Homeদেশের গণমাধ্যমেপ্রবন্ধ সাহিত্যে আমাদের বলার কৌশল পাল্টেছে: বঙ্গ রাখাল

প্রবন্ধ সাহিত্যে আমাদের বলার কৌশল পাল্টেছে: বঙ্গ রাখাল


তরুণ কবি ও গবেষক বঙ্গ রাখাল। প্রবন্ধ সাহিত্যে অর্জন করেছেন ‘আবুল মনসুর আহমদ পুরস্কার’। চলতি বইমেলায় প্রকাশ হয়েছে তার প্রবন্ধগ্রন্থ ‘বিপ্লবী লীলা নাগ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’। এই গবেষক খুঁজে ফেরেন বাংলার লোক মানুষের ধ্যান, ধারণার উৎস। একজন গবেষক হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলেছেন রাইজিংবিডির সঙ্গে। সাক্ষাৎকার গ্রহণে স্বরলিপি।

রাইজিংবিডি: ‘বিপ্লবী লীলা নাগ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’ বইটি সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি।

বঙ্গ রাখাল:
‘বিপ্লবী লীলা নাগ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’ গ্রন্থের লেখাগুলো বিভিন্ন দৈনিক বা লিটলম্যাগের সম্পাদকদের তাগাদা থেকেই আলোর মুখ দেখেছে। তবে আকস্মিকভাবেই লেখাগুলো মলাটবদ্ধ হয়ে বই আকারে প্রকাশ পেয়েছে এটা আমার কাছে রীতিমতো আনন্দের। বাল্যে যাদের লেখা পড়ে আদর্শের পাঠ নিয়েছি, লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যাওয়া সেসব লেখকদের নিয়ে কিছু বলারও প্রয়াস পেয়েছি এইসব প্রবন্ধ-নিবন্ধে।এখানে আমি সাহিত্য বা কোনো ব্যক্তির জীবন নিয়ে রীতিমতো বিশ্লেষণ করতে বসিনি। শুধু বলেছি নিজের দ্বিধা-অপূর্ণতা বা আস্থাহীনতা কিংবা তাদের সাথে জড়িত আমার আত্মকথা। যা বুঝেছি তাই নিজের মতো করে বলার চেষ্টা করেছি মাত্র। এই গ্রন্থে মূলত আমার ভাবনাগুচ্ছই কিঞ্চিৎ রেখাচিত্রণে রূপান্তিত হয়েছে। ‘অনুপ্রাণন’ প্রকাশনীর আবু এম ইউসুফ বইটি প্রকাশ করেছেন। 

রাইজিংবিডি: প্রবন্ধ সাহিত্যে কোন পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছেন?

বঙ্গ রাখাল:
আমাদের সবকিছু যেহেতু পরিবর্তিত হচ্ছে সেহেতু প্রবন্ধ সাহিত্যও পরিবর্তিত হবে এটা স্বাভাবিক। কেননা আমাদের আচার-ব্যবহার কিংবা বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সাথে সাথে আমাদের ভাষাতেও পরিবর্তন আসে। আর এসব প্রভাব তো লেখার উপর পড়বে এটা স্বাভাবিক। আমরা লেখার ক্ষেত্রে পূর্বে যেমন ভাষা ব্যবহার করতে দেখেছি বর্তমানে তেমন ভাষার ব্যবহার দেখি না। মানে আমরা ভাষাকে আরও আয়ত্বে আনতে পেরছি এবং প্রবন্ধের ভাষাকেও পূর্বের চেয়ে আরও সহজ-সরল করতে পেরেছি। যা পূর্বের চেয়ে অনেকটা পরিবর্তিত হয়েছে এবং হচ্ছে। প্রবন্ধ সাহিত্যে আমাদের বলার কৌশলও পাল্টেছে। আগে প্রবন্ধসাহিত্যে হাতে গোনা কয়েকজন কাজ করলেও এখন এই শাখায় অনেকে অনেক বিষয় নিয়ে কাজ করছে এটা আমাদের জন্য ইতিবাচক দিক। অনেকের পূর্বে এই শাখার প্রতি আগ্রহ না থাকলেও বর্তমানে তা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বৃদ্ধি পাচ্ছেও বটে। এটাকেও কি পরিবর্তন বলব না।

রাইজিংবিডি: আপনার গবেষণা গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘লোক মানুষের গান ও আত্ম অন্বেষণ’ এই গবেষণার কাজটি কীভাবে এগিয়ে নিয়েছিলেন? এই ধরণের কাজে চ্যালেঞ্জ কোথায়? একটি গবেষণা সমাজকে কীভাবে প্রভাবিত করতে পারে?

বঙ্গ রাখাল:
আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। আগে থেকেই লেখালেখি করি গ্রামের আসরগুলোতে ঘুরে বেড়াই প্রবাদ-প্রবচন সংগ্রহ করি। জানাছিল এগুলো লোকসাহিত্যের উপাদান; তা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আমাদের চারিপাশি। আমরা এই সব সম্পর্কে যত্নবান না হলে হারিয়ে যাবে আমাদের অমূল্য সম্পদ। এসব কথা ভেবেই লোকসাহিত্য নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী হয়ে উঠি। বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা পড়ার সুবাদে আরও বেশি আগ্রহ জাগে কারণ লোকসাহিত্য বলে আমাদের একটা কোর্সই পড়ানো হত। এভাবেই কাজের প্রতি গভীর আগ্রহ তৈরি হয় এবং সন্ত-বাউল, পালাকার, লোককবি নিয়ে কাজ করা। সেই সব বাউল লোক কবিদের নিয়ে লেখা গ্রন্থ ‘লোক মানুষের গান ও আত্ম অন্বেষণ’। এই কাজটির জন্য বারবার ছুঁটে গিয়েছি ঢাকার ধামরাই দারোগ আলী বয়াতির বাড়ি, তার ছেলের কাছে। সংগ্রহ করেছি তার ছবি, গান। আরও অনেক তথ্য অজানা থেকে গেছে কেউ দিতে পারেননি। দারোগ আলীর যে সন্তান আমাকে তথ্য দিয়েছিল কয়েকদিন পরে তিনিও মারা যান। অন্য সব কাজের জন্য গিয়েছি ঝিনাইদহের শ্রীকান্ত ক্ষ্যাপা, লালন, দুদ্দু শাহ, পাঞ্জু শাহের মাজারে। সংগ্রহ করেছি নানা তথ্য-উপাত্ত। যা আমার গবেষণা কাজের রসদ জুগিয়েছে। বই প্রকাশের আগে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের আনন জামান স্যার বইটির ভূমিকা লিখে দিয়েছেন এবং ফ্ল্যাপ লিখেছিলেন ওস্তাদ বাবু রহমান। এসবই নিজের একান্ত চেষ্টাই করে বেড়ানো। যা আমার একনিষ্ঠতার প্রতিফলন বলা চলে। আসলে এই ধরণের কাজে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যেমন ধরেন আপনাকে সঠিকভাবে কাজ করতে হলে আপনি ফিল্ডপর্যায় ছাড়া সঠিকভাবে এই গবেষণা করতে পারবেন না। কেননা টেবিলওয়ার্ক করে এসব কাজ করা সম্ভব না। যে কারণে আপনাকে ফিল্ডে যেতে হবে। আর যখনই এই সব বিষয় নিয়ে কাজ করতে যাবেন তখন আপনার কোন তথ্য থাকবে না, ঘুরতে হবে যার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। আবার যখন কাজ করতে যাবেন তখন যাদের কাছে তথ্য বা কোন উপাদান আছে; তখন তারা এটাকে মহা সম্পদ মনে করে তার তথ্য না দিয়ে নানা বাহানা শুরু করেন। কারণ তারা ভাবেন গবেষক হয়তো এটা বেচে প্রচুর টাকা অর্জন করবে অথচ আমাদের টাকা দেবে না। নিজের কাছে রেখে লেখাপত্র প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত নষ্ট করবেন তাও কোন গবেষককে দিতে চাইবেন না। লোকসাহিত্য নিয়ে কাজ করতে গিয়ে অনেক অপমান বা সমাজের অবহেলা পেতে হয়; সমাজও এটাকে ভাল চোখে দেখেন না। কারণ এখনও লোকসাহিত্য নিয়ে সেভাবে সামাজিক মূল্য তৈরি হয়নি। যে কোন ভাল গবেষণা সব সময়ই নানাভাবে প্রভাবিত করতে পারে। কেননা গবেষণার কাজ হলো নতুন কোনকিছু আবিষ্কার করা। নতুন মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত করা। একজন গবেষকের কাজ হলো কোনকিছুকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করে তা জনসম্মুখে তুলে ধরা। আর যা মানুষ বিশদভাবে জানতে পারে তা একজন গবেষকের মাধ্যমেই। আর যে কোন নতুন বিষয়কে উদ্ধার, তা জনসম্মুখে তুলে ধরার কাজ সহজ বিষয় না। এর জন্য কত শ্রম-অর্থ, মানসিক শান্তি-অশান্তি কিংবা লাঞ্চণা-গঞ্জণা জড়িত যিনি গবেষণার সাথে জড়িত তিনিই বলতে পারেন। এছাড়াও রয়েছে গবেষকের আত্মত্যাগ। যা হয়তো অন্য জনের অধিকার ছিল একজনে গবেষকের কাছে। গবেষণার বিষয়টা এতো সহজ না। বললাম আল গবেষণা হয়ে গেল। তাহলো তো সবাই গবেষক হয়ে যেত।

রাইজিংবিডি: পড়া ও লেখার মধ্যে কীভাবে সমন্বয় করেন? কোন ধরণের বই পড়তে ভালোবাসেন। ২০২৪ এ কোন কোন বই পড়েছেন?

বঙ্গ রাখাল:
আমি তো পড়তে ভালোবাসি। আপনি জেনে থাকবেন যে আমি শিক্ষকতায় ছিলাম। সেখান থেকে এখন একজন উন্নয়নকর্মী হিসেবে কাজ করছি। এই কাজ মোটেও সুখকর নয়। পরিবার আছে-সংসার আছে। তবুও সবকিছুর আগে আমার পড়া এবং লেখা। আগে পড়তে চাই। পরে লেখা; লেখতে চাইলে প্রচুর পড়তে হবে। এই সত্য মানি সব সময়। তাই যা কিছুই করি না কেনো তার পরেও আমাকে প্রতিনিয়ত পড়ার টেবিলে বসতে হয়। আর লেখা তো এর মধ্যেই হয়ে যায়। যে কারণে আমাকে বেগ পেতে হয় না। আর নতুন নতুন কাজ করার জন্য আলাদা আলাদা প্রস্তুতি তো লাগেই।

পড়ার ক্ষেত্রে আমি সর্বভুক বলতে পারেন। তবে এই বছর কবিতার চেয়ে প্রবন্ধের বই বেশি পড়া হয়েছে। কবিতা-প্রবন্ধ গবেষণার বই বেশি ভালো লাগে। গল্প-উপন্যাস যে লাগে না তা নয়। এবার যে সব বই পড়া হয়েছে; তার মধ্যে বলতে পারি রমেশচন্দ্র দত্তের বাংলার কৃষক, শঙ্খ ঘোষের এখন সব অলীক, মোস্তফা তারিকুল আহসানের প্রজাপতি পাখা মেলো, রওশন জাহিদের বাংলা সাহিত্য ও বাংলাদেশের ফোকলোর তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, অজয় রায়ের আদি বাঙালির নৃতাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, জসীমউদ্দীন মণ্ডলের জীবনের রেলগাড়ি, দীপ্তি ত্রিপাঠীর বাংলাদেশের আধুনিক কাব্যপরিচয়, আলফ্রেড খোকনের নির্বাচিত কবিতা, কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত ও সরদার ফজলুল করিমের চল্লিশের দশকের ঢাকা, বিনয় মজুমদারের আত্ম পরিচয়।

রাইজিংবিডি: একজন লেখকের প্রচার কৌশল কেমন হওয়া উচিত বলে মনে করেন?

বঙ্গ রাখাল:
একজন লেখক তার বইয়ের প্রচার করবে এটা খারাপ কিংবা ভাল এ প্রশ্নে আমি যাব না। তবে বলব একজন লেখককে প্রচার কৌশল অবশ্যই জানতে হবে। কেননা স্বয়ং কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নিজের বইয়ের বিজ্ঞাপন দিয়েছেন এবং লেখার প্রচার-প্রসারের জন্য তাদের বাড়িতেই তিন/চারটা পত্রিকা চালু ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেও কোন কোনটার সম্পাদক ছিলেন। এসব তিনি নাও করতে পারতেন কিন্তু না; তিনি তা করেছেন চাঁদা দিয়েছেন পত্রিকা চালানোর জন্য। কারণ আমরা যা কিছুই লিখি না কেনো তার মূলত প্রচার চাই এবং নিজের খ্যাতিটাও চাই। আসলে কেউ যদি বলে না আমি চাই না তাহলে সে মিথ্যা বলে। আর এই প্রচারটা লেখককে করতে হয় একটু কৌশলে। সরাসরি নিজে প্রচার না করে অন্য কেউ বা কোন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন কিংবা কোন পত্রিকার পৃষ্ঠপোষকতা করেও নিজের লেখালেখি বা বইয়ের প্রচার হতে পারে। আবার অনেকের দিয়ে বুক রিভিউ লিখিয়েও নিতে পারেন। আসলে আমরা তো নিজের ঢোল নিজে পেটাতে পারি না। কেউ কেউ লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে করেনও বটে। নিজের কাজকে ব্যক্তি ভাল বলতে পারেন না তাই মানুষ বলবে। আমরা জানি যে জীবনানন্দকে অনেকে প্রচার-বিমুখ বলে থাকেন কিন্তু তিনিও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাতে তার লেখা পাঠাতেন। তিনি নিজেও অনেক বই নিয়ে রিভিউ লিখেছেন। তবে এখন আমরা যা দেখি প্রচারের নামে কবি-সাহিত্যিকরা ছেচড়ামি করে থাকেন। নিজেদের ব্যক্তিত্বকে বিসর্জন দিয়ে নিজেকে প্রচার করে থাকেন। এটা দৃষ্টিকটু মনে হয়। নিজেকে বিজ্ঞাপিত পণ্য করতে করতে এমন এক পর্যায় দাঁড় করিয়েছেন; তাতে মনে হয় তিনি তখন আর মানুষ থাকেন না; তিনি তখন একজন পণ্যে রূপান্তিত হয়ে যান। একজন লেখক ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন না হলে পাঠক তার প্রতি আগ্রহী হবেন কেনো? এভাবে নিজেকে আড়াল রেখে নানাভাবে লেখক নিজের লেখার প্রচার করতে পারেন। তবে এখানে যেন কোন প্রতারণা-বা ছলনা না থাকে।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত