ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে সাড়ে তিনশো বছরের ঐতিহ্যবাহী ‘কাটাগড় দেওয়ান শাগির শাহ’ গ্রামীণ মেলা এ বছর হচ্ছে না। প্রতিবছর বাংলা পঞ্জিকার ১২ চৈত্র ধর্মীয় সাধক শাগির শাহের (রহ.) উফাত দিবসে মেলাটি শুরু হয়ে চলে প্রায় মাসব্যাপী। মেলাটি আগামী ২৬ মার্চ থেকে শুরু হওয়ার কথা ছিল। জানা গেছে, স্থানীয় বিএনপির দুটি পক্ষ থেকে মেলা আয়োজনের জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করায় কোনও পক্ষকেই মেলার অনুমোদন দেয়নি প্রশাসন। তবে মেলা না হলেও ওরসের জন্য অনুমতি দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তানভীর হাসান চৌধুরী।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার রূপপাত ইউনিয়নের কাটাগড় গ্রামে অবস্থিত দেওয়ান শাগির শাহ্ (র.) ওফাত (মৃত্যু) দিবস উপলক্ষে উরসকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর এ মেলার আয়োজন করা হয়। চলতি বছর এ মেলার ৩৫১ বারের আয়োজন হওয়ার কথা ছিল। মেলাটি শুরু থেকে আজ পর্যন্ত কোন কারণেই মেলাটি এ পর্যন্ত বন্ধ হয়নি বলে জানিয়েছে এলাকাবাসী।
এমনকি করোনা মহামারির সময়েও (২০২১) স্বল্প পরিসরে এ মেলার আয়োজন করা হয়েছিল। এ বছর মেলার জন্য দুর্দান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা দোকান পাট নিয়ে এলেও অনেকেই স্থানীয়দের কাছ থেকে মেলাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা শুনে ফিরে যেতে দেখা গেছে।
স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিরা জানান, ফকির আন্দোলনের আধ্যাত্মিক গুরু দেওয়ান শাগির শাহ্ (রহ.) অষ্টাদশ শতকের কোনও একসময় কাটাগড় এলাকায় আসেন শাগির শাহ। শাগির শাহ্ (রহ.) ব্রিটিশ-বিরোধী ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলনের অন্যতম নেতা মজনু শাহর আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে পরিচিত। তিনি আধ্যাত্মিক শক্তি ও বিভিন্ন অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন বলে ঐতিহাসিকভাবে লোকমুখে শোনা যায়।
ঊনবিংশ শতকের চল্লিশের দশকের কোনও এক বছর ১২ চৈত্র শাগির শাহে (রহ.) মৃত্যু হয়। তখন থেকেই তার উফাত দিবস (মৃত্যু দিবস) উপলক্ষে সারাদেশ থেকে হাজার হাজার ভক্তরা আসেন কাটাগড়ের দেওয়ান শাগির শাহ’র মাজারে।
মাজারের পাশে মাঠে ঘোড়দৌড়, মেলা বসে, ফকির-সন্ন্যাসী ভক্তরা আসর জমান ভক্তিমূলক সংগীতের মাধ্যমে। দেশের দূরদূরান্ত থেকে ভক্তরা বিভিন্ন মানত নিয়ে আসেন এখানে। মানত করে ভক্তরা বিভিন্ন মসিবত থেকে রক্ষা পান। প্রতিবছর মেলা দেখার জন্য মেলার আশপাশের গ্রামগুলোসহ বিভিন্ন জেলা থেকে আত্মীয়-স্বজনের ভিড়ে উৎসবের আমেজ বিরাজ করে। তবে এবছরের চিত্রটা ভিন্ন দেখা গেছে।
এলাকাবাসী ও স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, কাটাগড় মেলাটি আগামী ২৫ মার্চ থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত এ মেলা আয়োজনের অনুমতি চেয়ে রূপাপাত ইউনিয়নের বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলী আক্কাস মন্টু ও উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মো. আনিচুর রহমান টিটোসহ একটি পক্ষ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে মেলা আয়োজনের জন্য গত ৫ মার্চ আবেদন করেন। এরা বিবদমান বোয়ালমারী উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ফরিদপুর-১ আসনের (বোয়ালমারী, আলফাডাঙ্গা ও মধুখালী উপজেলা) বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী শামসুউদ্দিন মিয়া ওরফে ঝুনুর সমর্থক।
অপরদিকে একই ওরস উপলক্ষে ৭ দিনের জন্য মেলা আয়োজনের আবেদন জানিয়ে গত ১৬ মার্চ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ‘কাটাগড় দেওয়ান শাগির শাহ (রহ.) মাজারের খাদেম মো. ইরাদত ফকিরকে দিয়ে আবেদন করান বিবদমান বোয়ালমারী বিএনপির অপর অংশ রূপাপাত ইউপি চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান ওরফে সোনা মিয়া, ইউনিয়ন কৃষকদলের সভাপতি শাহীন মোল্লা, ১ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি আকরাম শেখ, আজাদ মোল্যা, হাফিজুর মোল্যা ও আহাদ মোল্যাসহ অপর একটি পক্ষ। এ পক্ষটি কেন্দ্রীয় কৃষকদলের সহসভাপতি ও আগামী সংসদ নির্বাচনে ফরিদপুর-১ আসন থেকে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী খন্দকার নাসিরুল ইসলামের সমর্থক।
দুইপক্ষের লোকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, গত ১২ মার্চ কামরুল ইসলাম রেন্টু নামে এক যুবলীগ নেতা পার্শ্ববর্তী আলফাডাঙ্গা উপজেলায় বিএনপির করা একটি বিস্ফোরক মামলায় গ্রেপ্তার হলে এলাকাটি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এর জের ধরে ও কাটাগড় মেলার আয়োজন নিয়ে দুইটি পক্ষ গত ১৫ মার্চ বোয়ালমারী উপজেলা বিএনপির বিবদমান দুই নেতার অনুসারীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। সংঘর্ষের বিষয় নিয়ে স্থানীয় থানায় দুইপক্ষের পাল্টপাল্টি মামলা হয়। এ নিয়ে বিবদমান দুটি পক্ষ মানববন্ধনও করেছে। যার কারণে এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে প্রশাসন মেলার অনুমতি দেননি।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে মেলার জন্য কমিটি জমা দেওয়া রূপাপাত ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাটাগড় গ্রামের বাসিন্দা আক্কাস আলী মন্টু জানান, আমরা স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মী হিসেবে শামচুউদ্দিন মিয়া ঝুনু মিয়ার পক্ষে পড়েছি। আমাদের সঙ্গেই ইউনিয়ন বিএনপির প্রকৃত নেতাকর্মী আর খন্দকার নাসিরুল ইসলামের সঙ্গে রূপাপাত ইউনিয়নের কোনও বিএনপির লোক নেই। এ বছর কাটাগড় মেলা হচ্ছে না। শুধু ওরসের জন্য প্রশাসন অনুমতি দিয়েছে।
কাটাগড় দেওয়ান শাগির শাহ (রহ.) এর মাজারের ৯ম খাদেম সিদ্দিক ফকির বলেন, আমি এখানে ২০ বছর ধরে খেদমত করছি। এর আগে আমার দাদা, তার বাবা খেদমত করেছে। ১২ই চৈত্র শাগির শাহ (রহ.) উহাদি হয়ে যায়। সেইদিন থেকে এখানে ওরস হয়। ওরস উপলক্ষে এখানে মেলা হয়। মেলাটি কোনোদিন বন্ধের কথা শুনি নাই। এ বছর কী কারণে বন্ধ হলো জানি না। আমরা চাই এখানে আবার মেলাটি শুরু হোক।
মেলা কমিটির সাবেক কোষাধ্যক্ষ ও রূপাপাত ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান মো. আজিজার রহমান জানান, কাটাগড় দেওয়ান শাগির শাহ’র ওরস উপলক্ষে প্রায় ৫২ বছর ধরে আমরা সকল দলের লোকজন মিলেমিশে মেলাটি করে আসছি। আমরা আওয়ামী লীগের লোক হওয়ার কারণে এ বছর আমাদের মেলা কমিটিতে রাখেনি। এ নিয়ে আমাদের কোনও আপত্তি নেই। বিএনপির দুপক্ষের রেষারেষির কারণে এ বছর মেলাটি বন্ধ হয়ে গেছে। তারা মেলা মিলানোর জন্য তিনবার কমিটি করেছে। গ্রামে একটি মারামারি ঘটনায় আমাদের লোকজন আহত হয়ে হাসপাতালে রয়েছে। এ নিয়ে মামলাও হয়েছে।
বোয়ালমারী উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শামচুউদ্দিন মিয়া ওরফে ঝুনু বলেন, এ মেলা আয়োজনের জন্য ওই ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক একটি পরিচালনা কমিটি গঠন করে মেলা আয়োজনের জন্য অনুমতি চান। এসময় আওয়ামী লীগ সমর্থিত একটি অংশ যারা খন্দকার নাসিরের অনুসারীরা পাল্টা আবেদন জমা দেয়। পাশাপাশি নাসিরের সমর্থকরা হামলা চালিয়ে বিএনপির কর্মী সমর্থকদের উপর নির্যাতন করেছে।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় কৃষকদলের সহসভাপতি সাবেক এমপি খন্দকার নাসিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, বিএনপির কোন দ্বন্দ্ব বা কোন্দলের কারণে মেলা বন্ধ হয়নি। মূল সমস্যা হচ্ছে মেলা উপলক্ষে যে টাকা পয়সা ওঠে তার ভাগাভাগি নিয়ে। এতদিন আওয়ামী লীগরা টাকা খেতো, এখন অন্যরা খেতে চাচ্ছে। এর মধ্যে বিএনপির লোক যে নেই তা বলা যাবে না।
কাটাগড় মেলা এলাকায় তার কোনও পক্ষ নেই উল্লেখ করে খন্দকার নাসির বলেন, নিজের স্বার্থের জন্য সুবিধা পাওয়ার জন্য অনেকে ‘অমুকের লোক’, ‘তমুকের লোক’ পরিচয় দিয়ে ফায়দা তোলার চেষ্টা করছে।
বোয়ালমারী থানার অফিসার ইনচার্জ মো. মাহামুদুল হাসান বলেন, মেলা নিয়ে স্থানীয় দুটি পক্ষ সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। দুইপক্ষের মামলা আছে। অনেকে আহত আছে। মেলার আগেই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে মেলার সময় বা পরে আরো খারাপ অবস্থা হতে পারে। তাই আইনশৃঙ্খলা খারাপ হতে পারে এই আশঙ্কায় মেলার অনুমোদন না দেওয়ার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে বোয়ালমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তানভীর হাসান চৌধুরী বলেন, মেলা মিলানোর জন্য দুই গ্রুপে দুইটি কমিটির অনুমোদন চেয়ে আবেদন করেছিলেন। তাদের বলা হয়েছে, দুই গ্রুপ যদি এক হতে পারে তাহলে মেলা আয়োজন করুক। কারণ ওই এলাকায় মেলাকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষের ঘটনায় দুই গ্রুপেরই মামলা হয়। স্থানীয় দুটি পক্ষের হানাহানির কারণে মেলা নিয়ে নেগেটিভ প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। স্থানীয় পক্ষগুলোই চায় না মেলা হোক। আমরা কী করতে পারি? তবে সেখানে ওরশ শরীফ করতে কোনও বাধা নেই।