সমাধানে দক্ষতা বাড়ানো এবং ব্যর্থ হলে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ না এনে নিজেদের কর্মক্ষমতা উন্নত করা।
কিন্তু এই আশায় হয়তো গুড়ে বালি। ইতিহাস বারবার প্রমাণ করে, আমরা একই ভুল করি। যেমন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর আওয়ামী লীগ ‘জামায়াত সমস্যা’কে জিইয়ে রেখে নিজেদের রাজনৈতিক ন্যারেটিভ তৈরি করেছে। জামায়াত সমস্যা বলতে বোঝাই, ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করে এবং মজলুমের প্রতি ন্যায়বিচার না করে জামায়াতের উপস্থিতি টিকিয়ে রাখা, আবার মূলধারায় রাজনীতি করতে না দেওয়া। ২০০৯ সালে এসে ধীরে ধীরে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপিকে যুক্ত করে জনগণকে ‘জামায়াত-বিএনপির ষড়যন্ত্রের’ ভয় দেখানো হয়। গণতন্ত্র হরণ করা হয়।
মনে হচ্ছে ২০২৪ সালে এসে যারা ক্ষমতার ধারে কাছে আছেন, তারাও ‘আওয়ামী লীগ সমস্যা’ জিইয়ে রাখবেন নিজেদের ক্ষমতা বজায় রাখতে। লক্ষণ অন্তত তাই বলছে। অর্থাৎ, আওয়ামী লীগের দুর্নীতি, হত্যা, ভোটচুরি ও ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় জড়িত নেতাদের বিচার না করে, মজলুমের ইনসাফ না দিয়ে, ‘আওয়ামী লীগ সমস্যা’ টিকিয়ে রাখা হবে। দলের নেতাদের বিচার না করে এবং জনগণের সামনে তাদের অন্যায়ের প্রমাণ উপস্থাপন না করে, শাস্তি না দিয়ে শুধু নিপীড়নমূলক আইন ব্যবহার করে দলকে নিষিদ্ধ করার চেষ্টা হবে। যা আদতে কখনোই কাজ করে না। জনগণকে আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্রের ভয় দেখিয়ে এই পথে বৈধতা দেওয়া হবে। এভাবে ১৯৭১ সালের পরে যে ভুলগুলো করা হয়েছিল, সেগুলোর আবার পুনরাবৃত্তি হবে।
মনে রাখবেন, রাজনৈতিক দলের অন্যায় মোকাবিলা করতে হয় আদালতে ও সংস্কৃতির মাঠে। নিপীড়নমূলক আইন দিয়ে নিষিদ্ধ করলে রাজনৈতিক দলের জন্য তা আদতে সুবিধা বয়ে আনে। সন্দেহ থাকলে জামায়াতকে জিজ্ঞেস করুন। ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ স্মরণকালের ভয়াবহ নির্যাতন করে, নিপীড়ন করে জামায়াতের কিছু করতে পারেনি। বিএনপি নিপীড়নের মুখে শক্তিশালী হয়েছে, মানুষের কাছে সহানুভূতি পেয়েছে। আওয়ামী লীগকে ও এর নেতাদের ন্যায়বিচার না করে, ১৪০০ শহীদ পরিবারকে ইনসাফ না দিয়ে, অভিযুক্তকে আত্মপক্ষ সমর্থনের আইনগত সুযোগ না দিয়ে যদি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করেন, তবে এই আওয়ামী লীগই একদিন ‘মজলুম’ হিসেবে ফিরে আসবে। ট্রমার রাজনীতি আবারও পুনরুৎপাদিত হবে।
৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পরে এক সমাবেশে এই আন্দোলনের অন্যতম আদর্শিক নেতা মাহফুজ আলম ‘দরদ ও দায়িত্বের’ রাজনীতির কথা বলেছিলেন। তার বক্তব্যে জাতীয় নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তা এবং মজলুমের ইনসাফের গুরুত্ব উঠে এসেছিল। ট্রমার রাজনীতি বন্ধ করা এবং একটি ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য দরদ ও দায়িত্বের রাজনীতি ছিল আশার কথা। কিন্তু দরদ ও দায়িত্বের রাজনীতির পথ কঠিন পথ, এখানে ধৈর্যের সর্বোচ্চ পরীক্ষা দিতে হয়। শেষ পর্যন্ত সব প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে সমাজকে দরদের দিকে, দায়িত্বের দিকে পথ দেখিয়ে নিতে হয়। আর সহজ পথ হলো এসব কিছু না করে ট্রমার রাজনীতি শুরু করে দেওয়া। এতে হাতেনাতে ফল পাওয়া যায়। হতাশার কথা হলো, ক্ষমতা কাঠামো পুনর্গঠনের পর আমরা আমাদের নেতাদের কাছ থেকে দরদ ও দায়িত্বের রাজনীতির কঠিন পথের কথা আর শুনি না। এখন শুধু হুঙ্কার শুনি, যা প্রতিশোধের কথা বলে, ইনসাফের নয়।
আমরা প্রতিশোধের জায়গায় ন্যায়বিচার চাই, ইনসাফ চাই। ট্রমার রাজনীতি বন্ধ করে, দেশে সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করি। বিশ্বাস করুন, যদি আমাদের বাংলাদেশ রাষ্ট্র না থাকে, তাহলে কোনও দল বা নেতা কোনও গুরুত্ব রাখে না।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বাঙালি মুসলমানের আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই এই দেশ ছাড়া। তাই এখনই যদি সহাবস্থানের, ইনসাফের, ন্যায়বিচারের এবং শান্তির কথা না ভাবি, তাহলে একদিন দেখবেন, আমাদের দেশটা সিরিয়ার মতো হয়ে গেছে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে আরও এক যুদ্ধক্ষেত্র খোলার জন্য আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তি অপেক্ষা করছে। আর তারা সফল হলে বাঙালি মুসলমানের আর কোনও স্থান থাকবে না।
লেখক: পিএইচডি গবেষক, জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র। শিক্ষক, গবেষক এবং স্বাধীন সাংবাদিক।